#খেলাঘর ( তৃতীয় পর্ব)
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৫>
এইভাবেই দিনগুলো এগোচ্ছে | কৌস্তভ এখন প্রত্যেকটা দিন বুঝতে পারছে অনন্যাকে প্রথম দিনের চেনাটাই ঠিক ছিল | অনন্যার কথাবার্তার মধ্যে একটা ভদ্র মার্জিত ভাব এটা বুঝিয়ে দেয় যে কোনো ভালো পরিবারের মেয়ে ও | আর মিলি তো অনন্যাকে পেয়ে ভীষণ খুশি | চব্বিশ ঘন্টা আন্টি আন্টি করে | এমনকি অনন্যা থাকলে তো কৌস্তভকে বিশেষ পাত্তাও দেয় না |
তবে এইসবের মধ্যে কৌস্তভ এটাও খেয়াল করেছে যে অনন্যা কৌস্তভের সাথে হালকা একটা দূরত্ব বজায় রাখে | এক মাস হয়ে গেলো প্রয়োজনের তুলনায় একটা অক্ষর ও বেশি বলেনি কখনো | আর সেটার কারণ যে সেদিনকার ব্যবহার , সেটা বুঝতেও আর বাকি নেই | তার মানে অনন্যা কৌস্তভকে সেই দলেই ফেলে যারা এক টাকারও হিসাব রাখে | আর লোকজনকে না বুঝে অপমান করে | …এটা ভাবলেই কৌস্তভের মনটা কেমন খারাপ হয়ে যায় | মাঝে মাঝেই ভাবে না, এই ধারণাটাকে বদলাতে হবে অনন্যার | কিন্তু কি করে যে এই বদল আনবে সেটা ভেবে উঠতে পারে না |
কিন্তু দীর্ঘ্য এক মাস বাদে সেই দিন সুযোগটা এসেই গেলো কৌস্তভের কাছে | রাতে শুটিং থেকে ফিরতে ১২ টা বেজে গেছে | অনন্যা মিলিকে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিলো অনেকক্ষন |তারপর জানলার ধরে দাঁড়িয়েছিল একাকী, আনমনে | হঠাৎ কৌস্তভ এসে বললো,
“সরি, আজ ফিরতে অনেকটা দেরি হয়ে গেলো | তোমাকে অনেকক্ষন থাকতে হলো আজ |”
” না, ঠিক আছে , এটা তো আমার কাজ | আর আপনি তো এইসব আগেই বলেছিলেন |”
প্রয়োজন মতন উত্তরটা দিয়েই অনন্যা ব্যাগ নিতে যাচ্ছিলো বেরোবে বলে , কৌস্তভ তখনি হঠাৎ বলে উঠলো ,
” এতো রাতে যাবে কি করে ? বাস অটো তো সবই বন্ধ | আর এতো রাতে ট্যাক্সি করে যাওয়াটাও সেফ না | তুমি বরং আজকের রাতটা এখানেই থেকে যাও |”
” না, ঠিক আছে স্যার, আমার কোনো অসুবিধা হবে না | “.. এক কথায় উত্তরটা দিয়েই অনন্যা দরজার দিকে পা বাড়ালো ,কিন্তু কৌস্তভের কথায় থমকে গেলো | ———– “অনন্যা, তুমি এখনো সেই দিনের কথাগুলো মনে রেখেছো তাই না ?” .. বেশ দৃঢ় গলায় কৌস্তভ কথাটা জিজ্ঞাসা করলো ওকে | কিন্তু হঠাৎ করে এই প্রশ্নটার জন্য অনন্যা ঠিক তৈরী ছিল না | তাই কিছুক্ষন চুপ থেকে কিছু কথা সাজিয়ে বললো,
” না না, সেটা মনে রাখতে যাবো কেন ! আর আপনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও ঐভাবেই রিয়্যাক্ট করতো | সেটাই স্বাভাবিক |”
অনন্যার কথাটা শুনে কৌস্তভ বেশ ভারি গলায় বললো,
“বুঝলাম, তার মানে সত্যিই খুব খারাপ ভাবো আমাকে |”
এটা শুনে অনন্যা সাথে সাথেই বলে উঠলো,
” এ বাবা, না না | বরং আমি আপনাকে মানুষ হিসেবে খুব সম্মান করি | আপনি সেইদিন এক কথায় বিশ্বাস করে টাকাগুলো দিয়েছিলেন আমাকে | সেটা কটা লোকই বা করতে পারে ! আর এই যে, মিলিকে আপনি এতো ভালোবাসেন , এতটা কাছের করে নিয়েছেন ওকে , সেটাই বা কজন লোক পারে !”
