ক্যামেলিয়া পর্ব-১১

0
272

#ক্যামেলিয়া
#ফারহানা_চৌধুরী
[পর্ব ১১]

❌কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ❌

ইনায়া ঘর থেকে তৈরি হয়ে বের হতেই সুমিতা বেগম বাঁধা দিয়ে দাঁড়ালেন। ভ্রু কুঞ্চিত করে জিজ্ঞেস করলেন,
-“সকাল বেলাকোথায় যাচ্ছিস?”
-“সকাল কই মা? ১১টা বাজে।”
-“কোথায় যাচ্ছিস সেটা বল। টাইম শুনতে চাইনি আমি।”

ইনায়া কপাল চুলকে খানিকটা হালকা গলায় বলল,
-“একটু কাজ আছে।”
কিসের কাজ? ভার্সিটি বন্ধ না আজ?”
-“তো কি হয়েছে?”

সুমিতা বেগম চোখ রাঙালেন মেয়েকে৷ চাপা গলায় ধমকে বললেন,
-“তো কি হয়েছে মানে! জামাই বাসায় আছে ভুলছো কেন? এমন সময় তুমি বাইরে যাবে? আক্কেল জ্ঞান নেই তোমার?”

ইনায়া দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। মায়ের কথায় বিরক্ত হলেও এখন তর্কে জড়ালে লাভ নেই। তাই ধীর গলায় বলল,
-“ধ্রুব যাচ্ছে আমার সাথে।”

সুমিতা বেগম এবার একটু থমকালেন। ধ্রুব নামটা শুনে বিরক্তির বদলে কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল।
-“ধ্রুব? কোথায় যাবে তোমরা?”

ধ্রুব তখন সবে ঘরে ঢুকেছে। সুমিতা বেগমের প্রশ্নে থামলো। ইনায়ার হয়ে বলল—“একটু ঘুরতে যেতে চাইছিলাম আম্মু। তাই আর কি—”

সুমিতা বেগম মেয়ে জামাইয়ের কথায় গদগদ হয়ে বললেন,
-“তাই? তাহলে যাও বাবা৷ তাড়াতাড়ি ফিরো শুধু, কেমন?”

ধ্রুব মাথা কাত করে সায় জানালো। অল্প হাসলো। সুমিতা বেগম ধ্রুবর মাথায় হাত বুলিয়ে চলে গেলেন রান্নার কাজে। জামাই মানুষ বাসায় আছে! যত্ন-আত্তিরও তো একটা ব্যাপার-স্যাপার আছে! ইনায়া চুপচাপ ভ্রু কুঁচকে মায়ের পল্টি খাওয়া দেখলো৷ এতক্ষণ তার সাথে কেমন ঝাঁঝ দেখালো, আর ধ্রুবর সাথে দেখো। উঠতে বসতে ‘বাবা’ ছাড়া একটা লাইনও মনে হয় বলে না। ইনায়ার রাগ হলো। ধ্রুব চুপচাপ এগিয়ে এসে ইনায়ার কাঁধে হাত রাখলো। বড়ো আফসোসের সুরে বলল,
-“আমার মনে হয় কি জানো ইনায়া? তোমাকে না, আঙ্কেল-আন্টি কুড়িয়ে পেয়েছিলেন; বুঝলে! নাহলে তোমার থেকে আমায় এতো আদর-যত্নের মানে আছে বলো?”

ইনায়া চোখ গরম করে তাকালো তার দিকে। তার বাম কাঁধে রাখা ধ্রুবর হাতের দিকে তাকিয়ে তার পেটে গুঁতো মারলো। ধ্রুব চমকে হাত সরিয়ে পেট ধরলো। ইনায় বলল,
-“সেটা আপনার দেখতে হবে না। আমার বিষয় আমি বুঝে নেবো।”

বলে মুখ কুঁচকে চলে গেলো বাইরে। ধ্রুব হাসলো তা দেখে।

_______
লোক সমাগমহীন এক রাস্তায় কালো রাঙা মার্সিডিজ আর চেরি রঙের টয়োটা গাড়ি দুটো সমান তালে টক্কর দিয়ে আগে পিছে ছুটছে একে অপরের। ফিনিশিং লাইন বলতে বেশ দূরে জঙ্গল সাইডের একটা রাস্তায় ধ্রুব তার বন্ধুদেরকে বসিয়ে এসেছে। আর স্বাভাবিকভাবেই যে আগে তার কাছে পৌঁছাতে পারবে সে উইনার হবে। আকাশ মেঘে ঢাকা। যেকোনো সময় বৃষ্টি নামতে পারে। অবশ্য হুটহাট করে বৃষ্টি নামা অবাক করা কোনো বিষয় না। প্রায়শই হয়। চোখ ধাঁধানো গতিতে ছুটছে দুই গাড়িই। ইনায়া সামনের দিকে হেলে স্টিয়ারিং ধরে রেখেছে দৃঢ় হাতে। মুখে একরকম গাম্ভীর্যতা। সে এক্সেলেটরের প্যাডেল চেপে স্পিড বাড়ালো গাড়ির। বেগতিক গতিতে ছুটলো চেরি রাঙা টয়োটা গাড়িটা। ইনায়া কোনোমতে হলেও আজ এই ম্যাচ জিতবে। যেভাবেই হোক না কেন! ধ্রুব ইনায়ার গাড়ির গতি লক্ষ্য করলো। নিজেও সমান তালে স্পিড বাড়ালো। এভাবে চলতে চলতে দু’গাড়িই পাশাপাশি এলো৷ ধ্রুব হেসে ইনায়ার উদ্দেশ্যে বাণ ছুঁড়লো,
-“কেমন লাগছে ম্যাডাম?”

