খেরোখাতার ছেঁড়াপাতা পর্ব-৫+৬

0
127

#খেরোখাতার_ছেঁড়াপাতা –৫

হিসহিসিয়ে বলে মারুফ,
— এখানে থাকতে হইলে, আমার কথামতো চলতে হইবো?
অসহায় বকুল ফাঁদে আটকা পাখির মতো ছাড়া পাবার জন্য জোরাজোরি করতে থাকে। কিন্তু শক্তিতে পেরে উঠে না, নিরুপায় হয়ে কাঁদতে থাকে।

মাইয়াটারে ছাইড়া দে ব..জ্জাত? নইলে তোরে সোজা খুন কইরা ফালামু?

থতমত খেয়ে যায় মারুফ আচমকা মায়ের আগমনে, ছেড়ে দেয় বকুলকে। বকুল কাঁদতে কাঁদতে ভেতরের রুমে চলে যায়। ছেলের কাছে এসে সামনাসামনি দাঁড়ায় আফিয়া, চোখে চোখ রেখে বলে
— মানুষ আর হইতে পারলি না, জা..নোয়ার কোথাকার।
— সোজাসাপটা কইতাছি, ওরে আমার পছন্দ হইছে, বিয়ে পড়ায়ে দাও।
—- চড়ায়ে দাঁত ফেলে দেবো? মানুষের অসহায় অবস্থার সুযোগ নেস ক্যান?
— আমি তো ভালো করতে চাইতেছি, তুমি উল্টা বুঝো ক্যান মা?
— তোর ভালোর গুষ্টি কিলাই, আগে মানুষ হ, পরে চিন্তা করমু।

.
রাত পার হয়ে যায় আফিয়া বেগমের ঘুম আসে না, কি করা যায় ভেবে পাচ্ছেন না। কতক্ষণ পাহারা দেবেন ছেলেকে? সারাক্ষণ তো আর বাসায় বসে থাকতে পারেন না, বাড়ি বসে থাকলে তো আর পেট চলবে না। মানুষ হিসাবে যদি ছেলেটা ভালো হতো না হয় বিয়ে দিয়ে মেয়েটাকে নিজের কাছে রেখে দিতাম। নেশা করে এসে মারধোর করবে অশ্রাব্য গালি দেবে, জেনে শুনে তো আর পরের মেয়ের ক্ষতি করতে পারি না।

পাশে শুয়ে থেকে বকুলের চোখেও ঘুম নেই তার চোখ তো নির্ঘুমতার সাথে সন্ধি করেছে। নিজের জীবনের হিসেব মেলাতে পারেনা সে, শ্যাওলার মতো স্রোতের টানে ভেসেই চলেছে কোথায় গিয়ে থামবে তার জানা নেই? সুখ তার কাছে মরীচিকার মতো, হাতছানি দেয় আবার ধরার আগে পালিয়ে যায়। হায়রে জীবন বাঘের মুখ থেকে পালিয়ে শকুনের থাবার নিচে এসে ঠেকেছে ? কোথায় যাবে কি করবে কিছুই জানা নেই? শুধু এটুকু জানে এখানে থাকা নিরাপদ নয়, ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে মরে মরে বেঁচে থাকার চেয়ে একবারে মরে যাওয়া ভালো।

হাসনা পারভীন সোফায় বসে আছেন, বকুল তার পায়ের কাছে অবনত হয়ে বসা, আফিয়া পিরিচ থেকে মিষ্টি তুলে মুখে দিচ্ছেন।
— কি সমস্যা তোমার বাসায়? কেনো বকুলকে রাখতে পারছো না?
— ম্যাডাম, ঘরে আমার জোয়ান পোলা, আমি সব সময় ঘরে থাকি না, বকুল সোমত্ত মাইয়া, উল্টাপাল্টা কিছু হইয়া গেলে আমি আর ফিরাইয়া আনতে পারুম না কিছু।
—- হুমম তা ঠিক, একবার ঘটনা ঘটে গেলে আর শত চেষ্টা করলেও আর তা শোধরানো যায় না।
—- জ্বি ম্যাডাম
— এখন তুমি কি করতে চাচ্ছ?
— ম্যাডাম, বকুলরে আপনের কাছে রাখেন, মাশাল্লাহ আপনার কত্তবড় বাড়ি এককোনায় পইড়া থাকবো, আপনার ঘরের কামকাইজ করবো পেটেভাতে বাঁইচা থাকবো।
— বেশ থাকবে আমার কোনো আপত্তি নেই? আমি তো সেদিনই রাখতাম, পরে ভেবে দেখলাম তোমার এলাকায় মেয়ে তোমার দাবি আছে। তুমি নিজে থেকে না রেখে গেলে আমি কিভাবে বলি।
—- আমারে বাঁচাইলেন ম্যাডাম, বুক থেইক্কা পাত্থর সইরা গেলো? এরচেয়ে নিরাপদ জায়গা ওর লাইগা আর হয় না। আমার ভাইয়ের কাছেও আমার মুখ বাঁচলো।

ঝুমা দৌড়ে এসে বকুলকে জড়িয়ে ধরলো,
— তুমি এখন থেকে আমাদের বাসায় থাকবে? বেশ মজা হবে আমিও কথা বলার লোক পাবো।
আফজাল আহমেদ ছুটির দিন বলে বাসায় ছিলেন, তিনিও এসে বলেন
— ভালোই হলো বকুল এখানে থাকবে? আমিও চিন্তায় ছিলাম মেয়েটার কি করা যায় তাই নিয়ে। যাক এবার নিশ্চিন্ত হলাম।

