ক্রাশ_ইন_দ্য_সি পর্ব-০৮

0
20

#ক্রাশ_ইন_দ্য_সি
#পর্ব-০৮
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ

চট্টগ্রামের আর্মি কোয়ার্টারের পরিবেশ অনেকটাই শান্ত। মাসুদ রানা, মেহেরের বাবা, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কর্নেল। তার শান্ত কোয়ার্টার অপেক্ষা করছে কর্নেলের পরিবারকে গ্রহণ করতে।

আজ তিনি তার স্ত্রী জাহানারা আর মেয়ে মেহেরকে নিয়ে চট্টগ্রামে ফিরে যাবেন। মেহেরের এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। নতুন এক অধ্যায়ের শুরু করতে যাচ্ছে সে। কিন্তু যাওয়ার আগে বিদায়ের মূহূর্তটা মেহেরের জন্য সহজ নয়।

বন্ধু শায়লা আর পাভেল একসাথে দাঁড়িয়ে। মেহের একটু দূরে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। শায়লার চোখ ভেজা, কিন্তু মুখে একরকমের হাসি। পাভেলের মুখটা বিষণ্ন।

“তুই সমুদ্রের কাছে যাচ্ছিস, জানিস তো? সেখানে গেলে আমাকে মেসেজ লিখিস কিন্তু, ভুলিস না।” শায়লা হেসে বলে।

মেহের হাসে, তবে সেই হাসির মধ্যে বিষাদের ছায়া। পাভেল কিছু বলে না, শুধু মেহেরের দিকে তাকিয়ে থাকে।

বিদায়ের আগে মেহের তার ছোট ব্যাগ থেকে একটা ছবি বের করে। আমানের ছবি। পাকিস্তান নেভির ইউনিফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা এক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ও কঠিন চেহারার পুরুষ। মেহের ছবিটার দিকে তাকিয়ে নিজ মনেই নিচু স্বরে বলে,

“ আমি সমুদ্রের কাছাকাছি যাচ্ছি, আমান। তোমার সমুদ্র। আমার কাছে সমুদ্র মানেই তুমি। সমুদ্রের কাছাকাছি থাকলে আমি তোমাকে আরও গভীর ভাবে অনুভব করতে পারবো। আমার মনে হচ্ছে আমি তোমার কাছে যাচ্ছি। ওই কোয়ার্টার নয় তুমি আমার অপেক্ষায় দাড়িয়ে আছো। আমি আসছি আমান। তোমার কাছে আসছি। ”

শায়লা আর পাভেলের দিকে হাত নাড়িয়ে বিদায় জানায় মেহের। গাড়ির ভেতরে বসে চট্টগ্রাম কোয়ার্টারের দিকে যাত্রা শুরু করে। তার বাবা সামনের সিটে বসে আছেন। চট্টগ্রামের দিকে ছুটে চলা গাড়ির জানালা দিয়ে মেহের সমুদ্রের গন্ধ যেন আগেভাগেই অনুভব করতে পারে।

জলদস্যু দমনের মিশন শেষে পাকিস্তান নেভির পক্ষ থেকে আমান খান ও তার টিমকে অভিনন্দন জানানো হয়। তবে মিশনের ধকল আর সমুদ্রের ঝড় তাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্লান্ত করে তোলে। কিছুদিনের ছুটি নেওয়ার কথা ভেবে তিনি করাচি ফিরে যান।

ঠিক তখনই আসে একটি বিশেষ আদেশ—বাংলাদেশ নৌবাহিনীর সঙ্গে একটি যৌথ সামুদ্রিক মহড়ায় অংশ নিতে তাকে নির্বাচিত করা হয়েছে। ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য এই মহড়ার আয়োজন। আমান খান ভেবেছিলেন ছুটি নেবেন, কিন্তু নৌবাহিনীর সম্মান বজায় রাখতে আদেশটি তিনি গ্রহণ করেন।

একদিন পর, একটি বিশেষ নৌযানে চড়ে আমান তার টিম নিয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে পৌঁছান। বাংলাদেশের নৌবাহিনীর কর্মকর্তারা তাদের উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান। সমুদ্রের নিরাপত্তা, জলদস্যু প্রতিরোধ, এবং পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে মহড়ার কাজ শুরু হয়।

