#কোন_প্রিয়_নামে_ডাকি [১৪]
প্রভা আফরিন
প্রিয়তির হাত-পা ঠান্ডা হয়ে গেছে। ঋজু যে কাণ্ড ঘটিয়েছে তাতে মাথা তুলে তাকানোর আত্মবিশ্বাসটুকু পাচ্ছে না ও। ওরা বসে আছে ঋজুদের ফ্ল্যাটে। সঙ্গে আছে সুহাস। সে বারবার বোনকে বকঝকা করে যাচ্ছে, “তুই আমাকে একবার ফোন করে জানাতি।”
প্রিয়তি বলল, “আমি তো পাত্রপক্ষ আসার আগে অবধি ঘটনা ধরতে পারিনি। ভেবেছি শুধু দেখতেই আসবে। চাচি যে…”
সুহাসের কাছে তার মায়ের বদনাম করতে পারল না প্রিয়তি। তবে সু্হাস বুঝে নিল। বলল, “এরপরে ফোন দেওয়া যায়নি?”
“সুযোগ পাইনি। সব মহিলারা ঘিরে ধরেছিল। শুধু মনে হচ্ছিল দমবন্ধ হয়ে মা’রা যাব।”
“ঋজু সময় মতো না পৌঁছালে কি হতো?”
“আমি অল্পবয়সে স্ট্রোক করে বসতাম।”
“বেয়াক্কেলে মেয়ে!”
সুহাস গজগজ করে যাচ্ছে। এদিকে প্রিয় ভাবছে আসলেই যদি ঋজু না পৌঁছাতো তাহলে কি হতো। ওকে কি চাচি জোর করে, মে’রে-ধরে বিয়ে দিয়ে দিতো! সম্ভবত তাই করত। আইরিন স্পষ্ট বুঝে গেছিলেন প্রিয়তির প্রতি ঋজুর সফট কর্নার আছে। সেটা অল্প থাকা অবস্থাতেই লাগাম টানা ভালো। কাজেই পথের কাটা প্রিয়তিকে বিদায় করতে তিনি উঠেপড়ে লেগেছিলেন। প্রিয়তিকে না জানিয়েই এক পয়ত্রিশ বছর বয়সী প্রবাসীর সঙ্গে বিয়ে ঠিক করে ফেলেছিল। ভেবেছিল কায়দা করে প্রিয়তিকে গছিয়ে দিতে পারলেই হলো। সে আশায় জল ঢালল ঋজু। প্রিয়তিকে ঘর ভর্তি লোকের মাঝখান থেকে প্রায় ছিনিয়ে এনেছে সে। আইরিন অবশ্য পথরোধ করেছিলেন। বলেছিলেন, “কীসের জোরে ওকে নিয়ে যাওয়ার সাহস করছো তুমি?”
ঋজু তখন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে উত্তর দিয়েছে, “যে জোর আপনার নেই। ভালোবাসার জোর।”
“জেনেবুঝে হীরা ফেলে তামা বেছে নিচ্ছো? দুদিন বাদে যখন আবেগ ফুরাবে তখন ঠিকই বেমানান হিসেবে ছুড়ে ফেলবে।”
আইরিন যে হীরা বলতে নিজের মেয়েকে বুঝিয়েছে তা আর বলার অবকাশ রাখে না। ঋজু বলে, “যে হীরা শুধুই প্রদর্শনের বস্তু, যে হীরায় কেটে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে তা থেকে দূরে থাকাই ভালো, আন্টি। তাছাড়া আমি তো কোনো ধাতব বাছাই করছি না যে কোনটা বেশি চকচক করছে সেটা নেব। আমি বাছাই করছি মানুষ, আমি দেখছি তার মন ও মানসিকতা। সৌন্দর্যের বিচার করলেও আমার দুইচোখে প্রিয়তিকে আমি সুন্দরীই দেখি। তবে কি জানেন, সৌন্দর্য একদিন ফুরিয়ে যায় কিন্তু মানুষের ভালো গুণ কখনো ফুরায় না, হারায় না। সৌন্দর্য কোনো যোগ্যতা নয়, সৌন্দর্য শুধুই চোখের ভালো লাগা। তা দিয়ে সংসার চলে না। সংসার চালাতে, জীবনের পথ চলতে একজন উত্তম জীবনসঙ্গীরই প্রয়োজন পড়ে। আমি সেই সঙ্গী হিসেবে প্রিয়তিকেই বেছে নিয়েছি।”
আইরিন রাগে অন্ধ হয়ে পথরোধ করেছেন প্রিয়তির। বলেছেন, “ঋজু তোকে ভোলাচ্ছে, প্রিয়। ওর ফাঁদে পা দিস না। তুই বলে দে যাবি না। আমরা তোকে মানুষ করেছি। আমাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা নেই তোর?”
