কোন প্রিয় নামে ডাকি পর্ব-০২

0
1

#কোন_প্রিয়_নামে_ডাকি-২
প্রভা আফরিন

প্রিয়তির ভাগের মাংসের বাটিটা কোন মেহমানের জন্য তুলে রাখা হয়েছিল জানা গেল রাতে, যখন ঋজুকে খেতে দেওয়া হলো। প্রিয়তি চাচির কৌশল বুঝে হাসল। মেহমানকে তো আর ডাল-ভাত খাওয়াতে পারবেন না, প্রিয়কে বঞ্চিত করেই নাহয় মুখ রক্ষা হবে। কিন্তু রক্ষা কি আদৌ হলো! সুহাস ভাইয়ের বাল্যবন্ধু হঠাৎ কেন এতদিন বাদে এসে উদয় হলো সেই কারণ উন্মোচিত হলো তখনই। ঋজুদের বাড়ি বগুড়া। আগে তারা ঢাকায় ভাড়া থাকতো। এরপর পারিবারিক ব্যবসায় থিতু হয়ে সপরিবারে আবারো বগুড়াতেই ফিরে যায়। ঋজু পড়াশোনা শেষ করে কিছুদিন বাবার ব্যবসায় থিতু হতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু যে কাজে আগ্রহ নেই সেখানে বৃথা শ্রম দিয়ে সময় নষ্টই হয়েছে কেবল। অতঃপর ঢাকায় এসেছে চাকরির জন্য। থাকার জায়গা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার আগেই সুহাস নিজ বাসায় আসার প্রস্তাব করে। ঋজুও সে প্রস্তাব সহাস্যে মেনে নেয়। কিছুদিন সুহাসের কাছেই থাকবে সে। এ কথা শুনে আইরিন মনে মনে নিজের গর্দভ ছেলেটিকে একগাল বকে নিলেন। মেহমান বাড়িতে রাখা কি চারটেখানি খরচের কথা!
ঋজু আইরিনের চেহারা দেখে কিছু আন্দাজ করল কিনা বোঝা গেল না। হঠাৎ খাওয়া থামিয়ে প্রশ্ন করল, “আমি থাকলে আপনাদের খুব অসুবিধা হবে, তাই না আন্টি? হোটেলেই উঠতে চেয়েছিলাম। সুহাস জোর করল থাকতে।”

আইরিন থতমত খেয়ে বললেন, “আরে না না। তুমি তো আমার ছেলেই। এখানে থাকবে না তো কই থাকবে? সুহাস তোমাদের বাড়িতে গিয়ে কত থেকেছে! তুমিও সংকোচ করবে না।”

“ঠিক আছে।” আন্তরিক হাসিতে আইরিনের কথা মেনে নিল ঋজু। এরপর বলল, “আমি একা একা খাচ্ছি, আপনারা কেউ এটেন্ড করছেন না, আমার কিন্তু খারাপ লাগছে।”

সুহাস মায়ের এ ধরনের আচরণ জানে। বিরক্তও হয়। ঋজুর সামনে হাসিমুখে বলল, “আমরা একটু লেট করে খাই তো। আর তুই দূর থেকে জার্নি করে এসেছিস বলে আগে আগে খেতে বসিয়ে দিলাম। কাল থেকে একসঙ্গে খাব।”

ঋজু যে এত সহজে বন্ধুর বাড়িতে থাকার ছাড়পত্র পেয়ে যাবে ব্যাপারটা তা নয়। বাড়ির কর্তা বাহারুল সাহেবের ইন্টারভিউ পর্ব তখনো বাকি ছিল। একেই বাড়িতে দু-দুটো মেয়ে আছে। তারওপর একটা যুবককে ঠাঁই দেওয়া তো আর সোজা কথা নয়। ঋজুর খাওয়া শেষ হতেই বাহারুল সাহেব ঠোঁটে পানের রস মেখে বসার ঘরে এসে বসলেন। প্রথমেই তীক্ষ্ণ নজরে ঋজুকে আপাদমস্তক মেপে নিলেন। ধাপ্পাবাজ ছেলেদের পোশাক-পরিচ্ছদে চটকদার একটা ব্যাপার থাকে। আচরণে জ্ঞান জাহির করার অভ্যাস, আর অন্যের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হবার বাসনা থাকে। ছেলেটির মাঝে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা গেল না। মার্জিত সাধারণ পোশাক ও শান্তশিষ্ট সুরে সে বাহারুল সাহেবকে সালাম দিয়ে শরীর-স্বাস্থ্যের খবর নিল। বাহারুল সাহেব বললেন, “চাকরির ব্যবস্থা কি হয়েছে? নাকি এখনো খুঁজতেছো?”