শুরু হলো বকুলের নতুন জীবন, বাসা পেলো ঝড়ে ডানাভাঙা পাখি। কচুরিপানার মতো ভাসমান জীবনটা একটা জায়গায় স্থির হলো।
আফিয়া খালা যাবার সময় বকুলকে অনেকক্ষণ মাথায় হাতবুলিয়ে দিয়ে গেলেন
— মনে কষ্ট নিস না মা, তুই এইখানে অনেক ভালো থাকবি। আমার কাছে থাকলে তোর ভয়ে আতঙ্কে জীবন কাটতো, হয়তো তোর নিরাপত্তাও দিতে পারতামনা। দোয়া করি আল্লাহ তোরে একটা ভালো অবস্থানে রাখেন, মাথা তুইল্লা দাঁড়ানোর পথ দেখান।

আফজাল আহমেদের দুই মেয়ে এক ছেলে নিয়ে সংসার, বড় মেয়ে স্বামীসহ অষ্ট্রেলিয়া থাকে, তারপর ছেলে কানাডাতে সিএসই নিয়ে মাস্টার্স পড়ছে আর মধ্যবয়সের সন্তান ছোট মেয়ে ঝুমা ভিকারুননিসার ছাত্রী। ছিমছাম গোছানো সংসার কোন ঝুট ঝামেলা নেই। বকুল এসে সংসারের দায়িত্ব অনেকটা কাঁধে তুলে নিলো, কে কি খাবার কখন খেতে পছন্দ করে জেনে নিলো। সবার পছন্দের খাবারগুলো তৈরি প্রক্রিয়া শিখে নিলো। প্রতিদিন সকালের চা দিতে গিয়ে আফজাল আহমেদকে স্যার ডাকে হাসনা পারভীনকে ম্যাডাম, উনারা স্পষ্ট বলে দিয়েছেন — এসব স্যার ম্যাডাম ডাকা চলবে না।
তাই হাসনা পারভীনের নির্দেশ অনুযায়ী বকুল ওদেরকে মামা মামী ডাকে।

বকুলকে বেতনভুক্ত করতে চাইলে বকুল রাজী হয়নি তবুও হাত খরচবাবদ কিছু টাকা তাকে দেয়া হয়। আর আফজাল আহমেদ বকুলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে একটা ডিপিএস খুঁলে দেন।
বকুলের এখানে কোন কিছুর কমতি নেই, কিন্তু মনে একটা সুপ্ত বাসনা জেগেছে পড়ালেখা করার। সাহস হয় না মামা মামীকে বলার যদি কিছু মনে করেন, যদি ভাবেন বেশি পেয়ে আরো পাবার লোভ জেগেছে। মনের সাথে যুদ্ধ করে একদিন মামা মামীর সামনে যেয়ে দাঁড়ায়।
মামা বসে পত্রিকা পড়ছেন, মামী টিভি দেখছেন। বকুল সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই আফজাল আহমেদ চোখ তুলে তাকালেন
— কি রে বকুল? কিছু বলবি নাকি?
—- জ্বি মামা
—- তাহলে বল
—- জ্বি মামা, আমাকে ভুল বুঝবেন না।
— খুলে বল কি বলতে চাস? (হাসনা বললেন)
— মানে…. আপনারা সম্মতি দিলেই যাবো?
—- কিসের সম্মতি? কোথায় যাবি?
—- মামা মামী আমি পড়ালেখা করতে চাই।

আফজাল ও হাসনা দুজন দুজনার মুখের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলেন।

আফজাল বললেন
— সেতো ভালো কথা, তা আগে কি কোথাও পড়েছিস?
—- হ্যা মামা, আমি গ্রামের স্কুলে ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়েছি।
— রেগুলার স্টুডেন্ট হিসেবে তো তোকে নেবে না? এখন কি করবি?
— মামা আমি পেপারে পড়েছি, বিভিন্ন এনজিও স্কুলে পিছিয়ে পড়া ছাত্রছাত্রীদের পড়ানো হয় ওরকম একটা স্কুল হলেই হবে।
— হুমম বুঝলাম আচ্ছা দেখি খোঁজখবর নিয়ে। নতুন করে লেখাপড়া তুই কি পারবি?
— কেনো পারবে না, আমরা একটু দেখিয়ে দেবো, ঝুমা একটু ইংরেজি অংকে সাহায্য করবে, দেখে নিও হয়ে যাবে? ( বললো হাসনা)
–তাহলে আর কি? আমি সব খোঁজখবর নিয়ে দেখি।
—– মামী আমি ঘরের সব কাজ গুছিয়ে রেখে যাবো, আপনাকে কিছুতেই হাত দিতে হবে না। ( বললো বকুল)
হাসলেন হাসনা — আচ্ছা সে দেখা যাবে।

কয়েকদিন পর আফজাল আহমেদ খোঁজখবর নিয়ে ধানমণ্ডি লেকপাড় ঘেষা একটা এনজিও স্কুলে ক্লাস নাইনে ভর্তি করিয়ে দিলেন।
বকুলের খুশির সীমা রইলো না, আল্লাহর কাছে হাজার শুকরিয়া জানালো, মামা মামীর কাছে করজোড়ে কৃতজ্ঞতা জানালো।
প্রতিদিন ভোরে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে সকালের নাস্তা দুপুরের খাবার সব রেডি করে ফেলে। দুপুরে কয়েকটা গরম ভাত নিজেই করে ফেলেন হাসনা পারভীন আর ছুটা বুয়া অন্যান্য সব কাজ করে দিয়ে যায়।
বেশ চলছে বকুলের পড়ালেখা….


