খেরোখাতার ছেঁড়াপাতা পর্ব-১১+১২

0
130

#খেরোখাতার_ছেঁড়াপাতা– ১১

আয়ানের বুকে মাথা রেখে সাবেরা শুয়ে আছে, আয়ান অন্য হাত দিয়ে চুলে বিলি কেটে দিচ্ছে।

স্বেচ্ছায় ও মন থেকে কাছে আসার যে ব্রত দুজন নিয়েছিলো সেটাতে তারা আজ সফল। একসাথে থাকতে থাকতে চলতে ফিরতে একসময় মায়ার জন্ম নেয়, মায়াটা মাকড়ের জালের মতো ছড়িয়ে যায় সম্পর্কের মাঝখানে । লতা যেমন বৃক্ষকে এক সময় নিজের অলক্ষে জড়িয়ে ধরে তেমনি মানুষও একে অপরের সঙ্গের কাঙাল হয়, চলতে চলতে অভ্যস্ত হয়ে যায়। এভাবেই হয়তো ভালোবাসা জন্মে মায়ার বাঁধনে বেঁধে সংসারে টিকে যায়, একে অপরে আর বাঁধন ছেড়ে বেরুতে পারে না। তেমনি সাবেরা আর আয়ান একসময় একে অপরের কাছাকাছি চলে আসে আর একটা সময় নিজেকে সমর্পণ করে দেয়, একে অন্যের মাঝে ভালোবাসায় বিলীন হয়ে যায়। জেগে যায় স্নায়ু শিরা উপশিরা রন্ধেরন্ধে অনিন্দ সুখের জন্য পাগল হয়ে যায়, ঝড় উঠে দুটি তনুতে একসময় শান্তশ্রান্ত হয়ে সুখের আবেশ ছড়িয়ে থেমে যায় সেই সুখের ঝড়।
তেমনি এক অন্তরঙ্গ মুহূর্ত শেষে ক্লান্তশ্রান্ত আয়ানের বুকে মাথা রেখে শুয়ে আছে সাবেরা। আয়ান প্রশ্ন করলো
— তোমার বাবাকে বাঁচাতে তুমি কিছুই করবে না?
— না।
— তিনি তো তোমার বাবা!
— তিনি একজন অপরাধী।
— তবু্ও বাবা তো?
— অপরাধীর কোন স্ত্রী সন্তান নেই, পরিবার নেই, অপরাধীর একটাই পরিচয়, সে অপরাধী।
— তাহলে একজন উকিল ঠিক করে দাও?
— সে নিজেই পারবে। আর তাছাড়া তার শাস্তি প্রয়োজন, ঈশ্বর পাপের গড়া পূর্ণ হলে যার পাপ তার উপরই ঢেলে দেন। তুমি আর প্লিজ এসব নিয়ে কথা বলো না আয়ান। আমার ভালো লাগে না শুনতে।

আয়ানের মুখে আর কথা যোগায় না, সে চুপ হয়ে যায়।

.
রাত থেকেই নাফিসার ভীষণ পেটব্যথা হচ্ছে, বকুল একা কি করবে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। বিপদের সময় মেয়েটা তাকে আশ্রয় দিয়েছে তার জন্য কিছু করা বকুলের কর্তব্য, কিন্তু কি করবে বুঝতে পারছে না । যাদের সাথে সাবলেটে ওরা থাকে তাদেরকে উপায় অন্ত না পেয়ে বকুল ডেকে এনেছে।
ব্যথা কিছুতেই কমছে না অবস্থা বেগতিক দেখে সবাই মিলে দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে ইমারজেন্সীতে নিয়ে যাওয়া হলো সাথে নিলো দুজনার জমানো সমস্ত টাকা।
ডিউটি ডাক্তার সব দেখে বললেন এপেন্ডিসাইটিস এর ব্যথা দ্রুত অপারেশন করতে হবে, নয়তো রোগীর মৃত্যুও হতে পারে।
জরুরি ভিত্তিতে রাতেই অপারেশন করা হলো, রোগীর সঙ্গী হিসাবে সেবা যত্নের জন্য বকুল হাসপাতালে রয়ে গেলো, সাথের ওরা বাসায় ফিরে গেলো।