প্রিয় পুরোটা সময় স্বভাবসুলভ শান্তই ছিল। শান্তসুরেই উত্তর দিলো, “আমি অবশ্যই কৃতজ্ঞ, চাচি। কিন্তু তোমরা যদি এর বিপরীতে আমার থেকে দাসত্ব চাও তখন সেটা আর কৃতজ্ঞতায় আটকে থাকবে না। হয়ে যাবে সুবিধাভোগী। আমি সারাজীবন তোমাদের কৃতজ্ঞতা স্বীকার করব। কিন্তু নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে নয়।”
প্রিয় ঋজুর হাত ধরেছিল শক্ত করে। পেছনে ফেলে এসেছিল সমস্ত সংশয়, দ্বিধা। কিন্তু ঋজুর মায়ের মুখোমুখি হতে এখন ভীষণ ভয় করছে। ঋজু সেই যে মাকে বোঝাতে ভেতরে গেছে আর আসার নামই নিচ্ছে না। কে জানে কি হচ্ছে সেখানে!
______________
রেবেকা খানম ধাক্কাটা হজম করতে পারছেন না। শেষমেষ ঋজুর দ্বারা এরকম কাণ্ড ঘটতে পারে তাই যেন সবচেয়ে বড় ধাক্কার। ছোটোবেলায় খেলতে গিয়ে অ’প’রাধ করে বাড়ি এসে যেভাবে তাকাতো, আজ ঋজুর চোখে একই দৃষ্টি। সে এসেই মায়ের হাত ধরে বলেছে, “আমি প্রিয়তিকে তুলে নিয়ে এসেছি, মা। মেয়েটা অসুস্থ। আজ থেকে আমি ছাড়া ওর কেউ নেই। যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই। তুমি কি ওকে একটু জায়গা দেবে?”
রেবেকা থমথমে কণ্ঠে বললেন, “যাদের যাওয়ার জায়গা নেই তুই কি তাদের সবাইকে বাড়িতে জায়গা দিবি?”
“সেটা তো আমার পক্ষে সম্ভব নয়।”
“বাড়িতে তাদেরই জায়গা দেওয়া হয় যাদের বাড়ির সদস্য বানানো যায়। তোর এই জায়গা দেওয়ার মানেও কি তাই?”
বিপরীতে ঋজু মাথা চুলকে বলে, “আসলে মা, আমি অনেক ভেবে দেখেছি। ছোটো থেকে আমাকে আদর-যত্ন করার জন্য তুমি ছিলে, আছো। কিন্তু ভবিষ্যতে যখন আমায় বিয়ে করাবে তখন আরেক বাড়ির মেয়েটা এসে তোমায় তার মায়ের স্থান দেবে না এটাই স্বাভাবিক। কারণ সেই মেয়েটা অলরেডি তার মায়ের আঁচল ছেড়ে এসেছে। আর মায়ের রিপ্লেসমেন্ট কেউ হতে পারে না। তোমার রিপ্লেসমেন্ট আমার কাছে কেউ হবে না। দেখা যাবে কিছুদিন না যেতেই তুমি বউয়ের মাঝে কন্যাসুলভ বিনয় দেখতে না পেলে হাজারটা দোষ ধরবে, বউও তোমার মাঝে নিজের মায়ের মতো আদর না পেলে দোষ ধরবে। বউ-শাশুড়ি যু’দ্ধ শুরু হবে। তাই ভেবে দেখলাম সেদিক থেকে প্রিয়তি আমাদের জন্য বেটার অপশন। কারণ সে ছোটো থেকে মায়ের আদর পায়নি। তুমি ওকে সন্তানের মতো আদর করলে সেও তোমায় মায়ের মতোই আঁকড়ে ধরবে। নিজের মায়ের আদরের সঙ্গে তুলনা দেবে না। বরং আরো বেশি বেশি ভালোবাসবে। আমার সংসারে অশান্তিও হবে না। আর আমি হবো সবচেয়ে সুখী মানুষ। আমার সুখটাই তো তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ তাই না, মা?”
