ক্রাশ ইন দ্য সি পর্ব-০৪

0
20

#ক্রাশ_ইন_দ্য_সি
#পর্ব_০৪
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

পরদিন চট্টগ্রামে মায়ের সাথে বাবার কাছে চলে গেলো মেহের। চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে দাড়িয়ে বাবাকে জিজ্ঞেস করেছিল,

‘ এখান দিয়ে তো নেভিরা যাতায়াত করে তাই না বাবা?’

‘ হ্যাঁ। ’

‘ অন্য দেশের নেভিরাও কি আসতে পারে? ’

‘ আসতে পারে। ’

‘ পাকিস্তানের নেভিয়ানরাও? ’

‘ পারে মা। ’

‘ ওরা কেন আসে বাবা? ’

‘ ফ্রেন্ডশিপ বা চুক্তি করতে আসে। ’

‘ আজ কি ওরা আসবে? ’

মাসুদ রানা মেয়ের কথায় হেসে ফেললেন।

‘ অনেক দেশেরই অফিসাররা আসে মা। পাকিস্তানের ওরা ও এসেছে অনেকবার। আবার কবে কখন কোনো চুক্তির দরকার হবে সে তো বলা যায় না। তবে আজ হয়তো আসবে না। ’

মেহের মন খারাপ করে বলল,

‘ তুমি হাসছো কেন বাবা? ’

‘ নাথিং মাই চাইল্ড। তোমার কি তাদের দরকার? ’

‘ বাবা আমি তোমার কাছে কখনও কিছু চাইলে দিবে? ’

‘ কখনও নয়, তুমি সবসময়ই যা চাইবে তোমার বাবা সাধ্যমতো তা দিতে চেষ্টা করবে। ’

‘ তুমি তো আমার বেস্ট ফ্রেন্ড বাবা। আমি তোমাকে বেস্ট ফ্রেন্ড মনে করে একটা কথা বলি? ’

‘ বলো মেহের। ’

মেহের অশ্রুসিক্ত চোখে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘ তোমাকে একজনের ব্যাপারে খুঁজ নিতে হবে বাবা। পারবে? ’

‘ বলেই দেখো। ’

‘ পাকিস্তানের একজন নেভি অফিসারের খোঁজ নিতে হবে তোমায়। ’

মাসুদ রানা চমকালেন না। শুধু বললেন,

‘ নাম ও পদবী জানা আছে? ’

‘ তুমি জিজ্ঞেস করবে না আমি কেন তার খোঁজ নিতে বলছি? ’

‘ না। তোমার পার্সোনাল কিছু ও হতে পারে। তবে তুমি চাইলে শেয়ার করতে পারো। তোমার মা জানতে পারবে না। ’

‘ আমি তোমাকে আপাতত কিছু বলবো না বাবা। তার খোঁজ এনে দিতে পারলে বলবো। ’

‘ ঠিক আছে মা। ’

‘ তার নাম আমান খান। পাকিস্তানের নেভির লেফটেন্যান্ট কমান্ডার। ’

‘ আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। তাকে কি তোমার কথা বলতে হবে? বা তুমি কি তাকে কিছু দিতে চাও? ’

মেহের ছলছল চোখে তাকিয়ে ডাকলো,

‘ বাবা! ’

‘ বলো? ’

মেহের বুকে আছড়ে পড়লো,

‘ তুমি আমাকে জাজ করছো না কেন বাবা? তোমার আচরণ একদমই বাবাদের মতো নয়। ’

‘ তুমি আমার মেয়ে মেহের। আমি আমার অস্তিত্বকে বিশ্বাস করি। যা-ই করবে কোনো কারণ ছাড়া করবে না। বাবা সবসময়ই তোমার পাশে আছি। যখন তোমার মন চাইবে আমাকে জানিয়ে দিও কারণটা। কারণ আমি তো বাবা। কৌতূহল দমন করে রাখলেও তোমাকে নিয়ে চিন্তাটা চলেই আসে। ’

‘ আমি তোমাকে অনেক ভালোবাসি বাবা। ’

মাসুদ রানা হাসলেন,

‘ চলো ফিরে যাই। তোমার মা অপেক্ষা করছে। ’

‘ তুমি কি মাকে অনেক ভয় পাও? ’

‘ কিছু টা, তুমি? ’

মেহের মুখ চেপে হাসলো,

‘ আমি অনেকটাই ভয় পাই। ’

‘ তোমার মা তোমাকে অনেক ভালোবাসে। ’

‘ আমি জানি বাবা। ’

তাদের বাবা মেয়ের কথা চলতে থাকলো। মেহেরের মন থেকে কালো মেঘেরা সরে যেতে লাগলো ধীরে ধীরে। সে কিছু ঝিনুক কুড়িয়ে নিলো। সমুদ্রের কাছাকাছি আসাতে তার মন ফুরফুরে৷ এমনই কোনো সমুদ্রে সে ও তো রয়েছে। আচ্ছা সে কি কখনো কোনো চুক্তি করতে বাংলাদেশে আসবে?

