খেরোখাতার ছেঁড়াপাতা পর্ব-১৫+১৬

0
125

#খেরোখাতার_ছেঁড়াপাতা– ১৫

বকুলের কোলে গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে ঐশী। অদূরে উদ্বিগ্ন মুখে বসে আছে ইয়াশ, ডাক্তার বলে দিয়েছেন ২৪ ঘন্টা না গেলে কিছুই বলা যাচ্ছে না।

গভীর রাতে সাধারণত কোনো কল রিসিভ করে না বকুল। কিন্তু মাঝরাতে খালাম্মার নম্বর থেকে কল যাওয়াতে রিসিভ করলো, কল রিসিভ করতেই ইয়াশের ভয়ার্ত ও কান্নামিশ্রিত গলার স্বর শুনতে পেলো বকুল,
— হ্যালো।
— হ্যালো বকুল, আপনি কি একটু আমাদের বাসায় আসতে পারবেন? আম্মা খুব অসুস্থ, কি করবো বুঝতে পারছি না?

সামনাসামনি বিল্ডিং তাই খবরটা শুনে বকুল আর দেরি করেনি, তাড়াতাড়ি ও বাসায় গিয়ে দেখে খালাম্মা সেন্সলেস হয়ে আছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই এম্বুলেন্স চলে আসলে সবাই ধরাধরি করে খালাম্মাকে হাসপাতালে নিয়ে আসে। অবস্থা ক্রিটিকাল দেখে ডাক্তার দ্রুত আইসিইউতে শিফট করে দেন।

ভিজিটর রুমে বসে আছে দুজনে, বকুল দেয়ালে হেলান দিয়ে চোখ বুঝে আছে, কোলের উপর বেঘোরে ঘুমাচ্ছে ঐশী। একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে ইয়াশ, মনেমনে ভাবছে… কি স্বর্গীয় লাগছে দৃশ্যটা? দেখে যে কেউ ভাববে এরা মা মেয়ে অথচ এদের মধ্যে রক্তের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু আত্মার বন্ধনে আবদ্ধ দুজন, ঐশী বকুলকে ভীষণ পছন্দ করে, বকুল আন্টি বলতে পাগল। ইয়াশ দিনশেষে বাসায় ফিরলে বকুলের গল্পই সারাক্ষণ বলতে থাকে। যেদিন বাসায় বকুল আসে তার সাথে খেলা, গল্প করা আনন্দ হৈ হুল্লোড় সবই চলে। মা নিজেও বকুলকে বেশ পছন্দ করেন, শুধু ইয়াশ নিজের মনের কথা মা বা বকুল কাউকে বলতে পারে না।
মাঝেমাঝে ভাবে বকুলকে একদিন নিজের এই ভালো লাগার কথা জানাবে, কিন্তু সে সাহস সঞ্চয় করতে পারে না, যদি বকুল রাগ করে? যদি অপমানিত বোধ করে, ইয়াশ তখন মরমে মরে যাবে।

বকুল নড়েচড়ে উঠতেই ইয়াশ সতর্ক হয়ে চোখ সরিয়ে নেয়, তার উশখুশ ভাব দেখে বুঝতে পারে কিছু একটা লাগবে? কিন্তু ঐশী জেগে যাবে তাই হয়তো বকুল বেশি নড়াচড়া করছে না। ভাবগতিক বুঝতে পারে ইয়াশ প্রশ্ন করে,
— বকুল আপনার কিছু লাগবে?
— না…মানে…
— পানি খাবেন?
—জি
ইয়াশ পানির বোতলটা এগিয়ে দেয়, বকুল হাত থেকে বোতল নিয়ে ঢকঢক করে বেশ অনেকটা পানি খেয়ে নেয়। বোতলটা ইয়াশকে ফিরিয়ে দিয়ে বলে,
— ধন্যবাদ
— আপনাকে এত রাতে এনে কষ্ট দেবার জন্য আন্তরিকতা ভাবে দুঃখিত।

