#খেলাঘর ( চতুর্থ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
< ৭ >
এরপরের পাঁচ ছটা দিন অনন্যার যেন ঘোরের মধ্যেই কেটে গেলো | মিলির স্কুল, খেলাধুলো, ওকে খাওয়ানো , ঘুম পাড়ানো এই সবের মধ্যে কৌস্তভের কাছে নিজেকে আড়াল করার একটা অদ্ভুত চেষ্টা | আবার সেই হিসেবে মতন কথা বলা, দূরত্ব রেখে চলা | কৌস্তভ এই সব ব্যাপারই খেয়াল করছিলো | কিন্তু এর কারণ কি সেটা অনন্যাকে আলাদা করে জিজ্ঞাসা করার সময় পাচ্ছিলো না কিছুতেই | সব শুটিং বন্ধ রেখে নিশাকে নিয়ে ঘুরতে যাওয়া , ফিল্ম দেখা, রেস্টুরেন্ট এ ডিনার করা , ওকে চেনার আর বোঝার চেষ্টায় এতটাই ব্যস্ত ছিল | তবে এই সবের মধ্যেও কোথাও যেন একটা ফাঁকা ফাঁকা লাগতো কৌস্তভের, নিশার সাথে হাজার কথা বললেও নিজেকে কনেক্ট করতে পারছিলো না | কিছু একটা যেন প্রত্যেকটা মুহূর্তে মিস করছিলো ও |
এরই মধ্যে আমেরিকা থেকে কৌস্তভের বাবা, মা , নিশার বাবা,মা আত্মীয় স্বজনরা এসে গেছে | বাড়ি এখন জমজমাট | প্রত্যেকেই এনগেজমেন্টের প্রিপারেশন-এ ব্যস্ত | কিন্তু এই ব্যস্ততার মধ্যেও একদিন একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ডিসিশন নেয়া হয়ে গেলো , বিয়ের পর মিলি হোস্টেলে থাকবে , কৌস্তভদের সাথে না | মিলি থাকলে ইন ফিউচার নিশার নিজের সন্তান হলে তাকে অতোটা এটেনশন দিতে পারবে না , ভালোবাসাটা ভাগ করতে হবে দুজনের মধ্যে , তার সঙ্গে প্রপার্টিও ! এতো কমপ্লিকেশনস নিশা চায় না তাই | এই কথাটা শুনে প্রথমে কৌস্তভ প্রচন্ড রেগে গিয়েছিলো , সম্পর্কটা ভেঙে দেয়ার কথা ও বলেছিলো | কিন্তু লাস্ট এ মা বাবার কথা শুনে রাজি হতেই হলো | এতো দূর এগিয়ে গেছে কথাবার্তা, প্রেস , মিডিয়া সব জায়গায় জানাজানি হয়ে গেছে | এরপর এনগেজমেন্ট ভাঙলে সেটা নিয়ে অনেক জলঘোলা হবে | আর কৌস্তভকে নিয়ে কোনো স্ক্যান্ডেল ছড়াক সেটা ওর মা বাবা একদম চায় না | তবে হ্যাঁ, আগে যদি একবারও এই শর্তের কথা জানতো তাহলে বিয়ের কথা কখনোই এতটা এগোতে দিতো না, এই রকম একটা স্বান্তনা বাক্যও জুড়ে দিলো |
এরমধ্যে কিছু আত্মীয় স্বজন তাদের এক্সপার্ট ওপিনিয়ন শোনাতেও ছাড়লো না , একটা অনাথ মেয়েকে এডপ্ট করে তো তার লাইফ চেঞ্জ করেই
দিয়েছে | আর কি দরকার আছে কিছুর ! কোনো ব্যাপারেই এক্সট্রা বাড়াবাড়ি করা ভালো না |
সেদিন ড্রইং রুমে দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ ধরে অনন্যা সব কথাই শুনছিলো | কিন্তু কিছুই বলার ছিল না ওর | এই বাড়িতে ওর তো এমন জায়গা নেই যে ও নিজের কথা রাখতে পারে ! তবে সেদিন অনেকটা সময় বাদে কৌস্তভ খেয়াল করেছিল অনন্যাকে | কাছে এগিয়েও গিয়েছিলো কিছু একটা বোঝাবে বলে , কিন্তু অনন্যা কথা বলেনি | মিলির ঘরে গিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিলো | সত্যি কি কিছু বলার বা শোনার মতন বাকি আছে ! একটা বাচ্চা কে নিয়ে যখন এতগুলো মানুষ লাভ লোকসানের হিসেব কষে , তখন সত্যি কিছু বলার থাকে না |