দুই দিন পর রোগী কিছুটা সুস্থ হলে তাকে নিয়মাবলি বেঁধে দিয়ে ডিসচার্জ দিয়ে দেয় ডাক্তার। বকুলের কাঁধে ভর রেখে নাফিজা হাসপাতাল করিডোর দিয়ে আস্তে আস্তে বের হয়ে আসছে। হঠাৎ খুব দুর্বল কণ্ঠে কেউ ডেকে উঠলো বকুল…
থমকে দাঁড়ালো বকুল!
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ভ্রম মনে করে সামনে এগিয়ে যেতেই আবার জোরালো অথচ দুর্বল কন্ঠে আবার কেউ ডাকলো– বকুল, মা আমার।
এবার ডাকটা স্পষ্ট শুনলো দুজনে, নাফিসাকে পাশের একটা বেঞ্চিতে বসিয়ে খুঁজতে লাগলো ডাকের উৎস।

একটু পেছনে এসে খুঁজতে খুঁজতে একটা কেবিনের সামনের দরজায় এসে চক্ষুস্থির হয়ে গেলো, একেবারে সামনের সিটে শুয়ে আছে তার বাবা লোকমান শেখ।
বকুল ধীরেধীরে কাছে এগিয়ে গেলো, মেয়েকে এগিয়ে আসতে দেখে লোকমান শেখ ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন। বকুলও বাবার হাত ধরে কেঁদে ফেললো। সৎমা বাবার পায়ের কাছে বসা, তিনিও আশ্চর্য হয়ে গেছেন, এমনভাবে বকুলকে দেখবেন হয়তো ভাবতে পারেননি।

লোকমান শেখ মেয়ের মাথায় পিঠে হাত বুলাতে লাগলেন, আপ্লূত হয়ে কাঁদতে লাগলেন।
— মা তুই! তুই এইখানে কেমন কইরা?
— বাবা আমার বান্ধবীর অপারেশন হইছে আমি তার সাথে আসছি।
— এতদিন কই ছিলি মা, তোরে তো ভাবছিলাম জনমের তরে হারায়ে ফেলছি। তুই কেমন আছিস মা।
— মইরা বাঁইচা আছি বাবা।
— জাফরগঞ্জের মিয়া সাব বাড়িতে তোর খোঁজে লোক পাঠাইছিলো।
— কি বলো বাবা? ওইটা আস্ত একটা পিশাচ, নরপশু ওর লোক বাড়িতে জায়গা দিও না।
— শুনছি খুনের অপরাধে হেরে পুলিশে ধইরা নিছে।
— সত্যি বাবা! সত্যি!…. শুনে বুকটাতে আমার স্বস্তিতে ভরে গেল , আমার জীবনটারে লণ্ডভণ্ড কইরা দিচ্ছে ওই হারামী মানুষটা।
— তুই যখন বাড়ি থেকে পালাইয়া গেলি ভাবছিলাম জীবনেও তোর মুখ দেখমু না।
— আমি বাড়ি থেইক্কা পলাই নাই বাবা, ছোট মা আমারে বাড়ি থেইক্কা বাইর কইরা দিছিলো। ঠিক কই না ছোট মা?
ছোট মায়ের মুখ পাংশুটে হয়ে যায়, মুখে রা আসে না। বাবা তাজ্জব হয়ে জিজ্ঞেস করে,
— কি? কি কস এইসব?
— হ বাবা, ছোট মার ভাইয়ের কুনজর থেইক্কা বাঁচাইতে আমারে বাড়িত থেইক্কা বাইর কইরা দিছিলো।

