খেরোখাতার ছেঁড়াপাতা পর্ব-৭+৮

0
122

#খেরোখাতার_ছেঁড়াপাতা– ৭

বুঝলি বকুল আমার ভীষণ খুশি খুশি লাগছে, কত্ত বছর পর ছেলেমেয়ে দুটো দেশে আসবে তাও আবার একসাথে।

হাতের তালুতে নিয়ে গোল্লা গোল্লা নারিকেল নাড়ু বানাতে বানাতে বকুল মুখ তুলে দেখে এক আত্মতৃপ্ত মায়ের মুখ। নিজের মায়ের কথা মনে পড়ে যায় বকুলের, এইভাবেই পরিতৃপ্ত মুখে বকুলের জন্য মা পিঠা মোয়া নাড়ু বানাতো । কোথায় হারিয়ে গেলো, অন্ধকার অমাবস্যা গিলে খেলো তার সূবর্ণ অতীত।
— কিরে কোথায় ডুবে গেলি?
— কিছু না মামী আপনি বলেন?
— মেয়েটা তো জামাই নাতিপুতি নিয়ে এবার দেশে আসবে। দুই ভাইবোন যেহেতু একসাথে আসবে ছেলেটাকে এবার আসলে বিয়ে করিয়ে দেবো। সময় হাতে আছে আরো দুইমাসের মতো, এরই মধ্যে মেয়ে দেখে রাখবো। ভালো হবে না, কি বলিস?
—- হ্যা মামী খুব ভালো হবে।
— শোন তুই কিন্তু ওদেরকে নানারকম পিঠা বানিয়ে খাওয়াবি, তোর হাতের রান্নাবান্না খুব ভালো।
— আপনার কোন চিন্তা করতে হবে না মামী। আমি সব সামলে নেবো, আপনি শুধু ওদের সময় দেবেন।
— তুই একটা লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে রে বকুল।
— আপনি আরো ভালো মামী, নইলে চেনা নেই জানা নেই একটা মেয়ের জন্য মানুষ এত্ত কিছু করে?
— এভাবে বলিস না রে মা, তোর চোখ দেখেই আমি বুঝেছিলাম তুই পরিস্থিতির শিকার, তুই ভীষণ রকম নির্যাতিতা। তাইতো পাশে দাঁড়িয়েছি।

এইচএসসি ফাইনাল পরীক্ষা শেষে কিছুদিন গ্যাপ, একদিন মামা ডেকে বললেন
— বকুল শোন?
— জ্বি মামা।
—- এখন তো পরীক্ষার গ্যাপ, তুই বরং কোন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে পাটজাত পন্য তৈরির উপর প্রশিক্ষণ নিয়ে নে? কাঁথা আর কজন কিনবে দুই তিনটা বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করতে পারলে তোর খুব কাজ দেবে? চাইলে একসময় ব্যবসাও করতে পারবি।
— আচ্ছা মামা, মামীর সাথে পরামর্শ করে নেই।
— আচ্ছা কর? তোর প্রতিদিনের কলেজ টাইমেই হবে তাই বেশি বেগ পেতে হবে না। অন্যান্য কাজ সামলে নিয়ে করতে পারবি, তাই আমার মনে হয় তোর মামীও অমত করবে না।

মামীর সম্মতি নিয়ে দুইমাসের কোর্সে ভর্তি হয়ে গেলো। পাটজাত পন্য তৈরি শিখতে গিয়ে, সেলাই মেশিন চালানোও শেখা হয়ে গেলো। বকুল অল্পদিনেই আয়ত্ত করে নিলো সবকিছু, চমৎকার সব শপিং ব্যাগ, হ্যান্ডব্যাগ, পার্স, পাপোশ, ওয়ালমেট, জুতা, স্যান্ডেল, কার্পেট, সোফার কভার কুশন ইত্যাদি বানানোও শিখে গেল।

ওদিকে মামী দেদারসে মেয়ে দেখে চলেছেন তার একমাত্র ছেলে আবীর এর জন্য , হাজার ঘর দেখে বেছেকুছে মেয়ে আনবেন। এই নিয়ে ঝুমা আর আফজাল খুব হাসাহাসি করেন।
— তুমি দেখি দেশে আর কোনো মেয়ে বাদ রাখবে না?
— রাখবো না ই তো, ১০টা না ২০টা না একটা মাত্র ছেলে আমার। নিজের ছেলে বলে বলছি না, আচারে ব্যবহারে আমার ছেলে হাজারে একজন।
— আচ্ছা তোমার যেভাবে পরিতৃপ্তি আসে তাই করো।

ঝুমা আর বকুল একইসাথে এইচ এস সি পাশ করলো, ঝুমা এতদিন ভর্তি কোচিং করেছে এবার সে বিভিন্ন মেডিকেলে ট্রাই করতে লাগলো।
বকুলের সাধ্য নেই তাই সে বিএ ক্লাসে ভর্তি হলো কাছাকাছি একটা কলেজে। সপ্তাহে ৩/৪দিন ক্লাস করে বাকী সময় মামীর কাজে সাহায্য করে। অবসরে ঘরে বসেই অর্ডারের নকশীকাঁথা, ওয়ালমেট, বিছানার চাদরে নকশা তোলে। পাটজাত পন্য তৈরির কাঁচামাল সব এনে রেখেছে এগুলোও একটু একটু চর্চা করছে। পাটের তৈরি ব্যাগ পার্স এসব কেনে ঝুমার বন্ধু বান্ধবরা। বকুলের মোটামুটি ভালোই আয় হতে থাকে। সব টাকা একাউন্টে জমা করে রাখছে ভবিষ্যৎ স্বপ্ন পূরণের জন্য, দুস্থ অসহায় নারীদের নিয়ে ব্যবসা শুরু করাই তার একমাত্র লক্ষ্য।