ছেলের ধুরন্ধর মন্তব্যের পর থেকে রেবেকা খানম চুপ করে গেছেন। ঋজু ভয় পেয়েছিল মা বিষয়টাকে কীভাবে নেবে। আর মা যদি না মানে প্রিয়তিও নিজেকে অযাচিত ভেবে এখানে থাকবে না। অবশ্য ঋজু বিকল্প পথ ভেবে রেখেছে। সে অনেকক্ষণ বাদে বসার ঘরে ফিরে আসতেই দুই ভাইবোন উদগ্রীব হয়ে তাকাল। ঋজু একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, “আসলে ধাক্কা খেয়েছে তো। একটু সামলে নিতে সময় দাও।”
সুহাস বলল, “সবাই ধাক্কা খেয়েছি। সবারই সামলে নিতে সময় লাগবে। ব্যাপার না। আমি নাহয় এখন প্রিয়কে নিয়ে চলে যাই। আন্টির সঙ্গে বোঝাপড়া করে নাহয়…”
ঋজু চোখ রাঙাল, “আমি মাকে বলেছি এখন থেকে আমি ছাড়া ওর কেউ নেই। আমিই প্রিয়তির সব। তুই মাঝখানে ভাইগিরি দেখাতে এসে চাল বাঞ্চাল করিস না। যেতে হলে একা যা। প্রিয়তি এখানেই থাকবে।”
এরপর প্রিয়তির দিকে চোখ রেখে ভ্রু নাচাল ঋজু, “থাকবে না?”
প্রিয়র শ্বেত চন্দনরঙা গাল দুটি মুহূর্তেই রক্তচন্দনের রঙে লেপ্টে গেল। সুহাসের সামনে লজ্জায় কোনো উত্তর দিতে পারল না। ঋজু সেই অপূর্ব চিত্রটা নিরবে উপভোগ করে কপট রাগের ভান করে চোখ রাঙিয়ে বলল, “বেধে রাখব।”
ঋজুর বাবা আহাদুজ্জামান খবর পেয়ে পরদিন ভোরেই বগুড়া থেকে ঢাকায় এসে পৌঁছালেন। এসেই তিনি ঋজুর কাছে আবহাওয়ার খবর জানতে চাইলেন। ঋজু জানাল মা রাতে দরজা খোলেনি। প্রিয়তিকে গেস্টরুমে জায়গা করে দিয়েছে। আর নিজে চিন্তায় ঘুমাতে পারেনি।
আহাদুজ্জামান ছেলের বোকামিতে বিরক্ত হয়ে বললেন, “একেবারে বিয়ে করে ঘরে তুলতে পারলি না! তাহলেই তো বের করে দেওয়ার কোনো চান্স ছিল না। মেয়েটার অবস্থান শক্ত থাকত। আমিও নাহয় একটু হম্বিতম্বি করে মেনে নিতাম।”
ঋজু হেসে ফেলল। বলল, “তোমাদের ছাড়া বিয়ে করব তা কি হয়! আমি তো মেয়ে পালিয়ে আনিনি। তুলে এনেছি। বিয়ে করব সবার সামনে। আর তুমি হম্বিতম্বি করে হলেও যে আমার পক্ষেই রায় দেবে সে জন্যই আগেভাগে সব জানিয়ে রেখেছিলাম। এবার নিজের বউ সামলাও।”
“তার আগে মেয়েটার সঙ্গে দেখা করা।”