ছোট মা এগিয়ে এসে বকুলের হাত ধরে কেঁদে ফেলে,
— আমারে মাফ কইরা দে বকুল, আমি তোরে অনেক কষ্ট দিছি, কিন্তু আমার ভাইয়ের হাত থেইক্কা বাঁচাইতে তোরে আমি সবুজের হাতে তুইল্লা দিছিলাম। এছাড়া আমার কোনো উপায় আছিলো না। আমারে তুই মাফ কর মা, নইলে আল্লাহ ও মাফ করবো না।
— কষ্টে কষ্টে তো জীবন কাটলো ছোট মা, আমি সবই আমার নিয়তি মেনে নিয়েছি। কিন্তু তোমরা এইখানে ক্যান?
— তোর বাবার হার্ণিয়া অপারেশন হয়েছে, আমরা তাই এইখানে আসছি।
— আমারে দেখলা কি কিভাবে ?
— তোর বাবায় দেখছে আর বলতেছে, আমার বকুল, আমি নিষেধ করছিলাম ডাকতে। কারণ কারে দেখতে কারে দেখছে কিন্তু হে শোনে নাই, ঠিকই চিনছে তোরে।

লোকমান শেখ মেয়েকে কাছে টেনে নিলেন, মা রে তুই কেমন আছিস? কোথায় আছিস? কি হালে আছিস? আমারে খুইল্লা ক? তোর জীবনের সব দুঃখ আমার কারণে। আমি যদি শক্ত হইতাম তোর উপর এত অত্যাচার করার সাহস হইতো না তোর ছোট মায়ের। আমারে মাফ কইরা দে মা।
— এইভাবে বইলো না বাবা… আমি এখন ভালো আছি, পড়াশোনা করতেছি চাকুরী করি, কিন্তু মাঝখানের সময়টা কচুরিপানার মতো ভাসতে ভাসতে এক ফেরেশতার বুকে ঠাঁই পাইছিলাম, বুক দিয়া আগলাইয়া রাখছিলো আমারে, আল্লাহ তার ভালো করুন।
— তুই আমার সাথে বাড়ি চল মা, তোরে আর এই শহরে রাইখা যামুনা।
— না বাবা আমি এখন আর কোথাও যামু না, আমার পড়ালেখা আগে শেষ হোক, নিজের পায়ে দাঁড়াই, স্বাবলম্বী হই তখন যামু বাবা। আমার জন্য তুমি শুধু দোয়া করিও বাবা।

লোকমান শেখ মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।

.
খুনের মামলার মোড় নতুন দিকে ঘুরে গেলো, পুরাতন যত কেসের ফাইল ধামাচাপা দিয়ে রাখা ছিলো একে একে সব ওপেন হতে লাগলো।
মিয়া সাবের বিরুদ্ধে যত আলামত আছে সবই সংগ্রহে নামলেন ওসি সাহেব, জোর তদন্ত শুরু হলো। এমপি সাহেবও যথাসম্ভব সাহায্য করবেন বলেছেন। অথচ তার খুটির জোরে মিয়াসাব এতো অরাজকতা, এত জুলুম, নির্যাতন করতো। কথায় বলে না বিপদের সময় নিজের ছায়াটাও পাশে থাকে না। এলাকায় কানাঘুষা চলছে এবার আর মিয়াসাবের বাঁচার উপায় নেই।
পুরনো মামলায় সংশ্লিষ্টতার সন্দেহে তমিজ সর্দারকেও গ্রেফতার করা হয়েছে, মিয়া সাবের সমস্ত সহযোগীদের খুঁজে খুঁজে গ্রেফতার করা হচ্ছে, অতীত বর্তমানের কেউ যেনো বাদ না পড়ে প্রশাসনের কড়া নির্দেশ।