আজ যেন মনে হচ্ছে এতদিন অনন্যা কৌস্তভকে যা ভাবতো সবটাই ভুল | কৌস্তভ এই বাচ্চাটাকে নিজের জীবনে এনেছিল শুধুমাত্র নিজের একঘেয়েমি কাটানোর জন্য | আর আজ যখন ওর নিজের জীবনে লোকের ভিড় বাড়ছে তখন এই বাচ্চাটার আর দরকার নেই | তাই দূরে সরিয়ে দিচ্ছে | ঘরের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকা ছোট্ট মিলিকে দেখে আজ অনন্যার যেন মনে হচ্ছে নিজের প্রতিচ্ছবিকে দেখছে | ওর যেমন কেউ নেই, মিলিরও কেউ নেই | শুধু একটা নামই যেন মিলির পরিচয় , ‘অনাথ’ | তাই ওকে যেন কোনো মতে ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারলেই সবাই বাঁচে ! আজ বার বার অনন্যার চোখটা ভিজে আসছে জলে | খুব অসহায় লাগছে নিজেকে | মনে হচ্ছে যদি ওর কিছু টাকা থাকতো, ক্ষমতা থাকতো , তাহলে ও মিলিকে নিজের করে নিতো সারা জীবনের জন্য | এই রকম স্বার্থপর লোকেদের মাঝে ওকে কখনোই থাকতে দিতো না ! আজ হঠাৎ ও মিলিকে আঁকড়ে ধরলো | মিলির মিষ্টি নরম গাল , ছোট্ট ছোট্ট দুটো হাত কে অনেক আদর করলো | আজ কেমন যেন মনে হচ্ছে খুব বেশি দিন সময় নেই ওর কাছে ! মিলিকে হয়তো আর এতটা কাছ থেকে কখনোই পাবে না ! তাই সারা জীবনের জমানো আদরটা মিলিকে দিতে চাইছে অনন্যা |
<৮>
এইসবের পর তিন দিন কেটে গেছে | এর মধ্যে অনন্যা কৌস্তভের সঙ্গে দরকার হলেও দুটো শব্দও ব্যয় করেনি | কৌস্তভকে আজকাল কেমন অচেনা লাগে অনন্যার | মনে হয় এই মানুষটাকে তো এই প্রথম দেখছে | এতদিন যাকে দেখেছে , ভালোবেসেছে সে অন্য কেউ | কিন্তু এখন কৌস্তভেরও যেন এই পরিবেশটায় কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে| ও যেন কাউকেই কিছু বোঝাতে পারছে না | নিশার মতো একটা লোভী মেয়ের সঙ্গে মা বাবার চাপে পরে বিয়েতে হ্যাঁ বলতে হচ্ছে | যদি আগে এক সেকেন্ড এর জন্য ও বুঝতো যে নিশা এতো ছোট মনের তাহলে কখনোই এতো দূর কিছু এগোতেই দিতো না ! আর একদিকে অনন্যার মুখটা আজকাল মাঝে মাঝে কারণে অকারণে চোখের সামনে ভেসে ওঠে ওর | অনন্যার কথা , অনন্যার হাসি সবটা যেন হঠাৎ ওর কাছ থেকে চলে গেছে | আজকাল অনন্যা ওকে চিনেও চেনে না | কৌস্তভ বুঝতে পারছে কেন অনন্যা ওর সাথে এই রকম ব্যবহার করছে | কারণ এখন অনন্যার চোখে কৌস্তভ খুব খারাপ একজন মানুষ , স্বার্থপর মানুষ | যে শুধু নিজেরটা বোঝে ! আর সত্যিই তো, অনন্যার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও এই একই কথা ভাবতো ! এতটাই খারাপ ভাবতো ওকে | কৌস্তভ এর মধ্যে অনেকবার চেষ্টাও করেছে অনন্যার সাথে কথা বলার | কিন্তু অনন্যা কিছুই শুনতে চায়নি | ওকে দেখেই এড়িয়ে গেছে | এইসব কথাই ভাবছিলো সকাল থেকে আনমনে ! হঠাৎ ড্রইং রুমে চিৎকার শুনে ভাবনাগুলো ভাঙলো | নিশার গলা না ! সকাল সকাল এতো চেঁচাচ্ছে কেন আবার ?