ঋজুকে ডাকতে হলো না। প্রিয়তি সকাল সকাল উঠে নিজের হাতে চা করে এনেছে ঋজুর বাবার জন্য। দুজনের কুশল বিনিময় হলো অত্যন্ত স্নেহের সাথে। এমন সময় রেবেকা খানম দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন। প্রিয়তি বুক ভরে বাতাস নিয়ে নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। রেবেকা খানমের কাছে গিয়ে বলল, “আমি দুঃখিত আন্টি, আপনার অনুমতি ছাড়া আপনার রান্নাঘর ব্যবহার করার জন্য।”
আহাদুজ্জামান ঘাড় নেড়ে বললেন, “কত বড় সাহস না বলে রান্নাঘরে ঢুকে চা বানায়! অন্যায় করে ফেলে আর দুঃখিত হয়ে লাভ নেই। কি ভেবেছো, একের পর এক অন্যায় করবে আর মেনে নেব? রেবেকা, তুমি এক্ষুনি এই মেয়েকে শাস্তিস্বরূপ দুই বেলা রান্না করার হুকুম দাও।”
রেবেকা এত সহজে প্রিয়তিকে রান্না করার অনুমতি দিলেন না। শুধু ছোটো করে বললেন, “তোমাদের যা মন চায় করো।”
তিনি চুপচাপ রইলেন আরো একটা দিন। এর মাঝে প্রিয়তির মা ফোন করল প্রিয়তির কাছে। প্রিয়তি ঋজুর সঙ্গে বেরিয়ে যাবার পর পরই নাকি আইরিন প্রিয়তির মাকে ফোন করে যা তা বলেছে। মা আরেক লোকের হাত ধরে চলে গেছিল, তাই মেয়েও সেই শিক্ষাই পেয়েছে এমনসব কদর্য কথা বলে গালিগালাজের করেছে।
ঋজু উনাকে শান্ত করে বলল, “আপনি চিন্তা করবেন না, আম্মু। প্রিয়তির জন্য এখন আমি আছি, আমার পরিবার আছে। আপনি কিন্তু আমাদের বিয়েতে আসবেন।”
পরদিন সকালে রেবেকা স্বাভাবিকভাবেই সকাল সকাল সাংসারিক কর্মে লেগে পড়লেন। প্রিয়তি সাহস করে কাছে গিয়ে উনার হাত চেপে ধরল। বলল, “আন্টি, আমি হয়তো আপনার মনে বিরাট কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। আমাকে ছোটো ভেবে মাফ করে দেবেন। আপনাদের সংসারে আমাকে নিয়ে ঝামেলা হোক আমি তা চাই না। আমি আজই চলে যাব।”
কথাটা শেষ করে প্রিয়তি চলে যাচ্ছিল। রেবেকা খানম ঋজুকে শুনিয়ে বললেন, “তোরা শুরুটা কি করেছিস? যে যার ইচ্ছেমতো আসবে, আবার ইচ্ছেমতো চলে যাবে। বাড়িটার কি কোনো শৃঙ্খলা নেই?”