আসামীদের আদালতে তুলে পুলিশ রিমান্ড চাইলো, আদালত তা মঞ্জুর করলে। রিমান্ডে বেশ কয়েকদিন কথা বের করার সমস্ত পুলিশী কৌশল প্রয়োগ করা হলে সবাই একে মুখ খুঁলতে লাগলো। বর্ডারের কাছ থেকে অন্যতম আসামি মতিনকেও আটক করা হলো। মারের ভয় আর বয়সের কারণে হোক, পুলিশের প্রস্তাবে তমিজ রাজসাক্ষী হতে রাজী হয়ে গেলো।
দীর্ঘ মেয়াদি সময় নিয়ে মামলা চলতে লাগলো।

.
রাহেলা নাওয়াখাওয়া ভুলে হন্যে হয়ে উকিল খুঁজে বেড়াচ্ছেন, যতই খারাপ লোক হোক না কেনো মিয়াসাব তার স্বামী, স্ত্রী হয়ে স্বামীর এমন বিপদে ঘরে তো আর বসে থাকতে পারেন না। সদরে গিয়ে উকিলদের দ্বারে দ্বারে ঘুরে ফিরে আসছেন বারবার কড়া নাড়ছেন । কেউ কেস হাতে নিতে রাজী নন সবাই ফিরিয়ে দিচ্ছেন, দিনরাত সব ভুলে স্বামীকে ছাড়ানোর প্রচেষ্টায় আছেন।
এমপি সাহেবের কাছে গিয়ে হাতেপায়ে ধরে এসেছেন, তিনি কোন সাহায্য করবেন না সাফ জানিয়ে দিয়েছেন।
নিরাশ হয়ে রাহেলা মিয়াসাবের সাথে দেখা করতে গেলেন,
— ছোট আম্মায় কি ফোন করছিলো?
— না।
— কুনু যোগাযোগ করে নাই!
— ফোন করলে ধরে না, হে আপনের নামও শুনতে চায় না।
— তা চাইবো ক্যান? এখন বড় হইছে, পাখনা গজাইছে, বাপ মা চিনবো ক্যান?
— কাইল একবার ফোন দিমুনি, দেহি ধরে নাকি।
— তাইলে আমার লাইগা কিছুই করতে পারলা না? বেকুব মহিলা সারাজীবন তোমাগোরে লালনপালন কইরা আমার কি লাভ হইলো? বেঈমানের তাবেদারী কইরা গেলাম, সব নিমকহারামের দল।
(স্ত্রী মুখে সব শুনে আক্রোশে ফেটে পড়লেন মিয়াসাব)
— ভালা কাম তো জীবনে একটাও করেন নাই, যদি করতেন তাইলে আর আইজকা এই পরিনতি হইতো না। যত অপকর্ম করছেন সব নিজের খায়েশে করছেন, আমাগো লাইগা করেন নাই।
— চোওওওপ, চোপা বাড়ছে নাহ? বাইর হই একবার থোতা ভাইঙ্গা ফালামু।
— হ আপনে সেই আশায় থাকেন।

.
চলবে

#খেরোখাতার_ছেঁড়াপাতা — ১২

ঘুম আসছে না কিছুতেই….

দূর থেকে গাড়ীগুলোকে একেকটা জোনাকিপোকা মনে হচ্ছে, রাত অনেক গভীর তাই রাস্তায় গাড়ী চলাচলও কম। আকাশে মিটমিট করছে নক্ষত্ররাজি, বহুদিন আকাশ দেখা হয় না শেষ কবে দেখেছে মনে নেই । সেই ছোটবেলা মা উঠানে পাটি বিছিয়ে শুয়ে শুয়ে তারকা চেনাতো আর কত রূপকথার গল্প বলতো। রাক্ষসরাজা রাজকুমারীকে তুলে নিয়ে গেছে কোন এক অচিন দেশের রাজকুমার রাক্ষস বধ করে সোনার কাঠি রূপার কাঠি ছুঁইয়ে ঘুমন্ত রাজকুমারীকে জাগাবে।
বকুলের জীবনে তো রাক্ষসদের অভাব নেই, কই কোন রাজকুমার তো সোনার কাঠি রূপার কাঠি নিয়ে আসে না? আর কতকাল তাকে রাক্ষসের সাথে যুদ্ধ করে যেতে হবে বেঁচে থাকার লড়াই আর কতো? কবে হবে এই যুদ্ধের অবসান? সুখের মুখ এই জীবনে আদৌও সে দেখবে তো?

