কোন প্রিয় নামে ডাকি পর্ব-০৮

0
2

#কোন_প্রিয়_নামে_ডাকি [৮]
প্রভা আফরিন

ঋজু বাসায় ফিরতেই দরজা খুলল সুজানা। বেশ অবাক হলো সে। সুজানা বলল, “কেমন আছেন, ভাইয়া?”

“ভালো আছি। তুমি হঠাৎ…”

উত্তর দিতে দিতে ঋজু ঘরে ঢুকে দেখল মায়ের সঙ্গে আইরিন আন্টি বসে আছে। সালাম দিলো সে। আইরিন হেসে বললেন, “তুমি তো নিজের মাকে পেয়ে আমাদের ভুলেই গেলে। তাই আমরাই এলাম একটু খোঁজ নিতে। আমাদের সঙ্গে ছিলে, মায়া পড়ে গেছে তো।”

ঋজু সলজ্জে মাথা নেড়ে বলল, “ভুলিনি আন্টি। শুধু গুছিয়ে নিতে একটু সময় নিচ্ছিলাম।”

“আমরা বুঝি সাহায্য করতে পারতাম না? তোমাকে আমার ছেলে ভাবি না বুঝি!”

আইরিনের মমতাপূর্ণ কথায় রেবেকা খানম ভীষণ খুশি হলেন। সেই খুশির রেশ ধরে বিকেলে ঋজু তার মাকে নিয়ে কেনাকাটা করতে যাওয়ার কথা থাকলেও সঙ্গ নিল আইরিন ও সুজানা। কথায় আছে যত মাথা তত মত, আর যত মত তত বিশৃঙ্খলা। এক্ষেত্রেও তাই হলো। কিছু কিনতে গেলে আইরিন ও সুজানার মতামত চাইতে গিয়ে রেবেকা খানম বিভ্রান্ত হয়ে গেলেন। শেষমেষ কেনাকাটা তেমন হলো না। তবে চারজন মিলে ভালো একটা রেস্টুরেন্টে খাওয়া-দাওয়া হলো। সন্ধ্যা হয়ে যাওয়ায় সুহাস এলো মা-বোনকে নিতে। সুহাসের ভাবভঙ্গি খুব একটা সহজ মনে হলো না। যেন ঋজুর পরিবারের সঙ্গে মা-বোনের এই সখ্য তার কিছুটা অপছন্দ হলো।

বাড়ি ফেরার পথে আইরিন মেয়েকে বেশ ভালোমতো বোঝালেন, সে যেন স্কুল ছুটির পর এ পথে মাঝে মাঝে রেবেকা খানমের সঙ্গে দেখা করে যায়। সুজানা এর অর্থ না বোঝার মতো বোকা নয়। বরং মা যে তার পছন্দকে গুরুত্ব দিচ্ছেন তা ভেবেই সে খুশিতে আটখানা। বুঝল সুহাসও। বিরক্তি নিয়ে বলল, “এত কৌশল খাটিয়ে লাভ নেই, মা। ঋজুকে আমি চিনি। তোমার এ কৌশল কাজে দেবে না।”

“কেন? ঋজুর কি কোনো পছন্দ আছে?”

“থাকতেও পারে। এই যুগে তো আর এসব অসম্ভব নয়।”

আইরিন আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, “ভাবির কাছ থেকে জেনেছি আমি। ঋজুকে বিয়ে দেওয়ার জন্য ভাবছেন। ছেলের নিজের পছন্দ নেই। মায়ের পছন্দসই মেয়েকেই বিয়ে করবে।”

আইরিন তখনই মনে মনে ঠিক করে ফেললেন রেবেকা খানমকে দাওয়াত করে খাওয়াবেন। মেয়েটাকেও এবার টুকটাক রান্না শেখাতে হবে।
______________

প্রিয়র চাকরিটা হয়ে গেছে। নতুন চাকরির খবরটা সে শুরুতেই দিলো চাচাকে। বাহারুল সাহেব রাতে খাওয়ার পর দাঁত খোঁচাতে খোঁচাতে বললেন, “এতদূর কষ্ট করে পড়লি, একটা সরকারি চাকরির চেষ্টা কর৷ এখন আজেবাজে চাকরিতে ঢুকে যদি পড়ালেখা না হয় তাহলে তো এত বছরের পরিশ্রম বৃথা। টিউশনি করতি ওইটাই তো ভালো ছিল।”

প্রিয় তার টিউশনি চলে যাওয়ার সংবাদ ইচ্ছে করেই জানায়নি। এখন জানাল, “আমার টিউশনিটা চলে গেছে। তাই তো চাকরি খুঁজছিলাম। পরে ঋজু ভাইয়ের অফিসে হয়ে গেল। খুবই ভালো চাকরি৷ স্টুডেন্ট এমপ্লোয়িদের পড়াশোনার সুযোগ আছে।”

ঋজুর নাম শুনে আইরিন এবার কথা বললেন, “ঋজুর অফিসে তুই চাকরি পেলি কি করে? তোর যোগ্যতা কি ঋজুর সমান? সত্যি করে বল তো ঘটনা কী?”