ঋজু বলল, “তোমার মনের ওপর চাপ দিয়ে আমরা কোনো শৃঙ্খলা আনব না, মা। প্রিয়তি বরং চলেই যাক।”
রেবেকা স্বামীকে ডেকে বললেন, “মেনে না নিলে তোমার ছেলে সারাজীবন আমাকে দোষারোপ করবে, আমি ওকে পছন্দের মেয়ে এনে দেইনি। তুমি কাজি ডাকো ঋজুর বাপ। বিনা পরিচয়ে কাউকে বাড়িতে রাখার পক্ষে আমি নই।”
______________
একদিকে যখন প্রিয়তি ও ঋজুর বিয়ের তোড়জোড় চলছে, অন্যদিকে সুহাস খুঁজে বেড়াচ্ছে চারুকে। সেই রাতে সুহাসের ঘরে চারু ও সুহাককে একত্রে আবিষ্কার করার পর আইরিন বাড়ি মাথায় তুলে চারুকে অপমান করেছিলেন। রাস্তার মেয়ে, বাজারি মেয়ে থেকে শুরু করে এমন কোনো বাজে কথা নেই যা বলেনি। বাদ রাখেনি প্রিয়তিকেও কথা শোনাতে। চারুর মুখটা অপমানে বোবা হয়ে গেছিল। সেভাবেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছিল মেয়েটা। এরপর থেকে নিরুদ্দেশ। প্রিয়তির কাছে মেয়েটির ইতিহাস শুনে সুহাস নিজেই ওকে খুঁজতে মরিয়া হয়ে গেছে। কিন্তু চারু অফিসেও আর যায়নি। অফিসের নথিতে দেওয়া বাসার ঠিকানায় গিয়ে দেখা গেল সেখানে কেউ থাকে না। প্রতিবেশীর থেকে জানা গেল চারু এক সপ্তাহ ধরেই বাড়ি ফেরে না। চারুর একমাত্র ভাই, যাকে চারু নিজের সর্বস্ব দিয়ে মানুষ করছিল, পড়াশোনা করাচ্ছিল, সেই ভাইয়ের খোঁজ করতেও গিয়েছিল সুহাস। সেখানে গিয়ে জানতে পারল কিছুদিন আগেই নাকি চারুর ভাইকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে মা’দ’কদ্রব্যসমেত। হোস্টেলে থেকে বোনের র’ক্ত পানি করা টাকায় নেশা করত ছেলেটা। চারু হয়তো নিজের অপমানের ধাক্কা সয়ে নিতো, কিন্তু যাকে নিয়ে সারাক্ষণ বড় কিছু করার স্বপ্ন বুনতো, সেই ভাইয়ের অধঃপতনের ধাক্কা সামলাতে পারেনি।
সুহাস সেদিন থেকে চারুকে খোঁজা বন্ধ করে দিলো। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কোথাও যেন একটা ক্ষত নিরবেই তাজা রয়ে গেল।
____________
ঢাকায় প্রিয়তি ও ঋজুর ছোট্ট সংসারটা গুছিয়ে দিয়ে আহাদুজ্জামান ও রেবেকা দম্পতি বগুড়ায় নিজেদের বাড়িতে ফিরে গেছেন। যদিও প্রিয়তি একদমই যেতে দিতে চায়নি উনাদের। একটা নিজের পরিবার পেয়ে মেয়েটা সবাইকে বুক দিয়ে আগলে রাখতে চাইছে। রেবেকা প্রিয়তির এ ভানহীন, নির্ভেজাল ভালোবাসায় গলে গেছেন খুব অল্প সময়েই। তবে আত্মীয়রা মাঝে মাঝেই খোঁচা মেরে বলে, “ছেলের জন্য কি আর মেয়ে পেতে না? একেই স্বাস্থ্যবতী মেয়ে, তারওপর নেই পরিবার। ছেলেটাকে ভাসিয়ে দিলে!”
আহাদুজ্জামান সাহেব জবাব দেন, “দেশে কোটি কোটি মেয়ে আছে। কিন্তু নসীবে ওই একটাই জোটে যে নির্ধারিত। আমার ঋজুর নসীবে প্রিয়তি ছিল। সংসার করবে ওরা। তোমাদের এত জ্বা’লা কেন? আমার বউমা কি তোমার ঘরের ভাত খেয়ে মোটা হয়েছে?”
তবুও লোকের মুখ বন্ধ হবার নয়। হয় সামনাসামনি লজ্জা দেবে, নয় আড়ালে ফিসফাস করবেই। তাদেরকে উপেক্ষা করেই জীবন চলতে হয়।
অপ্রিয় থেকে প্রিয়তমা হয়ে ওঠা প্রিয়তির সকালটা শুরু হয় স্বামীর বাহুতে লেপ্টে, রাত নামে একে অপরের হৃৎস্পন্দন ছন্দে। দুষ্টু ঋজু এখন প্রায়ই নিরীহ মুখে ভয়ংকর কথাগুলো বলে প্রিয়কে লজ্জায় ফেলে। বিশেষ করে তার একটি অতি নিরীহ আবদার হলো, “আমার যেখানে তিল আছে তোমারও সেখানে তিল আছে। আমি কি সেই তিলটা একটু ছুঁয়ে দেখতে পারি?”
