খেলাঘর পর্ব-০৫ এবং শেষ পর্ব

0
3

#খেলাঘর ( শেষ পর্ব )
#ঈপ্সিতা_মিত্র
<৯>
অনন্যার চলে যাওয়াটা কিছুতেই কৌস্তভ মেনে নিতে পারছিলো না | আর আগের বারের মতন দৌড়ে গিয়ে আটকাবে সেই মুখও ছিল না | এইবারের অপমানটা যে কি ভয়ঙ্কর সেটা কৌস্তভ যতবার ভাবছিলো ততবার লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যাচ্ছিলো | বার বার মনে হচ্ছিলো যে কি যেন একটা শেষ হয়ে গেছে | যেটা কৌস্তভ আর হাজার চাইলেও জোড়া লাগাতে পারবে না | সবার কাছে বাড়ির একটা সামান্য মেড চলে গেছে | তাই সবাই ব্যস্ত পরের দিনের এনগেজমেন্ট এর জন্য | কিন্তু কৌস্তভ প্রত্যেকটা মুহূর্তে বুঝছে যে কে চলে গেছে ! যে একটা বছর ওর জীবনের অনেকটা জুড়ে ছিল | বার বার মনে পড়ছে সেই সব পিকনিক গুলো , স্কুল প্রোগ্রাম গুলো যেখানে কৌস্তভ, মিলি আর অনন্যা একসাথে ছিল | সেইবার যখন শুটিং থেকে ফিরে কৌস্তভের হঠাৎ জ্বর এলো , অনন্যা সারা রাত জেগে কৌস্তভের পাশে বসেছিল |
প্রত্যেক রবিবার কত যত্ন করে ওদের জন্য নানা রকম জিনিস রান্না করতো | মিলির ক্লাস এ ফার্স্ট হওয়া নিয়ে কতটা খুশি হয়েছিল অনন্যা | সেইদিন রাতে ওরা একসাথে ডিনার করতে গিয়েছিলো মিলির ফেভারিট চাইনিজ রেস্টুরেন্ট এ | সত্যি তো, ওরা যেন একটা ফ্যামিলি ছিল | সারা দিন কাজ, শুটিং এর চাপ এইসবের পর যখন বাড়ি ফিরে অনন্যা আর মিলিকে দেখতো তখন একটা হাসি আপনাআপনিই চলে আসতো কৌস্তভের মুখে | আর সেই অনন্যা আর মিলি ওকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে ! এতো বড়ো ভুল করলো কি করে কৌস্তভ ! না, কিছুতেই ওদের যেতে দেয়া যাবে না | ওদের ছাড়া কৌস্তভ বাঁচবে কি করে !
এইসব ভাবনার ভিড়েই রাত টা কেটে গেলো আর নতুন একটা দিনের শুরু হলো | কৌস্তভ ডিসিশন নিয়ে নিয়েছে কি করবে | সকাল সকাল সেটা জানাতেই ড্রইং রুমে এসে দেখলো ফ্যামিলির সবাই আছে | আজ এনগেজমেন্ট | প্রত্যেকেই তাই কিছু না কিছু নিয়ে ব্যস্ত | নিশা কফি হাতে সোফায় বসে ম্যাগাজিন পড়ছে | কৌস্তভ কোনো রকম ভনিতা না করে একেবারে সামনাসামনি গিয়েই বললো ,
” সরি নিশা, আমি তোমার সাথে এনগেজমেন্ট করতে পারবো না |”
কথাটা শুনেই সবাই আঁতকে উঠলো | নিশা তো যেন আকাশ থেকে পড়লো | কৌস্তভের বাবা মা কোনো কারণ খুঁজে না পেয়ে বলে উঠলো, —
” কেন ? কোনো এমার্জেন্সি শুট চলে এসেছে ? ডেট পোস্টপন করতে হবে ? ”
কৌস্তভ দৃঢ় ভাবে উত্তর দিলো , — ” না, আর কোনো নতুন ডেট এর দরকার নেই | এনগেজমেন্ট আজই হবে | তবে নিশার সাথে না,
অনন্যার সাথে |” …..
নিশা এবার রাগে জ্বলে উঠলো , — ” মানেটা কি ? কি বলতে চাও তুমি ?”
