কোন প্রিয় নামে ডাকি পর্ব-০৫

0
1

#কোন_প্রিয়_নামে_ডাকি [৫]
প্রভা আফরিন

প্রিয়তির টিউশনটা ছুটে গেল। এর চেয়ে মর্মান্তিক দুঃসংবাদ বোধহয় কিছু হতে পারে না ওর জন্য। ছুটে যাওয়ার কারণ ছাত্রীর পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট। ছাত্রী অসুস্থ থাকার ফলে ভালো প্রিপারেশন নিতে পারেনি, ক্লাস টেস্টে খুব একটা ভালো করতে পারেনি। এখানে প্রিয়র কি দোষ! একটা অসুস্থ মেয়েকে সে কতটুকুই বা জোর করে পড়াতে পারে? ছাত্রীর মায়ের কথার ধরনে মনে হলো যেন টাকা দিয়ে টিচার রেখেছে বিধায় সব পড়া ছাত্রীর মাথায় ঢুকিয়ে দিতে হবে। পারলে টিচার গিয়ে পরীক্ষার খাতায় লিখে নম্বর তুলে আনবে। প্রিয় অযথা কথা বাড়ায়নি। বকেয়া স্যালারির খামটা নিয়ে বিদায় নিয়ে চলে এসেছে। মাথার ওপর পড়ন্ত বিকেল নিয়ে এখন রাস্তায় উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছে। বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। এমনিতেই সম্বন্ধ টেকে না বলে চাচি ওর ওপর নারাজ। তারওপর যদি জানে আগের মতো হাতে কটা টাকা গুজে দিতে পারবে না তাহলে যেটুকু স্বাধীনতা আছে সেটাও কথার বাণে বি’ষা’ক্ত হয়ে যাবে। নানান জল্পনাকল্পনা করতে করতে প্রিয় একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল। সচকিত হলো ডাক শুনে।

“অপ্রিয়?”

প্রিয়তি পিছু না ফিরেও চিনতে পারল। রিকশায় বসে হাক ছেড়েছে ঋজু। তার ফর্মাল গেটআপ দেখে বোঝা গেল অফিস থেকে ফিরছে। প্রিয়কে দেখতে পেয়ে রিকশা ছেড়ে দিলো সে। ভাড়া মিটিয়ে এগিয়ে আসতেই প্রিয় কিছুটা সংকুচিত হয়ে গেল। মনে পড়ল গতকাল রাতের কথা। ঋজু গরম লাগায় খালি গায়ে ছিল বলে প্রিয়র সে কি লজ্জা! ঋজুও সুযোগ ছাড়েনি মেয়েটিকে নাস্তানাবুদ করতে।

“অপ্রিয়, তোমার কি মনে আছে আমাদের দুজনের একটা সিক্রেট মিলের কথা? যেটা তুমি আর আমি ছাড়া কেউ জানে না।”

প্রিয়র যে মনে আছে সেটা ওর অনবরত চোখের পলক ফেলা দেখেই বোঝা গেল। মিলের কথাটা প্রিয় শুনতে চাইছিল না। কিন্তু ঋজু না বলে ছাড়ে নাকি! ফিসফিসানি সুরে বলেছিল,
“আমাদের দুজনের একই জায়গায় একটা তিল আছে। রাইট?”

প্রিয় চোখ বুজে মনে মনে নিজেকে কষিয়ে একটা চড় দিলো। বোকা বোকা কৈশোরের সূচনায় একদিন ঝুম বৃষ্টি মাথায় ঋজু এসে উঠেছিল সুহাসদের বাসায়৷ ঠান্ডা লাগার অভ্যাস আছে বলে টিশার্ট খুলে ফেলেছিল সে। প্রিয় সুহাসের ঘর থেকে গামছাটা এনে দেওয়ার সময় ঋজুর উন্মুক্ত বুকের ওপর বাঁ পাশে একটা কুচকুচে বড় সাইজের তিল দেখে বোকার মতো বলে বসেছিল, “আরে আপনার আর আমার তো একই জায়গায় তিল।”

কলেজ পড়ুয়া তরুণের মুখ দিয়ে একটা ভয়ংকর কথা চলে আসতে আসতেও থেমে গেছিল সেদিন। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক, প্রাপ্তমনস্ক পুরুষটির মুখে কথা আটকাতে চায় না।

“অপ্রিয়, তাকাও।”

প্রিয় চোখ তুলে চাইলে ঋজু তর্জনী দিয়ে বুকের বাঁ পাশের তিলটা দেখিয়ে বলল, “ঠিক এখানে না?”

