কোন প্রিয় নামে ডাকি পর্ব-০৩

0
1

#কোন_প্রিয়_নামে_ডাকি [৩]
প্রভা আফরিন

সুহাস তখন ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। উঠতি তরুণ বয়স। পাড়ার বন্ধুরা মিলে পৌষের একদিন ঠিক করল রাত জেগে আড্ডা দেবে, আগুন পোহাবে ও পোড়া মুরগী খাওয়ার আয়োজন করবে। ঋজু তখন পাশের এলাকায় থাকতো। সুহাসদের এ আয়োজনে বন্ধু হিসেবে সে অনায়াসে ঢুকে গেছিল। আয়োজন হয়েছিল সুহাসদের বাড়ির পেছনের দিঘি সংলগ্ন খোলা মাঠে। সকলে চাদা তুলে খাবারের ব্যবস্থা করেছিল। সেই সঙ্গে তরুণদের মাথায় ঘুরছিল দুষ্টু বুদ্ধি। সিগারেট জিনিসটা আড়ালে আবডালে দুই এক টানে চেনা হয়ে গেলেও অ্যালকোহল জাতীয় পানীয়টা এতটা সহজলভ্য না হওয়ায় সেটার প্রতি একটা গোপন আকর্ষণ তাদের ছিল। চাদার পরিমাণ কিছুটা বাড়িয়ে গোপনে তা কিনেওছিল। সারা রাত আড্ডা দিতে কিছু খেলাধুলার আয়োজনও হয়েছিল। আয়োজন যেহেতু সুহাসদের বাড়ির কাছাকাছি তাই টুকটাক যেকোনো প্রয়োজনে সকলে এ বাড়িতেই আসে।

ছেলেদের নৈশকালীন ভোজন দেখতে সদ্য কৈশোরের আঁচ লাগা প্রিয়র মনে প্রবল কৌতুহল। প্রিয়তি ছোটোবেলা থেকেই একটু নাদুসনুদুস ধরনের। কৈশোরে ওর সুস্বাস্থ্য যৌবনপ্রাপ্ত হয়ে এতটাই আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল যেন বর্ষার ভরাট নদী। গাল দুটি পাকা আপেলের মতো টসটসে দেখাতো। সুহাসের বন্ধুরা খেলাধুলা কিংবা পড়াশোনার জন্য এ বাড়িতে নিত্য আসা-যাওয়া করত বিধায় প্রিয়কেও তারা খুব ভালোমতো চিনত। সুহাসের বন্ধুদের মধ্যে ঋজুই ছিল একটু বেশি দুষ্টু। শান্তশিষ্ট প্রিয়কে সে প্রায়ই এটা-ওটা বলে ক্ষ্যাপাতো। প্রিয় চুপচাপ হলেও অল্পতে রেগে যাওয়ার অভ্যাস ছিল। আর রেগে গেলেই কেঁদে ফেলত, কিন্তু মুখে মুখে জবাব দিতে পারত না। তখন কান্না থামাতে হাতে দুটো ক্যান্ডি গুজে দিতে হতো। প্রিয় খেতে ভালোবাসে। দুটো ক্যান্ডিতেই রাগ গলে যেত মেয়েটির। সেদিনও দুটো ক্যান্ডি পেয়েছিল সে। তবে কান্নার ফলে নয়, অতিরিক্ত কৌতুহল দমাতে। ঋজু মেয়েটির হাতে ক্যান্ডি গুজে দিয়ে বলেছিল, “এত কৌতুহল ভালো না। ওদিকে সব ছেলেরা আছে। তোমার ওদিকে যাওয়ার দরকার নেই। ঘরে থাকো। তোমার জন্য সুহাস খাবার দিয়ে যাবে।”