বকুল চোখ তুলে সরাসরি তাকিয়ে থাকে। ইয়াশ চোখ নামিয়ে নিয়ে আবার বলে,
— আসলে বিশ্বাস করুন, ওই সময় কি করবো? কাকে ডাকবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না? মায়ের কললিস্টে আপনার নামটা প্রথমে দেখে আপনাকেই নক করে বসেছি। সরি
—- আপনি এভাবে বলছেন কেনো?এমন করে বলছেন যেনো গুরুতর অপরাধ করে ফেলেছেন? খালাম্মা আমাকে ভালোবাসেন, স্নেহ করেন, উনার কাজে লাগতে পেরে আমার নিজেরই খুব ভালো লাগছে।
— অশেষ ধন্যবাদ আপনাকে
— একটা কথা বলি?
— জি বলুন?
— কিছু মনে করবেন না প্লিজ।
— না, আপনি বলুন?
— এবার একটা বিয়ে করুন, আপনাকে নিয়ে খালাম্মা ভীষণ টেনশন করেন।
— বিয়ে…. কোন মেয়ে করবে আমাকে বিয়ে, তাছাড়া আমার ঐশীর মা হবার মতো যোগ্য মেয়ে পাবো কই?
— খুঁজে দেখুন? ভালোভাবে খুঁজলে পেয়ে যাবেন, এখনো অনেক ভালো মানুষ আছে জগতে।
— আপনি হবেন আমার ঐশীর মা?

বকুল হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে যায়, মুখে আর কথা যোগায় না, আকস্মিক এই প্রস্তাবের জন্য সে মোটেও প্রস্তুত ছিলো না।
ইয়াশও মুখ ফসকে বেফাঁস কথাটি বলে ফেলে লজ্জিত হয়ে পড়েছে। নিজেকে সামলে নিয়ে সে বললো
— সরি সরি বকুল, আমি বোধহয় আপনাকে বিব্রত করে ফেললাম। কথার পিঠে আচমকা বলে ফেলেছি। আসলে মনের ইচ্ছে বেশিক্ষণ চেপে রাখতে আমি পারি না।

বকুল চুপচাপ ইয়াশের সব কথা শুনে যাচ্ছিলো, অনেকক্ষণ দুজনেই চুপচাপ, তারপর বকুল নিজের মৌনতা ভাঙলো,
—- আমার রূপ দেখে পাগল হলেন?
— নাহ, রূপ আমার কাছে মেটার করে না। আপনার পারসোনালিটি আমাকে মুগ্ধ করেছে।
— কতটুকু জানেন আমার সম্পর্কে?
— কিছুই জানিনা, কিন্তু জানতে চাই?
— জানতে চাইবেন না সহ্য হবে না, আশাহত হবেন।
— হবো না।

বকুল একেবারে চুপ হয়ে যায় আর একটি কথাও বলে না, ঐশী জেগে উঠলে তাকে ওয়াশরুমে নিয়ে যায় ।
ফিরে আসলে দেখে ইয়াশ আশাহত চোখে তাকিয়ে আছে বকুলের দিকে, চোখ সরিয়ে নেয় বকুল এই দৃষ্টি তার সহ্য হয় না।

সকাল হতেই আত্মীয় স্বজনরা খবর পেয়ে একে একে আসতে থাকে, খালাম্মার ভাইবোন ঐশীর নানুর বাড়ির লোকজন। সারারাতের নির্ঘুমতায় বকুলের ভীষণ ক্লান্ত লাগে, ইয়াশের কাছে ঐশীকে দিয়ে বকুল নিজের বাসায় চলে যায়। বাসায় গিয়ে শপে ফোন করে ডিউটি বদল করে নিয়ে ইচ্ছেমতো ঘুমিয়ে নেয়।

*
২৪ ঘন্টা পর হোসনে আরা চোখ মেলে তাকান, ইয়াশের মনে স্বস্তি ফিরে আসে। শরীর সুস্থতার দিকে যেতে থাকে। বকুল সকাল বিকাল ফোন করে খোঁজখবর নেয় স্ব-শরীরে আসার আর সাহস দেখায় না। কি লাভ মায়া বাড়িয়ে? যা হবার নয় তার জন্য সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে লাভ কি? স্বপ্নচূড়া ভেঙে যখন মুখ থুবড়ে পড়তে হবে তখন নিজেকে বকুলের নতুন করে জুড়তে খুব কষ্ট হবে।

