#ক্রাশ_ইন_দ্য_সি
#পর্ব১৩ (শেষ পর্ব)
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
ভার্সিটিতে যেতে দেড় ঘন্টার মতো লাগে। তবুও মেহের হোস্টেলে উঠেনি। প্রতিদিন কষ্ট করে জার্নি করে কোয়ার্টারেই ফিরে আসে। আজও সন্ধ্যা নামার আগে সে কোয়ার্টারে ফিরলো। ফ্রেশ হয়ে সব ব্যস্ততা পাশে রেখে সে মোবাইল হাতে তুলে নিল। তারপরই তার চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। আমান তার মেসেজ সিন করেছে!
জীবন যথারিতি চলতে লাগলো। মেহের অপেক্ষা করতো আমানের তরফ থেকে কোনো উত্তরের। কিন্তু আসতো না। সিন করেই রেখেছে শুধু। মেহের ওইদিনের পর কোনো মেসেজ দেয়নি। টাইপ করার পর তার বুক কাপে। ভাবনায় চলে যায়। আমান তাকে কি চোখে দেখছে? তাকে কি সস্তা কেউ ভাবলো? নিজের মনের এসব ওভারথিংকিং এর জন্য মেহের আর মেসেজ দিতে পারে না। তার কান্না পায়।
একদিন ভার্সিটি থেকে এসে মেহের জানতে পারলো তাদের ঢাকার বাড়িতে মেহমান এসেছে। সে আর কেউ নয় আমান খান। বাংলাদেশে কি একটা কাজে আসা হয়েছে তাদের। তার ঠিক এক সপ্তাহ পর চট্টগ্রামে তার নামে পার্সেল আসলো। সেটাতে ঢাকায় ফেলে আসা নিজের ডায়েরি গুলো পেলো সে। সাথে একটা চিরকুট।
‘ আপনার অনুভূতি গুলো আমাকে প্রবাহিত করেছে মেহেরুন্নেসা। শীগ্রই দেখা হচ্ছে অপেক্ষা করুন। ’
তারপর শুরু হলো মেহেরের অপেক্ষা। অনেকমাস পর তাদের কোয়ার্টারে লোক সমাগম হলো। বড়ো বড়ো অফিসারের পা পড়লো। সাথে পা পড়লো পাকিস্তানের ওই নেভিয়ানের। কালো নিকাবে ঢাকা ছিল মুখটা। চোখ দুটো শুধু দেখা যাচ্ছিল। সেই মহিলটাটি মেহেরের হাতে আংটি পড়িয়ে দিলেন। মেহের তখনও হতভম্ব। সে অবাক হয়ে সবাইকে দেখছিল। একটু দূরে দাড়িয়ে থাকা আমানের তখন চোখ হাসছিল।
আংটি বদলের পর মেহেরুন্নেসার মনে যেন ঝড় উঠল। তার চারপাশে কোলাহল, আনন্দ, আর উৎসবের উচ্ছ্বাস—তবু তার ভেতরটা ছিল নীরব। আমান খান, যার জন্য এতদিন ধরে সে অপেক্ষা করেছে, যার নাম একসময় তার কল্পনার সীমায় আবদ্ধ ছিল, আজ তাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চলেছে।
কিন্তু একটা অদ্ভুত শূন্যতা কাজ করছিল মেহেরের মনে। কারণ, এখনো পর্যন্ত তাদের মুখোমুখি কথা হয়নি। তার মনে হাজারো প্রশ্ন ঘুরছিল—”আমান কি সত্যিই আমাকে ভালোবাসেন? নাকি এটা শুধু পারিবারিক আনুষ্ঠানিকতা?”
