#ক্যামেলিয়া
#ফারহানা_চৌধুরী
[পর্ব ২৫]
ধ্রুব প্রথমে বাসায় পৌঁছালো। ঘরে ঢুকেই গায়ের শার্ট খুলে বিছানায় ছুঁড়ে মারলো। রাগে শরীর কাঁপছে তার। মেজাজ খিঁচড়ে আছে চরমভাবে। সে ফোন করলো রাহাতকে ফোন করলো সোজা। ফোন প্রথমবারে রিসিভ হলো না। পরে আবার কল করলে রাহাত রিসিভ করলো ফোন। ফোন তুলতেই গর্জে উঠলো ধ্রুব,
-‘কই মরছিলি? ফোন তুলিস না কেন?’
রাহাত হসপিটাল থেকে এসে ঘুমে ছিলো। হঠাৎ ফোন করে ঘুম ভাঙিয়ে এমন তর্জন-গর্জনের মাঝে সে বুঝলো না। মুখ কুঁচকে নিল,
-‘কি হয়েছে? ক্ষেপে আছিস কেন?’
-‘আরাফের বাপের ব্যাপারে খোঁজ লাগাতে বল কামরুলকে। ঐ লোকরে আমি এক ঘন্টার মধ্যে আমার সামনে চাই।’
রাহাত অবাক হল,
-‘হয়েছেটা কি? এতো রেগে আছিস কেন?’
ধ্রুব বড়ো করে শ্বাস ফেললো। সংক্ষেপে সব বলল তাকে। রাহাত সবটা শুনে হতবাক হয়ে গেল। ভেবেচিন্তে বলল,
-‘আচ্ছা, মানলাম সব কাজ আরাফের বাপ করাইছে। ইভেন, ভাবির এক্সিডেন্টটাও। তবে ঐ লোক কি করে এটা শিওর হলো যে, তুইই আরাফকে মারছিস? মানে, নিউজটা বাইরের লোক কি করে জানবে?’
কথাটা সত্যি। ধ্রুব কোমড়ে হাত রেখে শ্বাস ফেললো। এমন নয় যে সে এটা নিয়ে ভাবে নি। ভেবেছে। তার সন্দেহও হয় ক’জনকে। সে বলল,
-‘কেউ এই কথা বাইরে লিক করছে। এন্ড আ’ম ড্যাম শিওর, এটা ঐদিন ওখানে উপস্থিত লোকের মধ্যে থেকে কারোর কাজ।’
-‘ওখানে তো ঐদিন আমরা আমরাই ছিলাম। কে লিক করবে কথা?’
ধ্রুব চুপ থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর সময় নিয়ে ভেবে বলল,
-‘ঐ রেজা তো নতুন এসেছে না?’
রাহাত মাথা দোলাল,
-‘হ্যাঁ।’
-‘ওর ব্যাপারে খোঁজ নে তো। উইদিন হাফ এন আওয়ার, এ টু জেড আমায় জানা ইন ডিটেইলস।’
-‘আ— ওকে। ভাবিস না, আমি দেখছি।’
-‘হুম।’
ধ্রুব ফোন বিছানায় ছুঁড়ে মারলো। তোয়ালে হাতে শাওয়ারে ঢুকল। মন মেজাজ বিক্ষিপ্ত। গোসল করলে তাও একটু ভালো লাগবে হয়তো।
ধ্রুব সময় নিলো। কোমরে তোয়ালে পেঁচিয়ে বেড়িয়ে এলো। ফুলে-ফেঁপে ওঠা বাইসেপ্স সহ শরীরের বিভিন্ন ভাজ সুস্পষ্ট। বাহু, পেট থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। সে তা মোছার বিশেষ তাগিদ দেখালো না। পটু হাতে আরেকটা তোয়ালে দিয়ে ভেজা চুল মুছতে লাগল। তখন তার ফোন বাজলো। সে সরাসরি না চেয়ে আড়চোখে সেদিকে তাকাল। কলার আইডি দেখে ফোন তুলল। কানে চেপে বলল,
-‘বল।’
-‘রেজাই সব কথা আরমান ব্যাটার কানে তুলেছে। ওর কল লিস্ট চেক করিয়েছি আমি৷ একটা নাম্বারে বেশ কয়েকবার কথা বলেছিলো ও সেদিন। পরে নাম্বার নিয়ে ঘেঁটে জানলাম ওটা আরমান মানে আরাফের বাবার। এইসব ছাড়াও রেজা ওনার সাথে বহুবার দেখা করছে। বহুবার!’
ধ্রুবর মনে হলো রেজাকে সামনে পেলে সে ফুটন্ত পানিতে চুবিয়ে চুবিয়ে তার চামড়া ঝলসে দিতো। ধ্রুব মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল, বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য হলেও সে তাকে জানে মারবে। কসম!
______
-‘আজব! এভাবে বাঁইধে রাখছেন ক্যান আমারে? কামরুল ভাই, এসব কেন করতাছেন?’