তারা উঠেছে হোটেলে। মাসুদ রানা হোটেলের দিকে যেতে যেতে বললেন,

‘ এক নামে এক পদে অনেকেই থাকতে পারে। তুমি আমাকে তার কোনো ছবি দিতে পারবে? ’

‘ আমি পাঠিয়ে দিবো বাবা। ’

জাহানারা বাপ মেয়েকে রুমে আসতে দেখে বললেন,

‘ আসার সময় হলো দুজনের। বাবাকে পেলে তো আমাকে মনেই থাকে না। আমার কাছে থাকলে তার শুধু মুড সুইং হয়। এক কাজ করো তোমার মেয়েকে তোমার কাছেই রেখে দাও। আমি একাই ঢাকাতে পড়ে থাকবো না-হয়। ’

মাসুদ রানা বললেন,

‘ আমার মামনির আর মুড সুইং হবে না। কারণ আবদার পূরণ করতে তার বাবা হাজির। পরীক্ষা শেষ হলে চট্টগ্রামে পার্মানেন্ট চলে আসবে তোমরা। একা থাকতে ভালো লাগে না। কাজ শেষে বাড়ি ফিরে তোমাদের হাসিমুখ না দেখলে আমারও মুড সুইং হয়। ’

‘ তোমার মেয়ের যে পরে এডমিশনের জন্য ঢাকা ছুটতে হবে তখন? ’

‘সে তো এডমিশনের জন্য চট্টগ্রাম ও ছুটে আসতে হতো। না-হয় চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাতে গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে আসবে। কি মামনি? ’

মেহের অনেক খুশি। সমুদ্রের কাছাকাছি থাকাটা তার জন্য আরও ভালো।

‘ আমি রাজি বাবা। পরীক্ষা শেষ হলেই চলে আসবো। ’

জাহানারা বললেন,

‘ তোমাদের যখন অসুবিধা নেই তবে আমার আর কি? তোমরা যেখানে আমিও সেখানে। ’

মেহেরের রুমটা পাশেরটাই। সে নিজের রুমে গেলো। পছন্দের আইডিতে লিখে পাঠালো,

‘ সমুদ্রের কাছাকাছি থাকার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। আমার কাছে সমুদ্র মানে আপনিই আমান। সমুদ্রের একেকটা ঢেউ আমাকে আপনার দিকে টেনে নিয়ে যেতে চায়। আমি কোনো এক ঢেউয়ের সাথে আপনার কাছে ভেসে চলে যাবো কখনো। ’

‘ আচ্ছা আপনি কোথায় আছেন আমান? আমি যে হোটেল রুমে আছি সেটার বারান্দাটা কাঁচের। কাঁচের মধ্যে সমুদ্র স্পষ্ট দেখা যায়। নীল আকাশ ও নিচে গভীর সমুদ্র। আপনিও কি এমনই কোনো সমুদ্রে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন? সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আমাকে মনে করবেন কখনও? একবার মনে করবেন প্লিজ। অজান্তে হলেও আপনার একবার বুক কেঁপে উঠুক৷ আপনি না জানলেও আপনার অবচেতন মন বুঝতে পারুক কেউ একজন সমুদ্রের কাছাকাছি দাড়িয়ে আপনাকে কি গভীর ভাবে মনে করে চলেছে। ’

‘ গতকাল যার সাথে আপনার ছবি দেখে মন খারাপ করলাম, পরে কমেন্টস চেক করে দেখলাম সে আপনার বোন হয়। কি বোকা আমি। মিথ্যা হোক বা সত্য, আপনাকে অন্য কারও সাথে আমি মেনে নিতে পারবো না। আপনি অন্য কারও হলে আমার মৃত্যু হোক। ’

‘ আমি আপনাকে এক সমুদ্র আবেগ নিয়ে ভালোবাসি আমান। আমার কাছে আপনি নিজেই একটি গভীর সমুদ্র। যার মধ্যে আমি তলিয়ে গেছি, অথচ তীরে উঠতে পারছি না। ’