ইনায়া ভ্রু উঁচিয়ে পাশে তাকায়। পরপর হেসে বলে,
-“খুব ভালো!”
-“আচ্ছা?” একপেশে হাসলো ধ্রুব,
-“যদি হেরে যাও?”

ইনায়া সাবলীল গলাতেই বলল,
-“গেলে গেলাম।”
-“আচ্ছা, তাহলে বি রেডি হানি।”
-“ফর হোয়াট?”
-“রেসের কন্ডিশন ভুলে গেলে?”

ইনায়া হাসলো। নিঃশব্দে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে সামনে ছুটলো।

কিছুটা এগিয়ে হুট করে ধ্রুবর গাড়ি থেমে গেলো। বারবার স্টার্ট দিলেও স্টার্ট নিলো না। সে একবার সামনে তাকালো। ইনায়া অনেকটা দূরে। তাকে দেখতে পায়নি নাকি? ফিনিশিং লাইন আর বেশি দূরেও না। ধ্রুব বিরক্ত হয়ে নামলো গাড়ি থেকে। দেখলো গাড়ির টায়ার পাংচার হয়ে গেছে। ধ্রুব দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। তারপর হালকা হেসে মাথা নাড়ল,
-“এই মেয়ে ঠিকই বুঝে গিয়েছিলো, আমি হেরে যাব!”

সে গিয়ে গাড়ির ট্র্যাঙ্ক খুললো। এক্সট্রা টায়ার আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র রাখাই থাকে সবসময়। হুট করে কোনো বিপদ হলে সুবিধা হয় আসলে কিছুটা। সে সব নিয়ে নিজেই গাড়ির টায়ার ঠিক করতে বসলো। ইনায়ার কাছে যাওয়ার আর কোনো তো ওয়ে নেই৷ পাগলের মতোন গাড়ির পেছন দৌড়াতে তো আর পারবে না। এর চেয়ে গাড়ির টায়ার ঠিক জোরে যাওয়াটাই ঠিকঠাক।

_______
ফিনিশিং লাইনের বেশ কিছুটা দূরে রাস্তার মাঝে গাছ ফেলা দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো ইনায়া। স্ব জোরে গাড়িতে ব্রেক কষলো। একটু হলেই ধাক্কা লাগছিলো! সে বুঝলো না মাঝ রাস্তায় এমন গাছ ফেলে রাখার কারণ। পরক্ষণেই মাথায় এলো কাল রাতে বৃষ্টির সাথে ঝড়ও হয়েছিলো শুরুতে। সেই জন্যই হয়তো ভেঙে পড়েছে গাছটা। ইনায়া সিটবেল্ট আর গাড়ির চাবি খুলে গাড়ি থেকে বেড়িয়ে দাঁড়ালো। পরনের ফরমাল প্যান্টের এক পকেটে হাত গুঁজে অন্য পকেট থেকে ফোন বের করলো। পেছনে তাকিয়ে দেখলো ধ্রুব কেন, তার গাড়ির টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না পর্যন্ত। ইনায়ার ভ্রু কুঁচকে এলো। ফোনের দিকে তাকিয়ে দেখলো নেটওয়ার্ক পাচ্ছে না। ইনায়া বেজায় বিরক্ত হলো এবার। রাগ হলো ধ্রুবর উপর। কে বলেছিলো এমন জায়গা চুজ করতে? জানে না এরকম জঙ্গলে নেটওয়ার্কের কতো সমস্যা? তারউপর আশেপাশে একটা লোকও নেই। তার মন চাইলো ধ্রুবর মাথা ফাটাতে। গাড়িতে দিকে গিয়ে বসতে নিলে তার পাশে এসে একটা গাড়ি থামলো। চরম আশ্চর্য আর বিস্ময় নিয়ে তাকাতেই, গাড়িটা দেখে চোখে মুখে খেলে গেলো অবিশ্বাস্যর এক ঝলক। তার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকার মাঝেই গাড়ি থেকে একটা লোক নামলো। ইনায়া তাকালো তার দিকে। বুক খোলা শার্ট আর জিন্স পরা মানুষটাকে দেখে অবিশ্বাসের বদলে এখন বিরক্তি আর ঘৃণা ফুটে উঠলো স্পষ্টভাবে। আরাফ হাসলো। ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে এসে ফিচেল হেসে বলল,
-“হাই!”

