#ক্যামেলিয়া
#ফারহানা_চৌধুরী
[পর্ব ১০]
❌কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ❌
বিস্তৃত খোলা আকাশের নিচে বাঁধাহীন গতিতে ছুটছে ছাঁদ খোলা কালো মার্সিডিজটি। তার পাশে একটা চেরি রঙের টয়োটা গাড়ি সমানে তাকে টক্কর দিয়ে তার আগে পিছে ছুটছে। ধ্রুব হাসলো। অ্যাক্সেলেটর প্যাডেল পায়ে চেপে গাড়ি সামনে ছুটালো। কিছুটা সামনে এগিয়ে পাশ ফিরে একবার তাকালো টয়োটা গাড়ির চালকের দিকে। মেয়েটা যথেষ্ট খোশমেজাজে গাড়ি চালাচ্ছে। তবুও চোখে মুখে কোথাও একটা শক্তভাব। ধ্রুব তার দিকে তাকাতেই মেয়েটাও তার দিকে একপলক তাকালো। পরপর স্পিড বাড়িয়ে তাকে ছাড়িয়ে সামনে চলে গেলো। তারপর পিছু ফিরেই তার দিকে তাকিয়ে ত্রুুর হাসলো। ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে দেখলো তা।
ইনায়া স্টিয়ারিং হুইল ধরে খুব জোরে গাড়ি ঘোরালো। গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে তার হাত নিখুঁত স্থিরতায় ধরে আছে। প্রতিটা বাঁক সে নিচ্ছে এমন দক্ষতায়, যেন এই রাস্তাগুলো তার হাতের রেখার মতো চেনা।
ধ্রুব একাধিকবার তাকে ওভারটেক করার চেষ্টা করলো, কিন্তু ইনায়া প্রতিবারই তাকে পেছনে ফেলে দিলো। কখনো স্লিপস্ট্রিম ব্যবহার করে, কখনো হ্যান্ডব্রেক টার্নে আগেভাগে ঢুকে। আশপাশে আরও গাড়ি ছুটছে, হেডলাইটের আলো কাঁপিয়ে তুলছে অন্ধকার। কে কার প্রতিপক্ষ, কেউ জানে না। কিন্তু একটাই টার্গেট—শেষ লাইনের রঙিন পতাকা। পেছনের গাড়িগুলো একে একে আরো পিছিয়ে পড়ছে। রেস এখন কেবল দুইজনের, ধ্রুব আর ইনায়া।
শেষ বাঁকটা এলো তখন। সোজা ফিনিশ লাইনের দিকে ছুটছে সবাই। শেষ দশ সেকেন্ডে ইনায়া গতি বাড়িয়ে ফেললো। হাওয়া ফুঁড়ে তার টয়োটাটা প্রথম পার করলো শেষ দাগ। ধুলোর ঝাপটায় থেমে দাঁড়ালো গাড়িগুলো।
ধ্রুব তার গাড়ি থেকে থেকে নামলো, তাকালো সামনে। ইনায়া সবে গাড়ি থেকে নেমেছে। তার কিছু বন্ধুরা এসে তাকে ঘিরে দাঁড়ালো। ধ্রুব তাকিয়ে দেখলো ইনায়াকে। ক্লাব থেকে অনুষ্ঠিত এইরকম কার রেসে প্রথম কোনো মেয়েকে জিততে দেখে ধ্রুব অবাক হলো। সময় নিয়ে গভীর চোখে পর্যবেক্ষণ করলো মেয়েটার সম্পূর্ণ মুখ-চোখ-চেহারা। পরপর একপেশে হেসে ফেললো। মুখ ফুটে অস্পষ্ট স্বরে বেরোলো—“ইন্টারেস্টিং!”
.
.
.