হোসনে আরার শরীর কিছুটা সুস্থ হলে হাসপাতালে বসেই ঐশীর নানা নানু সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, ইয়াশ আর নিপুনের তারা বিয়ে দিতে দেবেন । হোসনে আরার পক্ষে সংসার ও ঐশীকে সামলানো সম্ভব নয়, তাই দ্রুত সম্ভব বিয়ের কাজ তারা সেরে ফেলতে চান।
এই বিষয়ে ইয়াশের মতামত জানতে চাওয়া হলে সে জানায়, ভেবেচিন্তে মায়ের শরীর পুরোপুরি সুস্থ হলে তার সাথে পরামর্শ করে জানাবে।

হোসনে আরাকে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে, বকুল কাজের ফাঁকে সুযোগ পেলে গিয়ে দেখে আসে। দিন সাতেক পরে বকুল ওই বাসায় গিয়ে দেখতে পায় ঘরোয়া বৈঠক বসেছে ইয়াশের বাসায়। ঐশীর নানাবাড়ির সবাই হাজির ওখানে, বকুলকে দেখে ইয়াশের চোখের তারায় দ্যূতি আসে, মন আনচান হয়, সে উশখুশ করতে থাকে, অদূরে বসে সবই নিপুণ খেয়াল করে। বকুল পরিস্থিতি বুঝে খালাম্মাকে দেখে দ্রুত চলে আসে। ঐশীর নানাভাই এবার সরাসরি ইয়াশকে প্রশ্ন করে,
—- ইয়াশ আমরা বুঝতে পারছি তুমি বিয়ে বিষয়টাতে আগ্রহী নও, কিন্তু তোমার মা ও ঐশীর কথা ভেবে, আমি আমার ছোট মেয়েকে তোমার হাতে তুলে দিতে চাই। এখানে তোমার মতামত কি?
— আসলে আমি এই মুহূর্তে বিয়ে নিয়ে ভাবছি না।
— আমরা ভাবছি, ঐশীর জন্য নিপুনের চেয়ে ভালো কেউ হবে না। তাছাড়া তোমার মাও অসুস্থ সংসারে তো কাউকে চাই তাইনা?
— দেখুন কিছু মনে করবেন না, নিপুনের আচার আচরণ ভালো নয়, খুব রুক্ষ, ও আমার মায়ের সাথে ভালো ব্যবহার করে না।
— সংসারী হলে সব ঠিক হয়ে যাবে।
— হবে না বরং সংসারে অশান্তি বাড়বে! আর নিপুনকে আমার পছন্দ নয়।
— কি? কোনদিক দিয়ে নিপুণ তোমার অযোগ্য? (ঐশীর নানু বললো)
— কোন দিক দিয়ে যোগ্য তাই বলুন?
— আমার নাতিনীকে অন্য কারো হাতে তুলে দিবো না, নিপুন খালা হয় সে সব থেকে বেশি যত্ন নেবে।
— আমার মেয়েটার কষ্ট আরো বাড়বে।
— তুমি অন্য কাউকে বিয়ে করলে, আমরা ঐশীকে তোমার কাছে দেবো না।
— ঐশী আমার সন্তান, আপনারা দেয়া না দেবার কে?