সময় পেরিয়ে অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত দিন এসে গেলো। বাসায় একটা উৎসব উৎসব আমেজ বিরাজ করছে। আফজাল আহমেদের একমাত্র ছেলে আবির আহমেদ , আর বড় মেয়ে নিগার আফরোজ রুমার পুরো পরিবারে আজ দেশে আসছে।
মামীর কোনদিকে তাকানোর হুশ নেই প্রত্যেকের জন্য তাদের পছন্দের খাবার তৈরি করছেন, নাতনী মাইশাকে তিনি দেখেছেন স্বচক্ষে কিন্ত নাতি অর্ক জন্মের পর এবার প্রথম আসছে বাংলাদেশে।

প্রত্যেকের জন্য তার নির্ধারিত রুম ঝেড়ে মুছে পরিস্কার করে পরিপাটি করে রাখা হয়েছে।

দুপুরের ফ্লাইটে আবীর চলে এলো বাসায় ৫/৬ বছর পর মা বাবাকে কাছে পেলো কথা যেনো আর ফুরাচ্ছে না। ফ্রেস হয়ে দুপুরের খাবারদাবার খেয়ে আবীর মা বাবার রুমে বিছানায় বসে আড্ডা জমালো। সবার কথাবার্তার মাঝখানে বকুল চা নিয়ে হাজির হয়, টেবিলে ট্রেটা রেখে মামা মামীকে চা দিয়ে এবার চা ভর্তি কাপটা আবীরের দিকে গিয়ে দেয়।
—- ভাইয়া চা।
আবীর নিস্পলক তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ,
‘কই চা’টা নে, মায়ের ডাকে সম্বিৎ ফেরে।
হাত বাড়িয়ে চা’টা নেয়।
— মা এই তবে তোমার বকুল! সো বিউটিফুল! লুক লাইক এ লোটাস!
বকুল লজ্জা পেয়ে বলে, মামী আমি আসি কিছু লাগলে আমায় ডাকবেন। বলেই রুম থেকে বের হয়ে গেল।
— হ্যা খুব ভালো মেয়ে বকুল, ও আসার পরে আমার আর সংসার নিয়ে একবিন্দুও ভাবতে হয় না। সবদিক ও একাই সামলে নেয়।
— ভেরি ট্যালেন্টটেড।
— এবার বিএ ক্লাসে ভর্তি হলো।
— বেশ তো।

বিকেলের দিকে আবীর নিজের রুমে ঢোকে বিছানায় কিছুক্ষণ গড়াগড়ি দেবার জন্য। বিছানায় শুয়ে আবীর বকুলের কথা ভাবতে থাকে, অপুর্ব সুন্দর মেয়ে বকুল, কী মিষ্টি মায়াবী চেহারা, মায়ের কাছে বকুলের কথা অনেক শুনেছে, মনে হয়েছে আশ্রিতা আর কেমন হবে? শ্যামলা ঢ্যাঙঢ্যাঙে চেহারার, শরীরের চেয়ে সাইজে বড় জামা পড়া মেয়েদের মতো হবে। কিন্তু এতো দেখি সাক্ষাৎ অপ্সরা, পরিমিত লম্বা, কি সুন্দর টানাটানা চোখ, সুন্দর হাসি, টিকালো নাক, দীঘল কালো চুল, হলুদাভ মায়াবী গায়ের রঙ। একদেখায় প্রেমে পড়ার মতো মেয়ে। প্রবাসে কি সব সাদা ম্যাড়মেড়ে চেহারার লাল, সাদা ছোট ছোট চুলের মেয়ে, দেখলে কখনোই প্রেম জাগে না। ওদের সাথে জাস্ট বন্ধুত্ব করা যায়, লাল বেনারশীতে ঘোমটা টানা বউ করা যায় না।
ভাবতে ভাবতে এক সময় জ্যাটলগের ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়ে।

রাতের ফ্লাইটে রুমা এসে হাজির হয়, সারা ঘরে হৈ হুল্লোড় আর বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস নেমে আসে। রুমার বাচ্চা দুটো যেনো জীবন্ত তুলতুলে পুতুল, সারাক্ষণ কোলে নিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে ৭বছরের মাইশা আর ৩ বছরের অর্ক বাবু।
এসেছে অবধি মায়ের পায়ে-পায়ে ঘুরছে, কারো কাছে যাচ্ছে না। নানা নানী অনেক চেষ্টা করলো ওদের সাথে স্বাভাবিক হতে কিন্তু ওরা মিশছেই না।

*
মিয়া সাব এলাকায় খুব জোরেশোরে প্রচার চালাচ্ছেন, দুই হাতে টাকা বিলাচ্ছেন। এককালে যাদেরটা কেড়ে নিয়েছেন তাদের দ্বারে দ্বারে টাকার বান্ডিল নিয়ে ঘুরছেন। গ্রামের সবাই সামনে হ্যা হ্যা করে সম্মতি দিলেও পেছনে মুখ ভরে গালি দিচ্ছেন। সাহস করে তমিজ সর্দার বলে,

— মিয়া সাব আপনার মাঠ তো ভালা না? মানুষ আপনারে পছন্দ করে না, মনে হয় মাস্টারের পাল্লা ভারী।
— সবার মুখে টাকা ঠুইসা দে, দুনিয়াটা টাকার গোলাম, টাকাই সব, টাকাই মা বাপ, টাকা দেখলে দুনিয়া কাইত হইয়া যায়।
— মনে হয় না টাকায় কাজ অইবো?
— তোগোরে পালতাছি কিয়ের লাইগগা, তোরা মানুষেরে বুঝাবি? আমি কি কি করতে চাই তাগো লাইগগা? গ্রামে স্কুল কলেজ মাদ্রাসা রাস্তাঘাট সবকিছুরে নতুন চকচকে কইরা দিমু।
—- আইচ্ছা ঠিক আছে।

