#খুশবু🍁।১।
#অনামিকা_রহমান। (লিখনিতে)
“খুশবুর উপর জ্বীনের ছায়া পড়েছে, ইলিয়াস সাহেব।”
মৌলভির মুখে এমন কথা শুনে ইলিয়াস মাহমুদের মুখখানা ভয়ে শুকিয়ে এলো। সে ভয়ার্ত কন্ঠে শুধালো মৌলভিকে,
“কি বলছেন কি হুজুর। ”
“ঠিকই বলেছি, এ যেমন তেমন জ্বীন নয়,শক্তিশালী আশিক জ্বীন।এই ছোট পুতুলের মতো মেয়েকে কেনো একা একা বাইরে বের হতে দেন।এই ছোট খুশবুকে একবার হাসিল করে নিলে ওই জ্বীন আর খুশবুকে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে দিবে না। ”
মৌলভি খুশবুকে আবার অবোলোকন করে কিছুক্ষন,তারপর খুশবুর ছোট হাতখানা নিজের কাছে টেনে চোখ বন্ধ করে নিতেই
দৈব্যদৃষ্টিতে দেখতে পেলেন জ্বীন বর করার দৃশ্য।
.
.
পড়ন্ত বিকেলে নদীর ধারের বটগাছের তলার দোলনায় দুলছে খুশবু, সঙ্গে রয়েছে পাশের বাসার প্রতিবেশির ছেলে রাইদ। খুশবু দোলনায় দুলছে আর রাইদ পেছন থেকে ধাক্কা দিচ্ছে।
রাইদ ধাক্কা দিতে দিতেই হঠাৎই খুশবুকে বলে উঠল,
“খুশবু এবার আমার চড়ার সময়।এখন দোলনা থেকে নেমে আয় আর আমি দোলনায় চড়বো তুই ধাক্কা দিবি।”
রাইদের এমন কথায় ৭ বছরের খুশবু জবাব দিলো ,
“আমি দোলনা থেকে নামবো না রাইদ ভাই।”
খুশবুর জবাব শুনেই যেনো রেগে গেলো রাইদ। একটানে খুশবুকে নামিয়ে দিলো তড়িৎ রাইদ দোলনা থেকে।তারপর দোলনায় নিজে ওঠে বসলো সে, এবং যেনো ব্যঙ্গ করেই খুশবুকে বলল,
“তোকে ভালো ভাবে বললে হয় না। এবার ভালো হয়েছে। এখন আমি চড়বো তুই দাড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখবি।”
খুশবু কাদো কাদো চোখে রাইদের পানে তাকিয়ে রইলো।
কিছু সময় যেতে না যেতেই হঠাৎ করেই রাইদের দোলনার বেগ বেড়ে গেলো,অট্টহাসির পড়শা বিছিয়ে কেউ যেনো হুঙ্কার দিয়ে বলল,
” কিয়া আপ জোলে পার সাওয়ার হোনা চাতেহে হে! হা হা হা, আগার এসা হে তো জোলে পার জুলে। ”
এই বলে সেই অদৃশ্য শক্তি দোলনায় ধাক্কা দিতে লাগলো।ধাক্কার বেগ এতটা প্রখর হলো যে রাইদ মাটিতে পড়ে গিয়ে হাত পা ছিলে গেলো।
খুশবু আর দাড়ালো না। এমন ভয়ানক অবস্থা দেখে সে ভয়ে ছুটে চলে গেলো বাসার দিকে।
.
.
