#ক্রাশ_ইন_দ্য_সি
#পর্ব_১০
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
শান্ত কোয়ার্টার টা দাড়িয়ে আছে। কোয়ার্টারের সামনে এসে থামলো মাসুদ রানার গাড়িটা৷ জাহানারা অসুস্থ মেয়েকে ধরে নামলেন। মাসুদ রানা ব্যাগপত্র নিয়ে আগে আগে গেলেন পেছনে তারা।
চোখমুখ শুঁকনো মেহেরের। দুদিন বিছানায় পড়ে ছিল সে। কিছুটা সুস্থবোধ করতেই মাকে জিজ্ঞেস করেছে সেই যুবকটির কথা। জাহানারা তখন মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত। সেজন্য তিনিও কিছু জানতেন না। মাসুদ রানাকে সব জানানোর পর তিনি চমকে যান নি। কারণ তিনি জানতেন মেহের যাকে পছন্দ করে এটা সেই অফিসারই। মেহেরকে তিনি জানাতেই চাইছিলেন। কিন্তু তার আগেই মেহের জেনে যায়। মাসুদ রানা বলেন আমান পরের দিন সন্ধ্যাতেই বাংলাদেশ থেকে রওনা দিয়েছে নিজের মাতৃভূমির উদ্দেশ্যে। জাহানারা সেটা মেহেরকে জানালে সে পাথরের মতো নিশ্চুপ ছিল। এতো কাছে এসেও তাকে একটা বার ভালো করে দেখা হলো না। জানানো হলো না নিজের অনুভূতি সম্পর্কে। অনেক দুঃখ, হতাশা নিয়ে মেহের আমানকে মেসেজ পাঠিয়েছিল,
‘ এতো কাছে এসেও আপনাকে কিছু জানাতে পারলাম না। আপনার কি বেশিই তাড়া ছিল? আমার জন্য একটু অপেক্ষা করা যেত না? করবেন কেন? আমি তো আপনার কেউ নই। আমার এই অভিমানে আপনার কিছু যায় আসে না। আপনি কখনও জানতেও পারবেন না কিছু। ’
‘ মেহের! ’
মেহের ভাবনা থেকে বের হলো। জাহানারা উষ্ণ কাঁথা ওর শরীরে জড়িয়ে দিলেন।
‘ দুপুরে কি খেতে চাস? ’
‘ তুমি যা বানাবে তাই খাবো। ’
মা চলে যেতেই মেহের রুমের চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো। এটা আজ থেকে তার রুম। এখানেই তার নতুন জীবন শুরু আবারও। কথাটা মনে হতেই মেহেরের বুক চিনচিন করে উঠলো। ঢাকার ওই ফ্ল্যাটে মেহের বুঝ হবার পর থেকে ছিল। যদিও ওটা ওদের নিজস্ব ফ্ল্যাট। এখন কাউকে ভাড়া দিয়ে দেওয়া হবে বাবা বলছিলেন। কিন্তু মা তাতে নারাজ। ছুটিতে ওখানে গিয়ে থেকে আসবেন, ঢাকাতেই তাদের আত্নীয়, বন্ধু বান্ধব সব। মেহেরের যে টান নেই তেমনটা না। শায়লা, পাভেল দুজনকেই সে মিস করছে। সাথে মিস করছে নিজের রুম কে। সেই বন্ধ রুমে আমানকে নিয়ে তার কত কল্পনা, কত কান্না। কত না বলা অনুভূতির সাক্ষী ওই রুমটা। ওই রুমের চারিদিকে হাহাকার। মেহেরের এগারো মাসের অনুভূতি, অভিমান, চোখের পানি ও ডিপ্রেশনের সাক্ষী। হ্যাঁ এগারো মাস, কয়েকদিন পর এক বছর হয়ে যাবে। আমানকে সে এক বছর যাবত ভালোবাসে। নিজের অব্যক্ত কথা যে ডায়েরিতে লিখে