ক্রাশ ইন দ্য সি পর্ব-০১

0
31

#সূচনা_পর্ব(০১)
#ক্রাশ_ইন_দ্য_সি
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

“ সেদিন ফেসবুকে নিউজ দেখলাম। প্রেমের টানে কোরিয়ান যুবক বাংলাদেশে চলে এসেছে। তোর নেভিয়ান সাহেব প্রেমের টানে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ কবে আসবে শুনি? ”

শায়লার ঠাট্টাতে তেমন ভাবান্তর হলো না মেয়েটির। সে আগের মতোই গোমড়ামুখে বসে রইলো অদৃশ্যে তাকিয়ে। শায়লার পর এবার পাভেল মাথায় গাট্টা মেরে বলল,

‘ তোর নেভিয়ান বোধহয় এতোদিনে বিয়ে করে বাচ্চা পয়দা করে বসে আছে। সংসার, চাকরি নিয়ে ব্যস্ত৷ সেজন্য তুই তাকে ফেসবুকে পাচ্ছিস না। আহারে, কাঁদিস না। আমার চাচাতো এক ভাই মেরিন একাডেমিতে আছে। তুই বলিস তো আমি তার সাথে তোর একটা ব্যবস্থা করে দিবো। ’

মেয়েটির শ্যামলা মুখটা রাগে কালো হয়ে গেলো। অগ্নি দৃষ্টিতে তাকালো বন্ধু নামক কালসাপদের দিকে। শায়লা পানির বোতল এগিয়ে দিলো,

‘ পানি খা। মাথা ঠান্ডা কর। বিষয়টা বুঝতে চেষ্টা কর। ’

মেয়েটির চোখ টলমল করে উঠলো। পাভেল বলল,

‘ দোস্ত হতে পারে ওই আইডিটা ফেইক। ফেইসবুকে এরকম কতো আছে। যদি সে ফেইক না-ও হয়ে থাকে, আর আইডি ডিলিট করে সে যদি সংসার করতে বিজি থাকে তাতে তার কোনো দোষ দেওয়া যাবে না। আমরা তাকে চিটার উপাধি দিতে পারবো না। ’

মেয়েটি এসব জানে, বুঝে। তবুও মন মানতে চায় না। কলেজ ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে সে দৌড়ে বেরিয়ে গেলো ক্যান্টিন থেকে। পাভেল ও শায়লা পেছন থেকে ডাকলো,

‘ মেহের! ’

মেয়েটি গেইট পেরিয়ে গেছে। শায়লা হতাশ হয়ে বলল,

‘ মেহুর কি হবে বল তো! ’

‘ কিছু হবে না। কলেজ পাশ করতে দে। ফ্যান্টাসি কমে যাবে। সারাক্ষণ প্রেমের উপন্যাস পড়ে। সেজন্য ওর মাথায় এসব কিলবিল করে। ’

পাভেলের কথাই হয়তো সত্যি। শায়লা তবুও বান্ধবীকে নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলো। মেহু অনেক নরম একটি মেয়ে। অতিরিক্ত আবেগি। কে জানে হয়তো গল্প উপন্যাস পড়া সবাই এমনই আবেগি হয়ে থাকে।

শায়লা মনে মনে অপরিচিত, অদেখা ভীনদেশী সেই নেভিয়ান পুরুষকে কয়েকটা গালি দিলো।

‘ আল্লাহ রুপ যৌবন দিছে বলে ফেবুতে নায়ক সেজে ছবি পোস্ট করতে হবে কেন? হাজার হাজার মেয়ের রাতের ঘুম কেঁড়ে নেয়। অথচ বাস্তবে এরা হলো আক্কেল আলী। নিজের বান্ধবীকে শায়লা এতোদিনে এটাই বুঝাতে পারলো না যে, ছবি ও বাস্তবে মানুষ দেখতে আলাদা অন্যরকম হয়। দেশরক্ষা করবি কর, তোরে ফেসবুকে ছবি পোস্ট করে মাইয়াদের হার্টে ফুটা না করলে হয় না? যত্তোসব।