বহু তিক্ততা নিয়ে সবাই চলে যাবার মুহূর্তে নিপুণ ইয়াশের রুমে ঢোকে,
— এই যে আসলো মেয়েটি সেকি আমার চেয়ে বেশি সুন্দরী, বেশি যোগ্য?
— নিজেকে প্রশ্ন করে দেখো? তাছাড়া এখন ওর কথা আসছে কেনো?
— আপনি এই মেয়েটির প্রেমে পড়েছেন আমি বুঝতে পারছি।

.
ক্লান্ত দেহ ক্লান্ত মন নিয়ে বকুল বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে, জীবনের অংক সেই ছোটকাল থেকে কষে আসছে বকুল কিন্তু হিসেব মেলাতে পারে না।
ইয়াশের প্রস্তাবটা বকুলকে নাড়িয়ে দিয়েছে। ইয়াশ আজ আবেগের বশে কথাটা বলে ফেলেছে বটে, কিন্তু বাস্তবতার মুখোমুখি যখন হবে তখন সত্যের রূঢ় রূপ থেকে পালিয়ে যাবে।
হঠাৎ ফোন বেজে উঠতেই চিন্তার ছেদ পড়লো। ফোন হাতে তুলে নিতেই চোখে পড়লো আননোন নম্বর, হয়তো কোন প্রোডাকটের জন্য কাস্টমার কল হবে তাই কল রিসিভ করলো,
— হ্যালো আসসালামু আলাইকুম
— ওয়ালাইকুম আসসালাম
— আমি ইয়াশ ইমতিয়াজ বলছি।
—- ও… আচ্ছা.. বলুন।
— কেমন আছেন?
— ভালো আছি।
— আপনি তো কিছুই বললেন না?
— কোন ব্যাপারে?
— সেদিন হাসপাতালে আপনাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম। আজ আবারও বলছি প্লিজ… আপনি কি ঐশীর মা হবেন?
— আপনি আমার সম্পর্কে কিচ্ছু জানেন না তাই এমন বলছেন। সব জানার পর মুখ ফিরিয়ে নেবেন, এই আবেগটুকু থাকবে না।
— ভুল ভাবছেন, আপনার প্রতি আমার হৃদ্যতা সাময়িক নয়।
— বেশ তবে কাল স্পাইস সিক্সে আসুন সেখানেই কথা হবে।
— বেশ তবে তাই হবে।

#শামীমা_সুমি
.
চলবে

#খেরোখাতার_ছেঁড়াপাতা — ১৬

সবইতো শুনলেন এবার বলুন, আমাকে কি আপনার জীবনের সাথে জড়ানো মানায়? আমার বেদনা আপনার মাথায় তুলে নেবার দায় নেই।