মিয়া সাব ঘরে ভেতর চলে যেতেই, তমিজ বাড়ির বাইরে আসে, থু করে একদলা থুথু ফালায়।
হালা খবিসের ঘরের খবিস, সারাডা জনম পার করছে মাইনষের সর্বনাশ কইরা, এহন আইছে ভালা মানুষ সাজতে, চেয়ারম্যান হইবো, মানুষের উপকার করবো। ঝাটা দিয়া পিডাইবো মানুষ। আমার আর কাম নাই ওর হইয়া সুপারিশ করমু।
— কার লগে বিরবির করো তমিজ ভাই?
— না কারো লগে না মতিন, মিয়া সাব কইছে গ্রামে গ্রামে বাড়ি বাড়ি যাইতে ভোটের প্রচারের লাইজ্ঞা। ২০-৫০জন কর্মী যোগাড় কর ? নির্বাচনী প্রচার করাবি।

— তুমিও সাথে চলো?
— আমিতো আছিই, তোরা আগা আমি তোগো লগেই আছি। সারাজীবন তো মিয়া সাবের পিছনেই সময় দিলাম, এইবার তোরা আগাইয়া যা জায়গা নিতে হইবো না।
— আইচ্ছা
— হুন টাকা লইয়া যাইস মিয়া সাবের কাছ থেইক্কা, মাইনষের হাতে হাতে দিবি? নিজেরা খাইয়া বইয়া থাহিস না আবার?
— আইচ্ছা ঠিক আছে।
.

বারান্দায় ইজি চেয়ারে শুয়ে গুড়গুড় আওয়াজে হুক্কা টেনে চলছেন মিয়া সাব তার চিন্তার শেষ নাই। কর্মীদের মুখে শুনতেছে, মোবারক মাস্টারের অবস্থান শক্ত পোক্ত, মানুষ তাইনেরে চেয়ারম্যান হিসাবে চায়। জীবনে কোন ইচ্ছাই অপূর্ণ থাকে নাই মিয়া সাবের, খালি বকুল মাইয়াডা খাঁচা ছাইড়া পলাইছে আর এখন মাস্টারের কারণে উদ্দেশ্যে বাগড়া পড়তাছে। এসব তো আর সহ্য করা যায় না, কিছু একটা বিহিত তো করতে হইবো।

বারান্দার সিঁড়িতে মতিন এসে ধপ করে বসে
— কিরে মতিন খবর কি?
— খবর ভালো কিছু বুঝতেছিনা, মাস্টাররে লইয়াই সবার মাতামাতি চলতাছে। আপনার কতা সামনে কয়, পিছনে মাস্টার মাস্টার করে।
— চা স্টলে বিনা পয়সায় সবাইরে চা বিস্কুট খাওয়ানো শুরু কর?
— করছি মিয়া সাব, ভাবসাব দেইখা তো মনে অয় আপনেরেই ভোট দিবো কিন্তু…
— কিন্তু কি?
— গোপন খবর পাই সব মাস্টারের সমর্থক।
— চিন্তায় পইড়া গেলাম রে।
— মিয়াসাব একটা কতা কই?
— কইতে থাক?
— কল্লাডা ফালাই দেই মাস্টারের।
— না না কি কস? এই সময়ে এই কাম করলে রক্ষা নাই? সবাই জানে আমার প্রতিপক্ষ মাস্টার। এমনিতেই দুর্নামের শেষ নাই আমার। অন্য পথে আগাইতে হইবো, দেহি কি করা যায়?

.
রুমা সকাল বেলা ঘুমভেঙেই উঠে রান্নাঘরে যায়, তার কফির তৃষ্ণা পেয়েছে। এগিয়ে গিয়ে খেয়াল করে দেখে বকুল আলুর পরোটা, নরমাল পরোটা আর সাদারুটি বেলে বেলে আলাদা পাত্রে রাখছে। কাবার্ড খুলে কফির বয়াম আর চিনি নিয়ে চুলার পাশে দাঁড়ালো। বকুল এগিয়ে এসে বললো
— দিন আপু আমি করে দিচ্ছি, আপনি রুমে যান আমি নিয়ে আসছি।
— না থাক না আমি বানিয়ে নেই, অস্ট্রেলিয়াতে তো আমাকেই করতে হয়, ওখানে তো আর বাড়তি লোক নেই।
— এখানে তাহলে রেস্ট করুন, যা লাগবে আমাকে বলবেন।
— আচ্ছা ঠিক আছে, তা এখানে কতদিন হয় আছো তুমি?
— ৬ বছর হলো আপু।
— এরমধ্যে তোমার পরিবার তোমার খোঁজ করেনি?
— আমার কেউ নেই আপু।
—- ওহ স্যাড, শুনলাম পড়াশুনাও করছো?
— জ্বি আপু, বিএ ভর্তি হয়েছি।
— হুমম ভালো স্বাবলম্বী হও, তোমাদের মতো দুস্থ মেয়েদের স্বাবলম্বী হওয়া জরুরী।

সব মেয়েদেরই স্বাবলম্বী হওয়া জরুরী রে মা, বলতে বলতে হাসনা পারভীন রান্নাঘরে এসে ঢুকলেন।
— হ্যা মা তা ঠিক বলেছো। তবে বকুলদের মতো যারা আশ্রিতা তাদের আরো স্বাবলম্বী হওয়া জরুরী।
— এভাবে বলিস না মা, বকুলকে আমি মেয়ের মতোই দেখি, ও আসার পর থেকে পুরো সংসারের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছে। ও আমাকে অনেক স্বস্তি দেয়।
— মেয়ের মতো আর নিজের মেয়ে হওয়াতে পার্থক্য আছে মা, তুমি কি ওকে সারাজীবন পালবে? পালবে না, একদিন না একদিন ওকে অন্য কোথাও যেতে হবেই।
— বকুল হস্তশিল্পের অনেক কাজ জানে ওর কোথাও সমস্যা হবে না, যদি আমি সারাজীবন নাও পালি।