আংটি বদলের পর কাজীর মাধ্যমে বিয়ে হলো। সেই রাতটিতে মেহের ঘুমোতে পারেনি। তার ছোট্ট কোয়ার্টারের ঘরে শুয়ে সে বারবার নিজের অনুভূতির গভীরে ডুব দিচ্ছিল। নিজের মোবাইল ফোনে পুরনো মেসেজগুলো বারবার পড়ছিল। সেই মেসেজগুলো, যা এক বছর ধরে সে পাঠিয়েছে, কিন্তু আমান কখনো উত্তর দেননি।
“কীভাবে একজন মানুষ এতটা নির্লিপ্ত থাকতে পারেন?”—এমন চিন্তা বারবার তার মনের গভীরে এসে আঘাত করছিল। তবে সেই নির্লিপ্ততাই তাকে আকৃষ্ট করেছিল। আমানের ব্যক্তিত্বের সেই অনড় অথচ গম্ভীর ভাব তাকে এমন এক আবেগে জড়িয়েছিল, যা সে নিজেও বুঝতে পারেনি।
পরদিন সকালটা ছিল ব্যস্ততার। মেহেরের পরিবার তাদের মেয়ে বিদায় দেওয়ার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত। কক্ষের এক কোণে বসে মেহের নিজের মনকে স্থির করার চেষ্টা করছিল। তার মা এসে পাশে বসে বললেন,
“মা, তুই এত চুপ কেন? এতদিন তুই যে ছেলেটার স্বপ্ন দেখেছিস, আজ সে তোর আপন হয়েছে।”
মেহের কেবল মৃদু হেসে মাথা নিচু করল। এই কথার উত্তর দেওয়ার ভাষা তার কাছে ছিল না। সে তখনও বুঝতে পারছিল না, তার জীবনের নতুন অধ্যায় কেমন হবে।
গাড়ি এসে দাঁড়ানোর সময় মেহেরের বুকটা কেঁপে উঠল। বড় বড় সামরিক কর্মকর্তাদের ভিড়ে আমান খান একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাকে দেখে মেহেরের মনের গভীরে একটা চাপা উত্তেজনা তৈরি হলো, যদিও তা প্রকাশ করার সাহস সে পাচ্ছিল না।
গাড়ির ভেতর উঠে বসার সময় মেহের একবার পেছন ফিরে তাকাল। তার মা চোখ মুছছিলেন। তার বাবা সামরিক ভঙ্গিতে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বিদায়বেলায় চোখের জল লুকানোর চেষ্টা করেও তাদের চোখে গর্বের ছাপ স্পষ্ট ছিল।
মেহের আর আমান প্রথমবার এক গাড়িতে পাশাপাশি বসেছিল। কিন্তু কেউই কিছু বলছিল না। গাড়ির ভেতরে ছিল অদ্ভুত নীরবতা। মেহের আড়চোখে তাকিয়ে দেখল আমান জানালার বাইরে তাকিয়ে আছেন। তার মুখে কোনো অভিব্যক্তি নেই। মেহের পা রাখতে যাচ্ছে নতুন জীবনে। সেখানেই আনুষ্ঠানিক অনুষ্ঠান হবে। আমান খান যেন তাকে স্বপ্নে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। মেহেরের সব স্বপ্ন সত্যি করে দিচ্ছে।
মেহের ভেতরে ভেতরে একটা অদ্ভুত অস্বস্তি বোধ করছিল। এই মানুষটিই তার সব স্বপ্নের কেন্দ্রবিন্দু, অথচ তাকে কী বলা উচিত, তা বুঝে উঠতে পারছিল না।
যাত্রার শেষে তারা পৌঁছাল সমুদ্রতীরে, যেখানে আমানের সামরিক দায়িত্বের ঘাঁটি। মেহেরের জন্য একটি ছোট্ট বাসস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। ঘরে ঢুকে মেহের দেখল, সবকিছু সুন্দর করে সাজানো। বিছানায় তার প্রিয় ফুল ছড়ানো।
ঘরে ঢোকার পর আমান বললেন,
“তোমার জন্য অনেকদিন ধরে অপেক্ষা করছিলাম।”
মেহের চমকে উঠল। তার গলা শুকিয়ে এলো। এতদিনের স্বপ্নের মানুষটি মুখ খুলেছেন, অথচ সে কী বলবে, তা খুঁজে পাচ্ছিল না। কেবল মাথা নিচু করে বসে রইল।
সন্ধ্যায় চায়ের টেবিলে তাদের প্রথমবার আলাপ হলো। আমান ধীর স্বরে বললেন,
“তুমি কি জানো, তোমার মেসেজগুলো যখন প্রথম পড়ি, তখন আমি কী অনুভব করেছিলাম?”
মেহের হতভম্ব হয়ে তাকাল। আমান যোগ করলেন,
*”আমি কখনো ভাবিনি, কেউ আমাকে এত গভীরভাবে ভালোবাসতে পারে। তোমার সরলতা আমাকে ছুঁয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তোমাকে উত্তর দেওয়ার সাহস পাইনি।”
মেহের একটু থেমে বলল,
“তাহলে আমায় গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিলেন কেন?”
আমান হেসে বললেন,
*”কারণ তোমার অনুভূতিগুলো সত্যি। আর সত্যিকারের ভালোবাসা কখনো অবহেলা করা যায় না।”
মেহের ঢুক গিলে বলল,
‘ আমি কি আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারি? ’
‘ তুমি আমাকে সবসময়ই জড়িয়ে ধরতে পারো মেহেরুন্নেসা। ’
মেহের অশ্রু বিসর্জন দিলো। আমান তাকে জড়িয়ে নিলো গভীর ভাবে। কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
‘ মেহেরুন্নেসা মেরি বেগম! ’
সেদিন রাতেই তাদের জীবন নতুন দিকে মোড় নিল। মেহের বুঝতে পারল, তার অপেক্ষা বৃথা যায়নি। আর আমান শিখল, ভালোবাসা কখনো কল্পনার মধ্যে আটকে থাকে না—এটি বাস্তবতার পথ পেয়ে যায়।
এই নতুন জীবন, যেখানে দুজনের ভালোবাসা ও দায়িত্ব একসঙ্গে জড়িয়ে থাকবে, সেখানেই তাদের সুখ খুঁজে নিতে হবে। ভালোবাসা তো কখনো সহজ ছিল না, কিন্তু মেহের জানত, তারা একে অপরের জন্য যথেষ্ট।
“প্রকৃত ভালোবাসা সময়ের সঙ্গে আসতে পারে, কিন্তু একবার এলে তা চিরকাল থেকে যায়।”
(সমাপ্ত)