খেলাঘর পর্ব-০২

0
4

#খেলাঘর ( দ্বিতীয় পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৩>
” না স্যার, টাকাটা দিয়ে আপনি সিরিয়াসলি ঠিক করেননি | প্রথম দেখাতেই যে এতগুলো টাকা চেয়ে ফেলে সে যে কি রকম পিস্ বুঝতেই পারছি !” ..
গাড়িতে বসে বসে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে গেলো অয়ন |
এমনিতেই শুটিং শেষ হয়ে প্রেস মিটিং এটেন্ড করতে করতে অনেকটা রাত হয়ে গেছে | খুব টায়ার্ড লাগছিলো কৌস্তভের | তার মধ্যে এতসব জ্ঞান মোটেই পোষাচ্ছিলো না | বিরক্তভাবেই বললো , — ” উফ, তাতে কি ? তুমি তো এড্রেস নিয়েই নিয়েছো |”
কথাটা শুনে অয়ন একটা ঢোক গিলে বললো , ” না, মানে স্যার , তখন প্রেস মিটিং এরেঞ্জ করার ছিল বলে একটু ব্যস্ত ছিলাম | তাই , মানে , এড্রেসটা নিতে ভুলে গিয়েছি |”
এই উত্তরটা শুনে কৌস্তভের বিরক্তিটা এবার রাগের আকার নিলো, —- ” বাহ্, অসাধারণ | তাহলে আর কি !”
— ” না , কিন্তু স্যার , এড্রেস নিলেও এর কি বা মানে আছে যে ওটা ঠিক এড্রেস ! এই সব লোকেরা কি আর নিজের ঠিক এড্রেস দেয় !”… অয়ন ম্যানেজ দেয়ার জন্য একটা দৃঢ় যুক্তি খাড়া করলো এবার | কিন্তু কৌস্তভের আর ইচ্ছে করছিলো না কথা বাড়াতে | তাই কথাগুলো শুনে গাড়ির খোলা জানলায় মুখ ফিরিয়ে নিলো |
এরপর সাত দিন কেটে গেছে , অনন্যার আর কোনোই পাত্তা নেই | অথচ কথা ছিল পরের দিন থেকেই কাজে আসবে | যে শুনছে সে ই বলছে কৌস্তভেরই ভুল | একদিন কথা বলেই কেউ টাকা দেয় ! অয়ন তো দুদিন বাদে এসে কৌস্তভের কাছে সরি ও বলে বলেছে , যে ওই মেয়েটাকে চিনতে পারেনি | ও ই তো মেয়েটাকে ঠিক ভেবে কৌস্তভের কাছে পাঠিয়েছিল | কেউ কেউ তো বললো পুলিশ এ রিপোর্ট লেখাতে | কথাটা ভেবেই কৌস্তভের মুখে হাসি চলে আসতো , দশ হাজার টাকার জন্য আবার পুলিশ এ রিপোর্ট ! এটা তো ওর একটা ব্র্যান্ডেড শার্ট এর পুরো দাম ও নয় !
কিন্তু এই তিনদিনে লোকের মুখে এতকিছু শুনে কৌস্তভের অনন্যার সম্বন্ধে ধারণাটাই বদলে গেলো | মাঝে মাঝেই মনে হচ্ছিলো ওই রকম নিষ্পাপ একটা মুখের আড়ালে কি না এই ! লোক ঠকিয়ে টাকা রোজগার ! চিনতে সত্যিই ভুল হয়েছিল মেয়েটাকে |
এইসবের পর সাতটা দিন কেটে গেছে | আজ রোববার | কৌস্তভের শুটিং নেই | তাই সকাল সকাল উঠে মিলির সাথে বকবক করেই সময়টা কাটাচ্ছিল , এই সময়ই নিচের সিকিউরিটি থেকে ফোন এলো | কোন একটা মেয়ে ওর সাথে দেখা করতে চায় | নাম অনন্যা |
শুনেই ভুরুটা কুঁচকে গেলো কৌস্তভের | আবার সেই মেয়েটা ! সাত দিন বাদে আজ পাত্তা পাওয়া গেলো | আবার হয়তো টাকা চাইতে এসেছে | কিন্তু না , এবার ওর কোনো কোথায় গলবে না , আর ওই রকম মেয়েকে মিলির দেখাশোনার জন্য তো কখনোই রাখবে না | এই সব মনে মনে ঠিক করেই ড্রইং রুমে এলো কৌস্তভ | অনন্যা ঘরে ঢুকতেই কৌস্তভ বেশ গম্ভীর গলায় বললো ,
” কি ব্যাপার ? সাত দিন কোথায় ছিলে ?”