“ব্যবস্থা হয়েছে। কাল থেকে জয়েন।”

“মা শা আল্লাহ! তা থাকবা নাকি কিছুদিন? থাকো, বেড়াও আমাদের বাড়ি। পরে কি মেস ঠিক করবা নাকি বিয়েশাদি করে বাসা নিয়ে থাকবা?”

“আপাতত একটা বাসা নিয়ে ব্যাচেলরই থাকার ইচ্ছে।”

বাহারুল সাহেব কপাল কুচকালেন, “বিয়ের বয়স তো হইছে। বিয়ে করে একেবারে সংসার শুরু করে দাও। তোমাদের মাঝে দেরি করে বিয়ে করার প্রবণতা এত বাড়ছে কেন বুঝলাম না। সুহাসরে কত বুঝাই বিয়ের জন্য। খালি বলে সময় আসুক। এদিকে মেয়েদের গতি করতে হবে। মধ্যবিত্তের জীবনে সংসার ছাড়া আছেই বা কি? এই যে প্রিয়র বয়স হইছে, বিয়ে দিতে হবে। মেয়ের নাই বাপ, মা সেই দায়িত্ব পালন করবে না দেখে আগেই ফেলে গেছে। কত যে চিন্তা নিয়ে ঘুমাতে যাই।”

প্রিয় চাচির সঙ্গে হাতে হাতে রান্নাঘরের কাজ করছিল। মায়ের প্রসঙ্গ আসতেই মেয়েটার মুখ শুকিয়ে গেল। নজর আর উঠল না। সুহাস বুঝল তার বাবা এখন সাংসারিক কাসুন্দি ঘেটে সবাইকে বিব্রত করবেন। তাই তাড়াতাড়ি ঘুমানোর বাহানায় ঋজুকে ঘরে নিয়ে গেল।

রাতের খাওয়া শেষ করে সবকিছু গুছিয়ে রুমে আসতে নয়টা বেজে গেল প্রিয়র। সাধারণত এ সময়েই তার অবসর শুরু। অবসর কাটে পড়াশোনা করে। সকলে ঘুমিয়ে গেলে মাঝে মাঝে লুকিয়ে চা বানিয়ে খায়। ওকে দুধ দিয়ে ঘন করে চা খেতে দেখলেই চাচি বলেন, ‘খাস না, মেদ বেড়ে যাবে।’
সে তো হাওয়া খেলেও নাকি প্রিয়র মেদ বেড়ে যায়৷ তাই বলে কি জীবনের সব সাধ পায়ে ঠেলবে! ঠেলতে চেষ্টা করেছিল কয়েকবার। ওজন কমানোর ভূত মাথায় চাপিয়ে দেহকে ঠিকঠাক খাবার দেয়নি। আমিষ ছোঁয়নি। ফলাফল, দুর্বলতা গ্রাস করে নিয়েছিল ওকে। হাঁটতে গেলে মাথা ঘুরে পড়ে যেত। নিজেকে কষ্ট দিয়ে শিক্ষা পেয়ে সেই চেষ্টায় আপাতত ইস্তফা দিয়েছে। কে জানে আবার কবে ওজন কমানোর ভূত চাপে। ভূত আপাতত মাথায় নেই বলেই জিভটাকে ঠকাতে পারছে না প্রিয়। যথারীতি সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর, রাত বারোটায় আবারো সাধ হলো এক কাপ ঘন দুধ-চায়ের। চায়ের সরঞ্জাম প্রিয় কিনে এনে নিজের কাছে রাখে। চুপিসারে এক কাপ ঘন চা বানিয়ে নিজের ঘরের বারান্দায় বসে একাকী পান করে। বারান্দাওয়ালা ঘরটা পাওয়া প্রিয়র জন্য খুব একটা কষ্টসাধ্য ছিল না। তার ও সুহাসের ঘর হলো পূর্বমুখী। এদিকে বিল্ডিংয়ের ফাক গলে বাতাস খুব কম আসে। অন্যদিকে চাচা-চাচি ও সুজানার ঘরে বড়ো দুটি খোলামেলা দখিনা জানালা আছে। সবদিক বিবেচনায় বাতাসে ভরপুর দিকটাই তারা বেছে নিয়েছেন। প্রিয়র তাতে অসুবিধা নেই। এক টুকরো আকাশ তো দেখা যায়! এতেই ওর প্রশান্তি।

“কট ইউ!”