পুরোনো কথা স্মরণে এলে হাসলো ধ্রুব। ইনায়ারই পড়া ভার্সিটির লেকচারার হিসেবে জয়েন করা কোনো কাকতালীয় ঘটনা ছিল না। বরং তার ঘটানো ঘটনা ছিল। ইনায়ার জন্য সে কতো কি করেছে তা কি এই মেয়েটা জানবে? অবশ্যই জানবে। কোনো একদিন ধ্রুব নিজে জানাবে তাকে এসব। ধ্রুব হাসলো। বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকায় বৃষ্টি এসে গায়ে লাগছে কিছুটা। সাথে শীতল বাতাসও। ধ্রুব বারান্দা থেকে বেড়িয়ে এলো। দরজা লাগিয়ে ঘড়ির দিকে তাকালো। তারপর বিছানার দিকে। ইনায়া ঘুমিয়ে আছে। ছাদ থেকে এসেই পোশাক পাল্টে শুয়েছে মেয়েটা। লাজে দু’বার তার দিকে তাকিয়েও দেখেনি। ধ্রুব আবার হাসলো। এগিয়ে গিয়ে বিছানার ফাঁকা পাশে আধশোয়া হয়ে শুলো। হাত রাখলো কানের নিচে গালে, তাকিয়ে দেখলো মেয়েটার ঘুমন্ত মুখশ্রী। কি স্নিগ্ধ! কি সুন্দর! ধ্রুবর কি যে ভালো লাগলো! হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দিলো মেয়েটার চোখ – নাক – ঠোঁট। আচমকা ঠোঁট এগিয়ে ছোট করে চুমু বসালো ইনায়ার কপালে। চুম্বনে সিক্ত করলো মেয়েটার শুভ্র ললাট। ছোট চুমুটাও ছিলো প্রচন্ড গভীর! ইনায়া নড়েচড়ে উঠলো৷ ঘুমের মধ্যেই তাকে ছোঁয়া ধ্রুবর হাত জড়িয়ে ধরলো। ফলে ধ্রুব আরো কিছুটা ঝুঁকে পড়লো তার দিকে। সেভাবেই চুপচাপ থাকলো ধ্রুব। নাড়লো পর্যন্ত না, পাছে মেয়েটার ঘুম ভেঙে যায়! ধীরে ধীরে ইনায়ার শ্বাস ভারি হলো। বুঝলো ঘুম গভীর হয়েছে। তখন ধীরে ধীরে হাত ছাড়িয়ে সরে এলো সে। নিজের জায়গায় শুয়ে পড়লো।
****************
সারারাত বৃষ্টির পর প্রকৃতি ঠান্ডা করে সকালবেলা কড়া রোদ উঠলো। কাঁচ খোলা জানালার থেকে রোদ ঘরের ভেতর পর্যন্ত আসছে। সূর্যের কিরণ চোখে মুখে পড়তেই মুখ কুঁচকায় ইনায়া। পিটপিট করে চোখ মেলে। চোখ খুলেই সামনে ধ্রুবকে দেখলো। ছেলেটা ঘুমিয়ে আছে। ইনায়া দেখলো তারা খুব কাছাকাছি শুয়ে। কিন্তু সে দূরত্বেই শুয়ে ছিলো। তাহলে ধ্রুব কি—? সে তাকালো ধ্রুবর দিকে।
রোদ সরাসরি তার মুখে পড়ছে। ছেলেটার কপাল বিরক্তিতে কুঁচকে আছে। কিসের এতো বিরক্তি? বোধহয় ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছে, সেই বিরক্তি। ইনায়া একবার তাকালো জানালার দিকে। তারপর ধ্রুবর দিকে। যেখান থেকে রোদ আসছে, সরে এসে সেই জায়গাটা আড়াল করলো। রোদ আর লাগছে না ধ্রুবরের মুখে। কুঁচকানো কপালও মসৃণ হয়েছে। ইনায়ার ছেলেটার ঘুমন্ত মুখ ভালো লাগলো। হালকা ঝুঁকে শুলো তার দিকে। দেখলো ছেলেটাকে। খুব গভীরভাবে। পুরু ঠোঁট, ঘন আইব্রো, ক্লিন জো লাইন, শ্যাম ত্বক, গালে টোল। সবটা কি চমৎকার লাগছে তার কাছে! ইনায়া দেখেই গেলো। আচমকা হাত বাড়ালো। এক আঙুল গলালো কপাল থেকে থুঁতনি পর্যন্ত। তবে থুতনিতে পৌঁছানোর আগে আঙুল ঠোঁটে এলো তখনই তার হাত ধরে ফেললো ধ্রুব। পিটপিট করে ঘুমঘুম চোখ মেলে চাইলো। ইনায়া ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে দেখলো শুধু। আকস্মিক ব্যাপার বুঝতে সময় লাগলো। যখন বুঝলো তখনই সরে যেতে নিলে বাঁধা পেলো। ধ্রুব হ্যাঁচকা টানে মেয়েটাকে বুকে ফেললো। ইনায়া হকচকিয়ে গেলো। উঠতে গেলে বাঁধলো বিপত্তি। চুল আটকেছে ধ্রুবর শার্টের বোতামে। টানা হ্যাঁচড়া করে তা ছাড়াতে চাইলো। পারলো না। ধ্রুব চুপচাপ তার কাজকর্ম দেখলো। হাসলো খানিকটা। তারপর মেয়েটার হাত ধরে তাকে থামালো। ইনায়া চোখ তুলে ভ্রু কুঁচকে চাইলো। ধ্রুব আস্তে আস্তে একে একে চুল ছাড়ালো। সম্পূর্ণ ছাড়িয়ে মেয়েটার চুল গুছিয়ে দিয়ে দিতে বলল—“এভাবে টানলে তোমার চুল ছিঁড়ে যাবে। পড়ে দেখা গেলো আমায় টেকো বউ নিয়ে সংসার করতে হলো। তখন আমার কি হবে সোনা?”