বেশ অনেকদিন পর আজ বকুলের রাত নিদ্রাহীন গেলো।

বাবার সাথে দেখা হওয়াটা ওর কাছে অনেকটা স্বপ্নের মতো, ছোট মা বলেছে বকুল পালিয়ে গেছে, বাবা তাই বিশ্বাস করেছে। যাচাই করার প্রয়োজন বোধ করেনি ঘটনায় কতটুকু সত্য মিথ্যের মিশেল আছে।
ছোটমায়ের ভাই বাড়িতে আসলে আদর করার ছলে শরীরের এখানে সেখানে খাঁমচে ধরতো। মা কে বলাতে কষে একটা চর মেরেছিলো, তার ভাইকে দোষী করা হচ্ছে এই হচ্ছে বকুলের অপরাধ ।
এরপর থেকে নিজেই চোখে চোখে রাখতে লাগলো,একদিন ছোটমায়ের ভাই জোর করে টেনেটুনে ঘরের কোনায় নিয়ে যাবার প্রাক্কালে নিজের চোখেই দেখে ফেলে। ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হওয়ায় ভাইকে শাসিয়ে বকুলকে রাতের আঁধারে বের করে দেয়। ওই মুহূর্তে সবুজ বাড়িতে সবুজ আসাতে মায়ের পথে সহজ হয়ে যায়, কৌশলে সবুজের সাথে বের করে দেয় ছোটমা। বাবার কানে গেলে যতই মেয়েকে অবহেলা করুক, শালাকে সোজা কেটে ফেলবেন তাই নিজের ভাইকে বাঁচাতে বকুলকে বাড়ীছাড়া করলেন, দায় চাপালেন বকুল প্রেমিকের সাথে পালিয়ে গেছে।
ছোটমা চারাগাছটিকে বাঁধতে পারতেন নিজের সাথে তার বদলে বেঁধে দিলেন কাঁটাগাছে।
এসব কথা মনে পড়লে বকুলের রাত আর ফুরুতে চায় না, পুরো রাতটাই ঘুমের সাথে লুকোচুরি খেলতে থাকে।
রাত ফুরোক আর না ফুরোক দিন কিন্তু ঠিকই চলে আসে। বকুলের জীবন এভাবেই চলতে থাকে, বকুলদের এভাবেই বাঁচতে হয়।

.
মেঘে মেঘে বেলা অনেক গড়িয়ে যায়, বকুল চাকরির পাশাপাশি স্নাতক কমপ্লিট করে ফেলে, পাস কোর্সে মাস্টার্সে ভর্তি হয়। দোকানে বকুলের হ্যান্ড মেড পন্য ভালো বিক্রি হতে থাকে। এই দোকান ছাড়াও অন্যান্য বেশকিছু মার্কেটের দোকানে দোকানে পার্সেন্টেজের উপরে পন্য দিতে থাকে।
দুই বান্ধবী মিলে এক কামরার বাসা ছেড়ে দুই কামরা প্লাস ড্রয়িং ডাইনিং বারান্দাসহ বাসা ভাড়া নেয় এবং পন্য উৎপাদন আরো বাড়িয়ে দেয়। ওদের দুজনের পাশাপাশি বাসাবাড়িতে কাজ করা মহিলাদের, বস্তিতে অলস বসে থাকা নারীদের কাজে লাগাতে থাকে। মহিলারাও বাসা বাড়ির কাজের পাশাপাশি দুই পয়সা বাড়তি ইনকামের লোভে বকুলের অধীনে কাজ করা শুরু করে, ওদের দিয়ে বকুল কাঁথা তৈরির কাজগুলো করায়।
বকুলের এখন একটাই স্বপ্ন নিজস্ব একটা ভ্যারাইটিজ স্টোর গড়ে তোলা, সে জানেনা এই স্বপ্ন পূরণ হবে কিনা তবুও তার দুচোখ জুড়ে এই একটা স্বপ্ন।