বকুলের প্রশ্ন শুনে চোখ তুলে তাকায় ইয়াশ ইমতিয়াজ, কিছুক্ষণ চুপ থেকে তারপর মৌন্যতা ভেঙে উল্টো প্রশ্ন করে,
— বিধবা কি আপনি স্বেচ্ছায় হয়েছেন?
— না তা হইনি।
— তাহলে এখানে আপনার দোষ কোথায়?
—- কিন্তু আমি তো ধর্ষিতা, সমাজের চোখে ঘৃণ্য।
— না আপনি বা আপনারা যারা এই পরিস্থিতির শিকার তারা ঘৃণ্য নন, ঘৃণ্য তারা যারা এই জঘন্য কাজটি করে এবং এর ইন্ধনদাতা, আর যারা সব দায় নারীর গায়ে চাপিয়ে দেয়। আসল ঘৃণ্য আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, অপরাধ ধামাচাপা দেয় আর ভিকটিমকে সারাজীবনের যন্ত্রণা বহন করতে ছেড়ে দেয়।
— কিন্তু?
— আপনি কি জানেন কত নারী স্বেচ্ছায় বিকৃত বাসনা মেটাতে বা সামান্য টাকার লোভে, অনেকে জীবনকে উপভোগ করার নামে নিজের ইজ্জত বিকিয়ে দেয়? তাদের থেকে খারাপ তো আপনি নন।
— কিন্তু সমাজ তো ধর্ষিতাকে অচ্ছুৎ করে রাখে, তার জীবন নরকের চেয়েও ভয়ংকর করে তোলে। তাদের প্রতি পদেপদে কটাক্ষ-বানে কত মেয়ে শেষ পর্যন্ত আত্মহননের পথ বেছে নেয়। প্রশাসনও তাদের বাঁচাতে মরিয়া হয়ে থাকে, ধর্ষিতার পরিবার শেষ অবধি মিথ্যে আশ্বাস ছাড়া কিছুই পায় না।
— জগতে সব মানুষ এক নয়। এই সমাজে খারাপের পাশাপাশি ভালো মানুষ ও আছে।
— আপনার এই আবেগ তো সারাজীবন থাকবে না।
— থাকবে আজন্মকাল, আমি মন থেকে চেয়েছি আপনাকে মোহে পড়ে নয়।
— আমার বিশ্বাস হয় না কাউকে।
— একবার বিশ্বাস করেই দেখুন আপনি ঠকবেন না। আর কাউকে না কাউকে তো বিশ্বাস করতেই হবে তাই না?
— আপনি মানলেন কিন্তু আপনার পরিবার যদি না মানে?
— আমি জেনেছি এটাই যথেষ্ট, আমার পরিবারের কেউ জানবে না। মা বোন জানবে আপনি বিধবা ব্যাস আর কিছু নয়।
— কিন্তু এটা তো পুরো সত্য নয়, আর আধা সত্য মিথ্যের চেয়ে ভয়ংকর।
— আপনি তো মিথ্যে বলছেন না, শুধু কিছু কালো অধ্যায়ে আজীবনের জন্য চাপা দিচ্ছেন, সত্যকে গোপন করছেন। যাতে করে কারো কোনো ক্ষতি হবে না।
— কখনো যদি জেনে যায় তখন কি হবে?
— জানবে না, আর জানলেও আমিতো আছি, ভয় কিসের?
— আপনি সারাজীবন পাশেই থাকবেন তার ভরসা কি?
— বিশ্বাসের উপর জগত টিকে আছে, একবার বিশ্বাস করে হাত বাড়িয়ে দেখুন সারা জনম বুকে ধরে রাখবো।
— তবে আমাকে কিছুদিন সময় দিন।
— না, সময় পেলে আপনি মন বদলে ফেলবেন, আমি সে ঝুঁকি নেবো না।

( বলেই মুচকি হাসি দিলো ইয়াশ জবাবে বকুলও স্মিত হাসলো)
— তাহলে আমার গার্জিয়ানদের সাথে কথা বলে জানাচ্ছি।

.
সন্ধ্যায় বসে চা নাস্তা খাচ্ছেন আফজাল আহমেদ আর হাসনা পারভীন, হঠাৎ কলিংবেল বেজে উঠতেই এসে দরজা খুঁলে দেখেন বকুলকে দাঁড়িয়ে আছে। বকুলকে দেখে তিনি যারপরনাই বিস্মিত হন।
— আরে বকুল তুই? হঠাৎ কি মনে করে? আয় আয় ভেতরে আয়।
— আপনাদের কথা মনে পড়ছিলো তাই দেখতে চলে এলাম।
— বেশ করেছিস, আমি ভীষণ খুশি হয়েছি। তুইতো আমাদের ভুলেই গেছিস।
— না না মামী কি বলেন? আপনাদের কথা এই জীবনে ভুলবো না। আপনাদের স্নেহের হাত না থাকলে কোথায় যে ভেসে যেতাম। আজকের বকুল হয়ে উঠার পেছনে আল্লাহর পর আপনারাই ছিলেন।
— এভাবে বলিস না মা সবই আল্লাহর ইচ্ছা, আমাদের কিছু করার ক্ষমতা নেই।

বকুল ভেতরে গিয়ে সোফায় বসলো, মামা আফজাল আহমেদ কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন, খোঁজখবর নিলেন কোথায় আছে, কী করছে পড়াশোনা কেমন চলছে। ঝুমাও দুই তিনদিনের জন্য বাড়ি এসেছে বকুলকে দেখে খুব খুশি হলো, সে ও এসে আলোচনায় যোগ দিলো।
কথার মাঝখানে মামী বললেন
–শোন আজ কিন্তু তুই যেতে পারবি না! আমি খাবার দাবারের ব্যবস্থা করছি।
— না না মামী আমার জন্য কোনও ঝামেলা করবেন না।
— কোন ঝামেলা হবে না, তুই চুপচাপ বস।
তাহলে আমিও আসছি আপনার সাথে।

