#ক্যামেলিয়া
#ফারহানা_চৌধুরী
[পর্ব ৫]
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
রহমান সাহেব বড্ড হাস্যরসিক মানুষ। ছেলে মেয়েদের সাথে বড্ড মিশতে পারেন তিনি। ছেলেমেয়েদের তার সাথে প্রচুর ভাব। মায়ের থেকে তারা বাবার সাথে আরো বেশি সহজ। সুমিতা বেগম অবশ্য খুশিই হন এই বিষয়ে। বেশিরভাগ সময় এমন হয়ে আসে, বাচ্চা তাদের বাবার সাথে একটা অদৃশ্য দূরত্ব নিয়ে চলে। যা আপনা-আপনি চলে আসে। হয়তো তারা কোনো কারণে বাবার সাথে কথা বলতে, মিশতে ভয় পায়; কিংবা সংকোচ বোধ করে। যার ফলে সম্পর্কে এই একটা বিশাল অদৃশ্য, অদুর কমের দূরত্ব চলে আসে। তবে তাদের ক্ষেত্রে বিষয়টা উল্টো। রহমান সাহেবের আচার-আচরণে বাচ্চারা আরো বেশি মিশে যায় তাঁর সাথে৷
______
ইনায়া রহমান সাহেবের ঘরে বসে আছে। তার সরাসরি সামনের সোফায়। ইনায়ার দিকে তাকিয়ে আছেন সুমিতা বেগম। রাগে আপাতত ফুঁসছেন তিনি৷ রহমান সাহেব নির্বিকার বসে আছপরন ইনায়ার সরাসরি সামনের সোফায়। ইশমাম এক কর্ণারে দাঁড়িয়ে ঘরের। পরিস্থিতি বেশামাল। কি করবে সে বুঝছে না। ইশিতা ইনায়ার বিয়ের পরদিনই নিজের শ্বশুড়বাড়ি চলে গিয়েছে স্বামী-সন্তানের সাথে। ইনায়া নিশ্চুপ। মুখের আদল নির্লিপ্ত, নির্বিকার। সুমিতি বেগম রেগেমেগে বললেন—“এসবের জন্য ভার্সিটিতে যাও তুমি, হ্যাঁ?”
রাগে চিল্লিয়ে বললেন কথাগুলো। ইনায়া ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে তার দিকে। কিছু বলতে যাবে তার আগে রহমান সাহেব নরম গলায় বললেন—“সুমি চেঁচিও না। তুমি আমার জন্য এককাপ চা করে দাও বরং? আমি ইনায়ার সাথে কথা বলছি।”
সুমিতা বেগম অগ্নি চোখে তাকালেন। ভস্ম করে দিচ্ছেন যেন চোখ দিয়ে—“এসবের মধ্যেও তোমার চা খেতে মন চায়?”
রহমান সাহেব মিইয়ে গেলেন কিছুটা। মিনমিনে গলায় তবুও বললেন—“এক কাপ দুধ চা খেতে মন চাইছে।”
সুমিতা বেগম আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালেন না। গজগজ করতে করতে উঠে চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে। জোরে জোরে হাঁটতে গিয়ে একবার পায়ের চপ্পলও পিছলে গেল। পড়ে যেতে গিয়েও দেয়াল ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে দ্রুত পায়ে চলে গেলেন তিনি।
রহমান সাহেব স্ত্রীর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে মেয়ের দিকে তাকালেন। তার শান্ত, স্বাভাবিক চেহারা দেখে ইশমাম খানিকটা অবাকই হলো। মুখে তা স্পষ্ট ফুটে উঠছে। ইনায়া জিহ্ব দিয়ে ঠোঁট চাটে। পরপর বাবার দিকে তাকিয়েই বলল—“আব্বু? আরাফ বাজে বিহেভ করেছিলো, এজন্য এমন করেছি। নাহলে ওর সাথে কথা বলার আমার কোনো ইচ্ছে ছিলো না।”
রহমান সাহেব এবার জিজ্ঞেস করলেন—“তুমি কি এজন্য স্যরি ফিল করছো, ইনায়া?”
ইনায়া দুপাশে মাথা নাড়ালো—“মোটেও না।”
রহমান সাহেব হাসলেন এবার—“গুড!”
কিছুটা থেমে বললেন —“তবে ইনায়া, সবদিকে খেয়াল রেখে কাজ করতে হয়, না? তুমি যা করেছো, আই এপ্রিশিয়েট দ্যাট। তবে এটা ভুলো না, তোমার আশেপাশে এখন ধ্রুবও থাকে। ও যদি এসব দেখে?”
ইনায়া পিঠ পিছনে হেলিয়ে বসলো। হালকা গলায় বলল—“ধ্রুব দেখেছে।”
রহমান সাহেব চমকালেন। চোখ দুটো বড়সড় করে চাইলেন—“কিহ!”
ইনায়া মাথা দোলালো—“হুম।”
“কোনো কিছু বলেনি?”
“কি বলবে?”
“কিচ্ছু না?”