ইনায়া তীক্ষ্ণ চোখে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। বলল—“আমাকে সব ভাবে মানতে না পারলে বিয়ে কেন করেছিলেন?”
ধ্রুব হাসলো। মজার ছলেই বলল—“তোমায় ভালোবাসবো আর শত সন্তানের জননী বানাবো তাই।”
“আপনি এটা অসভ্য!”
“তুমি তো সভ্য। আমাকেও একটু সভ্য করে দাও?”
ইনায়া ধ্রুবর বুক ঠেলে উঠে বসলো। কথা কাটাতে বলল—“ফ্রেশ হোন। আমি যাচ্ছি।”
“কোথায়?”
“জাহান্নামে। আপনি যাবেন?”
“তুমি প্রতি কথায় এতো চেঁতে যাও কেনো?”
“কারন আমি এমনই।”
“সবার বেলাতেই নাকি শুধু আমার বেলাতেই?”
ইনায়া ভ্রু কুঁচকে তাকালো। ফিচেল হেসে জিজ্ঞেস করল—“আপনি কি স্পেশাল কেউ?”
ধ্রুব সুক্ষ্ম অপমানটা গায়েও মাখলো না। বরং হেসে বলল—“অন্যের কাছে না হলেও, তোমার কাছে আমি স্পেশাল।”
“একদমই না।”
“একদমই হ্যাঁ।”
“কি করে?”
ধ্রুব এগিয়ে এসে ঝুঁকলো তার দিকে। হালকা হেসে বলল—“নাহলে আমার ঘুমের ফায়দা ওঠাতে না। বেশি বলিও না, পড়ে তুমিই লজ্জায় মুখ ঢাকবে৷”
বলে উঠে পড়লো সে। বাথরুমে গিয়ে শব্দ করে দরজা দিলো। ইনায়া চমকে তাকালো। মূহুর্তেই কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠলো।
***************
সকালের নাস্তা করে উঠতেই সুমিতা বেগম ইনায়াকে বললেন ধ্রুবকে বাগান ঘুড়িয়ে আনতে৷ ইনায়া তার কথা শুনে বিরক্ত হলেও রাজি হলো। ধ্রুবকে নিয়ে বাগান ঘোড়াতে গেলো। আজকে শুক্রবার থাকায় তাদের অফ ডে৷ তাই তেমন তাড়া নেই। ইনায়া ধ্রুবকে বাগান ঘুড়িয়ে বাসায় ঢুকছিলো। বাড়িতে ঢোকার পথে পাশের দিকে গাড়ির গ্যারেজ। ধ্রুব তার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লো৷ ইনায়া নিজের পাশে ধ্রুবকে না পেয়ে ভ্রু কুঁচকালো। পিছনে এসে দেখলো ধ্রুব গ্যারেজের ওখানে দাঁড়ানো। ইনায়া তার পিছে গিয়ে দাঁড়ালো। ধ্রুব তার উপস্থিতি টের পেলো। গ্যারেজের মধ্যে পার্ক করা চেরি রঙের টয়োটা গাড়ির দিকে দৃষ্টি স্থির রেখে জিজ্ঞেস করল—“গাড়িটা কার?”
ইনায়া নির্লিপ্ত গলায় জবাব দিলো—“আমার।”
“তুমি ড্রাইভ করতে পারো?”
জেনেশুনেও বেকার প্রশ্ন করা। ধ্রুব নিজে জিজ্ঞেস করে নিজেই চাপা হাসলো। ইনায়া তার কথায় ফিক করে হেসে ফেললো যেন কৌতুক শুনেছে মাত্র। তার মতোন রেসারকে কি না প্রশ্ন করছে সে ড্রাইভিং পারে নাকি। এটা হাস্যকরই বটে। অবশ্য ধ্রুবর এ ব্যাপারে না জানাটাও অস্বাভাবিক নয়। ইনায়া হাসলো। বলল—“তা পারি কিছুটা।”
ধ্রুব হাসলো। ইনায়ার দিকে ফিরে তাকালো। ফিচেল হেসে প্রস্তাব রাখলো—“লেটস্ হ্যাভ আ রেস?”
ইনায়া তৎক্ষনাৎ ভ্রু গুটিয়ে তাকালো। জিজ্ঞেস করল—“রেস?”
“হুম রেস।”
ইনায়া প্রশ্ন করলো—“জিতলে কি পাবো?”
“যা চাইবে।”
“আর যদি হারি?”
“নাথিং, যাস্ট আমায় ‘ভালোবাসি’ বলবে।”
ইনায়া তীর্যক হাসলো—“তাহলে ড্রিম অন। এই জীবনে আর আমার মুখে ‘ভালোবাসি’ শোনা হবে না আপনার।”
ধ্রুব শুনলো। একপেশে হাসলো।
#চলবে