খেলাঘর পর্ব-০১

0
6

#খেলাঘর ( প্রথম পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<১>
কৌস্তভ সবে ঘুম থেকে উঠে কফি আর নিউজপেপার সহকারে ড্রইং রুমে এসেছে | মার্চ মাসের সেকেন্ড উইক , তাই শীতটা চলে গেলেও কলকাতায় ভ্যাপসা গরমটা এখনো পড়েনি | তাই বেশ সুন্দর লাগছিলো বসন্তের এই সকালটা | এমন সময়ই পি.এ এসে হাজির ,
” স্যার , আসবো ? গুড মর্নিং ..”
” আরে অয়ন ! এসো | গুড মর্নিং .. তো আজ হঠাৎ এতটা সকালে চলে এলে যে ? ”
” না স্যার , এমনি | স্যার বলছিলাম যে আপনি বলেছিলেন না মিলির রাত দিনের দেখাশোনার জন্য একটা গভর্নেস চাই , তো কাল কয়েকটা মেয়ের ইন্টারভিউ নিয়েছিলাম | এদের মধ্যে এই অনন্যা বলে মেয়েটাকে সব দিক থেকে বেশ এপ্লিকেবল লেগেছে | এই নিন স্যার , মেয়েটার বি.এ পাশের সার্টিফিকেট | এম.এ না কি পড়তে পড়তেও ছেড়ে দিতে হয়েছে | অভাবে |”
“বুঝলাম | ঠিক আছে, আজ সকাল ১০টায় এর সাথে এপয়েন্টমেন্ট ফিক্সড করো , আমি নিজে কথা বলে দেখি |”
কথাটা শেষ করে টেবিলে পড়ে থাকা বি.এ পাশ এর সার্টিফিকেটের ওপর চোখ চলে গেলো কৌস্তভের | হিস্ট্রি তে অনার্স , তার ওপরে আবার ফার্স্ট ক্লাস , তার মানে তো যথেষ্টই ভালো স্টুডেন্ট | তাহলে হঠাৎ কি এমন হলো যে এম.এ পড়া ছেড়ে দিয়ে গভর্নেস এর কাজ করতে হচ্ছে ? স্ট্রেঞ্জ ! এতই অভাব ! যাই হোক, তাতে কৌস্তভের কি , ওর একটা ভালো শিক্ষিত মেয়ে পাওয়া নিয়ে কথা | যে মিলিকে দেখাশোনার সাথে সাথে ওর পড়ার ব্যাপারেও নজর দিতে পারবে | নইলে, কৌস্তভের তো সময়ই নেই |
<২>
কৌস্তভ সেন , বাংলা ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সব থেকে পরিচিত নাম | বর্তমান বাংলা ইন্ডাস্ট্রিতে এক নম্বর ডিরেক্টর | কমার্শিয়াল ফিল্ম হোক, কি আর্ট ফিল্ম , সবেতেই সমান ভাবে সফল | পাঁচ বছরের ছোট ক্যারিয়ারে দুটো ন্যাশনাল অ্যাওয়ার্ড ও জিতে নিয়েছে |
কিন্তু এতো কিছুর পরও কোথাও না কোথাও খুব একা লাগে ওর | আসলে ওর মা বাবা লন্ডনে সেটেল্ড | তাই সারা দিনের লাইট ক্যামেরা একশনের শেষে যখন ফাঁকা ফ্ল্যাটটাতে ফিরতো তখন একটা খালিভাব ঘিরে ধরতো ওকে | কিছুদিন আগে মা বাবাই তাই এই এডপশনের বুদ্ধিটা দিলো | এমনিতেও কৌস্তভ বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতে খুব ভালোবাসে | ব্যাস, তার পরেই মাদার টেরিজার প্রতিষ্ঠান থেকে মিলি কে পাওয়া | পাঁচ বছরের ছোট্ট মিলি কৌস্তভের জীবনে এসে যেন এক মুঠো রং ছড়িয়ে দিয়েছে | শুটিং, মিডিয়া , হাজার কাজের ব্যস্ততা আর একঘেয়েমির মধ্যে মিলি যেন একটা অন্য রকম প্রাপ্তি | ছোট্ট মিলিকে সকালবেলা ঘুম থেকে আদর করে তোলা, শুটিং এর একশন কাট এর মাঝে মিলির সাথে বকবক করা , উইক এন্ডস এর সকালগুলোতে মিলিয়ে নিয়ে পার্ক এ যাওয়া যে কৌস্তভকে কতটা আনন্দ দেয়, সেটা ও কাউকে বলেও বোঝাতে পারবে না | এই একমাসের মধ্যে মিলি ওর জীবনের সাথে এতটাই জড়িয়ে গেছে |
