#ক্রাশ_ইন_দ্য_সি
#পর্ব-১২
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আমান খান, পাকিস্তান নৌবাহিনীর একজন দক্ষ কর্মকর্তা, এখন গভীর সমুদ্রে এক গুরুত্বপূর্ণ মিশনে। তার নেতৃত্বে জাহাজের দলটি একটি কৌশলগত মহড়া চালাচ্ছে। দায়িত্বের এই মুহূর্তে তার মনে কোনো দুর্বলতার জায়গা নেই। প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রতিটি নির্দেশ, তার সতীর্থদের জীবন আর দেশের নিরাপত্তার সাথে সরাসরি জড়িত। কিন্তু রাতের গভীরে, জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে, প্রশান্ত সমুদ্রের নীল অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে থাকা আমান নিজের চিন্তার গভীরে হারিয়ে যায়।
অল্প কিছুদিন আগে, বাংলাদেশে এক সামরিক মহড়ার সময় আমান নামটি শুনেছিল—মেহেরুন্নেসা। সেদিন এক সাধারণ সামাজিক সংযোগে পরিচিত এক ব্যক্তি বলেছিল,
“আপনার নাম আমান খান, তাই না? মেহেরুন্নেসা আপনাকে খুব ভালো চেনে। সে সবসময় আপনার কথা বলে।”
আমান তখন মৃদু হাসি দিয়ে শুধু মাথা নাড়িয়েছিল। কাজের ব্যস্ততায় সে বিষয়টিকে আর গুরুত্ব দেয়নি। তবে জানতে পারে কর্নেল জাহিদ এ ব্যাপারে এই ব্যক্তিকে বলেছেন।
কিন্তু আজ, সমুদ্রের বুকে যখন চারপাশ নীরব, তখন আমানের মনের মধ্যে সেই নামটাই বারবার প্রতিধ্বনিত হয়—মেহেরুন্নেসা।
“কে এই মেহেরুন্নেসা? কীভাবে সে আমাকে চেনে? কেন তার নামটা বারবার মনে পড়ছে?”
সে তার স্মৃতিতে বাংলাদেশের সেই কয়েকটি দিনের কথা ভেবে দেখতে চেষ্টা করে। মেহেরুন্নেসার চোখে কি কোনো বিশেষ উজ্জ্বলতা ছিল? না, মনে করা সম্ভব হয় না।
অন্যদিকে, মেহেরুন্নেসা গত এক বছর ধরে ফেসবুকে আমানকে দেখে তার প্রেমে পড়েছে। আমানের দায়িত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব, সামরিক পোশাকে তার দৃঢ় চেহারা, আর তার চোখের গভীরতা মেহেরকে মুগ্ধ করেছে। ফেসবুকে মেহের বারবার মেসেজ পাঠিয়েছে—সাধারণ শুভেচ্ছা, কুশল প্রশ্ন, কখনো নিজের অনুভূতিও। কিন্তু আমান সেই মেসেজ রিকোয়েস্ট কখনো খোলেনি।
মেহেরের বাবা, একজন বাংলাদেশি সেনাবাহিনীর কর্নেল, তাকে সবসময় শিখিয়েছেন সম্মানের সঙ্গে জীবনযাপন করতে। কিন্তু মেহেরের মন সেই সম্মানের পথেই আমানের দিকে টান অনুভব করে।
মেহেরের এই একতরফা ভালোবাসা একধরনের নীরব আর গভীর অপেক্ষায় রূপ নেয়। সে জানে, আমান তাকে কখনো চেনে না, কিন্তু তার এই ভালোবাসা কখনো মিথ্যে হতে পারে না।
জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের গর্জন শুনতে শুনতে আমান নিজের মনে অদ্ভুত এক অস্থিরতা অনুভব করে। তার মনের মধ্যে প্রশ্ন ওঠে—
“আমি কি নিজের দায়িত্বের কারণে কোনো বিশেষ মুহূর্ত ভুলে যাচ্ছি? এই নাম, এই মেহেরুন্নেসা, কেন বারবার আমার মনে আসছে?”