একা একা উঠানে পায়চারি করছেন মিয়া সাব, ভেতরে ভেতরে তার অনেক খেদ।

এই জীবনে যা চেয়েছেন সবই হাসিল করেছেন স্বেচ্ছায় হোক বা জবরদস্তি করে হোক। এই প্রথম কোন জিনিস তার হাতছাড়া হলো, এতটুকু একটা মেয়ের হাতে পরাজয় মেনে নিতে তার কষ্ট হচ্ছে। রাতারাতি হাওয়ায় মিশে গেলো মেয়েটি?
তমিজ সর্দার সামনে এসে দাঁড়ালেন
— মিয়া সাব আমারে ডাকছিলেন?
— হ, কই থাহস আজকাল? তোরে তো খুইজ্জা পাওন যায় না?
— কাছাকাছিই তো ছিলাম? ভাবী সাব ডাইকা হাটে পাঠাইলো, সাবেরা আম্মা নাকি বাড়ি আইবো?
—- ও আচ্ছা ছোট আম্মা আইবো? তাই কাইল টাইমমতো রেলস্টেশনে যাইস কিন্তু, আম্মার য্যান খাড়ায়ে থাকা না লাগে।
— জ্বি আইচ্ছা।
—- শোন যে কারণে তোরে খুঁজছিলাম।
— জ্বি
—- বকুলের কোন খোঁজ পাইলি?
—- না মিয়া সাব ।
— আর যে নদী পার কইরা দিছে হের?
— জি না পাই নাই। মিয়া সাব আপনে এই বিষয়ডা নিয়া চিন্তা বাদ দেন তো? মাইয়া যেখানে গেছে যাউক, হে তো আর আইসা জনেজনে সব বইলা বেড়াইতেছে না, আর সবুজ্জাও তো কুনুদিন ফিরা আইবো না, কৈফিয়তও চাইবো না। আর জমিজমা বাড়িঘর সবতো আপনের হইয়া গেলো।
—- তমিজ্জা কামডা তুই করস নাই তো?
— মিয়া সাব, আপনে আবার আমারেই সন্দেহ করলেন?
— আমার ক্যান যে তোরেই সন্দেহ হয়। ঘটনার দিন তো তুই ছিলি আর কেউ তো ছিলো না, কেউ জানে না জানবার কতাও না।
— আপনে এক কাজ করেন, আমারে কাম থেইক্কা বাদ দেন মিয়া সাব, এই অপবাদ আমি আর নিতে পারতাছিনা।
— যা যা কামে যা মেলা প্যাঁচাল পারস।

তবারুক মিয়ার দুইটি কন্যা সন্তান বড় মেয়ে সায়মা সুলতানা স্বামী সন্তান সহ সৌদি আরব থাকে আর শেষ বয়সের কন্যা সাবেরা সুলতানা ঢাকা থেকে পড়ালেখা করে। ছোট মেয়েকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন মেয়েকে জজ ব্যারিস্টার বানাতে চান, ছোট বেলা থেকে তাই মেয়েকে শহরের নামীদামী স্কুলে পড়িয়েছেন স্কুল হোস্টেলে রেখে, এখন মেয়ে বেসরকারি ভার্সিটিতে পড়ে। পুত্র সন্তানের জন্য বড্ড আক্ষেপ ছিলো মিয়া সাবের কিন্তু বিধির বিধান মেনে নিয়েছেন।

মিয়া সাবের স্ত্রী গোবেচারা সরল স্বভাবের রাহেলা খাতুন , সাত চড়েও রা নেই, স্বামীর সব অন্যায় অত্যাচার দেখেও না দেখার ভান ধরে থাকেন। বাইরের মানুষ যতটা না মিয়া সাবকে ভালো জানে ঘরের মানুষ রাহেলা জানে তার স্বামী কতবড় অমানুষ। মনে মনে স্বামীকে প্রচন্ড ঘৃণা করেন কিন্তু মুখে বলার সৎসাহস নেই তার। রাহেলা জানে তার ছোট মেয়েটিও বিপথে গেছে, যা খুশি তা করে বেড়ায় বন্ধুবান্ধব হৈ হুল্লোড় আড্ডা এই তার জীবন, রাস্তায় দাঁড়িয়ে দেদারসে সিগারেট খায়, বড় ছোট লেহাজ নেই। বোনের ছেলে খোঁজ নিয়ে এসে এসব জানিয়েছে তাকে, কিন্তু কি করবেন তিনি? তার কথা কেউ মান্য করবে না তাই চুপ থাকাই শ্রেয় মনে করেন?

সাবেরা সেমিস্টার ভ্যাকেশনে বাড়ি এসেছে। আসা অবধি বাবার সাথে একটা কথাও বলেনি বলবেও না, কথা না বলা বিষয়টা বারো বছরের, বিগত বারো বছর যাবত সে তার বাবার সাথে কথা বলে না। প্রতিবার মিয়া সাব কথা বলার চেষ্টা করেন, এবারও তার ব্যতিক্রম হয় না।
—- আম্মা কয় দিনের ছুটিতে বাড়ি আইছেন?
আমি অনেক খুশি হইছি আপনারে দেইখা, থাকেন যতদিন ইচ্ছা।
যখন যা খাইতে ইচ্ছা হয় বইলেন? আপনারাই তো আমার সব?
আপনাগো লাইগাই তো আমার এত সম্পদ।
ঠিক আছে আপনে খান আমি উঠলাম। আমার আবার একটা বৈঠক আছে,
ফিরা আইসা কথা কমুনে ঠিক আছে?