মৌলভি সাহেবের এই দৃশ্য আর সহ্য হলোনা। সে চোখ খুলে ফেলল।সে ইলিয়াস সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠল,
“ইলিয়াস সাহেব ওই বটগাছে একটা আশিক জ্বীন আছে, খুবই শক্তিশালী জ্বীন।এই জ্বীন এই খুশবু মামনির প্রেমে পড়েছে। তাই খুশবুকে নিজের করে নিতে চায়।ওই বটগাছের ওখান থেকেই খুশবুর উপর নজর দিয়েছে।ওইদিন খুশবু বাসায় আসার পর থেকে কি কি ঘটনা ঘটছে আমায় একটু খুলে বলুন ইলিয়াস সাহেব।”
“মেয়ে আমার খুব ভয় পেয়েছিলো।ওর মা দোয়া দুরুত পড়ে ফুক দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল।কিন্তু খুশবুর মা রুম থেকে বেড়িয়ে আসার সাথে সাথেই রুমের দরজা একা একাই বন্ধ হয়ে যায়। বহু চেষ্টা করেও, খুলতে পারছিলাম না। বাড়ির পেছন থেকে গিয়ে খুশবুর রুমে উকি দিয়ে দেখলাম, খুশবু কার সাথে যেনো কথা বলছে। কিছুক্ষন বাদেই দেখলাম মেয়ে বিছানায় শুয়ে আবার ঘুমিয়ে পড়লো।ওই দিনের পর থেকেই আমার মেয়ের সাথে আজব সব কান্ড শুরু হতে লাগলো। মেয়ে আমার একলা একলা খেলা করতো, কথা বলতো।মেয়ের এমন অবস্থা দেখে তার বন্ধুবান্ধবরাও সঙ্গ ত্যাগ করলো।খুশবুকে পাগল বলতো,কেউ কেউ বলতো জ্বীনের ছায়া পড়েছে, কিন্তু বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু সেদিন যখন খুশবু স্কুলে যেতে দেড়ি হওয়ায়, স্কুলের গার্ড খুশবুকে না ডুকতে দিয়ে, উলটো ধাক্কা মারে,আর খুশবু রাস্তায় পড়ে যায়। তখনি গার্ডের গালে নাকি স্বজোরে কেউ থাপ্পড় মা’রে,গার্ডের মতে ওখানে কেউ ছিলো না।
তখন গার্ড নাকি খুশবুকে চেচিয়ে বলে ওঠে, সবাই ঠিকই বলে তোর উপর জ্বীনের ছায়া আছে।ওই কথা শুনে খুশবু সেদিন কান্না করতে করতে বাড়ি ফেরে। মেয়ের এমন অবস্থা দেখে আমি স্কুলে ফোন করে এই ঘটনা জানতে পারি। তাই তো আপনার কাছে আসা হুজুর।আমার মেয়েটার একটা ব্যবস্থা করুন। ওকে আপনি রক্ষা করুন। ”
মৌলভি সাহেব ছোট্ট খুশবুর পানে চক্ষুদ্বয় স্থির করে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন।বলে উঠলেন,
“ইলিয়াস সাহেব এই জ্বীন খুবই শক্তিশালী তবুও আপনার মেয়েকে একটা রক্ষা কবচ দিচ্ছি।এটাকে কখনও খুলতে দিবেন না এর গলা থেকে। নেহাৎ বড় সর্বনাশ হয়ে যাবে। একবার যদি খুশবুকে আয়ত্ত করে নেয় এই মেয়ে আর স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে না। তাই খুশবুকে বলবেন এই তাবিজটা যেনো না খোলে। ”
খুশবুর মাথায় মৌলভি সাহেব দোয়া পড়ে ফুক দিয়ে একটা কবচ বানালেন, তারপর সাথে সাথেই তাবিজটা খুশবুর গলায় পড়িয়ে দিলেন।
_____
কক্ষে খুশবু ঘুমাচ্ছে। মৌলভির দেওয়া রক্ষা কবচ জ্বীনটাকে খুশবুর কাছে আসতে দিচ্ছে না। খুশবু পবিত্র বলয়ে বন্দি। এই সব অবলোকন করতেই জ্বীনটার রাগের প্রতিফলন দেখা গেলো কিছুক্ষন বাদেই,খুশবুর বিছানার পাশের ফুলদানি ভেঙে চুরমার করে দিলো জ্বীনটা। ড্রেসিং টেবিলে লেখে দিলো,
❝খুশবু শুধু আমার।ওকে আমি ছাড়ছি না। এই তাবিজ তো একদিন না একদিন ওর সঙ্গ ত্যাগ করবেই,ততদিন আমি ওর ছায়া হয়ে থাকবো।কেউ আমায় খুশবুর থেকে আলাদা করতে পারবে না। আমি মুরতাকিব কথা দিচ্ছি,খুশবুকে আমি হাসিল করে ছাড়বোই।❞
এতোটুকু লিখেই হাওয়ার বেগে যেনো মুরতাকিব কক্ষ ত্যাগ করলো।ফুলদানি ভেঙে যাওয়ার আওয়াজে খুশবুর ঘুম ভেঙে গিয়ে কান্নায় বিচলিত হয়ে পড়লো। ইলিয়াস মাহমুদ, হাজেরা খানম ছুটে চলে আসে খুশবুর কক্ষে। খুশবুর কক্ষের ড্রেসিং টেবিলের দিকে নজর পড়তেই আবার আতঙ্ক গ্রাস করে নিলো ইলিয়াস সাহেবকে।