অমানিশার এই নীরবতায় তার মনের মধ্যে আরও কিছু কথা উঁকি দেয়। জীবনের এই যুদ্ধে, সমুদ্রের অগাধ দায়িত্বের মাঝেও, তার মনে কোথাও কি একটা শূন্যতা আছে? একজন সঙ্গীর অভাব, একজন মানুষের ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি? সে কখনো ভাবেনি যে এমন কেউ তাকে নিজের জীবনের অংশ হিসেবে ভাবতে পারে।
আমান মাথা ঝাঁকিয়ে নিজের মনকে সামলে নেয়।
*”আমি একজন সৈনিক। আমার কাজ আমার ইবাদত। ভালোবাসা কিংবা ব্যক্তিগত সম্পর্ক নিয়ে চিন্তা করার সময় আমার নেই।”
হঠাৎ এক সতর্কবার্তা আসে। রাডারে সন্দেহজনক কিছু ধরা পড়েছে। আমান সঙ্গে সঙ্গে নিজের দায়িত্বে ফিরে আসে। পুরো জাহাজে টানটান উত্তেজনা। তবে সংকট সমাধানের পর, যখন সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়ে, তখনও আমানের মনে সেই নাম—মেহেরুন্নেসা।
সমুদ্রের গভীর রাত যেন মেহেরের ভালোবাসার মতোই নিরব, অথচ গভীর। আমান সিদ্ধান্ত নেয়, ফিরে গিয়ে একবার হলেও সে এই নামটি খুঁজে বের করবে। তবে সেটি শুধু কৌতূহল, না কি অদ্ভুত এক আকর্ষণ—এখনও সে বুঝে উঠতে পারে না।
“আমার মন কি সত্যিই এই নামের কাছে বন্দি হতে শুরু করেছে?”
অন্যদিকে, মেহেরও একই রাত জেগে আমানের জন্য দোয়া করছে। সে জানে না, তার এই নীরব ভালোবাসা আদৌ কখনো আমান পর্যন্ত পৌঁছাবে কি না। কিন্তু তার মন বলে, আমান একদিন তার মেসেজ পড়বে, তার নাম জানবে, আর হয়তো তাকেও একটু গুরুত্ব দেবে।
সমুদ্র আর দুই দেশের দূরত্ব সত্ত্বেও, আমান আর মেহেরের জীবন যেন এক সূক্ষ্ম সুতোয় বাঁধা। আমানের মনের কৌতূহল আর মেহেরের একতরফা ভালোবাসা তাদের ভবিষ্যতের দিকে এক অজানা পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ের মতো, সময়ই একদিন তাদের মিলনের সাক্ষী হতে পারে।
মেহের চট্টগ্রাম ভার্সিটিতে চান্স পায়। জীবন জীবনের মতো চলে যাচ্ছে। কিন্তু আমানকে মেসেজ করা, পাগলামি করা থামায়নি। তার সাথে ঘটে যাওয়া প্রত্যেকটা ঘটনা সে আমানকে শেয়ার না করে থাকতে বারে না। আমান না জানুক, সে শেয়ার করবেই। এ যেন অদৃশ্য এক শান্তি। ভালোবাসার এই অধ্যায়ে মেহেরুন্নেসা কি শুধু দুঃখ কুড়িয়েই যাবে? আমান খানের কি কখনও সময় হবে এক কিশোরীর আবেগ পড়ে দেখার!
মিশনের পর আমান খান যখন কাজ থেকে ছুটি নিয়ে নিজ ঘরে ফিরে, তখন তার মাথায় মেহেরুন্নেসার নামটা বেশ জোরেশোরে জায়গা করে নেয়।
“মেহেরুন্নেসা… এই নামটা আমার মনে এভাবে জায়গা করে নিল কেন?”
