ক্যামেলিয়া পর্ব-০৮

0
266

#ক্যামেলিয়া
#ফারহানা_চৌধুরী
[পর্ব ৮]

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

“আর কখনো পরবে না। তুমি সাজবেও আমার জন্য, শাড়িও পরবে আমার জন্য। অন্যকারো জন্য এসব কখনো করবে না। বুঝেছো?”

ইনায়া ততক্ষণাৎ ভ্রু গুটিয়ে ফেললো—“আপনার কথা মতো?”
“হ্যাঁ।”

ইনায়া রেগে বলল—“আমি কেন মানবো আপনার কথা? কে আপনি?”

ধ্রুব হাসলো। হেসে হেসেই জবাব দিলে—“গুড কোয়শ্চন! এন্ড দ্যা অ্যান্সার উড বি, ‘আ’ম ইউর বিলাভড্ হাজবেন্ড!”

ইনায়া হালকা ধাক্কায় ধ্রুবকে দূরে সরালো। ধ্রুব দূরে সরেও প্রতিক্রিয়া দেখালো না তেমন। হাসলো শুধু। ইনায়া বলল—“আমি আপনার কথা শুনতে বাধ্য নই। আপনি আমার হাজবেন্ড হোন, বা যা-ই হোন।”

বলে কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ধ্রুবর মুখোমুখি দাঁড়ালো। চোখে চোখ রেখে তর্জনি তাক করে রীতিমতো ধ্রুবকে শাসিয়ে বলল—“আমাকে ডমিনেট করার সাহসও দেখাতে আসবেন। আমি যা করতে পারি সেটা আপনি দেখলে আফসোসে বাঁচবেন না। এরচেয়ে ভদ্র বাচ্চার মতোন নিজের ভালোটা বুঝুন।”

বলে ভেতরে চলে গেলো ইনায়া। ধ্রুব সেদিকে তাকালো একপলক। পরপর কপালে বাম হাতের তর্জনী ঘষে একপেশে হাসলো। ধীর কন্ঠে সেভাবেই বলল—“ ইন্টারেস্টিং!”

______
রহমান সাহেব আর সুমিতা বেগম কেক কাটতেই করতালিতে মুখরিত হলো পরিবেশ। সকলকে টুকরো টুকরো কেক খাওয়িয়ে ইনায়া আর ধ্রুবকে কাছে ডাকলেন তারা। ওরা পাশে আসতেই রহমান সাহেব হেসে মেয়ের মুখে কেক পুরে দিলেন। ধ্রুবকেও খাওয়ালেন।

ইশিতা আর ইশমাম মিলে ফটোগ্রাফার আনিয়েছিলো ছবি তুলবে বলে। ইনায়ার যদিও এসবে কোনো কালেই আগ্রহ ছিলো না। ছবি তোলার প্রতি তীব্র অনীহা এই মেয়ের। ফোনের গ্যালারি ঘাটলেও একটাও তার নিজের ছবি পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ! তবুও আজকে মা আর বোন কোনোমতে ধমকে-টমকে রাজি করিয়েছে তাকে ছবি তোলাতে। যার ফলসরূপ এখন ধ্রুবর পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। ধ্রুব মারাত্মক খুশি হয়েছে এতে। সে পারে না কৃতজ্ঞতা সরূপ ইশিতা আর সুমিতার পায়ে লুটিয়ে পড়ে থাকে।

যেহেতু ছাঁদে অ্যারেঞ্জ করা হয়েছে সব, তাই বড় জায়গায় ছবি তোলার জন্য ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে তেমন সমস্যা হবে না। ফ্যামিলি ফটোশুট হওয়ার পর ইশিতার সাথে তার স্বামী আহনাফের ফটোসেশান চলছে। ইনায়া এক পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। একটা কল পেয়েই এখানে আসা রিসিভ করতে। হুট করে পাশে কারো উপস্থিতি পেলো। সে পিছনে তাকালো। ধ্রুবকে দেখে চোখ খিঁচে নিলো। বলল—“কিছু বলবেন?”

ধ্রুব মাথা দোলালো—“হু।”
“বলেন।”
“ছবি তুলবো।”

ইনায়া দায়সারাভাবে জবাব দিলো—“তো তুলুন।”
“তোমার সাথে তুলবো।”

ইনায়া ভ্রু গুটিয়ে তাকালো তার দিকে। চোখে-মুখে অসন্তুষ্টির ছাপ স্পষ্ট। সাথে বিরক্তিরও। ধ্রুবর অবশ্য কিছুই এলো-গেলো না এতে। সে ইনায়ার হাত ধরলো। নিয়ে যেতে লাগলো ওদিকে।

ইনায়া চমকে নিজের হাতের দিকে তাকালো। তারপর ধ্রুবর দিকে। ভাবখানা তার এমন যেন, এখন তার মনে ইন্ডিয়ার বাংলা সিরিয়ালের সেই বিখ্যাত ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক বাজছে—“ধুম তা না না! ধুম তা না না!”