রেজার চিৎকার শুনে কামরুল রেগেমেগে তেড়ে এলো তার দিকে। এতোদিন যাকে ভাই সমতুল্য ভেবেছিলো সে এমন বেইমানি করবে সেটা ভেবেছি তার গা গুলিয়ে আসছে। সে প্রচন্ড বাজে খিস্তি ছুঁড়লো রেজার উদ্দেশ্যে,
-‘তোরে ভালো ভাবছিলাম। তুই এমন বেইমানি করলি কেন রেজা? ভাইরে ধোঁকা দিলি? কেমনে পারলি? বুক কাঁপে নাই?’
রেজা ভীরু চোখে চাইল পাশের চেয়ারে বেঁধে রাখা আরমানের দিকে। আরমান তার দিকেই তাকিয়ে। অবাক হয়ে। রেজা চোখ সরিয়ে কামরুলের দিকে তাকিয়ে আর্তনাদ করে বলল,
-‘ কি বলতাছো কামরুল ভাই? আল্লাহ! আমি ভাইরে ধোঁকা দিমু? আল্লাহর পাপের ভয় নাই আমার?’
-‘থাকলে এমন করতিস?’
তন্মধ্যে সেখানে নাহিদ নামে একটা ছেলে উপস্থিত হলো। কামরুলের সাথের লোক। সে এসেই বলল,
-‘কামরুল ভাই, ভাই আসতেছে।’
কামরুল তাকাল একবার রেজার দিকে। তার মুখ শুকিয়ে এইটুকুন হয়ে গিয়েছে। কামরুল তার শুকনো মুখের দিকে চেয়ে বলল,
-‘এবার যা কওয়ার ভাইরে কইস। ভাই বিচার করবো তোর।’
রেজা ভীতু হলো। আড়চোখে তাকাল আরমানের দিকে। ইশারায় সাহায্য চাইলে তিনি মুখ ফিরিয়ে নিলেন অন্যদিকে। রেজা হতবাক হয়ে গেল। কার জনয় কাজ করলো এতোদিন? কার জন্য বেইমানি করলো? সে-ই তো তার সাথে বেইমানি করছে এখন।
ধ্রুব ভেতরে এলো পকেটে হাত গুঁজে। সাথে রাহাত, রাফি এসেছে। সে এসেই আরমানের মুখোমুখি বসলো। আরমান সাহেব তাকে দেখেই ক্ষুব্ধ হলেন,
-‘এই ছোকরা! তুমি আমাকে এভাবে নিয়ে আসছো, তোমার সাহসের বালাই করা লাগে। ছাড়ো আমাকে!’
ধ্রুব হাসে,
-‘এতো রাগছেন কেন? বেশি রাগা উচিত না।’
-‘এই, এই! তুমি এখন আমাকে রাগা উচিত কি উচিত না শেখাবে? বাপের বয়সী লোকের সাথে এমন করছো লজ্জা করে না?’
-‘আপনার নিজের ছেলের বয়সী ছেলের সাথে লাগে লজ্জা করলো না?’
-‘কি করেছি আমি? আমাকে হুমকি দাও তুমি? চেনো আমাকে?’
-‘ডিটেইলসে বলব? লজ্জায় মুখ লুকাতে হবে আপনার।’
আরমান ভ্রু কুঁচকে তাকান,
-‘মানে?’
ধ্রুব হাসল। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে পকেট থেকে ফোন বের করলো। ঝুঁকে এসে একটা ভিডিও ওপেন করলো আরমানের সামনে। আরমান আঁতকে উঠলেন ভিডিওটা দেখে৷ একটা মেয়ের সাথে তার অন্তরঙ্গ মুহুর্তের ভিডিও এটা। তিনি চকিতে তাকালেন ধ্রুবর দিকে। ধ্রুব হাসল। প্রচন্ড দুঃখ প্রকাশ করে বলল,
-‘এই ভিডিওটা আপনার প্রত্যেকটা ফ্যামিলি মেম্বারের কাছে যাবে। আপনার মেয়ের শ্বশুরবাড়িতেও যাবে। ইভেন, পাবলিকও হবে। তারপর আপনার নাম-ধামের কি হবে? আপনার এতো পরিচয়, এইসব রেপুটেশন কোথায় যাবে আঙ্কেল?’
আরমান সাহেব ভড়কে গেলেন। আতংক গ্রাস করে ফেললো তাকে। নিজের ছেলের বয়সী ছেলের সামনে এসবের স্বীকার হওয়া নিতান্তই লজ্জাজনক ব্যাপার। ওনার প্রবল আত্মসম্মানে তা ঘা করলো। অস্বস্তিতে গাঁট হয়ে বসে রইলেন তিনি। ধ্রুব এবার বলল,
-‘আচ্ছা, এবার বলেন। ইনায়ার এক্সিডেন্টের পেলে কার হাত আসলে?’
