#ক্যামেলিয়া
#ফারহানা_চৌধুরী
[পর্ব ২২]
উদয় রাস্তার একপাশে টংয়ের দোকানে বসে। পাশে রিমঝিম। রিমঝিমকে কি বলা যায়? উম্.. প্রেমিকা বোধহয়। তবে তারা তো প্রেম করছে না। তবে? উদয় হাসলো। রিমঝিমের দিকে চেয়ে বলল,
-“কিছু খাবে?”
রিমঝিম মাথা নাড়াল,
-“উহু। একটু দেখা করতে এসেছি তোমার সাথে। অনেক দিন হলো দেখাই হয় না।”
-“হ্যাঁ। আচ্ছা, বলো কিছু। এভাবে চুপ করে বসে থাকলে কি করে হবে?”
রিমঝিম কি বলবে খুঁজে পেলো না। সামনে বসা ছেলেটা তার অত্যাধিক পরিমাণের পছন্দের হওয়ায় প্রায়শই ছুঁতো খোঁজে সে দেখা করার জন্য। তবে, ছেলেটা যদি তা বুঝত! রিমঝিম কানের পিছে চুল গুছিয়ে রাখলো। উদয়ের দিকে চেয়ে আমতা আমতা করে বলল,
-“আ- আমার পড়ায় একটু তোমার হেল্প লাগবে।”
উদয় চমকাল না। হাসল,
-“আমার?”
-“আব্— হ্যাঁ।”
-“আমি কি হেল্প করবো তোমার বলো? আমি নিজেই তো পড়াশোনায় কাঁচা। কলেজ থেকে দেওয়া অ্যাসাইনমেন্ট এখনো পড়েই আছে। ধরিওনি।”
রিমঝিম বলল,
-“তুমি ক্লাস টপার হয়ে এমন বললে আমরা কোথায় যাবো? দেখো, আমার হেল্প লাগবে তোমার। প্লিজ।”
-“আচ্ছা। আচ্ছা করবো।”
রিমঝিম হাসল। মিষ্টি করে। তখনই রাস্তার পাশে হইহট্টগোল হতে দেখা গেল। রিমঝিম সেদিকে তাকালো উৎসুক দৃষ্টিতে। লোকজন ছোটাছুটি করে একদিকে যাচ্ছে। রিমঝিমের দেখাদেখি উদয়ও তাকালো। লোকজনের ছোটাছুটি দেখে ভ্রু কুঁচকালো। রিমঝিম বলল,
-“কি হচ্ছে এখানে?”
-“জানি না। চলো তো, দেখি।”
বলে উদয় টংয়ের দোকানদারের হাতে চায়ের আট টাকা ধরিয়ে উঠে দাঁড়ালো। রিমঝিমকে নিয়ে সামনের দিকে গেলো। লোকজনের ভিড় সেখানে। উদয় বুঝলো না ঠিক। পাশে একজন লোককে জিজ্ঞেস করলো,
-“ভাই? কি হয়েছে এখানে? এতো ভিড় কেন?”
লোকটা আফসোস দেখিয়ে বলল,
-“আর বইলেন না। এক্সিডেন্ট হইছে। ট্রাক মেরে দিছে। এরা দেখে শুনে গাড়ি কেন চালায় না! মেয়েটা বেঁচে আছে কি না কেডা জানে।”
উদয় ওনার কথা শুনে রিমঝিমের দিকে তাকালো। রিমঝিম উঁকিঝুঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে। তার হাত ভিড়ে ধরে রেখেছে উদয়। ভিড় ঠেলল। কোনোমতে মাথা বাড়িয়ে উঁকি দিতেই রক্তাত্ত একটা দেহ বের করছে সকলে মিলে। পাশেই গাড়িটা দুমড়ে মুচড়ে পড়ে আছে। গাড়িটা দেখে উদয় অবাক হলো। অজানা আশংকা বাসা বাঁধলো মনে। সে আরো ভিড় ঠেলে চেহারা দেখার চেষ্টা করলো। বুক কাঁপছে তার। সে খুব করে চাইছে এমন কিছু না হোক। যা ভাবছে তা ভুল হোক। তখন মেয়েটাকে স্ট্রেচারে করে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলো। উদয় মেয়েটার মুখ দেখলো তখন। ইনায়া! ভাবি! তার মনে হচ্ছে সে কথা বলতে পারছে না। গলায় সব আটকে আছে। রিমঝিম তার এমন হাবভাবে অবাক হলো। উদয়ের হাত ধরে উদগ্রীব হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“কি হয়েছে উদয়? এমন করছো কেন?”
উদয় কি বলবে বুঝছে না। তার হাত কাঁপছে। কি করা উচিত তার? সে রিমঝিমকে বললো,
-“আমি-, তুমি বাসায় চলে যাও। আমি পৌঁছে দিতে পারবো না তোমায়।”
কথাটুকু সম্পূর্ণ করতেও তার বেগ পেতে হলো। রিমঝিম কিছুই বুঝলো না। এমন করার কারণ কি? সে শুষ্ক ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
-“দেখো, তুমি বসো। পানি খাও। শান্ত হও। কি হয়েছে ধীরে সুস্থে বলো।”
-“তুমি একা যেতে পারবে না? চলে যাও প্লিজ। আমি যেতে পারছি না এখন।”
-“আমি—”
-“যেতে বলেছি আমি!”