সে হাত ছাড়াতে গিয়েও ছাড়ালো না। সবার মাঝে সিনক্রিয়েট করাটা খারাপ দেখায় বলে চুপ থাকলো। ফটোগ্রাফারকে বললে সে তাদের ছবি তুলতে থাকে। কখনো বলে এভাবে দাঁড়ান, কখনো সেভাবে দাঁড়ান। বেচারি ইনায়া মাত্রাতিরিক্ত বিরক্ত হয়ে রেগেমেগে লোকটাকে ধমক দিয়েছিলো একবার। পরে ইশিতার চোখ রাঙানো খেয়ে চুপ হয়ে গেছে।

প্রায় বেশ ক’টা ছবি তোলার পর সে ছাড়া পেয়েছে। ধ্রুবর দিকে কটমট করে তাকালে ছেলেটা হাসে। খুব মিষ্টি হাসি। তবে সেই মিষ্টি হাসিতেও যেন ওর গা জ্বলে ওঠে। মুখ ঝামটে সেখান থেকে দূরে একটা চেয়ারে গিয়ে বসে থাকে। এর সামনেও যাবে না আর ও। অসহ্য, বিরক্তিকর লোক একটা!

______
যাওয়ার সময় রহমান সাহেব আর সুমি তার জোড়াজুড়িতে ধ্রুবর এখানে থাকতে হয়েছে আজকে রাত। ইনায়ার কথাটা শোনার পর যেন রাগে-দুঃখে কান্না পাচ্ছে। এই লোককে বিন্দুমাত্রও তার সহ্য হচ্ছে না। এতক্ষণ অপেক্ষা করেছে কখন যাবে, আর এখন শুনছে তার সাথে থাকবে! ইনায়ার মনে খুব করে একটা শখ জাগলো। ইচ্ছে করলো বিছানায় পানি ঢেলে দিতে, যেন ঘুমাতে না পারে। তবে ধ্রুব যা ত্যাদর টাইপ ছেলে, দেখা যাবে নিজে তো ঘুমাবেন না; তাকেও জ্বালিয়ে মারবে। এই ভেবেচিন্তে সে আর এই কাজ করলো না। নিজেরই যেখানে লস, সেই কাজ করবে কেন?

ইনায়া যখন নিজের চিন্তা ভাবনায় মশগুল, তখন দরজা ঠেলে ঢুকলো ধ্রুব। এসে ধপ করে মেয়েটার পাশের সোফায় বসে পড়লো। বসার দরুণ নরম গদি ডেবে গেলো নিচে। ইনায়া হুট করে এমন হওয়ায় রেগে গেলো। কটমট করে তাকালো ধ্রুবর দিকে। চেঁতে গিয়ে বলল—“আপনার সমস্যা কি ভাই?”

ধ্রুব মুখে হাত চেপে দুদিকে মাথা নাড়িয়ে বড়ো নাটক করে বলল—“আগতাগফিরুল্লাহ! তওবা!”

ইনায়া থতমত খেলো—“কি হয়েছে?”
“তুমি না! জামাইকে ভাই কে ডাকে?”

ইনায়া বলল—“আমি ডাকি। আর আপনার সমস্যা কি? আমার পিছে পড়ে থাকেন কেন অলওয়েজ?”
“পিছে কই? আমি তোমার পাশে।”

বলে হাসলো ধ্রুব। ইনায়া রেগে তর্জনী তুলে তাক করলো তার দিকে—“আপনি—!”
“হু, আমি?”
“আপনি—”
“ ‘আপনি’, ‘আপনি’ না করে আসল কথা বলো।”
“আপনি… আপনি একটা নির্লজ্জ, অসভ্য লোক! প্রচুর বাজে।”
“জানি।”

ধ্রুবর নির্লিপ্ত বাচনে মেয়েটা আরো রেগে গেলো। উঠে চলে যেতে চাইলে ধ্রুব হাত টেনে ধরে আটকালো। হ্যাঁচকা টানে তাকে নিজের পাশে বসালো। ইনায়া হকচকিয়ে গেলো তার হঠাৎ কাজে। ধ্রুব বলল—“আচ্ছা, বাদ দাও। এতো রাগ কেন করো তুমি, সেটা বলো। উঠতে-বসতে, খেতে-শুতে সবেতে ক্ষেপে থাকো। কেন?”
“আমি এমনিই। বদলাতে পারবো না।”
“বদলাতে হবেও না। এমনি থাকো।”

