#ক্রাশ_ইন_দ্য_সি
#পর্ব_১১
#তাহিনা_নিভৃত_প্রাণ
আমান, পাকিস্তান নৌবাহিনীর একজন লেফটেন্যান্ট কমান্ডার, ছুটিতে বাড়ি ফিরেছে। কয়েক মাস ধরে সমুদ্রে দায়িত্ব পালন করে সে ক্লান্ত এবং মানসিক প্রশান্তির জন্য তার গ্রামীণ বাড়ির শান্তিময় পরিবেশে ফেরার অপেক্ষায় ছিল। বাড়িটি উত্তর পাকিস্তানের সবুজে ঘেরা এক ছোট্ট শহরে, পাহাড়ের পাদদেশে। এ বাড়ি তার শৈশবের স্মৃতির গাঁথা, যেখানে মা-বাবা আর ছোট বোন তার জন্য অগাধ ভালোবাসা নিয়ে অপেক্ষা করে।
বাড়িটি পুরনো শৈলীতে তৈরি—দোতলা কাঠের বাড়ি, লম্বা বারান্দা, আর চারপাশে নানা গাছগাছালি। উঠানে একটা বড় আমগাছ, যেখানে দড়ির দোলনা ঝুলছে। বাড়ির সামনের বাগানে গোলাপ, জুঁই আর লেবুর গাছ। পেছনে ছোট্ট একটা পুকুর, যেখানে আমান ছোটবেলায় সাঁতার কাটত।
আমানের ঘরটা দোতলায়, জানালার পাশে। তার ঘরের দেওয়ালে নৌবাহিনীর পুরস্কার, সার্টিফিকেট আর সমুদ্রে তোলা ছবিগুলো সাজানো। ডেস্কের ওপর তার প্রিয় বই, কলম আর নোটবুক। পাশে ছোট্ট শোকেসে পরিবারের পুরনো ছবিগুলো রাখা। তার বিছানায় নৌবাহিনীর লোগো আঁকা চাদর পাতা, যা তার মা বড় যত্নে রেখেছেন।
বাড়ির গেট খুলতেই আরিনা দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে।
“দাদা! তুমি এতদিন পর আসলে? আমার জন্য কী এনেছো? এবার তোমাকে ছাড়া যেতে দেব না!”
আমান হাসতে হাসতে বলল,
“এই দুষ্টু, ব্যাগ খোলার আগে একটু বিশ্রাম নিতে দাও।”
মা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। তার মুখে হাসি আর চোখে জল।মা বললেন,
“তুই এত শুকিয়ে গেছিস কেন? খেয়েছিস ঠিকঠাক? চল, আগে হাত মুখ ধুয়ে আয়। খেতে বসে সব কথা বলবি।”
বাবা বারান্দায় পাঞ্জাবি পরে চশমা ঠিক করছেন। জিজ্ঞেস করলেন,
“আমান, কী খবর? দায়িত্ব কেমন যাচ্ছে?”
“সব ভালো। তোমার শরীর ঠিক আছে তো, বাবা?”
“আলহামদুলিল্লাহ, তোর মাকে বেশি চিন্তা করতে দিস না।”
রাতে সবাই মিলে মাটির বারান্দায় পাটি বিছিয়ে খেতে বসে। মা তার প্রিয় খাবার বানিয়েছেন—বিরিয়ানি, গ্রিলড মাছ আর ঠাণ্ডা লাচ্ছি।
মা বললেন,
‘ এই মাছটা আমি নিজে কিনে এনেছি। তোর ছোটবেলার মতো রান্না করেছি।”
“মা, তুমি এমন ভালো রান্না করো, আমি কখনো বাইরে এটা খুঁজে পাই না।”
আরিয়া বিরিয়ানির হাঁড়ি থেকে নিজে খেতে খেতে বলে,
“দাদা, তোমাকে কত কথা বলার আছে! তোমার জাহাজে ওঠার গল্প শোনাবে, প্লিজ!”