.
দিন কয়েক পরে হাসনা পারভীন তার মেয়ে রুমা ঝুমাকে নিয়ে পাত্রী দেখতে গেলেন। ধনী ব্যবসায়ী বাবার একমাত্র মেয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ৩য় বর্ষে পড়ছে, মেয়ে অসম্ভব সুন্দরী ও মেধাবী। আপাতত প্রাথমিক দেখা দেখতে গেছেন সবার পছন্দ হলে ছেলেকে নিয়ে দেখতে যাবেন।
বকুল রান্নাঘরে রাতের খাবার তৈরি করছে, আফজাল সাহেব রুমে বসে টিভি দেখছেন।
— হ্যালো লোটাস, কি করছো?
বকুল চমকে গিয়ে পেছন ফিরে দেখে আবীর রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়ানো।
— রান্না করছি ভাইয়া, আপনার কিছু লাগবে?
— হ্যা এককাপ চা পেলে মন্দ হতো না।
— আচ্ছা এক্ষুনি দিচ্ছি।
— কি রান্না করছো?
— ফ্রাইড রাইস,অন্থন, চিলি চিকেন, প্রণ টেম্পুরা, চাইনিজ ভেজিটেবল।
— ওয়াও তুমি এসব রাঁধতে পারো।
— জ্বি মামীর কাছ থেকে শিখেছি।
— ও আচ্ছা, খুব গুণী তুমি, একটা কথা বলি?
— জ্বি বলুন
— তুমি যে অসম্ভব সুন্দরী সেটা কি তুমি জানো?

বকুল ভাবলেশহীন ভাবে চেয়ে থাকে আর ভাবে এটা রূপ নয় জীবনের অভিশাপ, যা জীবনটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে, তাই এসব শুনতে বকুলের ভালো লাগে না।

— রাগ করেছ?
— না ভাইয়া, নিন আপনার চা (আবীরের হাতে কাপ তুলে দিলো)
— আচ্ছা আসল কথাই তো জিজ্ঞাসা করা হয়নি? মা কোথায় আপু কোথায় ওদের তো দেখছি না?
— উনারা বেড়াতে গেছেন।
— কোথায়?
— গুলশানের ওদিকে।
— ওখানে আবার কার বাসা?
— জানি না ভাইয়া।

.
পরিবারের সবাই খেতে বসেছে, বকুলের রান্নার খুব প্রশংসা হচ্ছে, বকুল কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থেকে এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে।
খাবার টেবিলে বসে হাসনা পারভীন কথা তুললেন। আবীর তোর তো পড়ালেখা শেষ জবেও ঢুকেছিস, আমি এবার তোর বিয়ে দিতে চাই।
— এসব ঝামেলা কেনো শুরু করছো মা, কয়েকটা মাস আছি শান্তিতে থাকতে দাও।
— বিয়ে করলে কেউ অশান্তিতে থাকে না, বরং বিয়ে করলে মানুষ দায়িত্বশীল হয়। আমি কয়েকটা মেয়ে দেখে রেখেছি। তুই যেটা পছন্দ করবি আমরা সেটাতেই আগাবো।
—– এসব এখন বাদ দেয়া যায় না?
— না বাদ দেয়া যায় না, ছেলেমেয়ে বড় হলে মা বাবার কর্তব্য হলো, সময় থাকতে তাদের বিয়ে-শাদি দেয়া।(বললেন আফজাল আহমেদ)
—- আচ্ছা ঠিক আছে মা, তবে মেয়ে কাছাকাছি খুঁজে নাও।
— কাছাকাছি বলতে নিজেদের আত্মীয়দের মধ্যে?
— অনেকটা সেরকমই।

.
চলবে

#শামীমা_সুমি

#খেরোখাতার_ছেঁড়াপাতা –৮

বাড়ি এসে হতভম্ব হয়ে যায় সাবেরা!

মিথ্যে বলে তাকে বাড়ি আনা হয়েছে। মায়ের অসুস্থতার কথা শুনে সাবেরা এসে দেখে তার বিয়ের আয়োজন চলছে। পাত্র স্থানীয় এমপির বখাটে ভাগ্নে রিমন, এলাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী হেন কোন অপরাধমূলক কাজ নেই যা সে করেনি। বিএ পাস করে মামার প্রশ্রয়ে চাঁদাবাজি করে বেড়ায়, এলাকার মানুষ তার ভয়ে তটস্থ থাকে। এমপি সাহেব তো মহাখুশি ভাগ্নে বউ উকালতি পাস হলে তার তো সুবিধা ষোলো আনা।
শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক সুবিধা হাসিল করার জন্য বাবা তার নিজের মেয়েকে বিসর্জন দেবেন সাবেরা স্বপ্নেও ভাবেনি। সারাজীবন পাপ করে বেরিয়েছেন ভাবনা ছিলো অন্তত নিজের সন্তানদের রক্ষা করবেন কিন্তু এ কেমন বাবা?

আসা অবধি সাবেরা একফোঁটা পানিও মুখে তোলেনি, মা রাহেলা খাবার নিয়ে সাধাসিধা করেই চলেছেন।
রাতে আবার খাবার নিয়ে সাবেরার রুমে গেলে ক্ষেপে যায় সে,
— তুমি কি করে রাজী হলে মা? তুমি কি জানো না সে কি প্রকৃতির ছেলে?