বাংলাদেশের নৌবাহিনীর পক্ষ থেকে তাদের লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পান কর্নেল জাহিদ।

সন্ধ্যার আকাশ কালো। আকাশের রঙ সমুদ্রের জলে মিশে গেছে৷ চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে পাতলা সাদা শার্ট ও একটি ডেনিম প্যান্ট পড়ে পকেটে হাত গুঁজে সটান হয়ে যে পুরুষটি দাড়িয়ে আছে তার নাম আমান খান। কর্নেল জাহিদ হাতের দূরবীনটি এগিয়ে দিলেন। আমান দূরবীনে চোখ রেখে সমুদ্রের দূর থেকে বহুদূর পর্যন্ত পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো।

চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরের হোটেলের কাছে তখনই এসে থামলো একটি জীপগাড়ি। ড্রাইভার সিটে ছিলেন একজন লেফটেন্যান্ট। তিনি নেমে ব্যাগপত্র নামালেন। তারপর ফোন করলেন কর্নেল জাহিদকে।

কর্নেল জাহিদ মোবাইলে কথা বলা শেষ করে আমানকে বললেন,

‘ কমান্ডার সামনে যাচ্ছি আমার একজন কর্নেল বন্ধু পরিবার নিয়ে এসেছেন। রিসিভ করে হোটেল রুমে দেখা করছি৷ ততোক্ষণ এনজয়৷ ’

আমানের বাংলাসহ আরও অনেক দেশের ভাষা জানা আছে। সে দূরবীন থেকে চোখ না সরিয়েই বলল,

‘ ওহ্ শিওর কর্নেল। ’

কোয়ার্টারে আরও দুদিন পর যাবে তারা। মাসুদ রানার মিটিং রয়েছে এখানে। সেগুলো সেড়েই তারা কোয়ার্টারে যাবে। জাহানারা চোখের সানগ্লাসটা খুলে কাঁধের শালটা ঠিকঠাক করে নিলেন। তারপর নামলেন গাড়ি থেকে। মেহেরের সানগ্লাসটা চুলের উপর রাখা। সুয়েটারের বোতাম গুলো খোলা। জাহানারা বোতাম গুলো লাগিয়ে দিলেন।

‘ অনেক বাতাস মা, ঠান্ডা লেগে যাবে তোমার। ’

মায়ের হাত ধরে মেহের সমুদ্র বন্দরের মাটিতে পা রাখতেই তার শরীরে তীব্র একটি বাতাসের ধাক্কা লাগলো। পড়ে নিতেই যাচ্ছিল ধরে ফেললেন মাসুদ রানা। মেয়েকে এক হাতে জড়িয়ে রেখে আরেক হাত বাড়িয়ে হাত মিলালেন বন্ধু জাহিদের সাথে। তারপর এগিয়ে চললেন হোটেলের দিকে। মেহের বলল,

‘ বাবা চলো আগে সমুদ্র দেখে আসি। ’

জাহানারা বললেন,

‘ এখন নয় সোনা। ’

‘ প্লিজ মা, একটু! ’

মাসুদ রানা বললেন,

‘ ঠিক আছে৷ আগে ফ্রেশ হয়ে গরম কাপড় পড়ে নিবে। অনেক বাতাস ওখানে। ’

জাহিদ বললেন,

‘ কোনো সমস্যা হবে না মামনি, সমুদ্রের কাছাকাছি ঘুরতেও পারবে তুমি। আমাদের বোট আছে। ’

‘ থ্যাংক ইউ আঙ্কেল। ’

‘ মাই প্লেজার ’

হোটেল রুমে পৌঁছে মেহের ফ্রেশ হয়ে ডেনিম প্লাজুর সাথে কুর্তি পড়লো। উপরে লম্বা ওভারকোট। তারপর গিয়ে দাড়ালো বারান্দাতে৷