সেদিন ছিল পৌষালি কুয়াশায় ঢাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন রাত। দিঘির পাড় হতে মাঝে মাঝে ব্যাঙের ডাক ভেসে আসছিল। বাদুরের হাকডাক শোনা যাচ্ছিল মাঠের শেষ প্রান্তে প্রহরায় থাকা কড়ই গাছের ডালে। উত্তুরে হাওয়া দেওয়া অত্যন্ত ছমছমে পরিবেশ মেতে উঠেছিল তরুণদের উচ্ছ্বাসে। মাটিতে পাটি বিছিয়ে বন্ধুরা গোল হয়ে বসে গল্প করছিল ভালোবাসা নিয়ে। কে কোন মেয়ের ওপর ক্রাশ খেয়েছে, কে কোন মেয়েকে ভালোবাসে থেকে শুরু করে গল্প চলে গেছিল চুমু খাওয়া অবধি। সেই সঙ্গে অ্যালকোহলে চুমুকও দিয়ে ফেলেছিল কেউ কেউ। ফলে আড্ডায় ধীরে ধীরে অনেকের মনের দুয়ার খুলে গেছিল। সুহাস যখন একটু সরে গিয়ে নিভু আগুনের আঁচ বাড়াচ্ছিল, তখন ওর পাড়ার বন্ধু সজীব ঢুলুঢুলু কণ্ঠে অন্যদের কাছে স্বীকার করেই বসল, “সুহাসের চাচাতো বইনডারে দেখলে আমার মনডা উড়ু উড়ু করে। কষাইয়া একটা চুম্মা খাইতে মন চায়। একটা বার যদি সুযোগ পাইতাম…”

কথাটা শেষ করতে পারেনি সজীব। তার আগেই ঋজু চড়াও হয়েছিল সজীবে ওপর। পুরো আড্ডায় ঋজু ও সুহাসই নেশাদ্রব্য ছুঁয়ে দেখেনি। কারণ সুহাসের বাড়ি কাছে। বাবা জানলে কপালে দুঃখ আছে। ঋজুর ওপরও হুকুম আছে যত রাতই হোক বাড়ি ফিরতে হবে। তাই ওরা কোনো ঝুঁকি নেয়নি। তাই সজীবের বলা কথায় বাকিদের হেলদোল না হলেও উপস্থিত ঋজু সঙ্গে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। ঋজু আগেও খেয়াল করেছে প্রিয়র দিকে সজীবের একটা লোলুপ দৃষ্টি আছে। তাই নিশ্চয়তা পেয়ে সজীবকে সে ছাড় দেয়নি। দুজনের মাঝে চূড়ান্ত হাতাহাতি হয়ে গেছিল। এক পর্যায়ে অপমানিত, অপদস্থ হয়ে সজীব সেই আড্ডা ছেড়ে উঠে যায়। কিন্তু সমস্যা সেখানেই মিটে যায়নি।

ঋজু প্রিয়কে বাইরে বের হতে নিষেধ করে গেলেও অনবদমিত ইচ্ছেকে প্রাধান্য দিয়ে কিশোরী বাইরে বের হয়েছিল। ওদের বাড়ির পেছনে একটা বেল গাছ আছে। সেই গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে প্রিয় দেখেছিল দূরে কোনো একটা ঝামেলা হচ্ছে। তবে ঠিকঠাক বুঝতে পারেনি। আহত, অপদস্থ সজীব ফিরে যাচ্ছিল সুহাসদের বাড়ির পাশ দিয়েই। প্রিয়কে বেল গাছের তলায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে সজীব দাঁড়িয়ে গেছিল। প্রিয় অবুঝের মতো জিজ্ঞেস করেছিল, “সজীব ভাই, তোমাদের পিকনিক কি শেষ হয়ে গেছে?”

