কোন প্রিয় নামে ডাকি পর্ব-০৬

0
2

#কোন_প্রিয়_নামে_ডাকি [৬]
প্রভা আফরিন

ঋজুকে নিয়ে নিজের মতামত স্বামীর কাছে তুলে ধরলেন আইরিন। ছেলেটা বাড়িতে ওঠার পর থেকেই নজর রেখেছেন। নম্ব, ভদ্র, চালচলন ভালো, দেখতেও সুন্দর। বেশ ভালো অংকের বেতনে চাকরি করে। এমন পাত্র হাতছাড়া করা বোকামি। সুজানার বয়স ষোল পেরোলো। এখনই মেয়ের মন উড়ুউড়ু। আইরিন জানেন এই মেয়েকে বেশিদিন বেধে রাখতে পারবেন না। তারচেয়ে চরিত্র সুরক্ষিত থাকতেই ভালো দেখে পাত্রস্থ করা জরুরী। আর মেয়েরই যেহেতু ঋজুর প্রতি আগ্রহ আছে তাই আইরিনও সবদিক বিবেচনা করে এটাই উত্তম ভাবলেন। বাহারুল সাহেব সব শুনে সহসাই কোনো মতামত দিলেন না। স্বল্পবাক্যে বললেন, “এত তাড়াহুড়ার কিছু নাই। আমারে আগে বুঝতে দেও।”

“তাড়াহুড়া নাই বলে হাত গুটাইয়া থাইকো না। ভালো পাত্র সব সময় পাওয়া যায় না। ঘরে আরেক মেয়ে আছে। বয়স বাইশ হয়ে গেল এখনো গতি করতে পারলাম না। প্রিয়র একটা ব্যবস্থা হয়ে গেলেই আমি বাঁচি।”

“তো তুমি ঋজুর সাথে সুজানার কথা চিন্তা না করে প্রিয়তির কথা চিন্তা করলেই পারতা। ওরে ডিঙাইয়া তোমার ছোটো মেয়েরেই চোখে বাজল?”

আইরিন জ্বলে উঠলেন, “ছোটো কারে কও? ওই বয়সে তোমার ছেলেরে পেটে ধরছিলাম ভুইলো না। মেয়ে হইছে এক অকালপক্ব। এই মেয়ে আমার হাতে থাকব না বেশিদিন। ঘুড়ি ভোকাট্টা হওয়ার আগেই নাটাইয়ে বাঁধা বুদ্ধিমানের কাজ। ঋজুর চেয়ে ভালো পাত্র তো চোখে দেখি না। পানচিনি যদি করে রাখা যায় বিয়ে নাহয় দুই বছর পরেই হবে। অসুবিধা কই? ছেলের অর্থসম্পদে তো কমতি নাই। সবদিক দেখেই বলছি। আর ঋজুর মতো ছেলের একটা ব্যক্তিগত রুচি আছে না? তোমার প্রিয়তিরে তো ম্যাট্রিক পাশ পাত্রও পাতে তুলতে চায় না। ঋজু তুলবে? ওই কথা রাখো। প্রিয়র একটা গতি তুমি যেমনেই পারো করো। আমি অতি তাড়াতাড়ি সুজানার ভবিষ্যত গুছায় দিতে চাই। এরপর ছেলের বউ আনতে হবে ঘরে। সময় তো আর বইসা নাই।”

বাহারুল সাহেব এবার সত্যিই চিন্তিত হলেন। আর চিন্তাগ্রস্ত সময়ে তিনি পান চিবোতে পছন্দ করেন। আইরিনকে নির্দেশ দিলেন পান সাজিয়ে দিতে। এমন দরকারি মুহূর্তে পানের আবদার আইরিনকে বিরক্ত করল। তিনি মুখ ঝামটে উঠে গেলেন।

সারাদিন সংসারের কাজে ব্যস্ত থাকে বলে সাধারণত রাত এগারোটার মাঝেই চাচি ঘুমিয়ে যায়। প্রিয় জানে চাচি ঘুমালেই সে সবকিছুতে স্বাধীন। আজও তাই ভেবে একটু চা বানাতে রান্নাঘরে ঢুকেছিল। কাপে চা ঢালার মুহূর্তে হাতেনাতে ধরা পড়ে গেল। চাচির উপস্থিতি টের পেয়ে ভড়কে যাওয়ার প্রিয়র হাত ফসকে চা পড়ল পায়ে। জ্বলে গেলেও চেপে রাখা ঠোঁট থেকে আওয়াজ বের হলো না।

আইরিন একে তো রান্নাঘরের আলো জ্বলতে দেখে এসেছিলেন, প্রিয়কে চা বানাতে দেখে মেজাজ গরম হয়ে গেল। বললেন, “তাই তো বলি সময়ের আগে গ্যাস ফুরায় ক্যান? রাত-বিরাতে এমন করে গ্যাস নষ্ট করিস?”

প্রিয় থতমত খেয়ে সহসাই জবাব দিতে পারল না। আইরিন চায়ের দুটো কাপ খেয়াল করে বললেন, “দুই কাপ কেন? কার জন্য?”

এবার যেন প্রিয় নিজের দোষ ঢাকার সামান্য অজুহাত খুঁজে পেল। বলে ফেলল, “আসলে ঋজু ভাই চায়ের কথা বলছিল। তাই বানাতে এসেছি। নাহলে বানাতাম না।”

“এত রাতে ঋজু চা চেয়েছে? তোর কাছে?”