.
হাসনা পারভীনের সাথে বকুল এখন মাঝেমধ্যে দেখা করতে যায়। মামীর কাছে শুনেছেন আবীর কন্যা সন্তানের পিতা হয়েছে, মেয়ের নাম রেখেছেন ‘বকুল’, শুনে সে তাজ্জব হয় না, বোঝে ভালোবাসা হয়তো এমনি। ঝুমা বগুড়া মেডিকেলে চতুর্থ বর্ষে আছে, ডাক্তারী পাস করলেই তার বিয়ে হবে ডাক্তার পাত্রের সাথে সব ঠিকঠাক হয়ে আছে।
ইদানীং মামী বকুলকে অনেক অনুরোধ করেন আবার ফিরে যাবার জন্য। কিন্তু বকুলের মন আর সায় দেয় না, মামীকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে
— ছাড়লাম দেশের কোন মায়া থাকতে নেই মামী, তবে আপনাদের কাছে চিরঋণী থাকবো, ভেসে যাওয়া শেওলাকে টেনে তুলে গোবরে পদ্ম ফুটিয়েছেন।

মামা মামী মাথায় হাত ভুলিয়ে অনেক দোয়া করে দিলেন, আরো আশ্বস্ত করলেন বকুলের ডিপিএসটা আর একবছর পর ভাঙতে পারবে। বকুল বললো
— ওটা তো আপনাদেরই মামা, আমি তো তার একটা কিস্তি ও দেইনি।
— তা হোক তোকে আমরা নিজের সন্তান মনে করি, তুইতো এই বাসায় শ্রম দিয়েছিস কিন্তু কোনো বিনিময় নিস নি, তাই ওটা তোর জন্যই করা হয়েছে ওটা তোরই প্রাপ্য।

.
বাসা থেকে বের হতে আজ দেরি হয়ে গেছে তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হবে অথচ রিকশা পাচ্ছে না, তাই রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে বকুলকে। পুরনো বাসাটা গলির ভেতরে ছিলো এই বাসাটা রাস্তার পাশেই এখানে কিছুক্ষণ দাঁড়ালে রিকশা পাওয়া যায়। বারবার হাতঘড়ি দেখছে আর রিকশার অপেক্ষা করছে। হঠাৎ দেখতে পেলো রাস্তার ওপাশে ফুটফুটে একটা ৩/৪বছরের একটা বাচ্চা তার দিকে তাকিয়ে আছে। বাচ্চাটা সুদর্শন ও সুঠাম দেহের একজন পুরুষের হাত ধরে আছে, পুরুষটি ফোনে কথা বলার ব্যস্ত। বকুল বাচ্চাটিকে দেখে হাসলো, বাচ্চাটিও হেসে মুখে ললিপপ পুরে দিলো।
বকুলের পাশাপাশি একটা হরেক খেলনার ভ্যান এসে দাঁড়ালো, বকুল একটু সরে যেতেই অনেকগুলো রঙিন বেলুন নিয়ে একজন বয়স্ক লোকও পাশ কেটে এসে বকুলের পাশে দাঁড়ালো ।