সজীব তখন আহত বাঘের মতো হিংস্র। প্রিয়কে নিয়ে সামান্য মনের কল্পনা প্রকাশ করে মার খেতে হয়েছে বিধায় কল্পনাটা এবার সত্যি করে বদলা নেওয়ার জেদ চাপল মনে। বয়সের বিবেচনায় সজীব সুহাসদের চেয়ে বড়ো। তার গায়ের জোর বেশি। তারওপর অ্যালকোহলের প্রভাবে তার বিবেকবোধ লুপ্ত। প্রিয়কে সে অনায়াসে দুইহাতে বন্দি করে, মুখ চেপে ঝোপের মাঝে টেনে নিয়ে গেল।

বন্ধুদের আড্ডার তাল ছুটে যাওয়ায় সকলে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়েছিল। সজীবের ঘুষিতে ঋজু চোখের নিচে প্রচণ্ড ব্যথা পেয়েছে। স্থানটি ফুলে গেছে। এমন আঘাত নিয়ে বাড়ি গেলে বাবা-মায়ের জেরার মুখে পড়তে হবে। তাই বরফের সাহায্যে ফোলাভাব কমানোর জন্য ঋজুকে নিয়ে দোকানের দিকে যাচ্ছিল সুহাস। বাড়ির পাশের ঝোপের কাছ দিয়ে যাওয়ার সময় ওরা ধস্তাধস্তির শব্দ শুনতে পায়। ফোনের ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে এগিয়ে যেতেই দেখতে পায় হরিণ শাবকের মতো ভীত প্রিয়কে দানবীয় অজগরের মতো প্যাচিয়ে ধরেছে সজীব। এরপর কি ঘটেছিল প্রিয়র ঠিক মনে নেই। শুধু দেখেছিল সুহাস ও ঋজু তার রুদ্ধ হয়ে যাওয়া শ্বাসটা এক দানবের থাবা থেকে ফিরিয়ে এনেছিল। সজীবকে এরপর আর কোনোদিন ওদের বাড়ির আশেপাশে দেখা যায়নি। ঋজুও এরপর থেকে প্রিয়দের বাড়িতে তেমন একটা আসেনি। এলেও প্রিয়র সঙ্গে কথা বলেনি৷ ঋজুর কথা না শোনার অপরাধে প্রিয় হয়ে গেছিল ‘অপ্রিয়’। সেই অপ্রিয়কর রাতের অনুভূতি প্রিয়তিকে অনেক রাত ঘুমাতে দেয়নি। ঋজু, সুহাস ও প্রিয় ব্যতীত ভিন্ন কেউ ওই দিনের ঘটনা জানেও না।

এতদিন বাদে আবারো সেই অপ্রিয়কর রাতের স্মৃতি মনের আবদ্ধ কুঠির ভেঙে হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসতেই প্রিয়র দুটি চোখ নোনাজলে ভরে গেল। কেঁপে উঠল মেদে ভারিক্কি দেহ। ঋজু আবছায়ায় প্রিয়র দিকেই চেয়ে ছিল। স্থবিরতা ভেঙে বলল, “তোমার কান্নার স্বভাব এখনো গেল না!”

প্রিয় নিজেকে সামলে জবাব দিলো, “কান্না আমার স্বভাব নয়, ঋজু ভাই। কান্না আমার নিয়তি।”

আবারো নিরবতা নামল। প্রিয় নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, “আপনি তো সেদিন আ’ঘা’ত পেয়েছিলেন। বাড়ি গিয়ে কি জবাব দিয়েছিলেন?”

“বলেছিলাম ফেরার পথে রাস্তায় ছি’ন’তাইকারী ধরেছিল।”

“বিশ্বাস করেছিল?”

“হ্যাঁ। কারণ আমার ফোনটা সে রাতে কোনো একভাবে হারিয়ে ফেলেছিলাম।”

প্রিয় বুঝল সজীবকে শায়েস্তা করতে গিয়েই ফোনটা হারিয়েছে ঋজু। ওর মন খারাপ আরো বেড়ে গেল। ওর জন্য কতটা ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল মানুষটাকে! তাই হয়তো প্রিয়র ওপর এত রাগ জমেছিল! প্রিয় বলল, “সেদিনের জন্য আমি খুব দুঃখিত!”

