কোন প্রিয় নামে ডাকি পর্ব-০৯

0
2

#কোন_প্রিয়_নামে_ডাকি [৯]
প্রভা আফরিন

প্রিয় বর্তমানে রয়েছে ঋজুর কেবিনে। তাকে ডাকা হয়েছে ত্রিশ মিনিট হলো। এই ত্রিশ মিনিট ঋজু একটানা তাকে কাজের ব্রিফ দিয়েছে। কথা থামতেই প্রিয় বলে উঠল, “আপনাকে স্বল্পভাষী ভাবতাম, স্যার। আপনি তো দারুণ টকেটিভ।”

ঋজু হেসে হাতঘড়িটা ঢিলে করতে করতে বলল, “কাজের প্রয়োজনে সবই হতে হয়। আপনাকেও হতে হবে, মিস প্রিয়তি।”

প্রিয় আশ্চর্যের সঙ্গে হেসে বলল, “আপনি আমার নামটা সুন্দরভাবে উচ্চারণ করলেন, স্যার!”

“কর্মক্ষেত্র বলে কথা।”

“তা অবশ্যই।”

প্রিয় বিজ্ঞের মতো মাথা দুলিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিল। ঋজু টেবিলের এককোণে রাখা হলুদ জারবেরা ফুল দেখিয়ে বলল, “আপনার ড্রেসের সঙ্গে এই ফুলের রঙটা মিলে গিয়েছে, খেয়াল করেছেন?”

প্রিয় তাকাল ফুলগুলোর দিকে। বলল, “করেছি।”

ঋজু ল্যাপটপে চোখ রেখে বলল, “বোধহয় ওরা আপনার কাছেই যেতে চাইছে। নিয়ে নিতে পারেন।”

প্রিয় সরু চোখে চেয়ে বলল, “ফুলের রং ড্রেসের সঙ্গে মিলতেই পারে। তাই বলে আপনার ফুল আমি কেন নেব, স্যার?”

ঋজু চোখ রাখল প্রিয়র চোখে। চেয়ারে একটু হেলে বসে বলল, “কারণ পুরুষের চেয়ে নারীদের হাতেই ফুল বেশি মানায়, মিস প্রিয়তি। তাছাড়া ফুলেরা ফুলের জগতেই সুন্দর।”

প্রিয় চেয়ার ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে অকপটে বলল, “আপনি কি আমায় ফুল দিতে চাইছেন, স্যার?”

“ফুলগুলো একটা বাচ্চা মেয়ে বিক্রি করছিল। মেয়েটার মায়ের ওষুধ দরকার বলে খুব সাধল। তাই কিনে নিয়ে এলাম। কিন্তু এখন এর সঠিক অবস্থান খুঁজে পাচ্ছি না বলে আপনাকে সাধা।”

প্রিয় মুচকি হেসে বলল, “ফুল যাকে-তাকে দিতে নেই। সঠিক অবস্থান খুঁজে পেলে সেখানেই পৌঁছে দেবেন। আমি আসি।”

কেবিন থেকে বেরিয়ে প্রিয় দেখল লাঞ্চ টাইম হয়ে গেছে। পকেটের খুচরো কিছু টাকা সম্বল করে অফিস বের হলো সে। দেখল টংয়ের দোকানের বেঞ্চিতে পা তুলে বসে চায়ে বনরুটি ডুবিয়ে খাচ্ছে চারু। প্রিয়কে দেখে হাত নাড়ল দামাল মেয়েটি। প্রিয় মুচকি হেসে এগিয়ে গেল। চারু গম্ভীর গলায় বলল, “এখানে বসো আপু।”

প্রিয় পাশে বসতেই চারু আবার বলল, “তুমি যে বয়সে আমার চেয়ে বড় সেটা আগে বলোনি তো। সকালে আমায় আপু ডেকেছিলে বলে ভেবেছি জুনিয়র হবে। খাটোখুটো দেখে তো বয়স বুঝতে পারিনি। ম্যানেজার সাহেব ভুলটা ধরিয়ে দিলেন।”

প্রিয় হেসে উঠল, “অচেনা কাউকে আপু বলে ডাকাটাই ঠিক মনে হয়েছিল। তাছাড়া তুমি যে লম্বা! উচ্চতার বিচারে তো বড়ই হলে।”

“লম্বা, রোগা, কালো বলে লোকে শাকচুন্নীও ডাকে, হা হা! তুমি যে আপু ডেকে সম্মান দিয়েছো তাতে এই বান্দা চির কৃতজ্ঞ। যাইহোক এখন আমায় নাম ধরে ডেকো।”

“আচ্ছা ডাকব।”

“বলোতো কী ডাকবে?”

“চারু।”

চারু গৌরবের সঙ্গে বলল, “আই লাভ মাই নেম। আমার মা বই পড়তে খুব ভালোবাসত। চারু নামটা তারই রাখা। বলত এই নামে একটা সাহিত্যিক ব্যাপার আছে।”

“ভালোবাসত! তোমার মা কি নেই?”