এপ্রিল থেকে মিলির স্কুল শুরু হবে | তাই শুটিং এ মিলিকে নিয়ে আসা আর সম্ভব না | এছাড়াও আউটডোর শুট এর জন্য তো অনেক সময়ই কৌস্তভকে দেশের বাইরেও অনেকদিনের জন্য থাকতে হয় মাঝে মাঝেই | তাই মিলিকে দেখাশোনার একটা লোকের খুবই দরকার | এই সাত পাঁচ ভাবনার সাথে সাথেই স্ক্রিপ্টটার দিকেও একটু চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলো ও | এই সময়ই ভ্যানটির দরজায় ঠকঠক | স্পট দাদা এসে বললো,
” স্যার, আপনার সাথে একটা মেয়ে দেখা করতে এসেছে | ওই মিলির গভর্নেস না কি ! তার জন্য কথা বলতে চায় |”
” ও , হ্যাঁ | কি যেন নাম ! অনন্যা | পাঠিয়ে দাও ওকে |”
কথাটা বলেই আবার স্ক্রিপ্ট এর পাতায় চোখ রাখলো কৌস্তভ |
আর ঠিক পাঁচ মিনিটের মধ্যে আবার ভ্যানটির দরজায় ঠক ঠক | স্ক্রিপ্ট থেকে চোখ টা না সরিয়েই বললো , ” কাম ইন ..” …
————— ” স্যার, আমি অনন্যা |” ….. মেয়েটার গলার আওয়াজটা তো বেশ সুন্দর ! তাই স্ক্রিপ্ট থেকে চোখটা তুলতেই হলো |
চুলটাকে আলগা ভাবে একটা বিনুনি করা , কালো ফ্রেম এর চশমার ভেতরে দুটো গভীর চোখ , গায়ের রং ফর্সা , আর সবটা মিলিয়ে একটা নিষ্পাপ মুখ | সাদা রং এর খুব সাধারণমানের একটা সুতির চুড়িদার বোঝানোর চেষ্টা করছে যে অভাব আছে টাকার | কিন্তু তা সত্ত্বেও চেহারার মধ্যে অদ্ভুত এক আভিজাত্যের ছোঁয়া | এই মেয়েটাকে হঠাৎ করে একবার দেখলে তো কিছুক্ষণের জন্য চোখ ফেরানো যাবেই না | এটা ভাবতে ভাবতেই বললো , ——- ” বসো |” ..
অনন্যা সামনের চেয়ারটায় বসার পর কৌস্তভ প্রশ্ন করলো ,
” তো তোমার বাড়ি কোথায় ?”
” ঢাকুরিয়াতে |”
”হুম, তার মানে কলকাতার মধ্যেই | ভালো | তো তোমাকে কিন্তু রোজ রাত দশটা পর্যন্ত মিলির সাথে থাকতে হবে বাড়িতে , আর মাঝে মাঝে শুটিং এর জন্য আমি সারা রাত হয়তো বাড়ি ফিরলাম না , তখন মিলির সাথে সারা রাত আমার ফ্ল্যাটেই কাটাতে হবে | তাই অসুবিধা থাকলে আগেই ক্লিয়ার করে দাও |”
” না না | কোনো অসুবিধা নেই স্যার | অয়নবাবু আগেই এইসব বলেছেন আমাকে |”
” ও , তাহলে তো ভালোই | আর স্যালারি কিন্তু টুয়েন্টি থাওসেন্ট |”
” ঠিক আছে স্যার। কিন্তু একটা কথা ছিল আমার! ”
” কি কথা ? স্যালারি কম ??”