রাহেলা জবাব দেবার আগেই মিয়াসাব দরজায় এসে দাঁড়ায়,
—- সব বানোয়াট কথা, প্রতিপক্ষ ইচ্ছা কইরা সারা এলাকায় দুর্ণাম ছড়াইছে।
— সে একজন সন্ত্রাসী, গুন্ডা, ধর্ষক
— পুরুষ মাইনষের, একটু আধটু দোষ থাকেই, তাতে কিছু হয় না, মাইয়া মাইনষের কাজ ওসব শোধরাইয়া নেওয়া।
— মা বলে দাও, এই বিয়েতে আমি রাজী না।
— গরুরে জিগাইয়া হাল চাষ করমু না, এই বিয়া অইবোই।
— আমি মরে গেলেও এই বিয়ে করবো না।
— বিয়া করবেন ক্যান? শহর থেইক্কা খবর পাই, আপনি উল্টাপাল্টা চলেন, বিয়া ছাড়া বেগানা পুরুষের লগে বিছানায়….
—- কারো লগে শুইতে কি বিয়া করা লাগে নাকি?
উত্তর শুনে স্তব্ধ হয়ে যায় মিয়া সাব, মুখে কথা জোগায় না।

রাহেলা রেগে উঠে এসে ঠাশ করে একটা চড় কষান মেয়ের গালে,
— ফাজিল মাইয়া বাপের মুখেমুখে তর্ক করিস।
হতভম্ব হয়ে চেয়ে থাকে সাবেরা। কিছুক্ষণ পর বলে,
—- তুমি আমার মা একটা কেনো দশটা থাপ্পড় মারতে পারো, এমনকি কেটে কুচিকুচি করে ফেললেও কিছু বলবো না। কিন্তু এই প্রতিবাদটুকু আর কোনদিন করতে দেখলাম না। পারবে এমন একটা থাপ্পড় তোমার স্বামীর গালে দিতে? পারবে না জানি, কারণ তোমার মাথায় পাপ পূন্যের ভয় ঢুকে যাবে।
— স্বামীর গায়ে কেউ হাত তোলে নাকি?
— যদি তুলতে জানতে তবে অনেক অসহায় মেয়ের ইজ্জত বেঁচে যেতো। আছিয়া খালার সন্তান পিতৃ পরিচয় পেতো, স্বপ্নার বারবার গর্ভপাত করতে হতো না, রমেলার সন্তানের দায় কছিম চাচার গায়ে চাপিয়ে বিয়ে করতে হতো না, বকুলের গ্রামছাড়া হওয়া লাগতো না। এ বাড়িতে কাজ করতে আসা প্রতিটা নারী এই যে ভালো মানুষ সেজে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার হাতে নিগৃহীত। আসাদ কাকা দেশ ছেড়ে পালাই নাই মা, এই লোকটা তাকে মেরে মাটির নিচে পুতে রেখেছে বাগানবাড়িতে, নেয়ামত মামার গলা কাটা লাশ এই লোকটার কীর্তি। আর আরেকটা কথা শোনো আরতি কাকি পলায় নাই, এই লোকটা তারে পাচারকারীদের হাতে বিক্রি করে দিয়েছে। আরো শুনবা? আর শুনো না সইতে পারবা না মা সইতে পারবা না।

মিয়াসাব অগ্নিশর্মা হয়ে মেয়ের গালে জোরে একটা থাপ্পড় লাগালেন। চিৎকার করে বলতে লাগলেন।
— বেয়াদব মাইয়া আজেবাজে আজগুবি কথা শুইন্না আইসা বাপের নামে যা-তা কইতাছে। আইজ থেইক্কা বিয়া হওয়া আগ পর্যন্ত এই মাইয়া এই রুমে বন্দি থাকবো। কেউ যদি তারে তালা খুইল্লা দেয় তারে জান্ত মাটিতে পুইত্তা ফালামু।

রাহেলা একেবারে পাথুরে মূর্তি হয়ে যায়, ধপ করে মাটিতে বসে পড়ে সে।
কাজের মেয়েরা তার স্বামীর লালসার শিকার হয় এটা সে একটু আধটু জানতো। কিন্তু সংসার ভাঙার ভয়ে দেখেও না দেখার ভান করতো অঘটন ঘটে গেলে মোটা অংকের টাকা দিয়ে আপদ বিদায় করে দেয়া হতো।
কিন্তু খুনের ব্যাপারে সে কিছুই জানতো না, আসাদ মুন্সীকে খুন করেছে ঘুনাক্ষরেও বোঝা যায়নি, সবচেয়ে কষ্টের জায়গা তার একমাত্র আদরের ভাই নেয়ামতকে খুন করেছে এই লোকটা। ২৫/২৬বছরের টগবগে তরুণ বোনের বাড়ি বেড়াতে এসে ফিরে যাবার পথে লাশ হয়ে গেলো, পুলিশও বলেছে এটা ডাকাতি কেস, সাথে থাকা ক্যাশ টাকা ছিনিয়ে নিতে গিয়ে খুন করে রেখে গেছে। ভাই মরে যাওয়াতে সকল সহায় সম্পত্তির মালিক বনে যায় রাহেলা ।
সম্পদের জন্য পাষণ্ড লোকটা এমন জঘন্য কাজ করেছে।
অঝোরে কাঁদতে লাগলো রাহেলা, সারাজীবনের যত বুকচাঁপা ব্যথা আজ কান্না হয়ে বেরিয়ে আসলো।

