ক্রাশ_ইন_দ্য_সি পর্ব-০৫

0
19

#ক্রাশ_ইন_দ্য_সি
#পর্ব_০৫
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

রাত ক্রমশ গভীর হচ্ছে। আকাশে চাঁদ আধখানা, আর তার চারপাশে ছড়িয়ে থাকা তারা সমুদ্রের জলে প্রতিফলিত হচ্ছে। ওমান সাগরের ঢেউগুলো হালকা শব্দে জাহাজের গায়ে আছড়ে পড়ছে। ঢেউয়ের এই মৃদু গর্জন যেন একটি পুরোনো গান গাইছে। বাতাস ভারি, নোনা গন্ধে ভরা, আর এই নীরবতার মাঝেও সমুদ্র যেন গভীর কোনো গোপন কথা লুকিয়ে রেখেছে।

অজানা জাহাজটির সংকেত ধীরে ধীরে আরও পরিষ্কার হচ্ছে। লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আমান তার টিমের দিকে তাকিয়ে একটি কড়া নির্দেশ দিলেন,

“ সার্চলাইট তৈয়ার করো। অসলা তৈয়ার রখো। ”

দূরবীন দিয়ে দেখা যাচ্ছে, অন্ধকারের মধ্যে একটি জাহাজের আবছা ছায়া। এটি বাণিজ্যিক জাহাজ হতে পারে, আবার কোনো শত্রু জাহাজও হতে পারে। কেউ জানে না এই অন্ধকারে কী লুকিয়ে আছে।

জাহাজের ভেতরে কার্যক্রম তুঙ্গে। মেশিন রুমে ইঞ্জিনের শব্দ ক্রুদের কথোপকথনের চেয়ে জোরালো। রাডার রুমে প্রযুক্তিবিদরা মনোযোগ দিয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা দ্রুত তথ্য বিশ্লেষণ করছে এবং ব্রিজে রিপোর্ট পাঠাচ্ছে। ক্যান্টিনের এক কোণে কিছু নাবিক এক কাপ গরম চা হাতে নিয়ে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে, যদিও তাদের মুখে টেনশনের ছাপ স্পষ্ট।

সমুদ্রের মাঝখানে থাকা মানেই হলো অনিশ্চয়তার মাঝে ভাসা। এই নির্জনতা শুধু নাবিকদের শারীরিক পরীক্ষাই নয়, তাদের মানসিক দৃঢ়তারও চূড়ান্ত পরীক্ষা। গভীর রাতের অন্ধকারে সমুদ্রের নিচে হয়তো লুকিয়ে আছে সাবমেরিন, যা কোনো মুহূর্তে আঘাত হানতে পারে। আবার হয়তো কোনো জলদস্যুর জাহাজ ওৎ পেতে আছে শিকারের জন্য।

দূরে দিগন্তের কাছে হঠাৎ করে কালো মেঘ জমতে শুরু করেছে। এটি হয়তো একটি সামান্য ঝড়, আবার হতে পারে ওমান সাগরের beriberi বাতাসের পূর্বাভাস। ঢেউয়ের গর্জন বাড়ছে, আর জাহাজের ইঞ্জিনের গতি আরও ত্বরান্বিত হচ্ছে। ক্রুদের সবাই প্রস্তুত — কারণ সমুদ্রের মর্জি বদলাতে বেশি সময় লাগে না।

লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আমান জানেন, এই মিশন শুধুই একটি অভিযান নয়। এটি পাকিস্তানের সমুদ্রসীমা রক্ষার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। তাদের লক্ষ্য হলো উপসাগরের জলপথে শৃঙ্খলা বজায় রাখা, চোরাচালান বা শত্রুপক্ষের কার্যকলাপ থামানো এবং বাণিজ্যিক জাহাজগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করা।

পাকিস্তান নেভির যুদ্ধজাহাজ PNS Zulfiqar সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। রাডারের সংকেত ধীরে ধীরে আরও পরিষ্কার হচ্ছে। দূর থেকে অন্ধকারে আবছা দেখা যাচ্ছে একটি বিশাল বাণিজ্যিক জাহাজ। জাহাজটি কোনো সাড়া দিচ্ছে না।

জাহাজটি দেখতে বেশ পুরনো। ধূসর রংয়ের কার্গো জাহাজ, যার পেইন্ট উঠে গেছে, আর জং ধরা অংশগুলো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে। তারপরে, লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আমান সিদ্ধান্ত নিলেন, জাহাজটির দিকে একটি ছোট দল পাঠাতে হবে।