” না স্যার, সেটা না | স্যালারি আপনি আমাকে আরও কম দিলেও চলবে , কিন্তু প্লিজ এখন আমাকে দশ হাজার টাকা অ্যাডভান্স দিতে পারবেন ? খুব দরকার আমার |”
কি ! দশ হাজার টাকা অ্যাডভান্স ! প্রথম দিন কথা বলতে এসেই ! অন্য কেউ কথাটা বললে তাকে খুব লোভী মনে হতো | নিশ্চয়ই টাকা নিয়ে আর আসবে না | কিন্তু এই মেয়েটার সম্বন্ধে কিছুতেই যেন এই ধারণাটা করা যায় না | একে বিশ্বাসই করতে ইচ্ছা করলো কৌস্তভের | দু মিনিট এইসব ভেবে নিয়ে বললো , — ” ঠিক আছে , আমি অয়নকে বলে দিচ্ছি , ওর কাছ থেকে নিয়ে নাও |”
” থ্যাঙ্ক ইউ স্যার , থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ.. “…. অনন্যা কথাটা বলতে বলতেই ওর মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে গেলো | কৌস্তভ নিজের অজান্তেই খেয়াল করলো হাসিটা মুখটাকে আরও উজ্জ্বল করে দিয়েছে অনন্যার | আর হালকা একটা মন ছুঁয়ে যাওয়া , ভালো লাগার রেশ থেকে গেলো কৌস্তভের মনে |
<৩>
” না স্যার, টাকাটা দিয়ে আপনি সিরিয়াসলি ঠিক করেননি | প্রথম দেখাতেই যে এতগুলো টাকা চেয়ে ফেলে সে যে কি রকম পিস্ বুঝতেই পারছি !” ..
গাড়িতে বসে বসে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলো অয়ন |
এমনিতেই শুটিং শেষ হয়ে প্রেস মিটিং এটেন্ড করতে করতে অনেকটা রাত হয়ে গেছে | খুব টায়ার্ড লাগছিলো কৌস্তভের | তার মধ্যে এতসব জ্ঞান মোটেই পোষাচ্ছিলো না | বিরক্তভাবেই বললো , — ” উফ, তাতে কি ? তুমি তো এড্রেস নিয়েই নিয়েছো |”
কথাটা শুনে অয়ন একটা ঢোক গিলে বললো , ” না, মানে স্যার , তখন প্রেস মিটিং এরেঞ্জ করার ছিল বলে একটু ব্যস্ত ছিলাম | তাই , মানে , এড্রেসটা নিতে ভুলে গিয়েছি |”
এই উত্তরটা শুনে কৌস্তভের বিরক্তিটা এবার রাগের আকার নিলো, —- ” বাহ্, অসাধারণ | তাহলে আর কি !”
— ” না , কিন্তু স্যার , এড্রেস নিলেও এর কি বা মানে আছে যে ওটা ঠিক এড্রেস ! এই সব লোকেরা কি আর নিজের ঠিক এড্রেস দেয় !”… অয়ন ম্যানেজ দেয়ার জন্য একটা দৃঢ় যুক্তি খাড়া করলো এবার | কিন্তু কৌস্তভের আর ইচ্ছে করছিলো না কথা বাড়াতে | তাই কথাগুলো শুনে গাড়ির খোলা জানলায় মুখ ফিরিয়ে নিলো |
এরপর সাত দিন কেটে গেছে , অনন্যার আর কোনোই পাত্তা নেই | অথচ কথা ছিল পরের দিন থেকেই কাজে আসবে | যে শুনছে সে ই বলছে কৌস্তভেরই ভুল | একদিন কথা বলেই কেউ টাকা দেয় ! অয়ন তো দুদিন বাদে এসে কৌস্তভের কাছে সরি ও বলে গেছে , যে ও ওই মেয়েটাকে চিনতে পারেনি | অয়নই তো মেয়েটাকে ঠিক ভেবে কৌস্তভের কাছে পাঠিয়েছিল | কেউ কেউ তো বললো পুলিশ এ রিপোর্ট লেখাতে | কথাটা ভেবেই কৌস্তভের মুখে হাসি চলে আসতো , দশ হাজার টাকার জন্য আবার পুলিশ এ রিপোর্ট ! এটা তো ওর একটা ব্র্যান্ডেড শার্ট এর পুরো দাম ও নয় !