“ঋজু ভাইয়ের সমান যোগ্যতা নেই। কিন্তু একটা অফিসে সবার তো সমান যোগ্যতার প্রয়োজন পড়ে না। একই কর্মক্ষেত্রে শ্রমিক আর অফিসার থাকে। তাদের যোগ্যতা আলাদা থাকে কিন্তু সবাই মিলেই তো কাজের অংশ। এখানেও তেমন আরকি।”

“তোকে চাকরি দিলো কে? ঋজু?”

চাচির কথার সুর প্রিয়র কেন জানি ভালো লাগল না। নারীমন সহজেই পরিস্থিতি বুঝে ফেলে। প্রিয়ও তাই একটু ঘুরিয়ে উত্তর দিলো, “এপ্লাই করে ইন্টারভিউ দিতে গিয়েছিলাম পরশুদিন। টিকে গেছি। আগামীকাল জয়েন। সকাল সকাল উঠতে হবে। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি গিয়ে।”

প্রিয় কথা কাটিয়ে চলে গেল। আইরিনের মনের সংশয় যেতে চায় না। স্বামীকে বললেন, “এই মেয়ে ওড়া শিখে গেছে, সুহাসের বাপ। এতদিন পরের ডিমে তা দিয়েছি। এখন যদি বিপথে যায় আমাদেরই বদনাম হবে। সুজানার বিয়ে দিতে পারব না। ডানা বেশি মেলার আগেই ছেটে দেওয়া উত্তম। পরের ঘরে গিয়ে যত পারে উড়ুক। এবার ব্যবস্থা নাও।”

বাহারুল সাহেব স্ত্রীর কথায় ভাবুক হয়ে পড়লেন।
____________

আজ অফিসে প্রথম দিন প্রিয়র। নতুন এক চাকরিতে ঢোকার আগে আপন মানুষদের দোয়া নিতে হয়। আপন বলতে প্রথমেই যাদের বোঝায় তেমন একজন আছেন অবশ্য। কিন্তু তার সঙ্গে প্রিয়র যোগাযোগ প্রায় শূন্য। মানুষটা মাঝে মাঝে ফোন দেয়, খরচা পাঠাতে চায়। কি তীব্র আত্মসম্মানে প্রিয় প্রতিবারই তা নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে দেয়। খরচা না দিয়ে একটু আশ্রয় কি দিতে পারত না! সবার সুখে থাকার অধিকার ছিল, প্রিয়র কি ছিল না?

চোখ মুছে পুরাতন আলমারিটা খুলল সে। টাকা না নিলেও প্রতি ঈদে মা প্রিয়র জন্য পোশাক পাঠায়। প্রিয় খুব একটা পরে না। সুজানা চাইলেও শাড়ি ব্যতীত অন্য পোশাক নিতে পারে না। কারণ প্রিয়র শরীরের মাপ ওর ছিপছিপে গড়নে হয় না। সুজানা মাঝে মাঝেই আফসোস করে এই নিয়ে। কেন যে চাচি রেডিমেড জামা কিনে পাঠায়! আনস্টিচ পাঠালে সুজানা নিজের মাপে বানিয়ে নিতো।

অফিস করার জন্য ফর্মাল পোশাকের অভাববোধ করায় আজ মায়ের দেওয়া গত ঈদের একটা জামা বের করল প্রিয়। হালকা লেবু রঙের সুতি সালোয়ার কামিজ, লম্বা চুলে একটা বিনুনি, মুখে ফেইস পাউডার, চোখে টানা কাজল। এই তার পরিপাট্য রূপ। নিজের সৌন্দর্য সে ঘটা করে দেখে না এমন নয়। প্রায়ই সময় কেটে যায় নিজেকে দেখতে দেখতেই। কিন্তু স্থুলতার ভাজে সৌন্দর্য ম্লান হয়ে যায়। এমন তো নয় প্রিয়র কোনো খুঁত আছে, সে কোনোকিছুতে অকেজো! আর পাঁচটা মেয়ে যা পারে সেও তা পারে। তবে কেন পাত্তা পায় না? হাহ! সৌন্দর্যের মাপকাঠি কারা তৈরি করল? তাদেরকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে কেন মোটা, কালো, বেটে কিংবা রোগাদের তাচ্ছিল্যের ভাগে ফেলল।

প্রিয় চাচা-চাচির কাছে দোয়া নিয়ে বের হলো। সুহাসের বাইক আছে। প্রথমদিন বিধায় সুহাস আগ্রহ করে প্রিয়কে পৌঁছে দিতে এলো। অফিসের সামনে পৌঁছাতেই সুহাসের বাইকের সামনে আচমকা একটা মেয়ে এসে পড়ল। হুট করে ব্রেক করায় প্রিয় ও সুহাসও বেকায়দায় পড়তে পড়তে সামলে নিল। সুহাস রাগত সুরে বলল, “ম’রার কি আর কোনো উপায় নেই ম্যাডাম? সকাল সকাল আমার বাইকটাই পেয়েছিলেন সুই’সা’ইড করতে?”