উত্তর না পেয়েও একা একাই কথা বলে উঠে চলে যান মিয়া সাব। রাহেলা উঠে মেয়ের পিঠে হাত রাখেন ।
—- কি রে বাপের একটা কথারও তো উত্তর দিলি না, এটা কি ঠিক?

সাবেরা কিচ্ছু না বলে শুধু মায়ের মুখে দিকে তীর্যক দৃষ্টিতে তাকায়, তাকানোতেই রাহেলা উত্তর বুঝে যান। কথা ঘুরাতে মেয়েকে বলেন
— আরেকটু কবুতরের মাংস দেই তোরে? হোস্টেলে কি না কি খাস?
—- আম্মা তোমার এত ধৈর্য ক্যান?
—- মাইয়া মানুষ তাই।
—- মাইয়া মানুষ কি মানুষ না?
—- জানি না রে মা, নিজেরে মানুষ ভাবতে ভুইল্লা গেছি।
— মানুষ ভাবতে শিখো, নইলে সবাই পায়ের তলায় দাবাইয়া রাখবো।
— আর কি দাবাইবো রে মা, জীবনতো শেষই আমার, এখন শুধু মরণের অপেক্ষা।

খাওয়াদাওয়া শেষে মা মেয়েতে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। সাবেরা মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
—- মা বকুলরে ঢাকা শহরে দেখলাম।
— কি কস? কই দেখলি?
— ধানমন্ডি আমাকে দেখেও না চেনার ভান করে চলে গেলো।
— এদিকে তোর বাপে তো ওরে পাগলের মতো খুঁজতাছে।
— আমার বাপের এত গরজ কিসের?
—- তার হাতেই তো সবুজ বিদেশ যাবার আগে বকুলরে সঁইপা দিয়া গেছিলো।
—- তাইলে বকুল পলাইলো ক্যান? বেশি আদরের যন্ত্রণায় নিশ্চয়ই?

রাহেলা স্তব্ধ চোখে মেয়ের দিকে তাকালেন।
— এইভাবে তাকাইয়ো না মা, তোমার আরো শক্ত হওয়া দরকার ছিলো, তোমার জন্যই…… থাক আর বলমু না তুমি কষ্ট পাবা। শুধু তোমার জন্য এই নরকে আসি মা, নইলে কোনদিন আসতাম না।
উঠে বারান্দায় চলে যায় সাবেরা, পকেট হাতড়ে সিগারেট বের করে ঠোঁটে দিয়ে তাতে আগুন ধরায়।
ব্যথাতুর মন নিয়ে ভেজা চোখে বিছানায় এলিয়ে থাকেন রাহেলা।

.
ভোরে উঠতে দেরি হওয়াতে সব কাজ শেষ করতে সেদিন দেরি হয়ে যায় বকুলের। মামী যদিও বলেছেন,
— তুই যা বকুল আজ আমি রেঁধে ফেলবো।

নিজের বিবেকবোধ থেকে বকুল, মামিকে চুলার কাছে আসতে দেয়নি। যতটা সম্ভব দ্রুততার সাথে কাজ শেষ করেছে।
স্কুলের কাছাকাছি আসার পর রাস্তা পেরুতে গিয়ে মনে হলো, মিয়া সাবের ছোট মেয়েকে রিকশায় দেখলো। না দেখার ভান করে দ্রুত রাস্তা পার হলো, পেছন থেকে এই বকুল… বকুল ডাক শুনতে পেয়েও পেছনে ফিরে সে তাকায়নি। পাছে সত্যিই সত্যি চিনে ফেলে তবে সর্বনাশ হবে, এখন অন্য কেউ ভেবে ভুলে যাবে।

বিকেলে বারান্দায় বসে থেকে এসব কথা ভাবতে ভাবতে, বকুলের সারা গা কাঁটা দিচ্ছে।
যদি সাবেরা আপা চিনে থাকে, সে যদি তার বাবাকে ফোন করে সব বলে দেয়? যদি ওরা বাড়ি চিনে এসে ধরে নিয়ে যায়? যদি আবার ওই নরকে ফিরে যেতে হয়?
না না সে কিছুতেই যাবে না, কখনোই না।
মামা মামী তাকে যেতে দেবে না, তারা তাকে বাঁচাবেই, এইটুকু বিশ্বাস তাদের প্রতি আছে বকুলের।
— বকুল… বকুল কোথায় গেলি?
মামীর ডাকে বকুল সাড়া দেয়,
–আসছি মামী।
হাসনা এসে দেখেন বকুল বারান্দায় বসে আছে, চেহারায় ভয় আর আতঙ্ক।
—- কি রে কি হয়েছে তোর? চেহারার এই হাল কেনো?
— কই কিছু না তো মামী।
— খুঁলে বল আমায়? কি হয়েছে তোর?
—- মিয়া সাবের ছোট মেয়ে আমাকে রাস্তায় দেখে ফেলেছে।
— সেকি রে কিভাবে দেখলো?
— আমি স্কুলে যাচ্ছিলাম, উনিও কোথাও যাচ্ছিলেন।
— কথা বলেছিস?
—- না আমি না চেনার ভান করে দ্রুত চলে গেছি, উনি পেছন থেকে নাম ধরে ডাকছিলেন।
—- আচ্ছা ভয় পাস না, বাসা চিনবে না, আর চিনলেও তুই না চাইলে তোকে এখান থেকে কেউ নিতে পারবে না। এখন আয় আমার সাথে বিকেলের নাস্তা বানাই।