সুনামটা শুনে বেশ ভালোই লাগলো কৌস্তভের | কনফিডেন্স লেভেলটাও বেশ বেড়ে গেলো , এবার জিজ্ঞাসা করেই ফেললো ,
” দেন বি মাই ফ্রেন্ড ,…. আমি যখন মানুষ হিসাবে অতটাও খারাপ নোই, আর সেইদিনের কথাগুলো যদি একচুয়ালি মনে না রাখো , দেন বি মাই ফ্রেন্ড …” ………
অনন্যা এটার জন্যও তৈরী ছিল না | কারণটা স্বাভাবিক , একে বস , তার ওপরে এতো বড়ো সেলিব্রিটি ! দূরত্ব ছাড়া এর সাথে আর কিছু ভাবাই যায় না | তার বদলে একেবারে বন্ধুত্ব ! কিন্তু ফিরিয়েও তো দিতে পারে না প্রস্তাবটা | তাহলে কৌস্তভের খারাপ লাগবে , আর সেটাও ঠিক না |
তাই অজ্ঞতা অনন্যাকেও বন্ধুত্বের হাতটা বাড়াতেই হলো |
সেই রাতে কৌস্তভ অনেক কথা বলেছিলো | হয়তো অনন্যার সাথে একটু সহজ হতে চেয়েছিলো | আর আস্তে আস্তে কথাটা আর এক তরফ থাকলো না | অনন্যারও টুকরো টুকরো কথা চলেই আসতো কৌস্তভের সঙ্গে | আর দিন যত এগোলো কথার পরিমাণটাও ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলো |
<৬>
দেখতে দেখতে একটা বছর কেটে গেছে | এখন অনন্যা আর কৌস্তভের মধ্যে না দেখা দূরত্বটা আর নেই | বরং টুকরো টুকরো কথাগুলোই এখন লাইফের একটা বড়ো পার্ট হয়ে গেছে | আর অনন্যার জীবনে আত্মীয় বন্ধু বলতে শুধুই দুজন, কৌস্তভ আর মিলি | সে স্কুলের প্যারেন্টস টিচার মিটিং হোক , কি উইক এন্ডস এ মাঝে মাঝে পিকনিক , সবটাই একসঙ্গে | কৌস্তভের জোরাজুরিতে অনন্যা আবার এম.এ পড়তে শুরু করেছে ডিসটেন্স এ | মাঝে মাঝে ওর মনে হয় আজকাল, পুরোনো হারিয়ে যাওয়া সব কিছুই যেন ফিরে পাচ্ছে ও , কৌস্তভ আর মিলির হাত ধরে | কখন যে এই দুটো মানুষ ওর জীবনের সব থেকে বেশি দামি হয়ে গেছে ও বুঝতেই পারেনি ! ..
এটা ভাবতেই অনন্যার হাসিও পায় , আবার অবাক ও লাগে যে কলেজ লাইফ এ এই কৌস্তভ সেনেরই কত বড়ো ফ্যান ছিল অনন্যা | কৌস্তভের প্রত্যেকটা সিনেমা ও দেখেছে, তা ও আবার ফার্স্ট ডে , ফার্স্ট শো | আর আজ সে ই অনন্যার সব থেকে কাছের বন্ধু ! না, বরং বন্ধুর থেকে অনেক বেশি কেউ !