বাবা বললেন,
“তুই সারা পৃথিবী ঘুরে দেখছিস, আল্লাহকে ধন্যবাদ দে। এ জায়গাটাও ভুলিস না।”
রাতে, সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর আমান নিজের ঘরে বসে জানালার বাইরে তাকায়। চাঁদের আলোয় পুকুরটা চিকচিক করছে। সে একটা নোটবুক খুলে ভাবতে থাকে। সমুদ্রে কাটানো দিনের ক্লান্তি তার মনে ভেসে আসে—কখনো উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে দায়িত্ব পালন, কখনো বিপদের মুখে সতীর্থদের বাঁচানোর তাগিদ।
আমান ভাবছে,
“আমি কী করছি? এই দায়িত্ব কি আমার জীবনের মূল লক্ষ্য? আমার মা-বাবা, বোনের কাছ থেকে এত দূরে কেন থাকতে হয়? জীবনের সব আনন্দ কি শুধু দায়িত্বের জন্য উৎসর্গ করব? অবশ্যই করবো। আমার দায়িত্ব আমার দেশমাতৃকার জন্য কাজ করা। আমি সর্বদা অটল থাকবো। কিছু করতে হলে কিছু তো ছাড় দিতে হয়।
হঠাৎ তার মায়ের কণ্ঠস্বর শুনতে পায়। মা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন।
“ঘুমাসনি এখনো? তোর তো ভোরবেলা উঠতে হবে।”
“মা, তুমি কষ্ট করো কেন? আমি ঠিক আছি।”
“তুই তো বড় সাহসী ছেলে, কিন্তু আমি তোর চোখে কেমন যেন ক্লান্তি দেখতে পাই।”
পরদিন সকালে, উঠানে সকালের নাশতা খেতে বসে, আমান তার বাবার সাথে দেশের পরিস্থিতি আর তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলে। বাবা তাকে পরামর্শ দেন।
“আমান, তুই যদি চাস, আরো বড় কিছু করতে পারবি। কিন্তু মানুষের ভালো করাটাই সবসময় মনে রাখতে হবে।”
আরিয়া আবার এক দৌড়ে এসে বলে,
“দাদা, আমাকে তোমার ইউনিফর্মটা একদিন পরতে দাও। আমি তোমার মতো ফটো তুলব।”
সবাই হেসে ওঠে।
তৃতীয় দিন সকালে আমান ঘুম থেকে উঠেই শুনতে পায় বাগানের পাশ থেকে মায়ের ডাক—
“আমান, উঠে আয়। রোদ অনেক হয়েছে। নাশতা রেডি।”
ঘুমের ঘোরে নৌবাহিনীর কঠোর শিডিউলের অভ্যাসে উঠে বসে আমান। কিন্তু ঘরের আরামদায়ক পরিবেশ তাকে আবার শৈশবের স্মৃতির মাঝে নিয়ে যায়। ঘর থেকে বের হয়ে আমান বারান্দায় এসে দেখে, বাবা একটা চায়ের কাপ নিয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন, আরিফা পুকুরের ধারে বসে স্কুলের পড়া মুখস্থ করছে। বাড়ির পরিবেশ এতটাই শান্ত যে সমুদ্রের উত্তাল দিনগুলোর তুলনায় এটা স্বর্গের মতো লাগে তার কাছে।
নাশতায় মা গরম পরাঠা আর আলুর ভাজি দিয়ে বসে আছেন। আরিফা খালি চায়ের কাপে চিনি ঢেলে নিজের মতো মজা করছে। বাবা মৃদু হেসে বলেন,
“আমাদের আরিয়া তো একেবারে ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখে। আমান, তোর বোনের পড়াশোনার দায়িত্ব তুই নে।”
“দাদা, তোমার মতো ইউনিফর্ম পরলে কেমন লাগবে, বলো তো? আমিও তো কিছু করতে চাই।”
আমান হেসে বলল,
“তুই ইউনিফর্ম পরলে আমায় মনে হয় বেশি আদেশ দিবি। আমি কিন্তু পালিয়ে যাব!”
সকালের এই নির্ভার আড্ডাগুলো আমানের কাছে যেন হারিয়ে যাওয়া সময়ের পুনর্জন্ম। দায়িত্ব আর শৃঙ্খলার জীবনে এমন দিনগুলো খুব কমই আসে।
নাশতার পর আমান পুকুরপাড়ে গিয়ে বসে। একটা লাঠি নিয়ে পানিতে নেড়ে সে ছোটবেলার স্মৃতিতে ডুবে যায়। তার মনে পড়ে, যখন সে প্রথম সাঁতার শিখেছিল, তখন বাবা তাকে পানিতে নামিয়েছিলেন।
তার ঘরের এক কোণে রাখা শৈশবের খেলাগুলো দেখে সে নিজেই হাসে। একটা পুরনো রেডিও তুলে নেয়, যা তার বাবার কাছ থেকে পাওয়া। হঠাৎ আরিয়া এসে বলে,
“দাদা, তুমি না ছোটবেলায় এই রেডিও বাজিয়ে আমাদের সবাইকে বিরক্ত করতে।”
“তুই জানিস না, এটা ছিল আমার প্রথম নাবিক হওয়ার স্বপ্নের সঙ্গী। এই রেডিওতে প্রথমবার সমুদ্রের আবহাওয়ার খবর শুনেছিলাম।”
বিকেলে কয়েকজন প্রতিবেশী আর আত্মীয় আসেন আমানকে দেখতে। আমান তার বাবার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের কাছ থেকে শৈশবের নানান দুষ্টুমি আর সাহসিকতার গল্প শুনতে পায়।
একজন প্রতিবেশী বললেন,
“আমান ছোটবেলায় একটা গাছের চূড়ায় উঠে বলেছিল, সে বড় হয়ে পাইলট হবে। আজ দেখো, সে পুরো দেশের গর্ব!”