কৌস্তভ শান্ত গলায়ই বললো,—– ” আমি কি বলতে চাই সেটা বোঝার মতন বুদ্ধি তোমার আছে আশা করি | আমি তোমার মতন একটা সেলফিশ অসহ্যকর মেয়েকে বিয়ের জন্য যে কি করে হ্যাঁ বলেছিলাম গড নোজ … যাই হোক, থাঙ্কস টু গড যে ঠিক সময়ে আমি আমার ভুলটা বুঝতে পেরেছি আর বেঁচে গিয়েছি |”
নিশা এবার চেঁচিয়ে উঠলো, —– ” হোয়াট ডু ইউ মিন ? আর তুমি আমাকে ছেড়ে ওই কোথাকার কে অনন্যাকে বিয়ে করবে ?
এই তোমার টেস্ট ?”
এইবার কৌস্তভের ও সহ্যের সীমা পেরিয়ে গেছে | গম্ভীর দৃঢ় গলায় ও বললো , — ” গলা নামিয়ে কথা বলো | চেঁচাতে সবাই পারে | আর বলছিলে না অনন্যা কোথাকার কে , একচুয়ালি এখানেই তোমাদের তফাৎ | তোমাদের দুজনের ব্যবহার , রুচি বোধ দেখলেই বোঝা যায় যে কার শিক্ষা , কালচার কেমন | অনন্যা মিলি আর আমাকে সব সময় এক রাখতে চেয়েছে | আর তুমি আলাদা করতে | বেসিকালি তোমার মতন মেয়েরা টাকার জন্য সব পারে | একটা ছোট বাচ্চাকে কষ্ট দিতেও কিছু মনে হয় না |”
কথাগুলো শেষ করেই কৌস্তভ আর কারোর কোনো কথা শোনার অপেক্ষা না করে বেরিয়ে গেলো | ওর বাবা মা ও আর কিছু বললো না, কারণ জানে কৌস্তভ যদি একবার কিছু মনে করে ঠিক, তাহলে ও সেটাই করবে | আর কলকাতায় আসার পর থেকে যা যা হয়েছে মিলিকে নিয়ে তাতে কৌস্তভের বাবা মার্ মন থেকে নিশা অনেকটাই মুছে গেছে | শুধু প্রেস, মিডিয়া আর লোকের প্রশ্নের ভয়ে এই বিয়েটা দিতে চাইছিলো | তাই বিয়ে ভাঙ্গায় বিশেষ দুঃখ হয়নি | আর রইলো অনন্যা, প্রথম দেখাতেই মেয়েটা নজর কেড়েছিল ওদের | আর কালকে এত বড়ো একটা মিথ্যে অপবাদ দেয়ার পরও যেভাবে কোনো সিন্ ক্রিয়েট না করে অনন্যা চলে গেলো তাতে কৌস্তভের বাবা মার এটা বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে অনন্যা আলাদা ,সবার থেকে আলাদা | সুতরাং এই রকম মেয়েকে যদি ছেলের পছন্দ হয় তাহলে দুঃখ বৈকি খুশি হওয়ারই কথা |
আর এদিকে নিশার ফ্যামিলি অবশ্য নেক্সট ফ্লাইট এর টিকিট বুক করতে ব্যস্ত | এতো অপমানের পর এই বাড়িতে আর এক মুহূর্ত না | এরপর মেয়ের জন্য আমেরিকান পাত্র খুঁজবে | ইন্ডিয়াতে আর আসবেই না কখনো |
<১০>
কৌস্তভ এখন ভবানীপুরে অনন্যাদের এক তলা বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে | ও কি খুব দেরি করে ফেলেছে ! এখন কি আর ফিরে পাওয়া সম্ভব ! এইসব ভাবতে ভাবতেই কলিংবেলটা বাজালো | এতদিন অনেক সিনেমা বানিয়েছে , অনেক গল্পের এন্ড ও নিজে ঠিক করেছে | কিন্তু আজকে ওর নিজের গল্পের শেষটা যে কি লেখা আছে , বুঝতেই পারছে না | এইসব ভাবনার ভিড়েই দরজাটা খুলে সামনে এসে দাঁড়ালো সে | আজ চুলটা খোলা , তাই কি এখন একটু বেশি সুন্দরী লাগছে ওকে ? এক সেকেন্ডের জন্য প্রশ্নটা মনে এসেই মিলিয়ে গেলো | আসলে দরজার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা মুখটা আজকে খুব গম্ভীর | বেশ কঠিন গলায়ই কৌস্তভকে দেখে অনন্যা প্রশ্ন করলো ,