এইসব ভাবতে ভাবতেই সেইদিনের সন্ধ্যেটা নেমে এলো | আজ কৌস্তভের জন্মদিন | অনন্যা সেই জন্য একটা ছোট সারপ্রাইজ পার্টির এরেঞ্জ করেছে | এতদিনে কৌস্তভের প্রায় সব কাছের বন্ধুদেরই চেনা হয়ে গেছে | তাদেরকে ইনভাইট করা, নিজের হাতে কেক তৈরী করা, মিলির সাথে ঘর সাজানো শেষ করে সেইদিন ও কৌস্তভের অপেক্ষায়ই বসে ছিল , আর এলোমেলো ভাবনাগুলো এসে ভিড় করছিলো মনে | আস্তে আস্তে ঘড়ির কাঁটা এগোচ্ছিল | একে একে সব গেস্টরা আসার পর ফাইনালি কৌস্তভের গাড়ি এলো | নিচে সিকিউরিটি কে খবর দেয়াই ছিল | তাই কৌস্তভের আসার খবরটা পেয়েই অনন্যা দরজা খুলতেই অবাক ! হ্যাঁ, কৌস্তভ তো এসেছেই , সঙ্গে একটা মেয়ে | কে এই মেয়েটা ? কৌস্তভের সাথেই বা কি করছে ! অনন্যার মতন সবার মনেই এই প্রশ্নটা উঠছিলো | এর উত্তরটা কয়েক মুহূর্তের মধ্যে কৌস্তভ নিজেই দিয়ে দিলো ,
মেয়েটার নাম নিশা রায় | আমেরিকাতেই থাকে , মডেল | আর কৌস্তভের উড বি ওয়াইফ | কৌস্তভের মা বাবাই মেয়েটাকে পছন্দ করেছে | মেয়েটা ওর কলেজ লাইফের বন্ধু ছিল , আর মা বাবাও বিয়ের জন্য খুব জোরাজুরি করছিলো বেশ কিছুদিন ধরে, তাই ও নিজেও আর না করেনি | 15th এপ্রিল ওদের এনগেজমেন্ট | নিশা তাই পনেরো দিন আগেই চলে এসেছে | এই কটা দিন ওরা দুজন একটু কোয়ালিটি টাইম স্পেন্ড করবে তাই আর কি | বিয়েটা অবশ্য নেক্সট ইয়ার এ |
এই দারুণ নিউজটার সাথে সাথেই ডাবল সেলিব্রেশন , পার্টিতে প্রত্যেকের এক্সাইটমেন্ট টা ও যেন ডাবল হয়ে গেছে | কৌস্তভ সব গেস্টদের এটেন্ড করা, নিশার সাথে সবার আলাপ পরিচয় করিয়ে দেয়ার ফাঁকে অবশ্য একবার অনন্যার কাছে গিয়েছিলো , তারপর অল্প কথা সাজিয়ে বলেছিল,
” সরি , এতদিন কিছু জানাইনি | আসলে সব কিছু হঠাৎ করেই ঠিক হলো , তাই ভাবলাম নিশার সাথে হঠাৎ করে আলাপ করিয়ে তোমাকে একটা সারপ্রাইজ দেব | যাইহোক, কেকটা কিন্তু দারুণ খেতে হয়েছে .. থ্যাঙ্ক ইউ সো মাচ .. ”
কথাগুলো শুনে অনন্যা এই সময় আর কিছু বলতে পারেনি। সেইদিনের সেই মুহূর্তের ধাক্কাটা অনন্যাকে যেন ভেতর থেকে ভেঙে টুকরো টুকরো করে রেখে দিয়েছিলো | বার বার মনে পড়ে যাচ্ছিলো সেই পুরোনো দিন গুলো | আচমকা মা বাবার মুখটা ভেসে উঠছিলো চোখের সামনে ! কত সুন্দর একটা জগৎ ছিল ওর , মা বাবা আর ওর জগৎ | সেটা যেন একটা ঝড়ে তাসের ঘরের মতন ভেঙে গেলো | তারপর তো হাসার কথাই ছিল না অনন্যার , স্বপ্ন দেখারও কথা ছিল না | কিন্তু হিসেবটা উল্টে দিয়ে কৌস্তভ এলো ওর জীবনে | আবার তাস গুলো একে একে জুড়ে অনন্যা নতুন একটা স্বপ্ন দেখলো | একটা নতুন পরিবারের স্বপ্ন , যেখানে শুধু ওরা তিনজন | কিন্তু এই স্বপ্নের মাঝখানে ও মনে হয় নিজের আসল পরিচয়টা ভুলে গিয়েছিলো ! হিসেবের বাইরে ভাবনা এসেছিলো বলেই হয়তো আবার ঝড় এসে সবটা শেষ করে দিলো | বাস্তবে তো অনন্যা মিলির এটেন্ডেন্ট , ব্যাস , শুধু এইটুকুই পরিচয় |
সারাটা রাত জেগে জেগে অনন্যা এই একটা বছরের প্রত্যেকটা দিনকে মনে করার চেষ্টা করছিলো | না, এমন একটা ঘটনা, একটা কথা, একটা মুহূর্ত নেই যখন কৌস্তভ অনন্যাকে বন্ধুত্বের থেকে বেশি কিছু বোঝানোর চেষ্টা করেছে | কৌস্তভের বন্ধু হিসাবে পাশে থাকাকে অনন্যা তার মানে ভুল বুঝেছে ! ভালোবাসা ভেবেছে ! আর আজকে এই একবছরের জমে থাকা ভুলটা হঠাৎ করে যেন ভেঙে গেলো | এতদিনের জমে থাকা অনুভূতিগুলো যেন চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো !
( চলবে। )