রাখতো সেটা মেহের ওই রুমেই ফেলে এসেছে। সাথে ফেলে এসেছে শৈশব, কৈশোরের পাগলামি। ছুটিতে যখন যাওয়া হবে তখন ডায়েরিটা নিয়ে আসবে সাথে করে। মেহের উপলব্ধি করছে সে বড় হয়ে যাচ্ছে। অনেকটা বড়। আজকাল তার হুটহাট আত্মসম্মান জেগে উঠে। আমানকে মেসেজ সে দুদিনে ওই একটাই দিয়েছিল। তারপর শতবার ইচ্ছে থাকলেও নিজেকে আটকে রেখেছে। কি দরকার! সেই তো মেসেজ গুলো পড়েই থাকবে। কেউ দেখবে না। ওই মানুষটা পাথর দিয়ে তৈরি। নিজেকে অনেক বড় লাটসাহেব ভাবে কি না। মনে করে মেসেজ রিকুয়েষ্টে তার জন্য পাগল হাজার হাজার মেয়ে ঝুলে আছে। সেটা ভেবে নিশ্চয়ই অনেক আনন্দ পায়? পাবেই তো। একটু সুদর্শন আর একটা ভালো জব করে বলে আকাশে উড়ে বেড়ায়। একটাবার মেসেজ রিকুয়েষ্ট অপশনটা চেক করার প্রয়োজন মনে করে না!
মেহের বালিশে মুখ গুঁজে ফুপিয়ে উঠলো। আমান যেন তাকে অদৃশ্য এক প্রত্যাখ্যান করে চলে গেছে। নিজের অজান্তে মেহেরের আত্নসম্মানে তীব্র আঘাত দিয়ে গেছে। সেই আঘাত মেহের কে শান্তি দিচ্ছে না। আত্মসম্মান নাকি ভালোবাসা? মেহের দু-টানায় হাবুডুবু খাচ্ছে।
‘ আমান! আমান! আমান! আপনি এতো নিষ্ঠুর কেন! ’
মেহেরের বোবা কান্না চিৎকারে রুপ নিলো। জাহানারা ছুটে এলেন। মেহের মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। মেয়ের সাথে জাহানারা ও কাঁদছেন। দরজার সামনে দাড়িয়ে থাকা মাসুদ রানা এগিয়ে এলেন না। এই কান্না কিসের জন্য তিনি জানেন। নিশ্চুপে প্রস্থান করলেন তিনি।
‘ মেহের মাকে বল কোথায় কষ্ট হচ্ছে সোনা? ’
মেহেরের কান্না থেমেছে। সে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। জাহানারা চুল গুছিয়ে দিলেন।
‘ আমরা ঢাকায় ফিরে যাই চল? তোর নতুন পরিবেশে মানিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে অনেক। অসুস্থ হয়ে পড়েছিস৷ ’
মেহের এ পর্যায়ে আঁতকে উঠলো,
‘ না মা! আমি সমুদ্রের কাছ থেকে দূরে কোথাও যাবো না। ’
জাহানারা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন,
‘ কি হয়েছে মাকে বলবি? ’
‘ চিন্তা করো না মা। পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে গেলে ঠিক হয়ে যাবে। ’
‘ তোর ওকে মনে পড়ছে না? ’
মেহের ছলছল দৃষ্টিতে তাকালো। জাহানারা গালে হাত রেখে বললেন,