আকস্মিক গম্ভীর কণ্ঠের ধাক্কায় প্রিয়র হাত থেকে চা ছলকে পড়ল। পাশাপাশি বারান্দাটি সুহাসের। সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে এক লম্বাটে ছায়া। প্রিয় বুকে ফু দিয়ে অত্যন্ত বিরক্তি নিয়ে বলল, “ঋজু ভাই! রাত বিরেতে এভাবে ভূতের মতো ভয় দেখাচ্ছেন কেন?”

ঋজু বলল, “তুমি ভয় পেয়েছো?”

“স্বাভাবিক নয় কি?”

“ভয় বুকে নিয়ে এত রাতে অন্ধকারে কি করছো?”

“উঁহু, ভুল হলো। আমার অন্ধকারকে ভয় নয়, অন্ধকারের অচেনা অদেখা মানুষকে ভয়।”

“আমাকেও?”

“চিনে ফেললে আর লাগে না।”

“এইটুকুতেই চিনে গেছো!”

কথাটা যেন আঁধারী রাতের মতোই রহস্যময়ী মনে হলো৷ প্রিয়র এ নিয়ে কথা বাড়াতে ইচ্ছে হলো না। বলল, “আপনি তখন ওই কথা কেন বললেন? আমার জন্য আপনার হাড়গোড় ভেঙেছে?”

ঋজু আবারো হাত নাড়াতে নাড়াতে বলল, “এক্স-রে করে নিশ্চিত হতে হবে।”

প্রিয় মুখ কালো করল। লোকটা কি ওকে ইচ্ছাকৃত অপমান করতে চাইছে! কিন্তু প্রিয়র যেখানে দোষ নেই, সেখানে খাটো হওয়া চলে না। বিদ্রুপের সুরে বলল, “তাহলে তো বলতে হয় আপনি খুবই দুর্বল মানুষ। একটা মেয়ের ওজনে হাড়গোড় ভেঙে যাওয়া মানুষকে আপনার বাবা-মা শহরে একা পাঠাল কোন আক্কেলে?”

ঋজু হাত নাড়া বন্ধ করে ভ্রু উঁচাল, “এই প্রশ্ন তো আমিও করতে পারি। যে মেয়ে চলতে ফিরতে জানে না, রাস্তাঘাটে হুমড়ি খেয়ে অন্যকে আহত করে দেয়, তাকে আর পরিবার বাইরে একা ছাড়ে কী করে?”

বিপরীত বাক্যে ধরাশায়ী প্রিয় রাগে গনগন করে উঠলেও সযত্নে তা চেপে বলল, “চলতে ফিরতে সামান্য এক্সিডেন্ট হতেই পারে। তা নিয়ে অন্যকে হেয় করাটা ভালো মানুষের কাজ নয়।”

ঋজুও পরাস্ত হওয়ার মানুষ নয়। বারান্দার গ্রিলে হেলান দিয়ে স্থির সুরে বলল, “তো তুমি আজকাল ভালো মানুষ, মন্দ মানুষ বিচার করতে শিখে গেছো?”

কাপের চা কথার প্যাচে ঠান্ডা হয়ে গেছে। তিক্ত হয়ে উঠেছে বায়ু। প্রিয়র অযথা তর্ক ভালো লাগছিল না। বলল, “ঘুমিয়ে পড়ুন ঋজু ভাই। আমিও ঘুমাতে গেলাম। শুভ রাত্রি।”

প্রিয় পেছন ঘুরে এক পা বাড়াতেই ঋজুর সাবধানী কণ্ঠ ফিসফিসিয়ে উঠল, “অপ্রিয়, মনে আছে? সেদিনও এমনই অন্ধকার রাত ছিল, তাই না?”

প্রিয়তির শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল স্রোতের ঢল নেমে গেল। সেই রাত! সেই অপ্রিয় রাতের কথা মনে পড়লে আজও মেয়েটি স্বভাবসুলভ স্থিরতা হারিয়ে অস্থিরমতি হয়ে ওঠে।

চলবে…