“না।”
রহমান সাহেব চিন্তিত মুখে মাথা দোলালেন। তারপর ইনায়ার দিকে তাকিয়ে বললেন—“তুমি এখন ঘরে যাও। রেস্ট নাও। মায়ের কথা ভেবো না, আমি সামলে নেবো।”
ইনায়া মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালো। উঠে দাঁড়িয়ে নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ালো। ইনায়া যেতেই ইশমাম বাবার কাছে এলো—“আব্বু? ছোট আপু খারাপ কিছু তো করেনি, ভাইয়াওএটা ইজিলিই নেবে; তুমি ভেবো না।”
“হু।”
মুখ ফুটে সম্মতি জানালেও রহমান সাহেবের অভিব্যক্তিতে একটা চিন্তার ছাপ রয়েই যায়। ইশমাম দেখেও চুপ থাকলো। ঘাঁটালো না তাকে আর।
_____
বাদল এমন একধরনের ছেলে,যাকে কোনো মেয়েই চাইবে না। কারণ সে ভিতুর ডিম। একবার তার সাথে তার এক বান্ধবী নুহা কলেজ যাচ্ছিলো। হঠাৎ নূহাকে এক লোক ইচ্ছা করে ধাক্কা দিলো। বাদল তখনো উদাসীনভাবে হাঁটছিলো। মেয়েটা রেগে-মেগে বলে উঠলো—“এই ব্যাটা,ওই লোকটা আমাকে ধাক্কা দিলো,তুই কিছু বলবিনা?”
“কি বলবো?”
“লোকটা ইচ্ছা করে আমাকে ধাক্কা দিলো।”
“লোকে ধ্বাক্কা দিয়েছে, ট্রাকে না। চুপচাপ হাঁট!”
নূহা হতাশ মুখে তাকিয়ে থাকলো বাদলের দিকে। ইচ্ছে করছিলো মাথায় তুলে আছাড় মারতে। তবে বোধহয় একটু শান্তি পেত সে।
বাদলের অবশ্য এসব বলার কারণও আছে। প্রথমত, সে ঝামেলা এড়িয়ে চলে। দ্বিতীয়ত, সে মারামারি পারে না যে লোকটার সাথে লাগতে যাবে। দেখা যাবে লোকটার হাতের দাবাং মার্কা দুটো চড় খেয়ে সে নিজেই বেহুঁশ হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। এমনিই সে শান্তিপ্রিয় মানুষ। মারামারি থেকে দশ হাত দূরে থাকে। কোনো রাস্তায় কোনো ঝামেলা বেঁধেছে দেখলে, সে সেই রাস্তা পায়েও মাড়ায় না। সেখানে যেঁচে পড়ে কোন সাধে লাগতে যাবে লোকটার সাথে?
নূহা তার যুক্তি শুনে রেগে-মেগে চলে যায়। এই ছেলের সাথে আর একদিনও মিশবে না সে। তার হয়ে দুটো কথা বলতে পারে না, সে আবার কেমন বন্ধু?
_____
ধ্রুব ঘরে বসে কিছু কাজ করছিলো। সে একবার সামনে বিছাবায় রাখা ল্যাপটপের কিবোর্ড চাপছিলো, তো পাশে রাখা খাতায় কিছু ঠুকে নিচ্ছিলো। তখন ঘরের দরজায় কেউ উঁকি দিলো। মিষ্টি গলায় আধো আধো গলায় ডাকলো—“মামা?”
ধ্রুব মুখ তুলে চাইলো। দরজার ফাঁকে দাঁড়িয়ে থাকা ছোট খাটো বাচ্চা শরীরটা দেখে হাসলো। হাত বাড়িয়ে ভেতরে ডাকতেই, তিতির রীতিমতো ছুটে ভেতরে এলো। এসেই একপ্রকার তার কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লো। ধ্রুব হেসে ফেলে। পরপর দরজা খুলে তারিন ঢুকলো। তিতিরকে দেখে কিছুটা ধমকে বললো—“এখানে কি করছো তুমি? খেতে আসতে বললাম না?”
তিতির শুকনো মুখে ধ্রুবর দিকে তাকায়। ধ্রুব তারিনকে থামিয়ে বলল—“আপু? এমন করো কেন? থামো তো।”
“বেশি বকবক কোরো না। কয়টা বাজে চোখে দেখেছো? বড়ো আম্মু ডাকছে খেতে। নিচে আয়।”
ধ্রুব তাকালো দেয়াল ঘড়ির দিকে। প্রায় এগারোটার কাছাকাছি বাজছে। কাজ এখনো বেশ বাকি আছে। আপাতত ঠিক করলো খেয়েদেয়ে বাকি কাজ শেষ করবে। তিতিরকে তারিনের কোলে দিয়ে বলল—“তুমি যাও আমি আসছি।”
তারিন তিতিরকে নিয়ে নিচে গেলো। ধ্রুব সেদিকে তাকিয়ে বিছানার পাশে থাকা স্টাডি টেবিলের দিকে তাকালো। ফোনটা সেখানে রাখা। ধ্রুব হাত বাড়িয়ে ফোনটা নিলো। চেক করে হতাশ হলো। ইনায়া একটা কালও করেনি। অবশ্য করবেও যে না, তা তার জানা। তবুও একটা আশা রাখে, আর প্রতিবার সেই আশা ভাঙে। ধ্রুব তপ্ত শ্বাস ফেলে ফোন পকেটে পুরে উঠে দাঁড়ালো। পায়ে চপ্পল গলিয়ে ধীর পদে হেঁটে গেলো দরজার কাছে।
#চলবে…