‘ কাঁদিস না। আমার সাথে তোর বাবার বিয়েটা কিভাবে হয়েছে জানিস? তোর বাবাকে আমি পছন্দ করতাম। কিন্তু কখনো বলার সাহস পাইনি। সবটা ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়েছিলাম। কারণ ভাগ্যে থাকলেই কাউকে পাওয়া সম্ভব৷ আমাদের যুগটা কঠিন ছিল রে মা। একদিন কি হলো, তোর দাদা তোর নানার কাছে প্রস্তাব নিয়ে আসলেন। ব্যস, আমি তোর বাবাকে পেয়ে গেলাম। ভাইজানের বন্ধু ছিল সে। সেই সুবাদে তাকে আমি কয়েকবারই দেখেছিলাম। কিন্তু কখনও কথা হয়নি আমাদের৷ বিয়ে ঠিক হবার পর ও না। মানুষটাকে আমি ভয় পেতাম অনেক। আর আজ তাকে আমি হাতের ইশারায় নাচাই। বুঝলি? ’
মেহের ফিক করে হেসে ফেললো। জাহানারা বললেন,
‘ নিজের ভাগ্যের উপর ছেড়ে দে সব। সে যদি তোর জন্য তৈরি হয়ে থাকে তবে তুই তাকে কোনো না কোনো ভাবে পেয়ে যাবি৷ না পেলে কখনও ভাগ্যকে দোষারোপ করবি না। ভাববি তোর জন্য এর থেকেও উত্তম কিছু রয়েছে। ’
মেহেরকে বুঝিয়ে জাহানারা রান্নাঘরে চলে গেলেন। মেহের হুট করে ডিপ্রেশন ভুলে ছুটলো মায়ের কাছে৷
‘ মা আমি শাড়ি পড়বো। ’
জাহানারা তরকারি নাড়ছেন,
‘ বেশ তো, ব্যাগ গুলোতে দেখ। যেটা পছন্দ হয় বের কর। আমি পড়িয়ে দিবো। ’
মেহেরের মধ্যে হুট করে যেন আগের সেই চঞ্চলতা ফিরে এসেছে। সে একটি গাঢ় সবুজ রঙের টাঙ্গাইল শাড়ি বেছে নিলো। জাহানারা যত্ন করে পড়িয়ে দিলেন সেটা। মেহের মায়ের হাতে সাজলো। জাহানারা বললেন,
‘ তোমার চুলগুলো আগের থেকে একটু লম্বা হয়েছে। ’
‘ আমি চুল লম্বা করবো মা, আর কা*টবো না। ’
মেয়ের কপালে টিপ দিয়ে জাহানারা আয়নার সামনে দাঁড় করালেন।
‘ দেখো কত সুন্দর লাগছে আমার মেয়েকে। ’
‘ মা! চুড়িই তো পড়া হয়নি। ’
‘ তাই তো। ’
জাহানারা স্বর্ণের দুটো মোটা চুড়ি পড়িয়ে দিলেন। মেহের খিলখিল করে হেসে বলল,
‘ আমাকে বিবাহিত মনে হচ্ছে মা! ’
‘ তোমাকে বড়ো বড়ো লাগছে। নতুন বউ মনে হচ্ছে। ’
মেহের লজ্জা পেলো। জাহানারা রান্নাঘরে চলে গেলেন। মেহের মোবাইলে নিজের কিছু ছবি তুললো। বারান্দায় বসে হুমায়ূন আহমেদের বই “ মৃন্ময়ীর মন ভালো নেই ” হাতে নিয়ে মোবাইলে টাইমার সেট করে ছবি তুললো। তারপর সেটা পাঠালো প্রিয় মানুষের ইনবক্সে। লিখে পাঠালো,
‘ সমুদ্রের রাজপুত্র! সমুদ্রের কাছাকাছি এসেও আমার মন ভালো নেই। কারণ আমার যে তুমিই নেই। তুমি কাছে এসেও দূরে চলে গেছো। আবার কি কখনও দেখা হবে? আমার ভাগ্যে কি তুমি থেকে যেতে পারো না? পারো না হুট করে সামনে এসে বলতে, ‘ তুমি সমুদ্রের রাজপুত্রের জন্যে তৈরি! ’ শুনো রাজপুত্র, সমুদ্রের কাছাকাছি শান্ত যে কোয়ার্টার টা দাড়িয়ে? তার মধ্যে একজন রাজকুমারী বাস করতে শুরু করেছে। সাথে অপেক্ষায় আছে, তুমি একদিন আসবে বলে। তুমি আসবে তো সমুদ্রের রাজপুত্র? বাসবে তো আমায় ভালো? ’
(চলবে)