মাঝরাতে চুপিচুপি গিয়ে রাহেলা মেয়ের ঘরের তালা খুলে দিলেন
— যা মা এই নরক থেকে পালিয়ে বাঁচ।
— তোমার তো বিপদ হবে মা!
— আমার বিপদের কথা ভাবিস না, অনেক হয়েছে এবার এর শেষ দেখে ছাড়বো। তাড়াতাড়ি যা, তমিজ তোকে নদী পার করে দেবে ট্রেনে তুলে দিয়ে আসবে।
— এমন বিদ্রোহী যদি আরো আগে হতে পারতে মা তবে…
— কথা বলিস না, ধর এখানে আমার সমস্ত গয়না আছে, তোর পড়ালেখা শেষ করে বাকীটা তোর বিয়েতে কাজে লাগাস।

সাবেরা মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললো। রাহেলা চোখ মুছে মেয়েকে বিদায় দিলেন।

মিয়াসাব যখন ঘুম ভেঙে সাবেরার রুমে আসলেন, তখন রাহেলা সকালের রুটি ভাজির জন্য আলু কাটছে।
চেচামেচি করতে করতে মিয়াসাব রাহেলার সামনে এলেন
— তালা কেডায় খুলছে?
— আমি
— কে তোরে এতবড় সাহস দিছে?
— সাহস দেওনের কি আছে? আমার মাইয়া আমি বাইর করছি।

হারামজাদি তোর এতবড় সাহস, তুই আমার অবাধ্য হইছস আবার মুখেমুখে তর্কও করছ? আইজ তোর একদিন কি আমার একদিন?
রাহেলার চুলির মুঠি ধরতে গেলে, দা উঁচিয়ে এগিয়ে আসে রাহেলা,
— জানোয়ার, একপা সামনে বাড়াইলে, ঘাড় থেইক্কা তোর কল্লাডা ফালাইয়া দিমু। অনেক সইছি তোর অত্যাচার, আমার জীবডা তছনছ করছস, বড় মাইয়াডারে তিনগুণ বয়সের ব্যাডার কাছে বিয়া দিছস, আমার ছোট মাইয়াডার সর্বনাশ তোরে আমি করতে দিমু না। দরকার পড়লে তোরে খুন কইরা জেলে যামু।

রাহেলার রণমুর্তি দেখে ভড়কে যায় মিয়াসাব, সাতচড়েও যার রা নাই সে এত সাহস কই পাইলো? বউ, সন্তান সব দেখি মারমুখী হইয়া গেছে, আমি কি এখন ঘর সামলামু নাকি বাহির? কি হইবো এহন উপায়?

.
মনোযোগ দিয়ে অফিসের কাজ করছেন আফজাল আহমেদ, হাসনা পারভীন কাছে এসে বসলেন।
— ছেলের মর্জি হয়েছে কাছাকাছি মানে আত্মীয় স্বজনের মধ্যে বিয়ে করবে। আমি তো আত্মীয় স্বজনের মধ্যে ওর উপযুক্ত ভালো কোন মেয়ে দেখছি না। কি করা যায় বলতো রুমার আব্বু?
— খুঁজে দেখো, আমি এসব বুঝিশুঝি না।
— তোমার বোনের মেয়ে ত্রপা ওতো মাত্র ইন্টারে উঠলো। আমার ভাইয়ের মেয়ে তনুশ্রী এইবার এইচএসসি পাস করলো, আমাদের ঝুমার ব্যাচে আর বাকি সবাই তো ওর বড়, ওদের সবার তো বিয়ে হয়ে গেছে। আর তো মেয়ে দেখছি না।
— তনুশ্রীকে দেখতে পারো।
— হুম, কিন্তু তনুশ্রী ফর্সা সুন্দর তবে চেহারা বেশি একটা ভালো না। হতো যদি বকুলের মতো, আহা বিধাতা নিজ হাতে গড়েছেন।
— ছেলের পছন্দ হলে তুমি চেহারা দিয়ে কি করবে? বকুলের কথা থাক।
— আচ্ছা এক কাজ করি তনুশ্রীকে কয়েকদিনের জন্য এখানে নিয়ে আসি কি বলো?
— হুমম, যা ভালো মনে হয় করো।

দুইদিন পর তনুশ্রী ব্যাগপত্র নিয়ে ফুফুর বাড়িতে হাজির।
আবীর বাইরে বের হচ্ছিলো, তনুশ্রীকে দেখে বললো,
— কি রে ক’বছরের জন্য এলি? একেবারে বাক্সপেটরা নিয়ে চলে এসেছিস মনে হচ্ছে?
— মোটেও আমি বাক্সপেটরা নিয়ে আসিনি, মেয়েদের কত কি লাগে এসব তুমি বুঝবে না।
— বুঝে কাজও নেই।
বকুল ভার্সিটিতে যাবার জন্য রেডি হয়ে এসে দাঁড়ালো।
—– হ্যালো লোটাস, কোথাও যাচ্ছো নাকি?
— জ্বি ভাইয়া ভার্সিটিতে যাবো।
—- চলো নামিয়ে দেবো?
— না না ভাইয়া আমি একাই যেতে পারবো।
— আমিতো ওদিকেই যাচ্ছি, পথে নামিয়ে দেবো।
— না অসুবিধা নেই, আপনি যান ভাইয়া।

আবীর বের হয়ে যায় বাসা থেকে।

ওদের কথোপকথন দেখে তনুশ্রী বলে উঠলো
— বকুল.. ঘরে প্রচুর মানুষ এত এত কাজ এসব ফেলে তোমার ক্লাসে যাওয়া ঠিক হচ্ছে?
— জরুরি না হলে যেতাম না আপু, আর সব কাজ গুছিয়ে রেখে গেছি। বাকী যা আছে রনির মা করে ফেলবে।

বকুল চলে যেতেই মুখঝামটা দিলো তনুশ্রী,
হুহহ কাজের মেয়ের আবার লেখাপড়া যত্তসব আহ্লাদ।

ফুফু বকুলকে তোমরা এত আশকারা দাও কেন?