ধমকে উঠলো উদয়। মেয়েটা হঠাৎ ধমকে কেঁপে উঠল। মুখ শুকিয়ে এলো। উদয় দেখলো। তবে আর দাঁড়ালো না। ছুটলো অ্যাম্বুলেন্সের ওদিকে। রিমঝিম এবার আরো অবাক হলো,
-“আরে!”
সে দেখলো উদয় অ্যাম্বুলোন্সের ওখানে লোকজনের সাথে কথা বলে সেখানে উঠেছে। রিমঝিম একটু দূরে দাঁড়ানো রিক্সার কাছে গেলো। রিক্সায় চেপে বলল অ্যাম্বুলেন্সটার পিছু পিছু যেতে।
রিমঝিমের পৌঁছাতে একটু দেরি হলো। সে কোনোমতে ভাড়া চুকিয়ে হাসপাতালে খুঁজতে লাগলো উদয়কে। দো’তলায় করিডোরে তাকে পেলো শেষমেশ। সে দৌঁড়ে তার কাছে গেলো। উদয় একটা চেয়ারে বসে ছিলো। দু’হাতে মুখ চেপে। রিমঝিম তার পাশে বসলো। উদয় তখনো সেভাবেই বসে। হয়তো এখনো বোঝেনি সে এসেছে। রিমঝিম হাত বাড়ালো তার কাঁধ ছুঁতে। ছুঁতে ছুঁতেও গুটিয়ে নিলো। নিজেকে সামলে মিহি স্বরে ডাকল,
-“উদয়?”
উদয় চমকে তাকালো। ভারি অবাক হয়ে বলল,
-“তুমি এখানে কেন? বাড়ি যাও নি?”
-“তুমি এখানে কেন? আর এমন কেন লাগছে তোমাকে? বলো কিছু। আমার কেমন যেন লাগছে তোমাকে এভাবে দেখে।”
মেয়েটার কন্ঠস্বর বড্ড উদগ্রীব। উদয় তাকিয়ে রইলো ক্ষীণ কাল। মৃদু হাসল। হালকা গলায় নিজেকে সামলে বলল,
-“ঠিক আছি আমি। ওই মেয়েটা আমার ভাবি ছিলো।”
-“ইনায়া ভাবি?”
উদয় মাথা দোলায়। তখনই ফোন বাজে। উদয় পকেট থেকে ফোন বের করলো। কলার আইডি দেখে ফোন তুলবে কি তুলবে না চিন্তায় পড়ে গেল। মাকে ফোন করে সবটা জানালেও ধ্রুবকে জানানো হয়নি। জানলেই কি পাগলামো করবে তা তার ঠোঁটস্থ। এই ভয়েই ফোন না করলেও এখন ধ্রুব নিজেই ফোন করছে। রিমঝিম বলল,
-“ফোন তোলো?”
-“না, না। আমায় কবর দিয়ে দিবে ভাইয়া। ওকে কেন কিছু জানাইনি আমি।”
-“আরে! তোলো তো। দেখো কি বলে।”
উদয় হাজার না করা সত্বেও ফোন তুলতে হলো তার। ফোন কানে ধরতেই ধ্রুবর ব্যগ্র গলা শুনলো,
-“উদয়? ইনায়া কই? কি অবস্থা ওর?”
মা জানিয়ে দিয়েছে সব? শিট! সে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো,
-“ওটিতে নিয়েছে। ট্রাকের সাথে এক্সিডেন্ট হয়েছিল।”
ধ্রুবর বুক কাঁপল। বলল,
-“আমি আসছি। তুই এড্রেস পাঠা।”
উদয় কল কাটল। এড্রেস এসএমএস করে বসলো চুপচাপ।
______
কিছুক্ষণের মধ্যেই ধ্রুব এসে পৌঁছালো হসপিটালে। অবস্থা তার করুণ৷ উদয় তাকে দেখে বসা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। পূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল। পরনের শার্ট কুঁচকে আছে। চুল এলোমেলো৷ চোখদুটো লাল। অনেকক্ষণ কান্না করলে যেমন হয় না? তেমন। উদয়কে দেখে ধ্রুব ছুঁটে এলো। ব্যগ্র হয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“ইনায়া? কই ও? ডাক্তার বলেছে কিছু? কেমন আছে ও?”
-“বলেনি কিছু এখনো। তুমি বসো প্লিজ। শান্ত হও।”
ধ্রুব বসলো না। শান্তও হলো না৷ তখনই ডাক্তার বের হলো ওটি রুম থেকে। ধ্রুব তার কাছে গেলো দ্রুত। ডাক্তার জিজ্ঞেস করলো,
-“পেশেন্ট বেঁচে গিয়েছেন এই যাত্রায়। তবে অবস্থা মারাত্মক। বিভিন্ন জায়গা কেটেকুটে গিয়েছে।”
ধ্রুবর শ্বাস আটকে আসছে। সব কথা তীরের মতো বিঁধছে। তখনই আরো একটা তীক্ষ্ণ তীর ছুঁড়লেন উনি,
-“উনি ফোর উইক প্রেগনেন্ট ছিলেন। এন্ড উই আর স্যরি। আমরা বাচ্চাটাকে বাঁচাতে পারিনি।”
(#চলবে….)