*

বিছানায় কলেজ ব্যাগটা ছুঁড়ে ফেললো মেয়েটি। কলেজ ইউনিফর্ম না পাল্টিয়েই শুয়ে পড়লো বিছানায়। ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করে প্রবেশ করলো ফেসবুকে। কাঙ্ক্ষিত আইডিতে মেসেজ করা যায়। কিন্তু প্রোফাইলে ঢুকা যায় না। আজকের মতো তৃতীয়বার মেসেজটি পাঠালো সে। ছয়মাস ধরে ফলো করা আইডিটা গত কয়েকদিন হলো বন্ধ। বরাবরের মতো মেয়েটি মেসেজ করে। কিন্তু সবসময়ের মতোই তার মেসেজ ঝুলে থাকে মেসেজ রিকুয়েষ্ট অপশনে।

রান্নাঘর থেকে জাহানারা বেগম মেয়েকে ডাকলেন। কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে খুন্তি হাতে ছুটে এলেন মেয়ের ঘরে। মেহের মাকে দেখে উঠে বসলো।

‘ এখনও কলেজ ড্রেসটাই পাল্টাসনি। কখন থেকে খেতে ডাকছি। কোচিং এ যাবি কখন? ’

মেহের ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল,

‘ আজকে কোচিং এ যেতে ইচ্ছে করছে না মা। ’

‘ হাতের দিকে দেখেছিস? এটার বারি যদি না খেতে চাস তো জলদি খেয়ে কোচিং এ যা। ’

কাজ হলো। মেহের কলেজ ড্রেস পাল্টে গোসল করে খেয়ে ছুটলো কোচিং এ। সামনে তার এইচএসসি পরীক্ষা। হাজার বাহানা দিলেও মা ফাঁকি দিতে দিবে না।

কোচিং শেষ হতে হতে বিকেল ঘনিয়ে এলো। শায়লা ও সে একই কোচিং সেন্টারে পড়ে। গোধূলির আকাশ লাল রঙে রঙ্গিন। ফুচকা স্টলে ব্যাপক ভীড়। মেহের না চাইলেও শায়লা টেনে নিয়ে গেলো। গপাগপ ফুচকা খেয়ে দুজন ফুটপাত দিয়ে হাঁটতে লাগলো।

‘ তোর মন ভালো হলো? ’

মেহের ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে বলল,

‘ ভালো লাগছে। ’

কিন্তু মেহের ভালো নেই। মনে এক ধরনের ব্যথা। যার কথা কাউকে বলতে নেই। মেহের ঠিক করেছে তার বন্ধুদের আর কিছু বলবে না। ওরা হয়তো মজা করে হাসিঠাট্টা করে। ওই মানুষটাকে হয়তো গালাগালি করে। এসব মেহেরের মনে আঘাত করে। তার কষ্ট দ্বিগুণ বেড়ে যায়।

ঢিলেঢালা লং শার্ট পড়োনে, কাঁধ পর্যন্ত কালো কুচকুচে চুলে তাকে নিতান্তই কিশোরী মনে হয়। মেহের সদ্য আঠারোতে পা রেখেছে। ওই মানুষটাকে সে স্টোক করতে শুরু করেছে সতেরো বছর বয়সে। এইযে আঠারো হলো, এরপর বছর পেরিয়ে যেতে যেতে বয়স বাড়তেই থাকবে। মেহের কি কখনও ভুলতে পারবে তাকে? শায়লার বলা কথাই কি সত্যি হবে? মেহের কি গল্প উপন্যাস পড়ে ফ্যান্টাসিতে ভুগে ওই মানুষটাকে নিয়ে ভাবতো?