মেয়েটা পিচঢালা পথে পড়ে গেছে। প্রিয় গিয়ে তাকে ধরল। জিজ্ঞেস করল, “কোথাও লেগেছে আপনার?”

মেয়েটা প্রিয়র কথার জবাব না দিয়ে ফোঁস করে উঠে সুহাসের দিকে তাকাল। বলল, “আপনি খু’ন করতে আর কাউকে পান নাই সকাল সকাল? আমারেই চাক্কার তলে পিষতে মন চাইছিল?”

সুহাসও তেড়ে এলো, “এই মহিলা, সবাই সাক্ষী আপনি আমার বাইকের সামনে এসেছেন। আবার আমার সঙ্গে ফাপড় নিচ্ছেন?”

মেয়েটা দ্বিগুণ তেজে সুহাসের মুখোমুখি হয়ে বলল, “কে মহিলা? কাকে মহিলা বলছেন? মহিলা তো আপনার মা।”

সুহাস ব্যাঙ্গের হাসি হেসে বলল, “তাহলে আপনি পুরুষ? সরি! পোশাক দেখে মহিলা ভেবে ফেলেছিলাম।”

মেয়েটা অক্ষম রাগে মেঝেতে পা ঠুকে বলল, “এক্সকিউজ মি? আমি একটা বাচ্চা মেয়ে। বয়স মাত্র কুড়ি। কল মি মেয়ে। নট মহিলা। একে তো মা’র্ডা’র করতে আসছেন আবার জেন্ডার নিয়া অপবাদ দেন! নেহাৎ অফিসের সময় হইয়া গেছে। নাহলে এক্ষুনি থানায় যাইতাম।”

প্রিয় দুজনের যুক্তিহীন ঝগড়া বাড়তে দিলো না। সুহাসকে টেনে সরিয়ে মেয়েটিকে বলল, “আমরা ভীষণ দুঃখিত আপু। ঘটনাটা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে ঘটে গেছে। এতে আমাদের কারোই দোষ নেই।”

মেয়েটা যেমন চট করে রেগেছিল তেমনই চট করে ঠান্ডা হয়ে গিয়ে বলল, “তুমি খুব সুইট।আমি বুঝতে পেরেছি। তোমার সাথের লোকটা বোঝেনি। ওকে বোঝাও প্লিজ!”

“বুঝিয়ে দেব।”

এরপর মেয়েটা হাইহিলে গটগটিয়ে অফিসের ভেতর ঢুকে গেল। সুহাস রেগে বলল, “তুই দুঃখিত বললি কেন? দোষ তো ওই মহিলার।”

প্রিয় হেসে ফেলল, “তো সারাদিন ঝগড়া করতে দাঁড়িয়ে? এটা কি শোভনীয় হলো? মাঝে মাঝে সম্মানের কথা ভেবেও তর্ক ছাড়তে হয়। অফিসে লেট হচ্ছে রওনা হও।”

সুহাস চলে যাওয়ার আগে শুভেচ্ছা জানিয়ে গেল।

নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষদের মাঝে ভীষণ অস্বস্তি ও উৎকণ্ঠা নিয়ে পা পড়ল প্রিয়র। শুরুতেই বসের কাছ থেকে একটা অভ্যর্থনা ও উৎসাহমূলক বিবৃত শুনল সে। সেখানে ওই মেয়েটিকেও দেখতে পেল। মেয়েটা নিজেই এসে বলল, “আরে তুমি এখানে নতুন?”

“জি আপু।”

“আমিও নতুন। গত মাসে জয়েন করেছি। আমার নাম চারু। তোমার নাম?”

“প্রিয়তি।”

“কোনো প্রয়োজন হলে বোলো। আমি তোমার পাশের ডেস্কে আছি।”

“ধন্যবাদ আপু।”

চারু নামের লম্বা শ্যামলা বর্ণের মেয়েটি চলে যাচ্ছিল। ফিরে তাকিয়ে বলল, “তোমার সাথের লোকটা কে ছিল?”

“ভাইয়া।”

“তোমার ভাইটা কুচুটে। কিন্তু তুমি ভালো। আই লাইক ইউ। আসি।”

চারু চলে গেল। তার পায়ের হাই হিল বার দুয়েক বেঁকেও গেল। প্রিয় তা খেয়াল করে বুঝল কেন সুহাসের বাইকের সামনে পড়ে গেছিল। মনে মনে হাসল সে।

চলবে…