অতঃপর রাতটা কোনো রকম পাড় করে,সকালে মৌলভির নিকট ছুটে গেলো আবার ইলিয়াস সাহেব,তারপর সব খুলে বলল।
মৌলবি ইলিয়াস মাহমুদ কে শুধালেন,
“চিন্তা করবেন না ইলিয়াস সাহেব।যেহেতু খুশবু এখন সুরক্ষিত, ও আর কিছু করতে পারবে না। ও কারো ক্ষতিও করতে পারবে না। ওর কামনা শুধু খুশবু, তবে এই জ্বীন পরবর্তীতে ভয়ংকর হয়েও উঠতে পারে।তবে চিন্তা করবেন না যতদিন এই কবজ আকড়ে খুশবু থাকবে,খুশবুর কোনো ক্ষতি হবে না। ”
এভাবেই খুশবু তার রক্ষাকবজকে আকড়ে ধরে পাড়ি দিলো ১৫ টা বছর। এর মধ্যে বদলে গেলো অনেক কিছু। তবে মুরতাকিব এখনো খুশবুর আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়।দূর থেকেই মুরতাকিব খুশবুকে দেখে যায় অপলক।
খুশবু স্বাভাবিক ভাবে জীবন যাপন করলেও, ছোটবেলার জ্বীনের ছায়ার আচড় এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি।প্রতিবেশীরা নানাভাবে খুশবুকে অপদস্ত করে বেড়ায়।তাই ইলিয়াস মাহমুদ খুশবুর বিবাহ দিতেও পারছেন না। কিন্তু হুট করেই খুশবুর জীবনের অধ্যায় যেনো ওলোট-পালোট হয়ে গেলো।
“খুশবু আপা বাবাকে বোঝান আমার এখনও বিয়ের বয়স হয়নি। আমার এস.এস.সি পরীক্ষা সামনে। সবে মাত্র বয়স আমার ষোলোর কোঠায়।এখনও বিয়ের বয়স হয়নি।”কথাটা সেহের বলল খুশবুকে।
সেহেরের চুলে চিড়ুনি করতে করতে খুশবু জবাব দিলো,
“কাকা পাত্রপক্ষকে নিয়ে আসলেই তো আর বিয়ে হয়ে যায় না,আগে তো যা, তারপর দেখা যাবে। ”
সেহের যেনো বাধ্য হয়েই কিছুক্ষন বাদেই মেহমানদের সামনে যাওয়ার প্রস্তুতি নিলো।
বৈঠক ঘরে বসে আছে ইমতিয়াজ ও তার মা ইয়ানা রহমান। তাদের সামনে বসে আছে সেহেরের বাবা সাইফুল মাহমুদ ও চাচা ইলিয়াস মাহমুদ।
“কিছু যদি না মনে করেন, আপনাদের মেয়ের বয়স কতো জানতে পারি?”
সাইফুল মাহমুদের উদ্দেশ্যে বলে উঠল ইমতিয়াজ। সাইফুল মাহমুদ দ্বিধা না করেই জবাব দিলো, ষোলো বছর বয়স।ইমতিয়াজ তার মায়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,
” এতো কম বয়সি মেয়ে বিয়ে করতে পারবো না। মা তুমি জানতে, মেয়ের বয়স কম তাই না! তোমার কি জানা নেই বাল্যবিবাহ করা উচিত নয়।”
সবার কথা বলার মাঝেই চা-নাশতা নিয়ে বৈঠক ঘরে ডুকলো খুশবু। অতঃপর ইমতিয়াজ একপকল চেয়ে দেখলো খুশবুকে।
ইমতিয়াজ হালকা কাশি দিয়ে সাইফুল মাহমুদের যেনো দৃষ্টি আকর্ষণ করলো,
“আপনি যে মেয়ের কথা বলেছেন, এই কি সেই মেয়ে? ”
ইলিয়াস মাহমুদ সাইফুলকে বলতে না দিয়েই নিজেই বলতে লাগলো,
“ও খুশবু, আমার একমাত্র মেয়ে। ওর মা গত হওয়ার পর থেকে বহু আহ্লাদ করে বড় করেছি।”
“দেখুন আমি তো সেহেরকে বিয়ে করতে পারবো না, কারন হচ্ছে ওর এখনো বিয়ের বয়স হয়নি। যখন আপনাদের আমাদের মধ্যে একটা সম্পর্কের কথা হচ্ছেই,আপনারা যদি কিছু না মনে করেন আমি খুশবুকে বিয়ে করতে চাই। ”
খুশবু ইমতিয়াজের কথা শুনে বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।লাজে মুখে ওড়না ডেকে বৈঠকখানা থেকে প্রস্থান করে।
সাইফুল মাহমুদ উত্তেজিত সুরে বলল,
” সত্যি বাবা তুমি আমাদের খুশবুকে বিয়ে করতে চাও। ”
ইমতিয়াজ তার মায়ের পানে একবার তাকিয়ে ❝হ্যা❞ সূচক মাথা নাড়ায়।
চলবে।