শীতকাল পুরোপুরি আসেনি। কিন্তু বিকেলের এই সময়টায় হালকা শীত শীত অনুভব হয়৷ ফুটপাতের ওইপাশে ব্যাডমিন্টন খেলছে একদল কিশোর। মেহের শূন্য দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে আছে। শায়লার দেওয়া কত-শত জ্ঞান তার কানেই ঢুকলো না।

আরব সাগরের তীরে অবস্থিত কারাচি পাকিস্তানের দক্ষিণে অবস্থিত। গ্রীষ্মপ্রধান শহর হলেও সমুদ্রের কাছাকাছি হওয়ায় বাতাস সাধারণত ঠান্ডা৷ শীতকাল হালকা ও আরামদায়ক। শহরটি দেশের প্রধান সমুদ্রবন্দর হিসেবে পরিচিত।

বিকেলের লাল-সোনালি আলো ছড়িয়ে পড়েছে আকাশ থেকে সমুদ্রে। সমুদ্র তীরে উটের উপর কুর্তা-পাজামা পরিহিত একজন আঠাশ বছর বয়সী লম্বা চওড়া যুবক বসে আছে। বালুতে নেমে সে প্রাণীটির গলার কাছের রশিতে ধরে সমুদ্রের তীর ঘেষে হেঁটে যেতে লাগলো অনন্ত পথ।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসতে তেমন দেরি নেই। সমুদ্র তীরে মানুষজন কমই বলা যায়। হয়তো কিছুক্ষণ পর চারিদিক নির্জন হয়ে যাবে। যুবকটি উঠের মালিক কে উট ফিরিয়ে দিয়ে নিজের পথ ধরলো।

বালুচর পেরিয়ে রাস্তায় উঠে আসতেই তার মোবাইল শব্দ করে বেজে উঠলো। রিসিভ করে গম্ভীর অথচ তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বলল,

“ লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আমান খান স্পিকিং। ”

কথা বলে মোবাইলটা পকেটে চালান করলো পুরুষটি। ডাক এসেছে তার। যাওয়ার সময় এগিয়ে এসেছে। কয়েকটা দিন সবকিছু থেকে নিজেকে দূরে রেখেছিল সে। নিজের মতো কাটিয়ে অবশেষে আবারও ফিরতে হচ্ছে কর্তব্য পালন করতে।

বিশাল হোটেল রুমে ফিরে সে প্রথমে শাওয়ার নিলো। তারপর গায়ে জড়ালো তার পদমর্যাদার প্রতিফলক তার ইউনিফর্ম। পায়ের বুট জুতোর ফিতে বেঁধে ডায়াল করলো একটি নাম্বারে।

“ আসসালামু আলাইকুম। যা রাহি হুন আম্মি৷ দোয়া কারেন গে। আল্লাহ হাফেজ।

“ সালামত রেহনা বেটা। খোদা হাফেজ। ”

তারপর সাদা পোশাক পরিহিত পাকিস্তানের নেভির দক্ষ অফিসারটি সমস্ত পিছুটান ফেলে এগিয়ে চললো নিজের গন্তব্যের দিকে।

*

এই সময়টা মেহেরের পড়ার সময়। মেয়ের রুম থেকে ডিজে গানের শব্দ ভেসে আসছে। জাহানারা বেগম দরজায় ধাক্কা দিলেন। চিল্লিয়ে বললেন,

‘ কি করছিস তুই মেহের? ’

মেহের এতোক্ষণ বিছানায় লাফালাফি করছিল। মোবাইলের গানটি বন্ধ করে সে বিছানা ঠিকঠাক করে দরজা খুলে দিলো। জাহানারা বেগমকে আমতা আমতা করে বলল,

‘ এমনই নাচতে ইচ্ছে করছিল মা। ’

জাহানারা বেগম রাগ করতে গিয়ে হেসে ফেললেন।

‘ দুপুরে মন খারাপ ছিল না তোর? আমি তোর জন্য পকোড়া করেছি। খাবি আয়। ‘

‘ মন ভালো হয়ে গেছে মা। তুমি যাও আমি আসছি। ’

জাহানারা বেগম চলে যেতেই মেহের মোবাইল স্কিনে ঠোঁট ছুঁয়ে লজ্জায় মুখ ঢাকলো। তারপর লাজে রাঙা মুখ তুলে আবারও তাকালো মোবাইল স্কিনে থাকা ছবিটার দিকে।

কুর্তা-পাজামা পরিহিত সৌম্য পুরুষটি উট নিয়ে লালচে রঙা বিকেলে বালুচর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।

আজ ছয়দিন পর তার আইডি অন হয়েছে। সাথে পোস্ট করেছে নিজের সেই ছবিটি। মেহেরকে আজ পায় কে?

(চলবে)