উনি তরতর করে ঘামছেন। ধ্রুব তীক্ষ্ণ চোখে চাইল। কর্কশ গলায় বলল,
-‘কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি।’
-‘আমি কিছু করিনি। আমি কিছু জানি না।’
ধ্রুব হাসল। চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। পাশের টেবিলে রাখা চাকুটা হাতে নিয়ে আরমানের পিছে গিয়ে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
-‘যদি কিছু না-ই জানেন, তবে আপনার বেঁচে থেকে কি লাভ?’
আরমান চমকালেন। বলতে চাইলেন,
-‘মানে?’
তবে কিছু বলার আগেই ধ্রুব তার মাথার চুল একহাতে খাবলে ধরলো। টেনে পিছনের দিকে আনলো। আরমান চোখ বড়বড় করে তার দিকে তাকালেন। ধ্রুব সামনে তাকিয়ে তার চুল টেনে ধরা অবস্থাতেই তার গলায় ছুড়ি চালাল। এক পোঁচে রক্ত ছিটিয়ে বেড়িয়ে এলো। ধ্রুব সরে দাঁড়ালো৷ আরমান তখন ছটফট করছেন যন্ত্রণায়।
ধ্রুব তার সামনে এসে দাঁড়িয়ে তার চোয়াল চেপে ধরলো। মুখ কাছে নিয়ে এলো। হাতের চাকুটা দিকে তাকিয়ে রেজার দিকে তাকালো একবার। রেজা ভীতু চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ঘামে গলা বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। ভয়ে বুক ধরফর করছে। ধ্রুব মিষ্টি করে হাসল তার দিকে চেয়ে। তার পরপরই ছুরি দিয়ে লাগাতার আরমানের চোখে আঘাত করতে লাগলো। লাগাতার! যেভাবে আরাফের সাথে করেছিলো। ধ্রুবর মুখে রক্ত ছিটিয়ে এসে লাগলেও তার বিশেষ ভাবাবেগ হলো না। সে একই কাজ করতে লাগল। বারবার! বারবার! বারবার! এক পর্যায়ে সে থামলো। শ্বাস ফেললো এলোমেলোভাবে। শান্ত হলো কিছুটা। এরপর একদম হুট করেই পাশ ঘুরে ছুড়ি দিয়ে কোপ বসালো রেজার কপাল বরাবর। একেরপর এক কোপ বসিয়েই গেলো।
কামরুল রেজার পাশে দাঁড়িয়ে চমকে উঠলো। এমনটা অপ্রত্যাশিত ছিল। রাহাতরা আশ্চর্য হয়ে একে অপরের দিকে তাকাচ্ছে। ধ্রুব ততক্ষণে উন্মাদ হয়ে গিয়েছে। আগপর ব্যাপারটা স্রেফ তার স্ত্রীর হলেও, এবার তার স্ত্রীসহ তার বাচ্চার ব্যাপার এটা। তার স্পর্শকাতর জায়গায় হাত দেওয়া হয়েছে, তাকে ধোঁকা দেওয়া হয়েছে। এসব সে কি করে বরদাস্ত করবে? এত সহজে ছাড় দিয়ে দেবে? ধ্রুব শুধু কপাল না, গলাসহ বুকের কোপ বসালো। পৈশাচিক আনন্দ পেলো প্রচন্ড।
রাহাত গিয়ে টেনে ধরলো তাকে। জোর করে সরিয়ে আনলো। ধ্রুব হাজার ছোটাছুটি করেও ছাড়াতে পারলো না নিজেকে। একপর্যায়ে মাটিতে বসে পড়লো। আচমকা চিৎকার করে উঠলো ও। শব্দ করে কেঁদে উঠলো। কামরুল, রাফি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এসব কি হচ্ছে তাদের প্রসেস করতে সময় লাগছে। রাহাত শান্ত করতে চাইলো তাকে। ধ্রুব তখনও কাঁদছে। চিৎকার করে। আচমকা বুকে ব্যথা হচ্ছে খুব। বুক ফেটে আসছে যেন। এরা এমন করে না ঠকালে তার বাচ্চা বেঁচে থাকতো। ইনায়া হসপিটালের বেডে পড়ে থাকতো না। তাদের সুস্থ স্বাভাবিক একটা সংসার হতো। হতো না? তাকে কিছু সময়ের জন্য এমন মরণ যন্ত্রণা ভোগ করতে হতো না। এমন অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকতে হতো। তার ভেতরে কি হচ্ছে সে কাকে দেখাবে? কি করে বোঝাবে? তার বাচ্চাটার কি দোষ ছিলো? সে তো পৃথিবীতে এলোও না। তার আগের শত্রুতার স্বীকার হতে হলো তাকে। এসব কেন হলো? এতো প্রশ্নের উত্তর আছে কি? থাকলে তাকে দেয়া হোক।
(#চলবে….)