..
সাবেরা তাদের একতলা বাড়ির ছাদের উপর সিগারেট খেতে খেতে পায়চারি করছে আর দুঃসহ স্মৃতিগুলোর রোমান্থন করছে।

..
চলবে

#শামীমা_সুমি

#খেরোখাতার_ছেঁড়াপাতা — ৬

প্রথম যেদিন শরীরের স্পর্শকাতর অঙ্গে হাত দেয় জয়নাল স্যার সেদিন ভয়ে লজ্জায় সাবেরা খুব কেঁদেছিলো।

তারপর প্রায় দিনই পড়া বুঝিয়ে দেবার নামে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। হোস্টেলে থাকা মেয়ে কাছেপিঠে মা বোন নেই কার কাছে বলবে এসব কথা। উপরন্তু স্যার ভয় দেখিয়েছেন কাউকে বললে বদনাম হবে উনি ফেল করিয়ে দেবেন। আর প্রিন্সিপাল স্যারের কানে গেলে উনি স্কুল থেকে বের করে দেবেন। তবুও সাহস করে হোস্টেলের রুমমেট মিতুর কাছে চুপিচুপি বলেছিলো, মিতুর কাছে শুনলো স্যার অনেক মেয়ের সাথেই এমন করেন।

রোজার ছুটিতে বাড়ি গেলো সাবেরা রোজা ও ঈদ আনন্দ শেষ হবার পর, স্কুলে ফিরবার সময় হতেই বেঁকে বসলো স্কুলে ফিরবে না । মায়ের জোরাজোরিতে সব খুঁলে বললো, মা রাহেলা সিদ্ধান্ত নেন মেয়েকে আর এমন স্কুলে পাঠাবেন না। মা, বাবাকে বিষয়টা বোঝাতে গিয়ে খুব মার খান। বাবার বক্তব্য হলো– স্কুল হোস্টেলে না যাবার জন্য মেয়ে বাহানা খুঁজে বের করেছে।
বাবার প্রতি ঘৃণায় মন পরিপূর্ণ হয়ে যায়, ঘৃণার ষোলকলা পূর্ণ হয় মাঝরাতে, কাজের মেয়ে স্বপ্নার মিহিসূরে কান্না শুনে ঘুমভেঙে গিয়ে তাকে বাবা হাতে সম্ভ্রমহানি হতে দেখায়। গিয়ে দেখে স্বপ্না দু’হাতে বাঁধা দিচ্ছে কাকুতি মিনতি করছে আর বাবা তার উপর চেপে আছে, দুজনেই উ… নাহ আর ভাবতে পারছে না। ছোটবেলায় দেখতে পেতো বাবা প্রায়ই গোলাঘর থেকে বের হোন, পরে চোখ মুছতে মুছতে বের হতো কর্মরত কাজের মহিলা। মা নির্বিকার যেনো কিছুই হয়নি বা তিনি চোখে কিছুই দেখতে পান না এমনভাবে থাকতেন।
ছোট বলে তখন কিছুই বুঝতো না, নিজের চোখের স্বপ্নার এই ঘটনা দেখার পর আর কোনদিন বাবার সাথে কথা বলার রুচি হয়নি, যার বাবার চরিত্র এমন তার মেয়ের সাথে অপ্রীতিকর ঘটনা হবে এটাই তো প্রকৃতির লীলা।
পরদিন বিনাবাক্যব্যয়ে সাবেরা ঢাকা ফিরে যায় । নিয়ে যায় সাথে করে মায়ের অশ্রুস্নাত চোখের স্মৃতি।

ইতিমধ্যে জয়নাল স্যারের সাথে যোগ হয় মাসুদ স্যার, এক্সট্রা ক্লাস নেবার নাম করে আটকে রাখা, বুকে পিঠে হাত দেওয়া নিত্যকার ব্যাপার তাই এসবই চলতে লাগলো। কৈশোর ধ্বংস করে দেয়া এই বিষয়গুলো ধীরেধীরে গা সওয়া হয়ে গেলো।
সদ্য জয়েন করা রাশেদা ম্যাডাম এসে মেয়েদের এই যন্ত্রণার কথা বুঝলেন, সাবেরা সহ বিকৃতমনস্কতার শিকার মেয়েগুলোকে সান্ত্বনা দিতেন, কিন্তু নিজ থেকে কোন ব্যবস্থা নিতে পারলেন না। কিইবা করবেন মধ্যবিত্ত পরিবারের টানাপোড়েনের সংসারে চাকুরী সোনার হরিণ, সেটা হারানোর ভয়ে কিছুই করতে পারলেন না, সাবেরাও সবকিছু মেনে নিলো।

‘প্রতিকার যেখানে নেই সেখানে বিকৃত বিষয়টাকে উপভোগ করাই শ্রেয়।’

সবকিছুরই শেষ আছে, বাঘের উপরেও টাঘ আছে, তেমনি করে জয়নাল স্যার আর মাসুদ স্যার প্রশ্রয় পেতে পেতে একসময় আগুনে হাত দিয়ে বসলেন। নতুন ভর্তি হওয়া এক ছাত্রী যে কিনা বিত্তশালী ও রাজনৈতিক পরিবারের মেয়ে তার সাথে এসব আচরণ শুরু করেন। মেয়ে সাহস করে পরিবারকে সব বলে দিয়েছে আর যায় কোথায়? তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেলো! স্কুলে টনক নড়লো অভিভাবকদের, থানায় কেস করা হলো দুই শিক্ষকের নামে জেল জরিমানা হলো স্কুল থেকে তাদের বহিষ্কার করা হলো।।