চারু হাসি ধরে রেখেই জবাব দিলো, “জীবজগতে নেই। মনোজগতে বহাল তবিয়তে আছে।”

প্রিয় এই ছোট্ট কথাটার দ্বারা চারুর প্রতি আরো বেশি মুগ্ধ হলো। মায়ের প্রসঙ্গ উঠলে বেদনায় ছেয়ে যায় ওর মন। অন্যদিকে মাতৃহীনা চারু মায়ের বাস্তবিক শূন্যতাকে কি দারুণভাবে মানিয়ে নিয়ে হাসিমুখে আছে! এখানেই শ্যামলা বর্ণের মেয়েটিকে প্রিয়র কাছে বিশেষ মনে হলো।

প্রিয় নিজের জন্য চা ও বনরুটিই নিল। চারু বলল, “তুমি কি আমার দেখাদেখি নিলে? চাইলে রেস্টুরেন্টে গিয়ে খেতে পারো।”

“না। এটা আমার প্রিয় খাবার। বাড়ির বাইরে থাকলে চা, রুটি, কেক, কলা এসব দিয়েই নাশতা করি।”

চারু মুখ কুচকে বলল, “এসব আমার মোটেও প্রিয় নয়।”

“তাহলে খাচ্ছো কেন?”

“টাকার মায়ায় খেতে হয় গো। কিন্তু আমার যখন অনেক টাকা হবে তখন আর এসব খাব না। বড় বড় রেস্টুরেন্টে গিয়ে সব ভালো ভালো খাবারগুলো অর্ডার করে খাব। বিল কত এলো সে নিয়ে চিন্তাও করব না।”

“কিন্তু যখন সত্যিই হাতভরে টাকা আসবে তখন দামি খাবারে খরচা করতে ইচ্ছে করবে না। ভাববে বাঁচিয়ে রাখি, দরকারে কাজে আসবে।”

প্রিয়র কথায় চারু ফোঁস করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করল। বলল, “আমরা বাঙালি বোকা মেয়েরা এভাবেই তো সব সাধ আহ্লাদকে ফাঁকি দিয়ে এক জীবন পার করে দেই। এখন আর দেই না। যা ইচ্ছে হয় করে ফেলি। আমি না খেলে, না ঘুমালে, অসুস্থ হলে কারো কিছু আসবে যাবে না, ক্ষতিটা আমারই হবে। তাই কারো জন্য নিজের ক্ষতি করি না।”

চায়ের চুমুকের সঙ্গে লাঞ্চ টাইম শেষ হলে প্রিয় ও চারু আবারো কাজের জগতে ফিরে গেল।
____________

অফিসের প্রথম দিনটা ভালোমতোই উৎরে গেল প্রিয়র৷ অফিস থেকে বেরিয়ে কিছুটা সামনে এগোলেই বড় রাস্তা। সেখান থেকে বাস পাওয়া যায়। সিএনজি, রিকশাতে গেলে খরচ বেশি। তাই বাস ধরার উদ্দেশ্যেই হাঁটছিল প্রিয়। পেছনে থেকে ছুটে এসে পায়ে পা মেলালো ঋজু।

“আমার জন্য ওয়েট করলে না কেন, অপ্রিয়?”

অফিসের স্যারের পদ থেকে সদ্য ছুটি নিয়ে পুরোনো পদে আসীন হওয়া ঋজুর কণ্ঠের অসন্তোষ মনোযোগ এড়ালো না প্রিয়র। পথের দিকেই চোখ রেখে অকপটে বলল, “উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার সঙ্গে নিম্নপদস্থ কর্মচারীর সখ্য অফিস প্রাঙ্গণে বেমানান, ঋজু ভাই। ঠিক যেমন অফিসে আপনি আমায় অপ্রিয় ডাকতে অপারগ!”

“বাহ! কথা যেন পপকর্ণের মতো ফুটছে!”

“আপনি গুরু, আপনার থেকেই শেখা।”

“তাই! গুরু বলছো, গুরুদক্ষিণা দিতে পারবে তো?”

এ কথায় প্রিয় একটু বেকায়দায় পড়ল। আঁড়চোখে চেয়ে আমতাআমতা করে বলল, “কী দক্ষিণা চান?”

প্রিয়র মুখভঙ্গি দেখে হেসে ফেলল ঋজু, “সেটা নাহয় সময়মতোই বলব।”

ঋজুর হাতের হলুদ জারবেরা ফুলটা এতক্ষণে দৃষ্টিগোচর হলো প্রিয়র। ঋজু সেটাকে আলগোছে প্রিয়র বিনুনির গোছায় গুজে দিয়ে বলল, “মনে হলো ফুলটির জন্য এরচেয়ে সঠিক অবস্থান আর পাওয়া যাবে না।”

প্রিয়র চলার গতি থেমে গেছে আচমকা। বিকেলের কমলাটে রং চুয়ে পড়েছে যেন ওর তুলতুলে উজ্জ্বল গালের ওপর। প্রিয় চোখ তুলে চাইল না। কিছু বললও না।

ঋজু ফুল গোজা শেষে স্মিত সুরে স্বগোতক্তি করল, “অফিসের প্রথম দিনের শুভেচ্ছা জানাতে ফুল দিলাম৷ তুমি আবার অন্যকিছু ভাবোনি তো?”

প্রিয়র মনে হচ্ছে সে নিঃস্ব অবস্থায় পথ চলতে চলতে হঠাৎ করে অমূল্য কিছু কুড়িয়ে পেয়েছে যেন। নতুবা এভাবে চোখে জল আসবে কেন! জল লুকাতে অন্যদিকে ফিরে বলল, “অন্যকিছু ভাবিনি, ঋজু ভাই। আপনি নিশ্চিন্তে থাকুন।”

চলবে…