সে চুপচাপ নিজের রুমে বসে থাকলেও এই চিন্তা তাকে ছাড়ে না।
পরের দিন সকালে, তার এক পুরনো বন্ধু, রেহান, ফোন করে। রেহান পাকিস্তান নৌবাহিনীর একজন বেসামরিক কর্মকর্তা এবং আমানের খুব কাছের বন্ধু। কথোপকথনের এক পর্যায়ে রেহান বলে,
*”তুই জানিস? এক মেয়ে ফেসবুকে আমাকে তোর ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিল। নামটা মেহেরুন্নেসা। আমার কাছে মনে হলো, মেয়েটা তোকে বেশ ভালো চিনে।”
এই কথা শুনে আমানের কৌতূহল বেড়ে যায়।
*”কী বলিস? ও আমাকে কীভাবে চেনে? আমি তো এমন কাউকে জানি না।”
রেহান হাসতে হাসতে উত্তর দেয়,
“মনে হয় তোর ভক্ত। তুই মেসেজ রিকুয়েস্ট চেক করে দেখ।”
বন্ধুর কথায় আমানের মনে সন্দেহ জাগে।
“আমার ভক্ত? এটা কেমন শোনাল! আমি তো এমন কিছু করি না, যাতে ব্যক্তিগতভাবে কেউ আমাকে অনুসরণ করবে। মেহেরুন্নেসা নামে একজনকেই সে জানে এমন একজন কেই তার মনে পড়ে। বাংলাদেশের সেই কর্নেল কন্যা। ”
তবে কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে সে ফেসবুকে গিয়ে রিকুয়েস্ট চেক করে।
মেহেরুন্নেসার মেসেজগুলো দেখেই আমান হতবাক হয়ে যায়। প্রথম মেসেজটি পড়তে গিয়ে সে কিছুক্ষণ থমকে থাকে।
*”সালাম, আমান। আমি জানি না, আপনি আমাকে চিনবেন কি না, কিন্তু আমি আপনাকে দীর্ঘদিন ধরে ফেসবুকে অনুসরণ করছি। আপনার প্রতিটি কাজ আমাকে মুগ্ধ করে। আপনি সত্যিই একজন প্রেরণাদায়ী মানুষ।”
মেসেজের শব্দগুলো তার মনে গভীর একটা ছাপ ফেলে। সে মেহেরের অন্য মেসেজগুলো খুলে পড়ে। প্রত্যেকটি মেসেজই সরল, বিনম্র, আর শ্রদ্ধা দিয়ে লেখা। কিন্তু তারপরই সব পাগলামি। ভালোবাসার কথা, অনুভূতি, আক্ষেপ, আফসোসে ভরা সব মেসেজ। প্রত্যেক দিনের ঘটনা সবই পড়লো আমান। দীর্ঘ এক বছরের মেসেজ পড়ে আমান স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। এমন পাগলামি কেউ কারও জন্য করতে পারে সেটা যেন অবিশ্বাস্য। আমান কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। তার চোখে ভাসছে অসুস্থ মেহেরুন্নেসাকে। তার মনে পড়লো বাংলাদেশ থেকে কর্নেল মাসুদ রানা তার সম্পর্কে জানতে চাইছিলেন। মেহেরুন্নেসা তার মেয়ে। তার মানে মেহেরুন্নেসার ইচ্ছেতেই তার সম্পর্কে জানতে কেউ আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। আমান নিজের চুলের মুটি চেপে ধরলো। বালিশে মাথা রেখে শূন্যে তাকিয়ে রইলো। এ যেন স্বপ্ন। এমন কেউ করতে পারে কখনও? এসব ও সম্ভব! মেহেরুন্নেসার ভালোবাসাকে সে কিভাবে নিবে? অল্প বয়সের আবেগ? কারও আবেগ এতো গভীর, এতো দীর্ঘস্থায়ী হয়?
মেসেজগুলো পড়ার পরও আমান কোনো উত্তর দেয় না।কিন্তু তার মনের ভেতর অদ্ভুত একটা অনুভূতি কাজ করে। হয়তো এই মেসেজগুলোই তাকে জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের দিকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। কিংবা কখনোই নিয়ে যাবে না। আমান যেদিকে নিয়ে যাবে সেদিকেই সেটা এগিয়ে যাবে। আচ্ছা আমান কি করবে এখন!
(চলবে)