ভয়ংকর সব কৈশোর দমনীয় স্মৃতি নিয়ে মাধ্যমিক লেভেল পার হলো, উচ্চ মাধ্যমিকে উঠে আর ভয় ডর রইলো না। সদ্য কৈশোর পেরোনো মনে বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস, জগতটাকে জয় করার নেশা চেপে বসে। বন্ধু বান্ধবদের বাড়িতে আসা যাওয়া, পিকনিক, হলিডেটাইম স্পেন্ড সবই চলতো। সুবিধার জায়গা হলো প্রপার গার্জিয়ান নেই সময়মত হোস্টেলে পৌঁছাতে পারলেই হলো, পড়ালেখা শুধু পাস করাতেই টিকে রইলো টপার হবার চিন্তা কোন কালেই ছিলো না মাথায়।

এত এত নষ্ট মুহূর্তের মধ্যে সতিত্বটুকু নিভু নিভু প্রদীপের মতো টিকে ছিলো। সেটাও একদিন হারালো ক্লাবে বান্ধবীর জন্মদিনের পার্টিতে, হৈ হুল্লোড়ের মাঝে ড্রিংকসের সাথে চেতনানাশক খাইয়ে দিলো বান্ধবীর ভাই। হুল্লোড়ের মাঝে কারো খেয়াল রইলো না একটি ছেলে মেয়ে নিখোঁজ ঘন্টাব্যাপী, সর্বনাশ হয়ে গেলো একটি সরল বিশ্বাসী মেয়ের। বান্ধবীকে যখন সব বললো, সে উল্টো দোষারোপ করলো, বলা হলো শহরের স্মার্ট ছেলে পেয়ে লোভে পড়ে মিথ্যে অপবাদ দিয়ে ফাঁসানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
বন্ধুত্ব গেলো সতীত্ব গেলো বিশ্বাস ভেঙে চূর্ণ হলো।
বাবা মায়ের কাছে বলা হয়নি, বললে সেই পুরনো কাসুন্দি ‘ তুই গেলি কেনো?
বাবার এসব দেখার সময় কই? অন্যের সর্বনাশ করা থেকে সে ফুসরত পেলে তো? সাবেরা বোঝে এসব হয়তো ন্যাচার অফ রিভেঞ্জ, জমিনের মাটি আল্লাহ জমিনে ভাঙেন। এসব ঘটনার পর বেশ গুটিয়ে নিয়েছিলো নিজেকে, অনেক দিন খুব কেঁদেছিলো।
ডিপ্রেশন থেকে নেশায় আসক্ত হলো, নিয়মিত সিগারেট খাওয়া শুরু হলো। কোনরকমে এইচ এস সি পাস করলো সাবেরা।

বেসরকারি ভার্সিটিতে ভর্তি হলো সাবেরা সাবজেক্ট ল এন্ড জাস্টিস, সেমিস্টার ভ্যাকেশনে বাড়ি আসলো সাবেরা, বলতে গেলে মায়ের অসহায় মুখটা তাকে টেনে আনলো। বাড়ি এসে দেখলো সবুজ একটা ফুটফুটে ১৪/১৫ বছরের মেয়েকে বিয়ে করে নিয়ে এসেছে। কি সুন্দর দেখতে মেয়েটি নামটা ভারী মিষ্টি ‘বকুল’ কেমন যেনো চারিদিকে সুবাস ছড়ায়।
বকুলের আর সবুজের খুঁনসুটি ভরা প্রেম দেখলে বড্ড লোভ হতো সাবেরার, আহা এমন একটা জীবন যদি হতো সাবেরার!

এরই মাঝে বছর দুই গত হলো, একবার বাড়ি এসে সাবেরা শুনে গেলো সবুজ মালয়েশিয়া যাচ্ছে। বউকে রেখে যাচ্ছে সাবেরার মা বাবার জিম্মায়, ওদের বাড়ি থাকবে। সাবেরার মনে আশংকা জেগেছিলো আদৌও কি বকুল স্বস্তিতে থাকতে পারবে এই বাড়িতে? তার আশংকা সত্যি হলো, মেয়েটা পালিয়ে বেঁচেছে।

কি রে ঘুমাবি না? অনেক রাত তো হলো, আর কতক্ষণ জাগবি?
মায়ের প্রশ্নে সাবেরার সম্বিৎ ফিরে আসে, ভাবনার জগত থেকে বাস্তবে ফিরে আসে।
— হ্যা আসছি মা।
— আয় তবে আমি নিচে গেলাম।
— মা
— হুমম
— বাবাকে বকুলের কথা বলো না, মেয়েটাকে বাঁচতে দাও।
— আচ্ছা…… বলবো না। শোন?
—- বলো?
—- তোর নামে কি সব শুনি?
—- কি শোনো?
— তুই নাকি আজেবাজে ছেলেমেয়েদের সাথে মিশিস?
—- ওরা সবাই আমার বন্ধু মা।
—- খারাপ কিছু করিস না তো?
—- মা…. সব রক্তের টান, আমার শরীরের রক্ত দুষিত মা, আমার কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করো না।
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে রাহেলা… দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিচে নেমে যায়।

.
ঘড়ির কাঁটার সাথে সময় গড়িয়ে চললো দুই বছর পার হয়ে গেলো। কঠোর নিষ্ঠা ও অধ্যবসায়ের সাথে বকুল একে একে ক্লাস ডিঙিয়ে খুব ভালোভাবেই এস এস সি পাশ করলো, আফজাল আহমেদ ভীষণ খুশি হলেন বকুলের আত্মপ্রত্যয় দেখে, নিঃসন্দেহে মেয়েটার ভেতরে আগুন আছে, মেয়েটা পারবে নিজেকে জয়ী করতে।
আফজাল আহমেদ বকুলকে কাছাকাছি একটা কলেজে মানবিক শাখায় ভর্তি করে দিলেন।

.