ইনায়া তাকালো ধ্রুবর দিকে। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল—“তাহলে এতো অভিযোগ জারি করার কারণ।”
“এমনি।”

বলে খানিকটা কাছে এসে বসলো সে ইনায়ার। একহাতে কোমড় জড়িয়ে তার কাঁধে মাথা রেখে বলল—“তুমি যেমন আছো, পার্ফেক্ট আছো। যা বলেছি ওসব এমনিতেই বলেছি৷ নিজেকে বদলাতে যেয়ো না। আমার কাছে এমন তুমিটাই বেশ ভালো।”

ইনায়া কাঠ হয়ে বসে রইলো। এসব তার কাছে নতুন। সম্পূর্ণ নতুন! আরাফ তাকে কখনো এমন করে কিছু বলেনি৷ কখনো বলেনি, ‘সে যেমন আছে, পার্ফেক্ট আছে।’ ইনায়ার অদ্ভুত লাগলো। সে ধীরে ধীরে ধ্রুবর কাঁধে রাখা মাথাটা সরিয়ে দিলো। বলল—“প্লিজ, এভাবে থাকবেন না। আমাকে ভালো লাগছে না।”

ধ্রুব কিছু বললো না, চুপচাপ সরে এলো। ইনায়া উঠে চলে গেলো ওয়াশরুমে। ধ্রুব তা দেখে তপ্ত শ্বাস ফেললো। এভাবে এসব কতদিন চলবে সে জানে না। আদৌ এই সম্পর্কের ভবিষ্যৎ কি হবে সে তা-ও জানে না।

_____
ইনায়া ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখলো ধ্রুব বিছানায় বসা। তার হাতে ইনায়ারই বুক শেল্ফ থেকে নেওয়া একটা বই। ইনায়া ভ্রু কুঁচকে সেদিকে এগিয়ে এলো। বইয়ের নাম দেখতে তাকালে চমকে উঠলো। এইচ.ডি. কার্লটনের লেখা বিখ্যাত একটি বই ‘Haunting Adline’। ইনায়া বইটা দেখেই দ্রুত হাতে তা ধ্রুবর হাত থেকে কেড়ে নিলো। ধ্রুব সেভাবেই বিছানার হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসে বুকে আড়াআড়ি হাত গুঁজলো। তাকালো ইনায়ার দিকে। তার তাকানো দেখে ইনায়া বলল—“আপনি, এটা কেন পড়ছেন? আরো বই ছিলো তো, সেগুলো পড়তেন।”
“কেন, এতে কি হয়েছে?”

ইনায়া তোতলালো কিছুটা—“কি..কিছু না। তেমন একটা ভালো না বইটা, তাই।”

ধ্রুব হাসলো। বলল—“কবে কিনেছো এটা?”

ইনায়া বইটা কিনেছে বেশ কয়েকদিন হয়েছে। পড়েছেও সম্পূর্ণ। এজন্যই বারণ করেছে ধ্রুবকে পড়তে। কে জানে, এতক্ষণে কি না কি পড়েও বসে আছে! সে বইটা সেল্ফে রাখতে রাখতে বললো—“কিছুদিন হয়েছে।”
“তোমাকে আমি বারণ করেছিলাম এসব বই পড়তে। তারপরেও পড়ছো!”

ইনায়া কিছু বললো না। চুপ থাকলো। মাত্রাতিরিক্ত অস্বস্তি হচ্ছে তার এখন! ধ্রুব আচানক বলল—“তুমি কথার অবাধ্য হয়েছো। তো বলো, এর শাস্তিস্বরূপ তোমায় কি পানিশমেন্ট দেওয়া যায়?”

ইনায়া চমকে তাকালো—“পা..পানিশমেন্ট?”
“হু, পানিশমেন্ট! এক কাজ করো। এই বইটা এখন তুমি আমাকে পড়ে শোনাবে।”

ইনায়া চমকের উপর চমকালো যেন। এই বই সে ধ্রুবকে পড়ে শোনাবে? সে লজ্জায় মরে যাবে। কখনো পারবে না সে! এতশত ভাবনার মাঝে ধ্রুব আবার ডাকলো—“কি হলো? এসো এখানে, ফাস্ট!”

ইনায়া কাচুমাচু মুখ করে তাকালো তার দিকে। ধ্রুবর মায়া হলো না। বরং সে হাসলো। ইনায়া পারছে না মাটি ফাঁক করে ঢুকে পড়তে। কে জানে, কপালে কি আছে! এতসব ভাবতে ভাবতেই বইটা নিয়ে বিছানার কাছে গেলো ও।

#চলবে….