” আসলে আমার …” অনন্যার কথাটাকে শেষ না করতে দিয়েই কৌস্তভ বলে উঠলো ,
“না না , তোমার কি হয়েছিল সেই এক্সকিউজ শোনার টাইম নেই আমার | এন্ড আমি বুঝে গিয়েছি যে প্রথম দিন অ্যাডভান্স চেয়ে যে সাত দিন বাদে এসে মুখ দেখায় সে কি রকম টাইপ এর ! তোমাকে আর কাজ করতে হবে না | তুমি আসতে পারো |”
কথাগুলো শুনে এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়িয়ে থাকলো অনন্যা | তারপর নিজেকে সামলে ব্যাগ থেকে পাঁচ হাজার টাকা বার করলো অনন্যা | টাকাটা টেবিলের ওপর রাখতে কৌস্তভ অবাক ! …
অনন্যা থমথমে গলায় তারপর বললো, — ” আমার মা সেইদিন হসপিটাল এ ভর্তি ছিল | হার্ট এর অপারেশন হয়েছিল দুদিন আগেই | একটা ৭ হাজার টাকার ইনজেকশন আর কয়েকটা ওষুধের খুব দরকার ছিল | অপারেশন এর টাকাটা এরেঞ্জ করতে পারলেও তারপরে ওষুধ ইনজেকশনের টাকা জোগাড় করতে পারছিলাম না | আত্মীয় বন্ধু অনেকের কাছেই চেয়েছি, কিন্তু পাইনি | তাই আপনি যখন আমাকে আপনি চাকরিটা দিলেন , টাকাটা এডভান্স চেয়ে নিলাম | কিন্তু তাতেও দেরি হয়ে গেলো | ট্র্যাফিক জ্যাম ছিল সেদিন খুব | হসপিটাল পৌঁছতে পারিনি ঠিক সময়ে | ইঞ্জেকশন আর ওষুধগুলো কিনেওছিলাম | কিন্তু লাগলো না | মা ততক্ষনে শেষ | যাইহোক , ইনজেকশন আর ওষুধ গুলো ফেরৎ দিয়ে টাকাগুলো নিয়ে এসেছিলাম | কিন্তু ঘাটকাজ , শ্রাদ্ধ এইসবের মধ্যে আর আসতে পারিনি |”
কথাগুলো বলে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে অনন্যা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো |
<৪>
কিছুক্ষনের জন্য কৌস্তভ কিছুই ভাবতে পারছিলো না | চোখটা হাজার চেষ্টা করেও ওপরে তুলতে পারছিলো না | লজ্জায় সেটা মাটিতেই নেমে যাচ্ছিলো | এতো বড়ো একটা ভুল করে ফেললো ! যার মা মাত্র সাত দিন আগে মারা গেছে তাকে এতটা অপমান করলো ! তাও মাত্র দশ হাজার টাকার জন্য | নিজের কাছে এতটা ছোট লাগছিলো ওর | না, অনন্যাকে সরি বলতেই হবে | এতটা নিজের কাছে ছোট হয়ে কখনোই থাকতে পারবে না | কিন্তু অনন্যা কি চলে গেলো এতক্ষনে ! এটা ভাবার সঙ্গে সঙ্গেই কৌস্তভ ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো | না, করিডোরে তো নেই | লিফ্ট ও ফাঁকা | তার মানে নীচে নেমে গেছে | কৌস্তভ সঙ্গে সঙ্গে লিফ্ট এ উঠে গ্রাউন্ড ফ্লোরের সুইচটা টিপলো | নীচে নেমে এপার্টমেন্ট এর চারিদিকে তাকিয়ে দেখলো | কিন্তু না, অনন্যা এখানেও নেই | সিকিউরিটিকে জিজ্ঞাসা করার জন্য কৌস্তভ গেট এর