মামা আমি একটা কিছু করতে চাই?

আফজাল আহমেদ খবরের কাগজ পড়ছিলেন, বকুল চায়ের কাপ হাতে সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। পত্রিকা মুখের সামনে থেকে সরিয়ে আফজাল বললেন
— কি করতে চাস?
— মামা আপনাদের ঋণ আমি কোনদিন শোধ করতে পারবো না।
— আচ্ছা বুঝলাম, অতোবার বলতে হয় না, এখন কি করতে চাস সেটা বল?
—- এমন কিছু যা থেকে আমার ইচ্ছে-পূরণ হবে আবার দুটো টাকা পয়সাও আসবে।
— টাকা পয়সা! টাকা পয়সা কেনো? তোর টাকা লাগলে বল আমি দেবো?
—- না মামা আমি স্বাবলম্বী হতে চাই?
— পড়িস তো মাত্র ইন্টারমিডিয়েটে? এখন তুই স্বাবলম্বী হবি কি রে? অনেক সময় পড়ে আছে? আগে মন দিয়ে পড়াশোনা কর?

কি কথা হচ্ছে মামা ভাগ্নিতে?
বলতে বলতে সোফায় এসে বসলেন হাসনা পারভীন।
—- বকুল স্বাবলম্বী হতে চায়?
— হা হা হা হা, পাগলী আগে ইন্টারমিডিয়েট পাস কর। শোনো ওর হাত খরচটা বাড়িয়ে দাও?
—- আচ্ছা দেবো (বললেন আফজাল)
—- না না মামা মামী আপনারা আমাকে ভুল বুঝছেন? আপনারা আমায় ডিপিএস করে দিয়েছেন? আর যে হাত খরচ দেন তাতে খরচ শেষে আরো বেঁচে যায়।
— তাহলে?
— আসলে মামী, আমি চাচ্ছি অবসর সময়ে কিছু একটা করতে?
— যেমন?
— মামী আমিতো ছাত্রী হিসেবে তত ভালো নই টিউশনি করতে পারবো না, আর অন্যান্য উল্লেখযোগ্য কোন গুণও তেমন নেই। তবে আমি নকশীকাঁথা সেলাই করতে জানি?
— বাহ বেশ তো! কিভাবে শুরু করতে চাস?
— কাপড় কিনে এনে নিজেই নকশা আঁকবো, তারপর সুই সুতোর বুননে তা ফুটিয়ে তুলবো।
— কিন্তু কম্বলের যুগে কাঁথা কে গায়ে দেয়? কেউ কি কিনবে?(আফজাল আহমেদ)
—- কি বলো তুমি, অনেক সৌখিন মানুষ আছে যারা এখনো কাঁথা গায়ে দেয়। (বললেন হাসনা পারভীন)
— আচ্ছা দেখো তবে ও কি করতে চায়? আর কিভাবে সাহায্য করা যায়।

শুরু হলো বকুলে নতুন জীবন যাত্রা, খুব ভোরে উঠে সকালের নাস্তা, দুপুরের রান্না সব গুছিয়ে, কলেজে চলে যায়। ছুটি হতেই কোথায় সময়ক্ষেপণ না করে সোজা বাড়ি এসে গোসল খাওয়াদাওয়া অন্যান্য কাজ সেরেই বসে যায় কাপড়ে নকশা ফুটিয়ে তুলতে। প্রথমে মামী পুজি দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বকুল নেয়নি সে নিজের জমানো টাকা থেকে কাপড়, সুতা সহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে আনে। বকুলের হাত কাজ দেখে হাসনা মুগ্ধ হয়ে যান, এত সুন্দর করে ফুল লতাপাতা ফুটিয়ে তুলেছে যে জীবন্ত মনে হয়।

প্রথম খদ্দের হোন হাসনা, ন্যায্য দাম দিয়ে কিনে নেন বকুলের সৃজনশীলতাকে। নতুন কাজে হাত দিয়েছে বকুল কাস্টমার পাবে কই? তাই সহায়তা করার জন্য হাসনা তার মহিলা সমিতির মিটিংয়ে নিয়ে যান দুয়েকটা স্যাম্পল হিসাবে। সবাই কাজ দেখে মুগ্ধ হয়ে লুফে নিলো, কয়েকজন তো অর্ডার দিয়ে অগ্রিম টাকাও দিয়ে দিলো।