“আপনি খুব বিশ্রী, ঋজু ভাই।”

“বাহ! তুমি বললে ভালো আর আমি বললে বিশ্রী!”

“সেই হাবাগোবা আমি আর এই আমি যেমন এক নই, সেই আপনি আর এই আপনিও এক নন। সময়ের সাথে আমরা সবাই বদলাই।”

“কিন্তু আমার তিল তো বদলায়নি।”

শেষমেষ প্রিয় কথা থেকে বাঁচতে পালিয়েছিল। সকালে আর মুখোমুখি হয়নি। দেখা হলো এখন। ঋজু সামনে এসে দাঁড়াতেই প্রিয় স্বাভাবিক সুরে বলল, “অপ্রিয় ডাকটা কি বদলাবে না?”

“বদল চাও?”

“পিতা-মাতা প্রদত্ত একটা নাম আছে, সেটা বলে ডাকলেই হবে।”

“ডাকা যায়। কিন্তু ধরো দুদিন বাদে একটা প্রেমিকা জুটল। সে যদি দেখে আমি আরেক মেয়েকে ‘ও প্রিয় ও প্রিয় বলে ডাকছি ব্যাপারটা ভালোভাবে নাও নিতে পারে।”

“কৌশলে কি বলতে চাইলেন আপনি সিঙ্গেল?”

“কৌশলে কেন? সরাসরিই বলছি। এই জমানায় সিঙ্গেল থাকা যে কি পরিমাণ স্ট্রাগলের তুমি বোঝো? এলিজিবল ব্যাচেলর আমি। মেয়েরা শুধু প্রেম নয়, সরাসরি বিয়ের পাত্র হিসেবে মনোনিত করে বসে। মেয়ের মায়েরা কৌশলে যৌতুকের লোভ দেখিয়ে বাবা-মায়ের কাছে বিয়ের কথা তোলে। এর জন্যই তো বগুড়া থেকে পালিয়ে ঢাকায় আসা।”

প্রিয় জোর করে হেসে বলল, “আপনার স্ট্রাগলের গল্প শুনে নিজের স্ট্রাগলকে মিনিংলেস মনে হচ্ছে।”

হাঁটতে হাঁটতে ওরা রাস্তা থেকে মাঠে নেমেছে। দুজনের চলার ধরনই বলে দিলো বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছে না। প্রিয়র ভারাক্রান্ত মুখ দেখে ঋজু প্রশ্ন ছুড়ল, “তুমি কোনো অসুবিধায় আছো? বলতে পারো আমায়।”

প্রিয় ইউক্যালিপটাস গাছের নিচে বসে পড়ল। অতিরিক্ত ঘামে ও। ওড়না দিয়ে ভালো করে ঘাড়-গলা মুছে সহজ সুরে বলল, “টিউশনিটা ছুটে গেল আজ। তাই একটু মন খারাপ।”

ঋজু বলবে কি বলবে না দ্বিধা কাটিয়ে বলেই ফেলল, “তুমি তোমার মায়ের কাছে কেন চলে যাও না? উনার সঙ্গে যোগাযোগ নেই?”

প্রিয়র অঙ্গভঙ্গি সংকুচিত হয়ে গেল। ঋজু খেয়াল করে আবার বলল, “কিছু মনে কোরো না, তোমায় অস্বস্তিতে ফেলার ইচ্ছে আমার নেই।”

প্রিয় সামলে উঠল নিজেকে। সংক্ষিপ্ত সুরে বলল, “যে ফেলে গেছিল তার কাছে গিয়ে জীবনের বোঝা আর নাই বা বাড়ালাম।”

“চাচা-চাচীর কাছে বোঝাটা কম?”

