#কোন_প্রিয়_নামে_ডাকি [৪]
প্রভা আফরিন
প্রিয়তি যেমন খেতে ভালোবাসে, তেমনই চমৎকার ওর রান্নার হাত। কিন্তু চাচি প্রিয়কে সব সময় রান্না করতে দিতে পারেন না। মেয়েটা বড্ড খরুচে। হাতে টাকা থাকলে যেমন সকলের জন্য খরচ করে, তেমনই রান্নায় তেল, নুন, মশলা সব বেশি বেশি দেয়। অল্পকিছু হাতে ওঠে না। আইরিন যে বাজারে এক সপ্তাহ চালাতে পারবে প্রিয় তা দুদিনেই শেষ করে ফেলে। ফলে একটু সাশ্রয়ের জন্যই এই খাটুনিটা পুরোপুরি প্রিয়র ঘাড়ে দিতে পারেন না। প্রিয়তি নিজেও যে তা বোঝে না এমন নয়। দাদি ওকে শিখিয়েছিল, “প্রিয় রে, যদি কৌশল করে না চলতে পারিস এরা তোরে চুইষা খাইব। অন্যের ভালোর জন্য নিজেরে কষ্ট দিয়া ভালোমানুষি করবি না। তাতে তোর ফায়দা নাই। নিজের ভালোর জন্য মাঝে মাঝে অন্যের দাঁতের ঝারি খাইতে হইলেও খাবি। তাতে লাভ আছে।”
প্রিয় মনে রেখেছে দাদির কথা। তাই সব ক্ষেত্রে ছাড় দেয় না। চাচি পারলে পুরো সংসারের কাজ ওকে দিয়ে করিয়ে নিতে পারলে বাঁচে তা প্রিয় জানে। তাই কিছু কাজ ইচ্ছে করেই চাচির পছন্দের প্রতিকূলে করে যেন নিজের জন্য একটু সময় বের করে নিতে পারে। তবে যেদিন মেহমান আসে সেদিনের রান্না প্রিয়কেই করতে হয়। পাত্র পক্ষের বেলাতেও একই নিয়ম। আজ দুপুরে প্রিয়কে জলদি ভার্সিটি থেকে ফিরতে বলেছেন আইরিন। ঘটক এবার প্রবাসী পাত্রের জন্য সম্বন্ধ এনেছে। তাদের জন্য নাশতার আয়োজন প্রিয়কেই করতে হবে। তবে আজ চাচি ওকে শাড়ি পরতে নিষেধ করলেন। শাড়িতে নাকি বেশি মোটা দেখায়। প্রিয় সে কথায় হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। শাড়ি পরে সাজগোজ তো আর কম ঝক্কির নয়! বিকেলে পাত্রপক্ষ আসার আগে সুজানাকে পাশের বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন আইরিন। সুজানাটার রূপ দিন দিন খোলতাই হচ্ছে। তারওপর অল্প বয়স। যেন তেন পাত্রপক্ষের চোখে লাগানো যাবে না। প্রিয়র বিয়ে দিয়ে এরপর ধীরেসুস্থে সুজানার কথা ভাবা যাবে।
প্রিয়তিকে দেখতে এলো তিনজন মানুষ। এদের মধ্যে পাত্রটি নেই। সেই পুরুষ বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে ঘাম ঝরাচ্ছে। পরিবার তার জন্য পাত্রী নির্বাচন চূড়ান্ত করলে সম্ভবত দেশে আসবে।
পাত্রী দেখা হলো অনাড়ম্বরভাবে। বোঝা গেল পাত্রীর দেহের মেদ নিয়ে তাদের ইতিবাচক মনোভাব নেই। পাত্রের ভাবি বেশ হাসিখুশি মানুষ। বয়সে প্রিয়র সমান হবে। হাসিমুখে বলল, “ওজন আজকাল কোনো ব্যাপারই না। নিয়মিত এক্সারসাইজ আর ঠিকঠাক ডায়েট ফলো করলে অনায়াসে শরীরকে বশ করে ফেলা যায়। ইচ্ছেটাই আসল।”
ইচ্ছে কি প্রিয়র ছিল না! পরিশ্রমও তো সে কম করে না। তবুও মেদের সঙ্গে যুদ্ধে পেরে ওঠে না সে। পাত্রের ভাবির সঙ্গে তাল মেলালেন আইরিন, “হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমাদের প্রিয়তি করিৎকর্মা মেয়ে। ঠিকই ওজন কমিয়ে ফেলবে। বোঝেনই তো সারাদিন খায়, ঘুমায় আর পড়াশোনা করে। কোনো কাজ করতে দেই না। মেয়েরা বাপের বাড়িতে একটু সুখ করেই। স্বামীর ঘরে গেলে দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।”
পাত্রের মা দ্বিধার জায়গা প্রকাশ করে বললেন, “কিন্তু মেয়ের তো বাপের ঘর নেই। বাবা নেই। মা আছে শুনলাম। খোঁজ খবর রাখে না?”
“আছে, ওই না থাকার মতোই। ওকে আমরাই কোলেপিঠে বড়ো করেছি।”
মায়ের প্রসঙ্গে প্রিয়র ঘাড় নিচু হয়ে গেল। থুতনি ঠেকল বুকে। পাত্রের মা আবার বললেন, “ছেলে তো শ্বশুর-শাশুড়ির আদরই পাবে না। আর না পাবে ভরসা। তা মেয়ের বাবা মেয়ের জন্য সম্পত্তি কিছু রেখে যায়নি?”