পাকিস্তান নেভি মূলত আরব সাগর এবং ভারত মহাসাগরের উত্তর-পশ্চিম অংশে কার্যক্রম চালায়। তাদের দায়িত্বের মধ্যে রয়েছে পাকিস্তানের উপকূলীয় অঞ্চল এবং এর অর্থনৈতিক অঞ্চলের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

দিগন্তের শেষ প্রান্তে সূর্য ডুবছে, গাঢ় কমলা আকাশ সমুদ্রের পানিতে মিশে এক অদ্ভুত রংয়ের ছায়া তৈরি করেছে। ওমান উপসাগরের শান্ত অথচ গভীর নীল জলরাশির বুকে পাকিস্তান নেভির অত্যাধুনিক যুদ্ধজাহাজ PNS Zulfiqar গর্জনের মতো এক দৃঢ় ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছে। জাহাজটি একটি ফ্রিগেট, যার আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রযুক্তি সমুদ্রের যেকোনো হুমকি মোকাবিলায় প্রস্তুত।

জাহাজের ডেকের উপরে একদল নাবিক সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছে। তিন-স্তরের ডেকের মাঝের অংশে থাকা রাডার টাওয়ার ঘুরতে ঘুরতে সমুদ্রের প্রতিটি সংকেত ধরার চেষ্টা করছে। জাহাজের মূল ব্রিজের ভেতরে অফিসাররা পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। তাদের নীল ইউনিফর্ম এবং দৃঢ় দৃষ্টিতে স্পষ্ট যে, তারা প্রতিটি সেকেন্ডের জন্য প্রস্তুত।

ব্রিজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আমান। তিনি সাগরের নীরবতার মধ্যে হেডফোন দিয়ে আন্তর্জাতিক নৌযোগাযোগ মনোযোগ দিয়ে শুনছেন। তার সামনে রাখা ইলেকট্রনিক নেভিগেশন চার্টে দেখা যাচ্ছে জাহাজটির বর্তমান অবস্থান। জাহাজের ক্রুদের একজন তার কাছে এসে রিপোর্ট দিল:

“ স্যর, রাডার বলতা হ্যায় ১২ নটিক্যাল মাইল দূর এক গাইর-মালুম জাহাজ কা সিগনাল মিল রাহা হ্যায়। ”

“হোশিয়ার রহো,” আমান শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন। তিনি জানেন, এই এলাকায় জলদস্যুদের আনাগোনা বা শত্রু দেশের গোয়েন্দা কার্যক্রমও হতে পারে।

যুদ্ধজাহাজটির সামনে রয়েছে একটি শক্তিশালী ৭৬ মিমি কামান, যা শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে সক্ষম। ডেকের পেছনের অংশে একটি হেলিপ্যাড, যেখানে একটি সিকোরস্কি হেলিকপ্টার দাঁড়িয়ে আছে। জাহাজের চারদিকে লেগে থাকা অ্যান্টেনাগুলো ওমান উপসাগরের প্রতিটি তরঙ্গ বিশ্লেষণ করছে।

জাহাজটি রাতের জন্য প্রস্তুত। লাল আলো জ্বলছে ডেকের বিভিন্ন অংশে, যা শত্রুদের দৃষ্টি এড়াতে ব্যবহার করা হয়। জাহাজের ইঞ্জিন থেকে মাঝে মাঝে হালকা গর্জন শোনা যাচ্ছে, যা মনে করিয়ে দেয় যে, এই যুদ্ধজাহাজ সবসময় চলাফেরার জন্য প্রস্তুত।

চারপাশের বাতাসে নোনাজলের গন্ধ। দূরে ওমানের পাহাড়ি উপকূলের ছায়া আবছা দেখা যাচ্ছে। সমুদ্র শান্ত থাকলেও মাঝেমধ্যে ঢেউ এসে জাহাজের গায়ে ধাক্কা দিয়ে ফিরে যাচ্ছে।

এমন দৃশ্যের মাঝে পাকিস্তান নেভির এই যুদ্ধজাহাজ শুধু শক্তির প্রতীক নয়, এটি সমুদ্রপথে শান্তি ও সুরক্ষার প্রতিশ্রুতি। তবে, এই সুনসান রাতের মাঝেও ক্রুদের চোখে-মুখে সতর্কতা — কারণ ওমান উপসাগর কখনোই পুরোপুরি শান্ত থাকে না।

(চলবে)