সামনে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো | সামনের একটা ছোট পার্ক এর বেঞ্চ এ বসে আছে অনন্যা | কৌস্তভের এবার আর পা চলছে না | গিয়ে যে কি বলবে ! কিভাবে সরি বলবে ভেবেই পাচ্ছে না | আর এতটা খারাপ ব্যবহার করার পর আর কি কিছু বাকি আছে বলার মতন ! এই চিন্তা করতে করতেই আস্তে আস্তে বেঞ্চটার দিকে এগিয়ে গেলো |অনন্যার থমথমে মুখটা ও দূর থেকেই খেয়াল করেছে | বুঝতে পারছে ওর ব্যবহারে ঠিক কতটা খারাপ লেগেছে মেয়েটার | না, এবার সরি বলতেই হবে , ভেবেই কৌস্তভ নিঃস্তব্ধতা ভেঙে ওকে ডাকলো , ——- ” অনন্যা |” … হঠাৎ করে নিজের নামটা শুনে সম্ভিত ফিরলো অনন্যার | পাশে তাকিয়ে অবাক ! সামনে কৌস্তভ দাঁড়িয়ে | এতকথা শোনানোর পর হঠাৎ এখানে ! ব্যাপারটা বোঝার আগেই কৌস্তভ বলে উঠলো , —– ” আই এম রিয়ালি সরি অনন্যা , মানে আমি সত্যিই বুঝতে পারিনি | আই নো , এই পরিস্থিতিতে আমি যেই ব্যবহারটা করেছি তার পরে আর কিছুই বলার থাকে না | বাট প্লিজ এটা ভুলে যাও | এন্ড তুমিই মিলির দেখাশোনার দ্বায়িত্ব নাও , প্লিজ .. ” …
অনন্যাও আর না বলেনি | তখন এই চাকরিটা ওর খুবই দরকার ছিল | টাকার প্রয়োজনের থেকে বেশি একাকিত্ব দূর করার প্রয়োজনে | কোনো কাজ খুঁজে পেলে নিজের যন্ত্রনাটাকে ভুলে থাকার চেষ্টা করতে পারবে তাই | আর অপমান , সে তো বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই নিত্যদিনের সঙ্গী | অনন্যা ওই দিনগুলো কখনোই ভুলবে না যখন বাবার ব্যবসাটাকে বাঁচানোর জন্য প্রত্যেকটা আত্মীয় স্বজনের কাছে গিয়ে সাহায্য চেয়েছিলো | কিন্তু অপমান ছাড়া আর কেউই বিশেষ কিছু দিতে পারেনি | আর সেই সব দিনের কাছে আজকের দিনের ঘটনাটা তো খুবই তুচ্ছ |
যাই হোক, মিলির সাথে আলাপ হয়ে অনন্যার বেশ ভালোই লেগেছিলো | ওই বাচ্চা মেয়েটার মধ্যে এমন আন্তরিকতা , আপন করে নেয়ার ক্ষমতা , যেটা নিজের লোকেরা কখনোই করতে পারেনি | মিলিকে কাছে পেয়ে সব হারানোর যন্ত্রনার মাঝে হারিয়ে যাওয়া আনন্দটাকে কোথাও একটা খুঁজে পেলো | সকালে মিলিকে ঘুম থেকে তোলা, স্কুলের জন্য রেডি করা, বিকেলে পার্কে খেলতে নিয়ে যাওয়া , রাতে স্কুল এর হোমওয়ার্ক করিয়ে নানা রকম গল্প বলতে বলতে খাওয়ানো , এই সবের মধ্যে অনন্যার দিনগুলো যে কোথা দিয়ে কেটে যেত , বুঝতেই পারতো না ! এখন মাঝে মাঝে মনে হয়, মিলি যদি ওর জীবনে না আসতো তাহলে মা বাবার এই হঠাৎ করে চলে যাওয়ার কষ্টটা সহ্য করে বাঁচতে পারতো না ও |
( চলবে )