বকুল সবদিক সামলে মাসে ২/৩টার বেশি কাজ তুলতে পারে না, কিন্তু কাজ নিখুঁত হয় বলে খুব ভালো দাম পায় আর এর ব্যবস্থা হাসনা পারভীনই করে দিয়েছেন। সবার হাতে হাতে মোবাইল চলে এসেছে তাই বকুলও নিজের জন্য একটা নোকিয়া বাটন মোবাইল সেট কিনে নিলো। প্রতি মাসে যেটুকু ইনকাম হয় পুজি রেখে বাকিটা ব্যাংক একাউন্টে রেখে দেয়,প্রতি মাসে অল্পস্বল্প যা ই আয় হোক, বকুলের মনে সাহস সঞ্চয় হয়। এখানে তো সারাজীবন পড়ে থাকা ঠিক হবে না, একটা সময় তো একা হতেই হবে? সে সময় যেনো নিজে সহ আরও ১০জন নির্যাতিতা নারীর শক্তি হতে পারে এটাই তার স্বপ্ন।

.
ক্লাস গ্যাপে ক্যান্টিনে বসে আছে সাবেরা, পেছন থেকে তনিমা এসে কাঁধে হাত রাখলো।
— তুই এখানে? আর আমি পুরো ক্যাম্পাস ঘুরে এলাম।
— কেনো খুঁজছিস?
— আমি না অয়ন ভাইয়া খুঁজছে।
— কেনো? আমাকে খোঁজার কি হলো?
— সে আমি কি জানি?
— খুঁজুক, গাধা একটা। সারাক্ষণ পেছনে পড়ে থাকে।
— একটা কথা বলি?
— বল?
— এইভাবে যে পোশাকের মতো বয়ফ্রেন্ড পাল্টাস, তোর খারাপ লাগে না?
— নায়ায়া, খারাপ লাগার কি হলো? নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে বেশ মজা লাগে, আমি।খুইউউব মজা পাই।
—- এসব করে কি পাস?
— ছেলেরা বলে খেয়ে ছেড়ে দিয়েছি, তাই আমিও ওদের খেয়ে ছেড়ে দেই।
—- হা হা হা হা হা
— হাসলি….. পাগল সত্য বলে, লোকে ভাবে পাগলামি।
—- সিরিয়াস হ সাবেরা, এইভাবে জীবন চলে না
— চুপ থাক,
কি যাতনা বিষে, বুঝিবে সে কিসে
কভু আশিবিষে দংশেনি যারে।

দুজনার কথার মাঝেই ফোন কল চলে এলো। সাবেরা কল রিসিভ করলো
— হ্যালো মা
— কেমন আছিস?
— ভালো তুমি?
—- আমিও ভালো আছি
— হা হা হা হা তুমি ভালো থাকো কি করে মা? ইউ আর এ গ্রেট ওম্যান হা হা হা হা
— এমনিই ভালো থাকি, শোন তোর বাবা তোর বিয়ের জন্য পাত্র দেখেছে, তুই একবার বাড়ি আয়।
— মেজাজ খারাপ করিও না মা, তোমাদের না বলে দিয়েছি ? আমি কোনদিন বিয়ে করবো না।
— কিন্তু মা তুই যেভাবে আছিস এভাবে তো নিরাপদ না।
— নিরাপত্তার ধোঁয়া তুলো না, তোমাদের মুখে এসব মানায় না।
— তোকে বিয়ে দেয়া আমাদের কর্তব্য, —-বুবুকে বিয়ে দিয়ে কর্তব্য করেছো চলবে।
— ও তো সুখেই আছে।
— হ্যা পান থেকে চুন খসলেই গায়ে হাত তোলে জামাই, তোমাদেরকে বললে বলো, ও রকম সংসারে একটু আকটু হয়ই।,আর স্বামী মারলে কিছু হয় না, তুই বেহেশত পাবি। দুনিয়ায় নরকে পুড়ে এমন বেহেশত কি কোন দরকার আছে মা?

অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে চলে আসা অশ্রুটুকু মুছে নেয় সাবেরা, ঘাড় ঘোরাতেই দেখে অয়ন বসে আছে।
— কখন এলে?
— এইতো , তুমি কথা বলছিলে তাই ডাকিনি।
— কেনো খুঁজছিলে?
— এমনি, তোমার সাথে দেখা করতে ইচ্ছে হলো।
— কিছু কিছু ইচ্ছেকে গলাটিঁপে দিতে হয়।
— আমি পারতপক্ষে ইচ্ছের মৃত্যু ঘটাই না।
— হুমম, বুঝলাম
— তুমি আসলে উপরে যতটা শক্ত দেখাও ততোটা শক্ত নও।
— আমি পাথর
— আমি পাথরেও ফুল ফোটাতে পারি।
—- ফোঁটাতে থাকো (সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করতে করতে)
— শোন, আমার একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে সিনিয়র এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে অফার এসেছে, স্টার্টিংয়ে ভালো সেলারী দেবে।
— তো আমি কি করবো?
— বিয়ে
— আমি বিয়ে করবো না।
—- তাহলে কি করবে?
— তুমি তো জানোই আমি খারাপ মেয়ে, লিভ ইনে যাবো তবু বিয়ে করবো না।
— কোনদিনই বিয়ে করবে না?
— করবো হয়তো, বছর দশ বিশ পরে যখন পাশাপাশি বসে গল্প ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না।
—- তাহলে আমি অপেক্ষায় থাকবো।
— নায়ায়া
—- কেনো?
—- তুমি খুব ভালো ছেলে, একটা নষ্ট মেয়ের জন্য নিজের জীবন শেষ করতে পারো না, কিছুতেই না। আমি তা হতে দেবো না।

অবাক হয়ে চেয়ে থাকে অয়ন।

.
চলবে

#শামীমা_সুমি