কাঁচের বারান্দা থেকে সমুদ্র স্পষ্ট দেখা যায়। সন্ধ্যার অন্ধকার পুরোপুরি এখনো ছড়িয়ে পড়েনি। মৃদু অন্ধকারে স্পষ্ট হয়ে তার চোখে ধরা দিলো সমুদ্রের কাছাকাছি দাড়িয়ে থাকা সাদা শার্ট পড়া যুবকটি। দূরবীনে চোখ রেখে যে তাকিয়ে আছে অদূরে। পেছন থেকে তাকে দেখেই মেহের স্তব্ধ হয়ে গেলো। এই কায়া তার পরিচিত। এমন করে একজনই দাড়িয়ে থাকে। দূরবীনে চোখ রেখে সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে থাকে তার দেখা সেই একজনই। মেহেরের শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুত হলো। পা টলতে লাগলো। কাঁচের জানালার উপরে সে তার হাতটা রাখলো। বরফ শীতল কাঁচে হাত রাখতেই ঠান্ডায় জমে উঠার মতো অবস্থা হলো তার। মেহের কাঁপা কাঁপা ঠোঁট নিয়ে অস্পষ্ট স্বরে ডাকলো,

‘ আমান! ’

জাহানারা শাড়ি পাল্টে হাতমুখ ধুয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এলেন। শরীরে গরম কাপড় জড়িয়ে মাফলার হাতে নিয়ে বারান্দায় এলেন। মেহেরের তখন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা। তার গলা দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না। গলা শুকিয়ে কাঠ। জাহানারা পেছন থেকে বললেন,

‘ এদিকে আয় এটা পড়িয়ে দেই। গলা বসে যাবে নাহলে৷ ’

মেহেরের কানে পৌঁছালো কি না বুঝা গেলো না। সে আগের মতো বিস্ময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সমুদ্রের দিকে। চোখের পানিতে গাল ভিজে গেছে অনেক আগে।

‘ কি রে মেহের, এদিকে ঘুরে দাড়াবি তো। ’

মেহের কোনো আওয়াজ করলো না। জাহানারা টেনে ফিরালেন। মেয়ের মুখ দেখে অবাক হয়ে বললেন,

‘ ও মা! তুই কাঁদছিস কেন? ’

মেহের গলা দিয়ে অস্পষ্ট শব্দ করে ডাকলো,

‘ মা! ’

‘ কি হয়েছে বল? ’

মেহের হাতের আঙ্গুল ঘুরিয়ে কাচের আবরণে ঢাকা সমুদ্র দেখালো। জাহানারা বুঝলেন না।

‘ সমুদ্রে তো যাবোই, সেজন্যেই তো বলছি এটা পড়ে নে। ’

মেহের মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো।

‘ কি হয়েছে তোর? তোর বাবা সাথে যাবে না বলে মন খারাপ করছিস? তোর বাবা আমাদের নিরাপত্তার জন্য সব ব্যবস্থা করে গেছে। চলে আসবে দশটার দিকে। ’

মেহের প্রায় চিৎকার করে কেঁদে উঠলো। আছড়ে পড়লো মায়ের বুকে। তারপর হাতের আঙ্গুল দিয়ে ইশারা করে সমুদ্রের দিকে দেখিয়ে বলল,

‘ আমি তাকে দেখেছি মা! ’

জাহানার বিস্ময়ে চোখ বড়বড় হয়ে উঠলো। মেহেরকে সকালে তিনি বলেছেন যে তিনি সব জানেন। তারপর মেয়েকে অনেক বুঝিয়েছেন। মেহের শুধু চুপ করে শুনেছে৷ মায়ের কথাটাও ফেলে দেওয়ার মতো নয়। আমানের সাথে কি সত্যিই তার কখনও দেখা হবে? মায়ের যুক্তিতে মেহের হেরে গিয়ে বলেছিল সে চেষ্টা করবে এসব থেকে বের হওয়ার। সকালের কথা মনে পড়তেই জাহানারা বুঝতে পারলেন মেহের কার কথা বলছে।

‘ তুই ভুল দেখেছিস মা। ’

মেহের মাথা নাড়িয়ে না না করলো।

‘ আমি তাকে সব অবস্থায় চিনতে পারি মা! সেই ছিল। ’

জাহানারা গলায় মাফলার জড়িয়ে দিলেন।

‘ কাকে দেখেছিস দেখা তো। ’

মেহের আঙুল দিয়ে ইশারা করে দেখাতে গিয়ে দেখলো সেখানে কেউ নেই। ফাঁকা জায়গাটা।

(চলবে)