কেন কি করেছে বকুল?
— এই যে বাড়িতে এত কাজ ফেলে ভার্সিটিতে গেল।
— সব কাজ গুছিয়ে রেখে গেছে, খাবার রান্না করে হটপটে রেখে গেছে, তোর কিছু লাগলে বল আমি করে দিচ্ছি।
— এখন যদি কারো কিছু দরকার লাগে?
— তাহলে নিজের কাজ নিজে করে নেবে।
— আচ্ছা ফুফু বলো তো, কাজের মেয়ের এত পড়ালেখা করার দরকার কি?
— বকুলকে কাজের মেয়ে বলবি না, আমার বাসায় কেউ বলে না। লেখাপড়া করার অধিকার সবারই আছে।

— বকুলকে কিছু বলিস না রে তনু, মা বাবার ভালো লাগবে না।
দুজনার কথার মাঝখানে এসে রুমা বললো।
হাসনা পারভীন মেয়ের দিকে তীর্যক দৃষ্টি হেনে বললেন
— হ্যা ঠিক তাই, যে মেয়েটা আমাদের এতটা খেয়াল রাখে তাকে নিয়ে কটুক্তি কেনো করবি?
— আদর করছো ভালোবাসা দিচ্ছ ভালো কথা মা সাথে চোখকানও খোলা রেখো, তোমার ছেলেটা কিন্তু বকুলের একটু বেশিই খোঁজখবর রাখে।
— বাজে বকিস না রুমা।

দুজন চলে যেতেই হাসনা পারভীন বিরক্তি নিয়ে ভাবতে লাগলেন এরা বকুলকে হিংসা করে কেনো? আচ্ছা তনুশ্রী তো পরের মেয়ে, কিন্তু রুমা এত হিংসুক হলো কি করে? ভেতরে ভেতরে একটু শংকিত হলেন রুমার শেষ কথাটা শুনে, না না বকুল আমার এতবড় সর্বনাশ করবে না, সে বিশ্বাস আমার আছে।

.
বকুল ক্লাস না করে বান্ধবী নাফিসার বাসায় এসেছে। নাফিসার বাবা নেই মা অন্যত্র বিয়ে করেছে ও মামার কাছে মানুষ হয়েছে, এখন স্নাতক ভর্তি হয়ে রাপা প্লাজাতে একটা বুটিক শপে সেলসগার্ল হিসাবে কাজ করে। নাফিসার সাথে বিএ ভর্তি হবার পর পরিচয় হয় বকুলের, আর আজ ও এখানে প্রথম এলো। বকুলের উল্লেখযোগ্য তেমন কোন বান্ধবী নেই, কারো সাথে তেমন কোন সখ্যতা বাড়ায়নি কখনো। বাহিরের জগত বাহিরের মানুষ এসবে বকুলের খুব ভয়, কখন কে কোথায় বিপদে ফেলবে বলা যায় না।

বকুল ইদানীং বাসা থেকে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়, রুমা আপা তাকে বিশেষ পছন্দ করে না সেটা বকুল বোঝে। কিন্তু কিছুই করার নেই কোথায় যাবে সে, যেদিন ক্লাস থাকে সেদিন বেঁচে যায় , যেদিন ক্লাস থাকেনা সেদিন লেকপাড় গিয়ে বসে থাকে। বখাটেদের উৎপাতে কদিন যাবত লেকপাড় যাওয়া যাচ্ছে না।
আজ নাফিসার অনুরোধে তার বাসায় আসা, নাফিসা বেগুনভাজা, ডিম ভুনা আর খিচুড়ি তৈরি করছে।
ষষ্ঠ তলায় সাবলেটে এক কামরার এই বাসায় থাকে নাফিসা আসবাবপত্র তেমন নেই, একটা খাট, একটা টেবিল, অটবির সিঙ্গেল আলমারি, আরএফএলের র‍্যাক আর এককোনে একটা সেলাইমেশিন। জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায় বকুল, এখান থেকে পুরো শহরের অনেকটা দেখা যায়। দূরের মানুষ আর যানবাহনগুলো যেনো পিঁপড়ের সারি।

অনেক চিন্তাগ্রস্ত সে, আবীর ভাইয়া দেশে আসার পর তার বিপত্তি বাড়লো। আবীর ভাইয়ার ছুতোনাতায় রান্নাঘরে চলে আসা, অযথা ডাকাডাকি করা, দেখলেই মায়াভরা চোখে তাকিয়ে থাকা। কি যেনো বলতে চেয়ে পারে না ঠোঁট তিরতির কাঁপে, কোথায় যেনো দ্বিধা। এ সবই বকুল বোঝে, পুরুষের চোখ চিনতে বকুলের ভুল হয় না, ঘাটেঘাটে পোড়খাওয়া বকুল জীবনের অনেক রঙ দেখেছে। তবে এবার বকুলকে শক্ত হতে হবে, যে পাতে খেয়েছে সে পাত ছিদ্র সে করতে পারবে না কিছুতেই না। একটা সিদ্ধান্তে তাকে আসতে হবে পায়ের তলার মাটি সরে গেলে নতুন ভুমি খুঁজে নিতে হবে তাও নিজ যোগ্যতায়।

কিরে কি চিন্তা করছিস অতো?
নাফিসার ডাকে চিন্তার ছেদ ঘটে,
— না কিছু না… তোর বাসাটা খুব সুন্দর তাই দেখছিলাম, ঢাকা শহরের অনেকটা দেখা যায়।
— আয় খেয়ে নেই, কিছু মনে করিস না খুব সাধারণ খাবার, তুইতো রাজভোজ খাস।
— তোরটা অনেক মূল্যবান, নিজের রক্তের কামাই।
— তোরটাও রক্তের কামাই ওই সংসারে শ্রম দিচ্ছিস না?
— তা দিচ্ছি, তবে জীবন বোধহয় পরিবর্তনের সময় এসে যাচ্ছে।
— কি বলছিস? কেনো কিছু হয়েছে?
— কিছু না, পরে একসময় বলবো।