প্রিয় তখন অস্তগামী সূর্যের মতো টকটকে লাল মুখটা নিয়ে টুপ করে মুখ লুকায়। তবে পালাতে আর পারে না। ঋজু শুধু স্বামী নয়, হয়ে উঠেছে প্রিয়তির পুরো পৃথিবী। সেই পৃথিবীটায় যেন প্রিয়তির কখনো হাঁসফাঁ’স না লাগে সেই চেষ্টাতেই মগ্ন থাকে ঋজু। প্রিয়তিও স্বামীকে উজার করে ভালোবাসা দেয়।
প্রিয়তি ঋজুর অফিসের চাকরিটা ছেড়ে দিয়েছিল বিয়ের কিছুদিন বাদেই। কেননা অফিসের লোকজন প্রায়ই আড়ালে ফিসফাস করত, ঋজু স্যারের কি মেয়ের অভাব ছিল যে এই স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে ঘরে তুলেছে, স্যারের বোধহয় স্থুল নারীদের প্রতি ফ্যান্টাসি আছে ইত্যাদি আরো নানান কথা হয় ওদের দাম্পত্যকে ঘিরেও। প্রিয়তি আসলে বুঝে গেছিল এইসব যন্ত্রণা তাকে মানসিকভাবে দুর্বল দেবে। তাই ও ইচ্ছে করেই স্বামীর কর্মস্থল ত্যাগ করেছিল। এতে প্রিয়তি ও ঋজু দুজনেরই প্রতিনিয়ত লোকের কথার মানসিক অশান্তিটা কিছুটা হলেও কমে আসে।
প্রিয় নিজ চেষ্টায় এরপর চাকরি নিয়েছে একটি প্রকল্পভিত্তিক বিদেশি সংস্থায়। সেই সূত্র ধরেই মাঝে মাঝে ওকে ঢাকার বাইরে প্রকল্পের কাজে যেতে হয়। তেমনই একটা কাজে এবার প্রিয়তিকে যেতে হলো একটা মফস্বলে। ফিল্ডওয়ার্ক সেরে স্থানীয় একটি স্কুলের সামনে একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল ওরা। রোদের তেজে চোখ রাখা দায়। সেখানেই কতগুলো বাচ্চাদের মাঝে একটি রোগা, লম্বা শ্যামবর্ণা তরুণীকে দেখে প্রিয়তির দুটি চোখ থমকে গেল। কাছে গিয়ে চাপা চিৎকার দিলো, “চারু…”
চারু প্রিয়কে দেখে অবাক হেসে ছুটে এলো। জড়িয়ে ধরে বলল, “আরে আপু, তুমি এখানে? কতদিন বাদে দেখা। আগের চেয়ে শুকিয়ে গেছো দেখছি।”
প্রিয়র চোখে পানি এসে গেল। চারুর গালে চাপড় মেরে অভিমান করে বলল, “তোমায় কত খুঁজেছি। একটা বারের জন্যও কোনো খোঁজখবর দিলে না। এটা কি ঠিক করলে?”
চারু সে কথা হাওয়ায় উড়িয়ে দিলো, “ঠিক-বেঠিকের ধার আর ধারি না। কিন্তু তোমার নাকে নোজপিন কেন? তুমি কি বিয়ে করেছো?”
প্রিয় প্রশ্ন শুনে হাসল এবারে। চারু চুটকি বাজিয়ে বলল, “ওয়েট… ঋজু স্যারকে, রাইট?”
“রাইট। কিন্তু তুমি কীভাবে জানলে?
“হুউম… আমি আগেই ধরতে পেরেছিলাম তোমাদের মাঝে কিছু আছে।”
চারু ও প্রিয়তি একটা গাছের তলায় বসল। প্রিয় বলল, “এখানে কি করছো তুমি?”
“একটা স্কুলে পড়াই। বাচ্চাদের নিয়ে সময় কেটে যায়।”
“আর তোমার ভাই?”