বিরক্তি নিয়ে এদিকসেদিক দেখছে সে, মনেমনে ভাবছে যেদিন দেরি হয়ে যায় সেদিনই রিকশা পাওয়া যায় না। হঠাৎ খেয়াল করে বকুল দেখলো বাচ্চাটি রাস্তার মাঝখানে হয়তো বেলুন দেখে এসেছে আর দ্রুতগামী একটা প্রাইভেটকার ধেয়ে আসছে। বকুল রূদ্ধশ্বাসে দৌড়ে গিয়ে ছোঁ মেরে বাচ্চাটিকে নিয়ে এপাড়ে আসলো। প্রাইভেটকার আরোহী গাড়ী ব্রেক কষে বকুলের উপর রেগে গেলো।
— আজব তো বাচ্চা কাচ্চা দেখে রাখতে পারেন না? এখন কিছু হলে তো সব দোষ আমার হতো, যত্তসব!
বকুলেরও খুব রাগ লাগলো বাচ্চাটা খুব ভয় পেয়েছে অথচ সাথের লোকটার সামান্যতম কাণ্ডজ্ঞান নেই।
লোকটা ফোন কল কেটে দৌড়ে এই পাশে আসলো, বকুলের কোল থেকে বাচ্চাটিকে নিয়ে আদর করতে লাগলো
— দেখি দেখি, ঐশী মামনি ভয় পেয়েছো? কোথাও লাগেনি তো? রাস্তায় আসলে কেনো? যদি তোমার কিছু হয়ে যেতো?

বলেই বুকে চেপে নিলো।

বকুল রেগে গিয়ে প্রশ্ন করলো করলো,
— বাচ্চাটি কি হয় আপনার?
— আমার মেয়ে।
— আজব বাবা তো আপনি? দায়িত্ব জ্ঞানহীন মানুষ, বাচ্চা রাস্তায় চলে এসেছে আর আপনার কোন খেয়ালই নেই, ব্যস্ত আছেন ফোন কল নিয়ে।
— ম্যাম সরি, আসলে জরুরি ফোন কল ছিলো।
— আপনার বাচ্চার চেয়ে জরুরী? বাচ্চাকে সামলে রাখতে না পারলে সাথে নিয়ে বের হোন কেনো? মায়ের কাছে রেখে এলেই তো পারেন। যদি ওর মা এই কাজ করতো, বাড়ি মাথায় তুলে রাখতেন। ( এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বললো)
— আসলে ম্যাম সে সুযোগ আমার নেই।
— মানে?
— মানে ওর মা নেই।

স্তব্ধ বকুল আর কিছু না বলে ওখান থেকে সরে গেলো, সহসাই একটা রিকশা পেয়ে তাতে উঠে বসলো।
একবারের জন্য খেয়াল হলো না, দুইজোড়া চোখ তার চলার পথে নিবন্ধ হয়ে আছে।

সারাদিন কোনো কাজে মন বসাতে পারলো না বকুল, বারবার নিজের জীবনের প্রতিচ্ছবি ভাসতে লাগলো। এমন এতিম তো সে ছিলো, বাবাও তাকে এমন আদরই করতো অথচ তার ভাগ্য তাকে কোথায় নিয়ে এসেছে। এই ফুটফুটে বাচ্চা মেয়েটি কি করে বড় হবে মা ছাড়া, কি হবে তার ভবিষ্যৎ? বকুলের মতো জীবন হয়তো তার হবে না, কিন্তু খুব কি ভালো জীবন পাবে সে? যদি বাবাটি দ্বিতীয় বিয়ে করে তবে এই আদর ভালোবাসা কি থাকবে?
আসলে থাকে না, থাকার কথাও নয় যদিও বলা হয় নতুন মানুষটা একটা বাচ্চার জন্য সংসারে আসে। কিন্তু আসার পর তার স্বপ্ন দানা বাঁধে একান্ত নিজের করে পুরো সংসার, স্বামী নিজের গর্ভজাত সন্তানের আকাঙ্ক্ষা জন্মে। পূর্বস্ত্রীর সন্তানকে আগাছা ও জঞ্জাল মনে হয়, ঈর্ষা হিংসা তৈরি হয়। আর রোষাগ্নিতে পড়ে নিষ্পেষিত হয় অবুঝ শিশুমুখ।

দিন দুয়েক পর বকুল রিকশায় উঠতে যাবে এমন সময় পেছন থেকে ডাক শুনতে পায়,
— এই যে ম্যাম শুনুন।
বকুল পেছন ফিরে তাকায়।

.
চলবে

#শামীমা_সুমি