প্রিয় নিজের কথায় জড়িয়ে গেল। উত্তর হ্যাঁ হলে চাচি না জানি মনে মনে কি ভেবে বসেন।সেই ভয়ে প্রিয় এমনভাবে ঘাড় নাড়ল যে হ্যাঁ বা না কোনটা বোঝালো সে নিজেই জানে না। আইরিন ক্ষণিক স্থির চোখে প্রিয়কে পরখ করে চলে গেলেন। প্রিয় পায়ের জ্বলুনিতে সেদিকে আর খেয়াল করল না। এক কাপ চা পড়েই গেছে। সেটা পরিষ্কার করে বাকি এক কাপ চা ঋজুর জন্য তৈরি করে ঘরে নিয়ে গেল সে।

ঋজু বারান্দায় চেয়ার পেতে বসে আছে। ঘরের ভেতর সুহাস নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। সুহাসের ঘুম বেশি। একবার শুয়ে পড়লে কানের কাছে সানাই বাজালেও সে উঠতে রাজি না। অন্যদিকে ঋজু রাত জাগা মানুষ। বারোটার আগে কখনোই ঘুমায় না। ইদানীং প্রিয়র নিরব সঙ্গ ওর ভালো লাগছে। জানে এই সময়ে প্রিয় বারান্দায় আসে, এও জানে প্রিয় চা খেতে পছন্দ করে। টিউশন চলে যাওয়ায় মেয়েটা মন খারাপ করে আছে বলে ঋজু ইচ্ছে করেই চা খাওয়ার আর্জি প্রকাশ করেছে।

প্রিয় গরম চায়ের কাপটা এগিয়ে দিলে ঋজু ভ্রুকুটি করে বলল, “এক কাপ কেন?”

“আসলে আমার আজ ইচ্ছে করছে না।”

“তো আমি এখন একা একা চা খাব আর তুমি দেখবে?”

“দেখব কেন? আমার তো ভীষণ ঘুম পাচ্ছে।”

ঋজু রেগে গেল, “মানে আমি একা একা বসে থাকব আর তুমি ঘুমাবে?”

প্রিয় ভ্রু কুচকে বলল, “তো আপনি চাইছেনটা কি?”

ঋজু অকপটে বলল, “আমি চাইছি চা শেষ হওয়া অবধি তুমি এখানে থাকো। আমার পাশে।”

কিছু কৌতুহল প্রকাশ করতে নেই। কিছু আবদারের কারণ জানতে নেই। কিছু মুহূর্তে সচেতন মস্তিষ্ক অবচেতন হয়ে পড়ে। এখন বোধহয় তেমনই এক মুহূর্তে উপস্থিত। প্রিয় এ কথার বিপরীতে বিশেষ তর্ক করল না।

___________

সকালে নাশতা করতে বসে ঋজু বলল, “আন্টি, বেশ কিছুদিন তো আপনাদের বাড়িতে থাকলাম। আপনাদের আদরে মনেই হয়নি বাড়ি থেকে দূরে আছি। এবার আমায় বিদায় দিন।”

সুজানা চমকে উঠল। ব্যথিত সুরে বলল, “আপনি চলে যাবেন ভাইয়া?”

“যেতে তো হবেই, সুজি।”

ঋজু সুজানাকে সুজি বলে ডাকে। আগে কেউ সুজি বলে ভেঙালে সুজানা রাগ করত। ঋজু ডাকলে অবশ্য সে খুশিই হয়। ও বলল, “আপনি চলে গেলে খুব মিস করব।”

“আমিও তোমাদের মিস করব।”

ঋজুর চলে যাওয়া নিয়ে প্রিয়র কোনো মন্তব্য নেই। সে সুজানার মতো মিস করব বলতে পারবে না, আবার থাকতেও বলতে পারবে না। তাই সে চুপচাপ সকলের কথা শুনছে।

আইরিন বললেন, “এই বললে মনেই হয়নি বাড়ির দূরে আছো, তাহলে এখন দূরে সরে যাচ্ছো কেন, বাবা?”

“বাড়িতে আম্মা অসুস্থ। ভাবছি ভাড়া বাসায় উঠে আম্মাকে কাছে রেখে চিকিৎসা করাবো। তাই এবার যেতেই চাইছি। আপনারা অনুমতি দিন।”

আইরিন ভাবলেন এটাই ভালো। ঋজুর মা ঢাকায় এলে বিয়ের কথা তুলতে সুবিধাই হবে। তাছাড়া প্রিয় ও ঋজুর এক বাড়িতে কাছাকাছি থাকাটাও এখন আর ভালো লাগছে না। মনে হচ্ছে ঋজু দূরে গেলেই ভালো। তাই তিনি যাওয়ার ব্যাপারে বিশেষ আপত্তি তুললেন না। ঋজুর মায়ের সুস্থ হওয়া নিয়েই বেশি আগ্রহ প্রকাশ করলেন।

সেদিনই বিকেলে ঋজু ব্যাগ গুছিয়ে বাহারুল সাহেবের বাড়ি থেকে বিদায় নিল। সিএনজিতে ওঠার সময় প্রিয়র হাতে একটা কার্ড গুজে দিয়ে বলল, “এমনিতেই জীবনে ডিপ্রেশনের ঘাটতি নেই। এর মাঝে আর্থিক ডিপ্রেশন ঘাড়ে নিয়ে ঘুরে বেড়িও না। এই ঠিকানায় চলে এসো সময় করে। একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে আশাকরি। নিজেকে ভালো রাখার দায়িত্বটা তোমায় দিয়ে গেলাম। আশাকরি এই দায়িত্বে অবহেলা করবে না।”

সিএনজি ছেড়ে দিলো। প্রিয় কার্ডটা মুঠোয় চেপে ধরে বিড়বিড় করল, “দায়িত্বের ভার নিতে যে ভয় হয়।”

চলবে…