পেট্রোল বোটে করে তিনজন নাবিক এবং একজন অফিসার জাহাজটির কাছে পৌঁছে। কাছ থেকে দেখা যাচ্ছে, জাহাজটি সম্পূর্ণ নীরব। কোনো আলো জ্বলছে না, কোনো শব্দ নেই। জাহাজের ডেকে কোনো মানুষ দেখা যাচ্ছে না। নিচ থেকে ভাঙা জানালা দিয়ে বোঝা যাচ্ছে, জাহাজটি অনেক বছর ধরে পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে ছিল।

জাহাজে উঠতে গিয়ে এক নাবিক বলল, “ স্যর, ইহ জাগা আজীব লেগ রহি হ্যায়। ”

অফিসার তার দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, “ তুম দারোগে নহি। হামারা কাম খতম করো। ”

ডেকে পা রাখতেই এক ধরনের ভাঙা কাঠ আর লোহার গন্ধ নাকে লাগল। বাতাস ভারি আর নোনা। ভেতরে ঢোকার পর দেখা গেল, জাহাজের কার্গো হোল ফাঁকা। কোনো মালপত্র নেই। জাহাজের যন্ত্রপাতি পুরনো এবং ভেঙে গেছে।

হঠাৎ করেই একজন নাবিক নিচের ডেকে কিছু একটা দেখতে পেল। সেটি একটি লোহার ট্রাঙ্ক। অফিসার আদনান ট্রাঙ্কটি খুলে দেখতে বললেন। ভিতরে কিছু পুরোনো নথি এবং মানচিত্র পাওয়া গেল। এগুলোর মধ্যে কয়েকটি তেল পরিবহনের ডকুমেন্ট।

নথিগুলোর তারিখ ছিল ১৫ বছর আগের। তবে আরও কিছু জিনিস ছিল, যা পরিস্থিতি ঘোলাটে করল।

কয়েকটি লাল-কালো চিহ্ন দেওয়া মানচিত্র, যেগুলো জাহাজ চলাচলের রুটের ইঙ্গিত দেয়।একটি পুরনো রেডিও ডিভাইস, যা গত কয়েকদিনের মধ্যে ব্যবহৃত হওয়ার চিহ্ন দেখাচ্ছে।

এই অদ্ভুত আবিষ্কার আমানের মনে সন্দেহ তৈরি করল। তার মনে হলো, এই জাহাজটি হয়তো পরিত্যক্ত নয়। এটি হয়তো শত্রুদের কোনো পরিকল্পনার অংশ।

ঠিক এমন সময় রাডার রুম থেকে বার্তা এলো,

“ স্যর, হামনে এক অর সংকেত ধর লিয়া হ্যায়। ১০ নটিক্যাল মাইল পর এক তেজ রফতার জাহাজ হামারে তরফ আস রাহা হ্যায়। ”

আমান দ্রুত তার টিমকে ফিরে আসার নির্দেশ দিলেন। তিনি জানতেন, এই পরিত্যক্ত জাহাজটি হয়তো শত্রুপক্ষের ফাঁদ হতে পারে।

জাহাজ থেকে নেমে আসার সঙ্গে সঙ্গে যুদ্ধজাহাজ PNS Zulfiqar পুরোপুরি সতর্ক অবস্থানে চলে গেল। অস্ত্রগুলো সক্রিয় করা হলো, এবং জাহাজ দ্রুতগামী অবস্থায় শত্রুপক্ষের সম্ভাব্য উপস্থিতির জন্য প্রস্তুত হতে থাকল। আমান জানতেন, সামনের মুহূর্তগুলো সহজ হবে না।

রাডারের রিপোর্ট অনুযায়ী, ১০ নটিক্যাল মাইল দূরে থাকা দ্রুতগতির জাহাজটি অদ্ভুত আচরণ করছে। সেটি পাকিস্তানের যুদ্ধজাহাজের দিকে এগিয়ে আসছে, কিন্তু তার দিক বারবার পরিবর্তন করছে। লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আমান রাডার অপারেটরকে বললেন,‘জাহাজ কি রুখ দিখো। অগর ইহ সমুন্দরী ডাকুং কা হ্যায়, তো ফোরি রুখাও।’

কিছুক্ষণ পর ব্রিজে একটি সংকেত ভেসে এলো। অজানা জাহাজটি যোগাযোগের চেষ্টা করছে। তারা জানাল, “ হম এক তিজারতি তেলবাহি জাহাজ হ্যায়। হামারা জাহাজ নুকসান পোঁছা হ্যায়। মদদ দরকার হ্যায়। ”

তবে আমান সন্দেহ করলেন। কারণ এতদিন ধরে ওমান উপসাগরে অপহরণ এবং চোরাচালানের ঘটনা ঘটে আসছে। তিনি নিজেই রেডিওতে উত্তর দিলেন,

“ আপ কি পেহচান কি তাসদিক কারনি হোগি। আপ কা IMO নাম্বার বিহজেইন। ”