গ্রামের বাচ্চারা তার চারপাশে ভিড় করে। একটা বাচ্চা বলে,
“ভাইয়া, আপনি কি জাহাজ চালান? বন্দুক আছে আপনার কাছে?”
আমান হাসে,
“জাহাজ চালাই, আর বন্দুক থাকলেও তোমাদের বলব না।”
বিকেলের নরম আলো আর গ্রামের হালকা বাতাস তাকে এক অন্যরকম প্রশান্তি দেয়। সে বুঝতে পারে, এই গ্রামই তার প্রকৃত শেকড়।
রাতে, প্রতিদিনের মতো আমান তার ঘরে একা বসে নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবে। তার সামরিক জীবন তাকে একদিকে এনে দিয়েছে গর্ব আর দায়িত্ববোধ, কিন্তু অন্যদিকে পরিবারের কাছ থেকে দূরে থাকার কষ্ট।
“আমার দায়িত্বগুলো কি আমার ব্যক্তিগত সুখের থেকেও বড়? আমি কি আমার পরিবারের জন্য যথেষ্ট সময় দিচ্ছি? আমায় যদি কোনোদিন এমন কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হয়, যেখানে দেশের সেবা আর পরিবারের ভালোবাসার মধ্যে একটা বেছে নিতে হয়, আমি কী করব?”
তার নোটবুকে সে নিজের কিছু চিন্তা লিখে রাখে—
“জীবনে এমন কিছু করতে হবে, যা দেশের সেবার পাশাপাশি পরিবারের গর্বও হতে পারে।”
এই চিন্তাগুলো তাকে জীবনের প্রতি নতুনভাবে অনুপ্রাণিত করে। আমান কি যেন একটা মনে করতে চায় কিন্তু মনে পড়ে না।
পরদিন সকালে আমান তার ছোটবেলার স্কুলে যায়। প্রধান শিক্ষক তাকে ছাত্রদের সামনে বক্তৃতা দিতে বলেন। আমান ছাত্রদের উদ্দেশে বলে,
“তোমাদের মধ্যে থেকেই কেউ কেউ বড় হয়ে দেশের জন্য কিছু করবে। আমার মতো একজন গ্রামের ছেলেও নৌবাহিনীতে গিয়ে দেশের সেবা করতে পারছে। তোমরা যদি নিজের স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাও, তাহলে পৃথিবীর কোনো শক্তি তোমাদের থামাতে পারবে না।”
তার এই কথা শোনার পর ছাত্রদের চোখে নতুন স্বপ্নের আলো ফুটে ওঠে।
ছুটির শেষ দিনটা আমান পুরোপুরি পরিবারের সঙ্গে কাটানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সে মাকে বলে,
“মা, তুমি আর রান্না করবে না। আজ সব দায়িত্ব আমার। আমি তোমাদের জন্য নৌবাহিনীর মতো শৃঙ্খলাবদ্ধ করে রান্না করব।”
সবাই হেসে ওঠে। সে সেদিন চায়, পরিবারের প্রতিটি মুহূর্ত তার স্মৃতিতে রয়ে যাক। রাতে ঘুমাতে গিয়ে নিজের মনে ভাবনাচিন্তা করতে করতে আমানের মনে না করতে পারা নামটা মনে পড়ে যায়। “ মেহেরুন্নেসা! ”
যেদিন সে ছুটি শেষ করে ফিরে যাবে, বাড়ি ছাড়ার সময় মা কেঁদে ফেলে।
“তুই আবার কবে আসবি?”
“মা, আমার এই দেশই তো আমার পরিবার। দেশের জন্য দায়িত্ব শেষ করেই আমি আবার ফিরে আসব। তোমাদের ভালোবাসাই আমার সবচেয়ে বড় শক্তি।”
বাবা শান্তভাবে তার কাঁধে হাত রেখে বলেন,
“তুই আমাদের গর্ব। ফিরে এসে আবার তোর গল্প শোনাবি।”
আমান জানে, তার পরিবার তাকে নিয়ে গর্ব করে। কিন্তু তাদের এই ভালোবাসাই তাকে একদিন বড় কিছু করার শক্তি জোগায়। পেছন ফিরে তাকিয়ে সে দেখে, তার বাড়ি, তার শৈশব, তার শেকড়—সবকিছু তাকে অদৃশ্য এক সুরক্ষা দেয়। আর সামনে তাকিয়ে সে দেখে, তার অপেক্ষায় রয়েছে সমুদ্রের আরও দায়িত্ব আর নতুন সব চ্যালেঞ্জ।
(চলবে)