.
বকুল বাসায় ফিরে ফ্রেশ হতেই আবীর ডাকলো
— হেই লোটাস, এক কাপ চা দিয়ে যাও তো।
বকুল দ্রুত হাতে চা তৈরি করলো, ট্রেতে করে নিয়ে যাবার সময়, রান্নাঘরে ঢুকলো তনুশ্রী
— তোমাকে যেতে হবে না, আমাকে দাও আমি নিয়ে যাচ্ছি।
বকুল তনুর হাতে চা দিয়ে, বিকেলের নাস্তা তৈরিতে নিজেকে মনোনিবেশ করলো।
চুলায় হাঁসের মাংস ভুনা গরম বসালো, আর সকালে রেডি করে রেখে যাওয়া ময়ান কেটে লুচি বানাতে লাগলো অন্য হাতে ভাজতে লাগলো।
হাসনা পারভীন এসে লুচিমাংস নিয়ে সবাইকে পরিবেশন করলেন। সবাই খুব তৃপ্তি সহকারে খেয়ে বকুলের প্রশংসা করলো।
বকুল রান্নাঘরের কাজ সেরে নিজের রুমে গিয়ে বেশকিছু অর্ডারের হ্যান্ডব্যাগের চেইন লাগাতে বসে গেলো।

.
সাবেরা আর অয়ন মুখোমুখি বসে আছে, নীরবতা ভেঙে আয়ান প্রথম কথা বললো,
— সেই কখন থেকে আমরা বসে আছি সাবেরা। অলরেডি অর্ডার করা খাবারও শেষ, কফিও শেষ কি বলতে ডেকেছ বলবে তো?
— অয়ন আমি এখন যে কথাগুলো বলবো, মনোযোগ দিয়ে শুনতে হবে।
— হুমম বলো?
— আমি খুব বাজে একটা মেয়ে, আমার কৈশোর নিগৃহীত, আমার যৌবন কলঙ্কিত। বহু ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিলো আমার , আমার বাবা একজন খুব বাজে লোক, এসব কি তুমি জানো?
—- আমি তোমার অতীত জানিনা জানতে চাইও না, আমি শুধু তোমাকে চেয়েছি, তোমার মনটাকে ভালোবেসেছি।
— তুমি কখনো এসব নিয়ে কথা শোনাবে না তো?
— কখনোও না।
— আমাকে বিয়ে করতে পারবে।
— হ্যা
— তাহলে আজই এমনকি এক্ষুনি আমরা বিয়ে করবো।
— এক্ষুণি?
— হ্যা কোন সমস্যা?
— না না কোন সমস্যা নেই,
—- তাহলে চলো
— চলো একটু মার্কেটে যাই, শাড়ি পাঞ্জাবি কিনে ওখান থেকে কাজী অফিসে যাবো।

কাজী অফিসে পৌঁছে দেখে সাক্ষী হিসেবে অয়নের বন্ধু আর সাবেরার বান্ধবীরা সবাই হাজির।
সইসাবুদ করে ওদের বিয়ে হয়ে গেলো, ছন্নছাড়া জীবন থেকে নতুন জীবনে প্রবেশ হলো সাবেরার। এতদ্রুত বিয়ে করার অন্যতম কারণ হলো বাবা যদি লোক লাগিয়ে তুলে নিয়ে ওই বখাটের সাথে বিয়ে দিয়ে দেয়। বউ সেজে অয়নের বাসায় গিয়ে উঠলো সাবেরা। অল্প সংখ্যক আসবাবপত্র দিয়ে সাজানো ছিমছাম কামরা, একান্ত নিজের ঘর নিজের সংসার।

ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দেখলো অয়ন বাইরে থেকে খাবার কিনে নিয়ে এসেছে।
অয়ন কাপড়চোপড় ছেড়ে ওয়াশরুমে ঢুকতেই, সাবেরা রান্নাঘরে গিয়ে প্যাকেট খুঁলে খাবার সাজিয়ে বিছানায় নিয়ে আসে।
অয়ন বের হতেই দুজনে খেতে বসে যায়। খেয়েদেয়ে শুতে যেতেই অয়ন সাবেরার হাত ধরে বিছানায় বসায়।
— শোন সাবেরা, আমি জানিনা তুমি কেনো এত দ্রুত বিয়েটা করেছ। তবে যেকারণেই করে থাকো, তোমার ইচ্ছে যখন হবে তখন সব আমায় খুলে বলিও।
— আমি আসলে….
— আমি তোমায় জোর করছি না, পরে শুনবো কোন তাড়া নেই আমার আর তুমি হয়তো কিছুই জানোনা আমার সম্পর্কে। আমি এতিমখানায় বড় হওয়া মানুষ। আমার মা বাবা কে আমি জানিনা। তাই মা বাবা ভাই বোন সহ ভরা পরিবারের সুখটুকু আমি তোমায় দিতে পারবো না।
— আমি কিচ্ছু চাই না।
— আরেকটা কথা, আমি স্বামীত্ব ফলাতে তোমার উপর জোর খাটাবো না, তোমার মন যেদিন স্বেচ্ছায় সায় দিয়ে কাছে আসতে চাইবে সেদিনই আমরা অন্তরঙ্গ হবো, তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো। সম্পর্কটা আমাদের কাছে আগে সহজ হওয়া জরুরী। অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়।

বলেই কোলবালিশটা বিছানার মাঝখানে রেখে অয়ন শুয়ে পড়লো।

কৃতজ্ঞতায় সাবেরার দুচোখ পানিতে ভরে আসলো।

চলবে।

#শামীমা_সুমি