“কেন?”

প্রিয় অকপটে স্বীকার করল, “সেদিন আপনার কথা শুনলে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি হতো না।”

ঋজু হাই তুলে বলল, “অনেক রাত হয়েছে। যাও, ঘুমিয়ে পড়ো।”
___________

ঋজুর থাকার সংবাদে সবচেয়ে বেশি উচ্ছ্বসিত হয়েছে সুজানা। রুমঝুম নূপুর বাজিয়ে গতকাল থেকেই ঋজুর চারপাশে ঘুরছে সে। বয়সের দোষ! এমনটাই মনে হলো প্রিয়র। ছোটো বোনের আচরণের হেতু বুঝতে খুব একটা অসুবিধে হচ্ছে না এখন। ঋজু সুহাসের ঘরে থাকছে বলে সুজানা সকাল থেকে প্রিয়তির বারান্দার দখল ছাড়ছেই না। ক্ষণে ক্ষণে ছবি তোলা, গাছে পানি দেওয়া, গাছের যত্ন নেওয়া সহ কত যে বাহানা। যে মেয়ে দশটার আগে ঘুম থেকেই ওঠে না সে আজ সাতটা না বাজতেই ঘুম থেকে উঠে গেছে।
ঋজু ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় দাঁড়িয়েছে। পাশের বারান্দায় সুজানা তখন গাছের সেবায় মগ্ন। ঋজুকে দেখে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলল, “গুড মর্নিং, ভাইয়া।”

“ভেরি গুড মর্নিং, পিচ্চি।”

“আপনার ঘুম কেমন হয়েছে?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। বাহ! বারান্দাটা তো খুব সুন্দর। গতকাল নোটিস করিনি।”

সুজানা আগ্রহ নিয়ে বলল, “হ্যাঁ আমিই তো রোজ যত্ন করি গাছগুলোর। তাই এত সুন্দর সুন্দর ফুল ধরেছে।”

ঋজু প্রসন্ন সুরে বলল, “এই বয়সী মেয়েরা সব টিকটক, ইনস্টায় টাইম ওয়েস্ট করে। তুমি এত সুন্দর কাজে সময় ব্যয় করো শুনে ভালো লাগলো।”

প্রিয়তি সুজানাকে ডাকতে এসে ঘর থেকে দুজনের কথাবার্তা শুনতে পেয়ে মুখ টিপে হাসল। সুজানা আগ্রহ নিয়ে কোনটা কি ফুল বলে যাচ্ছে ঋজুকে। এক পর্যায়ে ঋজু একটা চারাগাছ দেখিয়ে বলল, “এটা কি গাছ, সুজানা? মনে হচ্ছে চিনি। বাট নামটা খেয়াল আসছে না।”

সুজানা আমতা আমতা করে উঠল, “এই তো কদিন আগেই কিনলাম। নামটা মনে আসছে না কেন যে!”

“ওটা ড্রাগন ফলের গাছ।” পেছন থেকে উত্তর দিলো প্রিয়তি।

সুজানা অপ্রস্তুতভাব সামলে নিয়ে বলল, “হ্যাঁ এটা ড্রাগন ফলের গাছ। কিছুতেই মনে আসছিল না।”

প্রিয়তি হাসি চেপে বলল, “আসলে সুজানা মাঝে মাঝে অনেক কিছু ভুলে যায়। এই যেমন ভুলে গেছে ওর ম্যাথ টিউটর গতকাল বলে দিয়েছিল আজ সকাল করে পড়াবে। আমি মনে করাতে এলাম। যা, চাচি তোকে ডাকছে।”

সুজানা কোনোমতে পালিয়ে বাঁচল। প্রিয় এবার ঋজুকে উদ্দেশ্য করে বলল, “আপনিও খেতে আসুন। নাশতা তৈরি আছে।”

চলবে…