কিন্তু এই তিনদিনে লোকের মুখে এতকিছু শুনে কৌস্তভের অনন্যার সম্বন্ধে ধারণাটাই বদলে গেলো | মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছিলো ওই রকম নিষ্পাপ একটা মুখের আড়ালে কি না এই ! লোক ঠকিয়ে টাকা রোজগার ! চিনতে সত্যিই ভুল হয়েছিল মেয়েটাকে |
এইসবের পর সাতটা দিন কেটে গেছে | আজ রোববার | কৌস্তভের শুটিং নেই | তাই সকাল সকাল উঠে মিলির সাথে বকবক করেই সময়টা কাটাচ্ছিল , এই সময়ই নিচের সিকিউরিটি থেকে ফোন এলো | কোন একটা মেয়ে ওর সাথে দেখা করতে চায় | নাম অনন্যা |
শুনেই ভুরুটা কুঁচকে গেলো কৌস্তভের | আবার সেই মেয়েটা ! সাত দিন বাদে আজ পাত্তা পাওয়া গেলো | আবার হয়তো টাকা চাইতে এসেছে | কিন্তু না , এবার ওর কোনো কথায় গলবে না , আর ওই রকম মেয়েকে মিলির দেখাশোনার জন্য তো কখনোই রাখবে না | এই সব মনে মনে ঠিক করেই ড্রইং রুমে এলো কৌস্তভ | অনন্যা ঘরে ঢুকতেই কৌস্তভ বেশ গম্ভীর গলায় বললো ,
” কি ব্যাপার ? সাত দিন কোথায় ছিলে ?”
” আসলে আমার …” অনন্যার কথাটাকে শেষ না করতে দিয়েই কৌস্তভ বলে উঠলো ,
“না না , তোমার কি হয়েছিল সেই এক্সকিউজ শোনার টাইম নেই আমার | এন্ড আমি বুঝে গিয়েছি যে প্রথম দিন অ্যাডভান্স চেয়ে যে সাত দিন বাদে এসে মুখ দেখায় সে কি রকম টাইপ এর ! তোমাকে আর কাজ করতে হবে না | তুমি আসতে পারো |”
কথাগুলো শুনে এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে থাকলো অনন্যা | তারপর নিজেকে সামলে ব্যাগ থেকে দশ হাজার টাকা বার করলো অনন্যা | টাকাটা টেবিলের ওপর রাখতে কৌস্তভ অবাক ! …
অনন্যা থমথমে গলায় তারপর বললো, — ” আমার মা সেইদিন হসপিটাল এ ভর্তি ছিল | হার্ট এর অপারেশন হয়েছিল দুদিন আগেই | একটা ৭ হাজার টাকার ইঞ্জেকশন আর কয়েকটা ওষুধের খুব দরকার ছিল | অপারেশন এর টাকাটা এরেঞ্জ করতে পারলেও তারপরে ওষুধ ইঞ্জেকশনের টাকা জোগাড় করতে পারছিলাম না | আত্মীয় বন্ধু অনেকের কাছেই চেয়েছি, কিন্তু পাইনি | তাই আপনি যখন আমাকে চাকরিটা দিলেন , টাকাটা এডভান্স চেয়ে নিলাম | কিন্তু তাতেও দেরি হয়ে গেলো | ট্র্যাফিক জ্যাম ছিল সেদিন খুব | হসপিটাল পৌঁছতে পারিনি ঠিক সময়ে | ইঞ্জেকশন আর ওষুধগুলো কিনেওছিলাম | কিন্তু লাগলো না | মা ততক্ষণে শেষ | যাইহোক , ইঞ্জেকশন আর ওষুধ গুলো ফেরৎ দিয়ে টাকাগুলো নিয়ে এসেছিলাম | কিন্তু ঘাটকাজ , শ্রাদ্ধ এইসবের মধ্যে আর আসতে পারিনি |”
কথাগুলো বলে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে অনন্যা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো জোরে পা চালিয়ে |

চলবে।