“এটা আমার বাবা-চাচার ভিটা। বাবার সম্পত্তির উত্তরাধিকার আমি। সে সূত্রে জমিতে আমারও ভাগ আছে। ওরা কি আর এমনি এমনি পেলেপুষে বড় করল আমায়? যত যাই বলুক, অন্তত দূর ছাই করে খেদাবে না। করলে আগেই করতো।”

এরপর দুজনে নিরব হয়ে বসে রইল অনেকটা সময়। কেউ কারো দিকে তাকালোও না, কথাও বলল না। পড়ন্ত বিকেলের মেদুর আভা ওদের চুলে আলতোভাবে বিলি কেটে গেল। বাদামওয়ালার কাছ থেকে এক ঠোঙা বাদাম কিনে ঋজু সহজ সুরে বলল, “তো এখন কি করার প্ল্যান আছে?”

বলে ঋজু বাদাম ছিলে প্রিয়র হাতে দিলো। প্রিয় বলল, “বসে খাওয়ার ভাগ্য নিয়ে তো জন্মাইনি। দেখি… একটা না একটা ব্যবস্থা করতেই হবে।”

ঋজু চিন্তামগ্ন হয়ে কি যেন একটা ভেবে যাচ্ছে। পড়ন্ত বিকেলের মিঠে রোদে তাকে সুদর্শন দেখাচ্ছে। এক পলক তাকিয়ে প্রিয়র মনে হলো ঋজু বোধহয় সত্যিই বলেছে, এমন সুপুরুষ ব্যক্তির জন্য সিঙ্গেল থাকাটা নিশ্চয়ই সংগ্রামের। ব্যক্তি ভেদে সংগ্রামের গল্প কত বিচিত্র! প্রিয় অজান্তেই হেসে উঠল।

****

সুজানা বাড়িতে টিশার্ট পরে অভ্যস্ত। শরীরের গঠনে নারীসুলভ বাক তৈরি হবার পর ওকে টিশার্ট পরতে বারন করেছিল প্রিয়। কিংবা পরলেও অতি ঢিলেঢালা দেখে। নতুবা চোখে লাগে। বড়ো বোন হিসেবে ভালো-মন্দ বোঝানোর অধিকার প্রিয়র আছে, এমনটাই ধারণা ছিল ওর। সুজানার সে বারন পছন্দ হয়নি। চৌদ্দ বছরের মেয়েটি একদিন গলা চড়িয়ে বলেই বসেছিল, “আমাদের বাড়িতে থাকছো, খাচ্ছো আবার আমার পোশাক নিয়ে নিন্দা করছো?”

সেদিন থেকেই প্রিয় নিজের গন্ডি বুঝে নিয়েছিল। সুজানাকে এ নিয়ে আর কিছু বলেনি। সুজানাও মাফ চায়নি। এরপর একদিন প্রিয় নিজেই ওকে লম্বা দেখে ঢিলেঢালা টিশার্ট কিনে দিয়েছে। সেগুলো এতই সুন্দর ছিল যে সুজানা লুফে নিয়েছে এবং ব্যবহারও করছে। আইরিন অবশ্য মাঝে মাঝে সুজানাকে বলেন বাইরের মানুষের সামনে যেন এসব পোশাক না পরে, কিন্তু সুজানা উঠতি বয়সের জেদি, একগুয়ে কিশোরী। কেউ ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধাচারণ করবে মানতেই পারে না।

যথারীতি ঋজু বাড়িতে ওঠার পরও সুজানার চলাফেরার উগ্রতা কমেনি। তবে একটা রাখঢাক করা পরিবর্তন এসেছে। আগে যেমন পানির গ্লাসটা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে হতো, কোনোকিছু খুঁজে না পেলে চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলতো, এখন আর তা করছে না। ঋজু অফিস থেকে ফেরার পর তার ঘরের আশেপাশে সুজানার আনাগোনা বেড়েছে। ঋজুর এটা-ওটা লাগলে এগিয়েও দিচ্ছে। আইরিন মেয়ের এই পরিবর্তন খেয়াল করলেন গভীরভাবে। রাতে স্বামীর কাছে এ ব্যাপারে সরাসরি কথা তুললেন।

চলবে…