কৌস্তভ ড্রইং রুমে যেতেই ব্যাপারটা পরিষ্কার হলো | কাল রাত থেকেই না কি কৌস্তভের মা একটা ডায়মন্ড ইয়ার রিংস খুঁজে পাচ্ছিলো না | নিশাকে আশীর্বাদে দেয়ার কথা ছিল দুল টা | ব্যাস, এটা শোনার পর থেকেই সারা বাড়ি মাথায় তুলেছে নিশা | ইন্ডিয়ার লোকেদের কোনোই ভরসা নেই , বিশেষ করে এই যারা বাড়িতে কাজ করে | এতো টাকার জিনিস তো কখনোই দেখেনি | তাই সুযোগ পেয়েই সরিয়ে দিয়েছে , ব্যাস | কথাগুলো যে অনন্যাকে শুনিয়েই বলছিলো সেটা কৌস্তভ ভালো করেই বুঝতে পারলো | ও নিশাকে থামানোর চেষ্টা করা মাত্রই নিশা নিজের গলার ভলিউমটা আরোও বাড়িয়ে দিলো | সোজা অনন্যার কাছে গিয়ে ওর ব্যাগটা চাইলো | ব্যাগ সার্চ করবে বলে | দুলগুলো চুরি করে তো ব্যাগ এর মধ্যেই ঢোকাবে নিশ্চয়ই | কৌস্তভের আটকানোর আগেই অনন্যার হাত থেকে ব্যাগটাকে টেনে নিলো নিশা , সবার সামনে চেন খুলে ব্যাগের সমস্ত জিনিস মাটিতে ফেলে দিলো এরপর এক মুহূর্তে| আসে পাশের আত্মীয় স্বজনরাও এর মধ্যে বলা শুরু করে দিয়েছে যে আজকাল বাড়িতে কোনো কাজের লোক রাখার আগে পুলিশ ভেরিফিকেশনটা করে নেয়া উচিত | এদের মধ্যে কে একজন বলেও উঠলো, ” কৌস্তভ তুমি নিশ্চয়ই এইসব কিছুই করোনি এই মেয়েটার ব্যাপারে ? মেয়েটার কোনো ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই তো ?” … না, আর চুপ করে থাকতে পারলো না কৌস্তভ | চেঁচিয়ে উঠলো ও , — ” থামো সবাই | থামো এবার | আর নেয়া যাচ্ছে না |” … না, এতক্ষণে নিশাও ক্লান্ত হয়ে গেছে | ব্যাগ এর ভেতরে কোথাও কোনো ইয়ার রিংস নেই | এর মধ্যেই মিলি হঠাৎ কানের দুলগুলো নিয়ে হাজির | কৌস্তভের হাতে দিয়ে ও যখন বললো যে খেলতে খেলতে দুলগুলোকে খাটের নিচ থেকে পেয়েছে , তখন সবাই চুপ | নিশারও আর কিছুই বলার ছিল না | কৌস্তভ কথাটা শুনে আর চুপ থাকেনি , সবার সামনে নিশাকে বলেছিলো, — ” শেম অন ইউ .. এতো ছোট চিন্তাধারা তোমার !” …. যদিও নিশারও এক্সকিউজ রেডি ছিল — ” আরে , আমাকে কেন বলছো ! নিতেও তো পারতো অনন্যা | ইউ নো পুওর গার্ল .. এতসব জিনিস দেখে হঠাৎ করে যদি ! তাই মনে হলো |” ………
এইসবের মধ্যে অনন্যা অবশ্য নিজের ব্যাগ নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে | কৌস্তভ সেটা খেয়াল করতেই মিলির ঘরে গেলো | অনন্যা নিজের প্রত্যেকটা জিনিস একটা একটা করে ব্যাগ এ ঢুকিয়ে নিচ্ছে | কৌস্তভ সঙ্গে সঙ্গে অনন্যার কাছে গিয়ে বললো ,
” অনন্যা, আই এম রিয়ালি সরি , রিয়ালি … আজ যেটা হলো সেটার পর আমার সিরিয়াসলি কিছু বলার নেই | প্লিজ ফরগিভ মি ..”
তবে ততক্ষণে অনন্যার ব্যাগ গোছানো শেষ | ও কৌস্তভের দিকে ফিরে বললো ,– ” সরি , আমি আর এখানে কাজ করতে পারবো না | আর আপনারা তো মিলিকে হোস্টেল এ দিয়েই দেবেন | তাই আর কিছুদিন বাদে এমনিতেও আমার প্রয়োজন শেষ হয়ে যেত | যাই হোক, বাকি কটা দিন প্লিজ একটু মিলিকে দেখে নেবেন | এন্ড সরি, আপনার অসুবিধাটা বাড়িয়ে দিলাম |”
কৌস্তভের কথাটা ভেতর থেকে লাগলো | অনন্যা এতটা দূরে কবে সরে গেলো ! আর আপনি করে কথা বলছে কেন ! .. কিছুই বুঝতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেই ফেললো | আর উত্তরটা শুনে যেন হঠাৎ থমকে গেলো | অনন্যা সেইদিন কৌস্তভের দিকে দৃঢ়ভাবে তাকিয়ে বলেছিলো,
” ভুল ছিল , ভেঙে গেছে তাই | আর আপনার মতন হাই প্রোফাইল মানুষের আমার মতন সাধারণ কারোর সাথে দূরত্ব রেখে চলা উচিত | যাই হোক, এই মাসের স্যালারি আমার লাগবে না | সব কটা দিন তো কাজ করলাম না | আসি |”
কথাগুলো বলে অনন্যা বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতে যাবে দেখে দরজায় মিলি দাঁড়িয়ে | অবাক চোখে দেখছে ওদের দুজনকে , আর বোঝার চেষ্টা করছে কি হচ্ছে | অনন্যা দরজার সামনে গিয়ে মিলিকে শেষ বারের মতন জড়িয়ে ধরলো সেইদিন | তারপর আর পেছনে ফিরে তাকালো না | সামনের খোলা দরজাটা দিয়ে পুরোনো সমস্ত মুহূর্তগুলোকে ফেলে চলে গেলো ও | আজকে হয়তো সবটাই শেষ |
( চলবে )