ইনায়া মুখ কুঁচকে নিলো৷ অসম্ভব বিরক্তির মাঝে খানিকটা বিস্ময় নিয়েই সে জিজ্ঞেস করল,
-“তুমি এখানে কেন?”

আরাফাত অবাক হওয়ার ভান করে গালে হাত দিলো। তারপর বলল,
-“এখানে কেন মানে! তোমার জন্য সোনা। তোমাকে ছাড়া আমার থাকতে খুব কষ্ট হয়। ট্রাস্ট মি!”

বলে কন্ঠনালি ছুঁলো সে। ইনায়া শক্ত চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঝাঁঝালো গলায় জিজ্ঞেস করল—“তুমি কি করে জানলে আমি এখানে?”

আরাফ হাসলো এবার,
-“কি করে! তোমার কথা আমি জানবো না তো কে জানবে সোনা?”
-“নাটক করবে না আরাফ। বিরক্ত হচ্ছি আমি। তুমি জানলে কি করে আমি এখানে?”

খানিকটা চেঁচিয়ে বলল ইনায়া। আরাফ আবার হাসলো। নির্লজ্জের মতোন হেসে বলল—“ তোমার হাজবেন্ড? তার থেকে।”

বিস্ময়ে হতবাক ইনায়া। অস্পষ্ট স্বরে কোনোরকমে বলল,
-“ধ্রুব!”
-“হ্যাঁ, ধ্রুব স্যার। এখন চলো আমার সাথে।”

বলে আবার হাসলো আরাফ। ইনায়ার রাগে গা জ্বলে উঠলো। পরক্ষনেই ভীত হলো সে। অযাচিত অভিমানে গলা ধরে এলো কান্নায়। ধ্রুব এমন করে ধোঁকা দিলো কেন? এজন্য তাকে এখানে এনেছিলো? রেসের নাম করে এখানে এভাবে আনলো। আর আরাফকেই বা সে কি করে চেনে? এতোশতো প্রশ্ন মাথায় হিট করতেই মেয়েটা পিছু হটলো। গাড়ির দিকে ছুটতে গেলেই আরাফের শক্ত হাত তাকে ধরে ফেললো। ইনায়া চেঁচালো, ছাড়তে বললো; আরাফাত তাকে ছাড়লো না। উল্টো তার নাকে রুমাল চেপে ধরলো। সব এতো তাড়াতাড়ি ঘটলো মেয়েটা কিছু বুঝলোও না। ক্লোরোফর্মের ঘ্রাণ নাকে এলে ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়লো সে। হাত-পা যেন ভেঙেচুরে এলো। নিস্তেজ হয়ে শরীরের ভার ছেড়ে লুটিয়ে পড়লো আরাফের বাহুতে।

______
ধ্রুব টায়ার পাল্টে সব ঠিকঠাক করে গাড়িতে উঠলো। ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে ফোন করলো রাহাতকে। রাহাত আর তার কিছু বন্ধু রাফি, মাহিন সবাই মিলে ফিনিশিং লাইনের ওখানে আছে। সে ফোন করতেই রাহাত ফোন রিসিভ করে। কানে লাগাতেই রাহাত চেঁচিয়ে উঠলো ওপাশে,
-“কি মামা? এতো টাইম লাগে কেন আসতে? রাস্তাতেই শুরু কইরা দিছোনি?”

ধ্রুব স্বাভাবিক রইলো। বন্ধুরা কেমন খুব ভালো করেই জানা তার। এসব নরমাল ব্যাপার-স্যাপার তাদের ভেতর। তাই সে স্বাভাবিক ভাবেই জিজ্ঞেস করল—“তোদের ভাবি পৌঁছাইছে?”

রাফির কপালে এবার ভাঁজ পড়লো। মাহিন চিন্তিত গলায় বলল—“ভাবি পৌঁছাইছে মানে? তোর সাথে নাই? এখানেও তো এখনো আসেনি।”

ধ্রুব ভ্রু কুঁচকে ফেললো। জিজ্ঞেস করল,
-“ইনায়া এখনো যায়নি? ওর তো এতক্ষণে যাওয়ার কথা। আনার গাড়ি খারাপ করছিলো রাস্তার মাঝে তাই ঠিক করছিলাম। ওর এতো সময়ে চলে যাওয়ার কথা।”

ধ্রুবর অস্থির, চিন্তিত গলা শুনে ওপাশে ওরা থম মেরে গেলো। রাহাত বলল—“ভাবি মনে হয় হারিয়ে গিয়েছে৷ হয়তো ওনাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না!”

কথাটা শুনেই ধ্রুবর বুকটা ধ্বক করে উঠলো। গলা কেঁপে উঠলো। এই অবস্থায় কি করবে বুঝে পেলো না। ইনায়া কোথায়? তার বুকটা কাঁপছে প্রচন্ড!

#চলবে