রান্নাঘরে মামীর সাথে গল্পে গল্পে সব খুলে বললো বকুল, মামী সব শুনে মামার সাথে বিস্তারিত আলোচনা করলেন।
রাতে খাবার শেষে সবাই একসাথে বসলো ড্রয়িংরুমে, মামা প্রশ্ন করলেন
— ছেলে তাহলে সাব ইন্সপেক্টর?
— জি মামা
—- বাড়ি কোথায়?
— নেত্রকোনা
— পরিবারে কে কে আছে?
— মা আর তার ছোট একটা মেয়ে, বাবা নেই বড় বোন স্বামীসহ বেনাপোল থাকে।
— হুমম, সবই তো ঠিক আছে, এখন তুই কি করতে চাস?
— আমি বুঝতে পারছি না কি বলবো?
— এখন ম্যাচুরিটি এসেছে নিজের সিদ্ধান্ত নিতে তো তোকে শিখতে হবে।
— আপনারা যা বলবেন তাই হবে, আমি মানুষকে বিশ্বাস করতে ভয় পাই।
— বিশ্বাস তো কাউকে না কাউকে করতেই হবে, বিশ্বাস না করে জগতে টিকতে পারবি না।
— শোন বকুল আমাদের সাহসের বড্ড অভাব ছিলো, লোকলজ্জা ভয় সমাজের কথার ভয়, সমালোচনার ভয় করেছি। নইলে তোর মতো মেয়েকে আজীবন বুকে ধরে রাখতে পারলাম না সেটা কি আমাদের জন্য কম দুর্ভাগ্য? (বললেন হাসনা পারভীন)
— মামী এভাবে বলবেন না, আমি জানি আপনারা আমায় খুব ভালোবাসেন, যা করেছেন আমার ভালোর জন্যই করেছেন।
— এই ছেলের সাহস আছে, সমাজ সংস্কার, লোকলজ্জার ভয় দুপায়ে মাড়িয়ে যাবে,তোকে সুখে রাখবে দেখিস? তুই একে সম্মতি জানাস।
— ওকে ফ্যামিলি নিয়ে আমার কাছে আসতে বল। ( বললেন আফজাল আহমেদ)
— জি মামা।

*
নিপুণকে বিয়ে করতে না চাওয়ায় পারিবারিকভাবে অনেক অশান্তি হলো। ঐশীর নানাবাড়ির সাথে সারাজীবনের জন্য মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে, হয়তো সম্পর্ক আর রাখবেনও না উনারা। নিপুনের মতো মেয়ে নিয়ে এটলিস্ট সংসার হবে না। এদিকে বকুল সেই যে সময় চেয়ে নিয়েছে এখন পর্যন্ত হ্যা না কিছুই বলেনি। ইয়াশের আর ধৈর্যে কুলাচ্ছে না, অগ্যতা দ্বিধাদ্বন্দ্ব নিয়েই বকুলকে কল করলো। বকুল কল রিসিভ করতেই ইয়াশ বললো,
— হ্যালো….. কোন নেগেটিভ কথা শুনতে চাই না, যা বলবেন সব যেনো পজেটিভ হয়।