চারু উদাসীন সুরে বলল, “সে আছে নিজের দুনিয়ায়, রঙিন নে’শায় ব্যস্ত। আমি আমার দুনিয়ায়। আসলে কি জানো আপু, নিজেকে ঠকিয়ে নিজের ভাগের সুখ কাউকে দিতে নেই। তুমি যাকেই উজার করে দেবে, সেই তোমাকে আগে ছু’রি মেরে বুঝিয়ে দেবে তুমি যে কত বড় বোকা। আমার কথা ছাড়ো তো। সংসার কেমন চলছে তোমার?”
“এসে দেখে নিও একবার। প্লিজ এসো চারু। এভাবে হারিয়ে যেও না।”
চারু এক ঠোঙা ঝালমুড়ি কিনে নিল। খেতে খেতে অত্যন্ত অবহেলায় বলল, “চারুরা হারায় না। চারুরা বেঁচে পৃথিবীর দুঃখের ভাত বইতে। অন্যরাও চারুদের পেয়ে তাদের দুঃখের ভাগ দিতে চায় বলেই চারুদের একটু লুকিয়ে থাকতে হয়। সে যাই হোক। তোমার সেই কাঁচি থুক্কু চাচির কি খবর? আর তার দুই ছানাপোনা?”
প্রিয় দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলল, “আমার বিয়ের কিছুদিন বাদেই সুজানা এক জনপ্রিয় টিকটকারের হাত ধরে বাড়ি থেকে পালিয়েছে। কিন্তু কিছুদিন বাদেই সেই ছেলেটা ওকে ব্যবহার করে ছুড়ে ফেলে দেয়। সুজানা এখন বিয়ে করার দাবীতে দফায় দফায় ফেসবুক লাইভে এসে অভিযোগ করে। কান্নাকাটি করে রিলস বানায়, মিলিয়ন ভিউজ পায়। মানুষ তাকে নিয়ে হাসাহাসি করে। এতে সুজানার পরিচিতি আরো বাড়ে। ভাইরালের নেশায় পড়ে মেয়েটা নিজের সঙ্গে পরিবারের সম্মানও বিকিয়ে দিয়েছে।”
“মারহাবা শুনে খারাপ লাগা উচিত কিন্তু ভালো লাগছে। হি হি! সরি! আরেক ছানা?”
“সুহাস ভাইয়া পরিবারের বেহাল অবস্থা দেখে নিজেকে আরো বেশি গুটিয়ে নিয়েছে। চাচি বিয়ের কথা বললেও ভাইয়া রাজি হয় না। বাড়ি থেকে দূরে থাকে। চাচি এখন দিন-রাত কান্নাকাটি করেন আর ভাগ্যকে দোষারোপ করেন।”
চারু মুড়ি চিবোতে চিবোতে বলল, “আহারে! এবারও কষ্ট লাগছে না।”
প্রিয় এবার সন্তর্পণে সে কথাটা বলল, “তবে আমার কি মনে হয় জানো চারু? ভাইয়া আসলে অন্য কোনো কারণে বিয়ে করছে না। তোমায় অনেক খোঁজাখুঁজি করেছে আগে। তুমি কি জানো কেন?”
“জানি না। জানতে চাইও না।” বলে উঠে যাচ্ছিল। প্রিয় ওর হাত টেনে ধরল। বলল, “এবার নিজের ভাগের সুখটা নিজেই উপভোগ করো না, চারু। আর ঠকবে?”
চারু হেসে জবাব দিলো, “করছি তো। দিনে বাচ্চাদের পড়াই। রাতে কাত হয়ে শুয়ে ঘুম দেই। এভাবেই জীবন কাটিয়ে দেব। না কোনো পিছুটান আর না আপনজন। লাইফ বিন্দাস।”
প্রিয়তির অন্তর মায়ায় পরিপূর্ণ হয়ে গেল। চারুকে জড়িয়ে ধরল সে। বলল, “এত দুঃখ সয়ে কীভাবে এত শক্ত থাকিস রে, বোন?”
চারু স্মিত হাসি ধরে রেখেই জবাব দিলো, “তুমি যখন নিজের পিঠে নিজেই হাত বুলিয়ে সান্ত্বনা দিতে শিখে যাবে, তখন দেখবে কোনো দুঃখই আর দুঃখ লাগছে না।”
(সমাপ্ত)