এ কথায় আইরিনকে আমতা আমতা করতে দেখা গেল। পাত্রপক্ষ পরে সিদ্ধান্ত জানাবে বলে সেদিনের মতো বিদায় নিল।
সন্ধ্যায় ঋজু ও সুহাস একত্রে বাড়ি ফিরল। প্রিয়র বানানো নাশতাই ওদেরকে খেতে দেওয়া হলো। সুহাস খাবারের চেহারা দেখেই বলল, “প্রিয় বানিয়েছে নাকি?”
সুজানা উত্তর দিলো, “আপুকে দেখতে এসেছিল। সেই উপলক্ষেই বানিয়েছে।”
ঋজু খাবারের পেয়ালা হাতে নিয়ে চুপচাপ দেখতে লাগল। খেলো না। সুহাস বলল, “দেখতে এসেছিলো মানে? মা তো কিছুই বলল না।”
আইরিন কথাটা শুনতে পেয়ে ঘর থেকেই জবাব দিলেন, “অত বলে কী হবে? সম্বন্ধ কি একটাও এগোয়? না আছে শেকড়ের জোর, আর না রূপের। বাবা-মা তো অর্থকরিও দিয়ে যায়নি। এমন অভাগীরে কোন সচেতন পরিবার নিতে চাইবে?”
ঋজু আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখল। প্রিয়কে এসে অবধি একবারও দেখতে পায়নি। এমনকি রাতে খাবারের সময়ও দেখা গেল না। জিজ্ঞেস করাটা ভালো হবে কিনা বুঝতে না পেরে ঋজু কোনো কথা বলল না৷
রাত দশটা। নিশুতির গায়ে ভর দিয়ে উড়ে আসা বাতাস গাছের পাতায় হেলান দিয়ে গল্প করছিল। এমন সময় লোডশেডিং হওয়ায় ঋজু আবছা বারান্দায় এলো স্বস্তির আশায়। শুনতে পেল পাশের বারান্দায় কে যেন ফিসফিস করে কাঁদছে। ঋজু বলল, “অপ্রিয়, কাঁদছো?”
প্রিয় ঋজুর উপস্থিতি টের পায়নি বিধায় আকস্মিক ডাকে চমকে তাকাল। নিজেকে চমৎকারভাবে সামলে নিয়ে হাসিমাখা সুরে বলল, “না, আজকে গাছেদের পানি দেওয়া হয়নি বলে ওরা রাগ করেছে। তাই একটু পানি দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম।”
“কলে পানি নেই?”
“অভিমান কলের পানিতে ভাঙে না। অভিমান ভাঙাতে হয় চোখের পানিতে।”
ঋজু অদ্ভুত হেসে বলল, “শুনলাম বিয়ে করার জন্য লাফাচ্ছো?”
প্রিয় থমথমে গলায় বলল, “আপনাকে কে বলেছে আমি বিয়ের জন্য লাফাচ্ছি?”
“বলতে হবে কেন? দেখতেই পাচ্ছি। বিয়ে হচ্ছে না বলে ঘরে দরজা দিয়ে বিরহযাপন করছো। আড়ালে মুখ লুকিয়ে কান্নাকাটি করছো।”
প্রিয়র নাকের পাটা ফুলে উঠল। দাঁতে চেপে বসল দাঁত। প্রত্যেকটা বাক্য যেন ওর ব্যক্তিত্বের অপমান। শক্ত কণ্ঠে বলল, “না জেনে কাউকে কটাক্ষ করবেন না, ঋজু ভাই। সবসময় যা দেখেন তা সত্যি হবে এমন কোনো যুক্তি নেই। আমার ব্যক্তিত্ব এতটা দুর্বল নয়।”
এবার যেন ঝাঁঝই ফুটে উঠল ঋজুর কণ্ঠে, “তাহলে নাচতে নাচতে পাত্রপক্ষের সামনে বসা হয় কেন? নিজের প্রদর্শনী করতে? তখন কি ব্যক্তিত্ব জানালা দিয়ে পালায়?”
প্রিয় নিজেকেই যেন উপহাস করে বলল, “ব্যক্তিত্ব দুর্বল না হলেও অনেক সময় পরিস্থিতির জন্য নিজের অবস্থান দুর্বল হয়। জলে বাস করে কুমিরের সঙ্গে ঝামেলা করা যায় না।”
এইটুকু কথাতেই প্রিয় তার সম্পূর্ণ পরিস্থিতি যেন বুঝিয়ে দিলো। অনেকটা সময় দুজন কোনো কথা বলল না। এক পর্যায়ে প্রিয় স্বাভাবিক হয়ে বলল, “আপনার জবের প্রথম দিন কেমন কাটল?”
“নট ব্যাড। একটু গুছিয়ে উঠলেই ভাড়া বাড়ি দেখব।”
কথার মাঝেই বিদ্যুৎ চলে এলো। আলোর ধাক্কা সামলে চোখ পিটপিট করে তাকাতেই প্রিয় বিদ্যুতের শক খাওয়ার মতো আঁতকে উঠল, “এ কি ঋজু ভাই, আপনি খালি গায়ে কেন?”
“গরম লাগছিল তাই টিশার্ট খুলে ফেলেছি। এতে লজ্জায় টমেটো হওয়ার কি আছে?”
প্রিয় মুখ ঘুরিয়ে নিল। হুট করে পাশের বারান্দায় নগ্ন দেহের সুঠাম পুরুষটির অবয়ব আবিষ্কার করে সে সত্যিই লজ্জা পেয়েছে৷ অথচ ঋজু দামাল ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে প্রিয়র অবস্থার মজা নিচ্ছে!
চলবে…