কিছু সময় চুপ থাকার পর তারা IMO নম্বর পাঠাল। আমান সেটি দ্রুত ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন এর ডাটাবেসে চেক করালেন। ফলাফল এল— নম্বরটি ভুয়া।

এবার আমান নিশ্চিত হলেন, এটি একটি শত্রুপক্ষের চাল।

সম্ভবত এই দ্রুতগতির জাহাজ জলদস্যুদের দল, যারা নেভির জাহাজকে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছে। অথবা এটি শত্রু দেশের কোনো গুপ্ত মিশন, যেখানে তারা পাকিস্তানের নৌসীমায় ঢুকে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ চালানোর পরিকল্পনা করছে।

অজানা জাহাজটি এবার আরও দ্রুত গতিতে পাকিস্তান নেভির দিকে এগিয়ে আসতে শুরু করল। আমান ব্রিজে দাঁড়িয়ে তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত দিলেন, “অসলা তৈয়ার করো। ইহতিয়াতি গোলি চালাও। ”

যুদ্ধজাহাজ থেকে সতর্ক গুলি ছোঁড়া হলো। অজানা জাহাজটি আচমকা দিক পরিবর্তন করল এবং পালানোর চেষ্টা করল। কিন্তু ঠিক এমন সময় রাডার দেখাল, আরও দুটি ছোট নৌযান পাশের দিক থেকে দ্রুত এগিয়ে আসছে। এদের গতি এবং আকার দেখে স্পষ্ট, এগুলো আক্রমণকারী জলযান।

সমুদ্রের লড়াইয়ের শুরু। আমান তার ক্রুদের নির্দেশ দিলেন, প্রধান কামান দিয়ে দ্রুতগতির জাহাজগুলোকে লক্ষ্য করতে। রাডার এবং অস্ত্রশস্ত্রকে আরও সক্রিয় রাখতে। একটি টহল নৌকা প্রস্তুত রাখতে, যাতে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যায়।

তীব্র গতিতে গর্জে উঠল জাহাজের কামান। প্রথম গুলিতেই একটি নৌযান ধ্বংস হলো। অন্য দুটি দিক পরিবর্তন করে পেছনে সরে গেল। কিন্তু দ্রুতগামী মূল জাহাজটি পালানোর চেষ্টা করছে।

ঠিক তখনই, যুদ্ধজাহাজের রাডারে আরও একটি সংকেত ধরা পড়ে। এটি ছিল একটি সাবমেরিন, যা সমুদ্রের গভীরে অবস্থান করছে। এটি সম্ভবত শত্রুপক্ষের এবং জাহাজকে লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।

আমান দ্রুত পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলেন এবং সাবমেরিন ধ্বংস করার জন্য একটি ডেপথ চার্জ (জলমধ্যে বিস্ফোরণের জন্য বিশেষ অস্ত্র) ব্যবহার করার নির্দেশ দিলেন।

জাহাজ থেকে ডেপথ চার্জ ফেলা হলো। গভীর সমুদ্রের তলদেশে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটল, আর কিছুক্ষণ পর রাডার দেখাল— সাবমেরিনটি ধ্বংস হয়েছে।
অজানা দ্রুতগামী জাহাজটি ভয় পেয়ে পিছু হটল এবং পালিয়ে গেল।

লেফটেন্যান্ট কমান্ডার আমান এবং তার টিম নিশ্চিত করল, ওমান উপসাগরে পাকিস্তানের জলসীমা রক্ষা করা হয়েছে। পুরনো বাণিজ্যিক জাহাজটি পরিত্যক্ত অবস্থায় রেখে সেটি পুরোপুরি স্ক্যান করার জন্য একটি বিশেষ টিম পাঠানো হবে।
সমুদ্রের বুক থেকে ভোরের আলো ফুটে উঠল। আমানের চোখে-মুখে ক্লান্তি থাকলেও দায়িত্বপালনের আত্মবিশ্বাস স্পষ্ট।

চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের একটি হোটেল রুমে তখন জ্বলে উঠেছে আলো। মেহের ঢকঢক করে পানি খেয়ে নিজেকে শান্ত করতে চেষ্টা করলো। ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে তার মন প্রাণ সবকিছু উদ্বিগ্ন। মোবাইল হাতে নিয়ে প্রিয় আইডিতে টাইপ করে পাঠালো,

‘ আপনি ঠিক আছেন আমান? ’

বরাবরের মতোই উত্তর এলো না। মেহের চিন্তিত হয়ে বসে রইলো। গতকালের ওই বার্থডে পোস্টের পর আর কোনো পোস্ট করা হয়নি আমানের আইডি থেকে। মানুষটা ঠিক আছে তো?

(চলবে)