বলার ধরন শুনে বকুল হেসে ফেললো
— যদি পজেটিভ না হয়।
— তাহলে আপনাকে মেরে নিজেও মরে যাবো।
— এত আবেগ।
— জ্বি আবেগের এখনো কিছুই দেখেননি, দেখাবো যদি সুযোগ একবার পাই।
— ইশশশ
— হুমম দেখাবো, এখন বলুন সময় কি শেষ হলো?
— জ্বি, মামা মামী আপনার পরিবারকে নিয়ে যেতে বলেছে উনাদের কাছে।
— থ্যাংকস গড, হাফ ছেড়ে প্রাণ বাঁচলো।
— কেনো প্রাণ কি ওষ্ঠাগত ছিলো নাকি?
— সে আর বলতে, আচ্ছা আসছি আমি আপনার দ্বারে।
— আচ্ছা রাখছি
— এখনই যাবেন, প্লিজ আরেকটু থাকেন না।
— না মায়া বেড়ে যাবে।
— বাড়ুক না মন্দ কি?
— ভবিষ্যতের জন্য তুলে রাখুন।
— ভবিষ্যতেরটা ভবিষ্যতে এখনকারটা মিস করতে চাই না।
— আচ্ছা… তাই নাকি?
— হ্যা, আমার হার্টবিট শুনুন ধুকপুক ধুকপুক করার বদলে শব্দ হচ্ছে বকুল বকুল।
— হুমম… কথার পন্ডিত।
— কাজেও
— মানে?
— মানে কাজেকর্মে, ভালোবাসায় আরো বেশি।
— আচ্ছা… দেখা যাবে।
— সারাজীবন বুকে ধরে রাখবো, কথা দিলাম।
— হুমম
— কি হুমম?
— মানে বুঝলাম।
— ভালোবাসি বকুল, ভীষণ ভালোবাসি, যেদিন থেকে দেখেছি এই তেজস্বিনী বকুলকে সেদিন থেকেই ভালোবাসি।
— আচ্ছা…… রাখছি।
মোবাইল রেখে বকুল জলভরা চোখ দুটো মুছে নিলো।

.
ইয়াশ ড্রয়িংরুমে চুপচাপ বসে আছে আর আড়চোখে বকুলকে দেখছে।
আফজাল সাহেবের যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছে ইয়াশের মা হোসনে আরা। সমস্ত জেরা জেরবার ও প্রশ্নোত্তর পর্বের শেষে আফজাল আহম্মেদ বললেন,
— যদিও আমরা বকুলের গার্জিয়ান, কিন্তু বকুলের মা বাবা দেশে আছে, আর তারা আমাদের সিদ্ধান্তের উপর কথা বলবেনা । তাই এদিক থেকে আমি নির্ভার আছি, তাদেরকে সবকিছু ঠিকঠাক হলে দেশ থেকে আনিয়ে নেবো।
— জি ভাইজান অবশ্যই আনবেন, তা কি করে বকুলের বাবা?
— তিনি ব্যবসায়ী মানুষ, গ্রামে থাকেন ওখানকার বাজারে বেশকিছু দোকানপাট আছে তার । বকুল আমার এখানে থেকে লেখাপড়া করেছে।
— বকুল খুব লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে।
— নিঃসন্দেহে আপা।
— আরেকটা কথা ভাইজান বিয়ে বেশি আড়ম্বরপূর্ণ করতে চাই না, দুই পরিবারের কিছু কাছের লোক থাকবে, বাড়তি মানুষ এনে দশ কথার দরকার নেই। আমরা আমরাই শুভ কাজ সেরে নেবো।
— জি আপা তাই হবে।

.
বারান্দায় জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে বকুল, অনতিদূরে ইয়াশ দাঁড়িয়ে বকুলকে দেখছে, বকুল জড়োসড়ো হয়ে আছে
— আমার ভয় লাগছে?
— কিসের ভয়?
— এত সুখ কি আমার কপালে সইবে?
— কেনো সইবে না, ভুল মানুষের হাত তো ধরোনি।
— তবুও ভীষণ ভয় লাগে? জানেন জীবনে এত কষ্ট পেয়েছি যে সুখ আমার কাছে অলীক স্বপ্নের মতো।
— আমি আছি তোমার পাশে, পৃথিবীতে আর কেউ তোমাকে দুঃখ দেবার সাহস করবে না, এমনকি আমিও না।
— সারাজীবন এভাবে পাশে থাকবেন তো?
— আলবাত থাকবো, আর আজ থেকে আপনি বলা বন্ধ করে দাও।
—- আমি পারবো না।
— পারতে হবে।
— আমাকে সময় দিন।
— আচ্ছা দিলাম, প্রস্তুতি নাও আর অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকো।

.
চলবে।

#শামীমা_সুমি