” আপনি ? এখানে ? কি দরকার ? বলেছি তো কালকেই , আমার এই মাসের স্যালারি লাগবে না |”
” স্যালারি ! আমি স্যালারি দিতে আসিনি |”
” তাহলে কি দরকার ? ”
” সব দরকারি কথা কি বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই বলবো ? মানে ভেতরে আসতে পারি না ?” …
কথাটা শুনে হাজার অনিচ্ছা সত্ত্বেও অনন্যা দরজাটা থেকে সরে দাঁড়ালো | আসলে চাইলেও কারোর সাথে এতটা অভদ্রতা করতে পারে না ও |

যাইহোক, বাড়ির ভেতরটা বেশ সুন্দর ভাবে সাজানো | দামি ফার্নিচারের ভিড় না থাকলেও বেশ সুন্দর ! দেয়ালে হাতে আঁকা কিছু পোট্রেট আর সিনারি দেখে কৌস্তভ হঠাৎ বলে উঠলো ,
” তুমি এত সুন্দর আঁকো আগে জানতাম না তো !”
” আপনি কি নিজের এনগেজমেন্ট ছেড়ে এই সাত সকালে আমার ছবি আঁকা দেখতে এসেছেন ? কোনো দরকার থাকলে সোজাসুজিই বলতে পারেন | এতো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা সাজিয়ে টাইম ওয়েস্ট করার দরকার নেই |”
” হ্যাঁ , সেটা ঠিক | সাত সকালে এনগেজমেন্ট ভেঙে যখন এসেছি তখন দরকারটা খুবই জরুরি | ”
” এনগেজমেন্ট ভেঙে মানে !” … কথাটা শুনে অনন্যা অবাক না হয়ে পারলো না এবার | কাল অব্দি তো সব ঠিকই ছিল | আজ হঠাৎ কি হলো ! কথাটা ভাবতে ভাবতেই কৌস্তভ বলে উঠলো,
” এনগেজমেন্ট ভাঙার গল্পটা আলাদা | পরে শোনাবো | এখন বরং সেই ইম্পরট্যান্ট কথাটা বলি যেটা বলার জন্য সব ছেড়ে এখানে এসেছি | আসলে তোমাকে আমার দরকার , খুবই দরকার অনন্যা | সারা জীবনের জন্য দরকার |” ……
কথাটা শুনে অনন্যা চমকে উঠে বললো,
” কি ? আপনি বলতে টা কি চান ? ”
কথাটা শুনে কৌস্তভ শান্ত গলায় বললো,
” প্রথমে এটাই বলতে চাই যে এই আপনি আজ্ঞে করাটা বন্ধ করো প্লিজ | এটা আর নিতে পারছি না | মানছি ভুল হয়েছে | কিন্তু তার জন্য এই রকম ব্যবহার করতে হবে ? আমি জানি আমি বুঝতে অনেকটা দেরি করে ফেলেছি | আসলে কেউ সঙ্গে থাকলে তার ইম্পর্টেন্সটা অতোটা বোঝা যায় না , কিন্তু যখন সে হঠাৎ হারিয়ে যায় তখন বোঝা যায় যে সে লাইফে কতটা জায়গা জুড়ে ছিল | যেটা বেশ কিছুদিন ধরেই আমি রিয়ালাইজ করছিলাম , যখন হঠাৎ আমাদের কথা কমে গেলো | তুমি আমাকে এভোয়েড করতে শুরু করলে , তখন থেকেই | আর যখন কালকে তুমি সব কিছু ছেড়ে চলে গেলে , আর ফিরে তাকালে না , সেই মুহূর্তে বুঝলাম যে তুমি কতটা দামী আমার জীবনে , আর আমি তোমাকে এইভাবে হারিয়ে যেতে দিতে পারি না। … তুমি মিলি আর আমি তো একটা ফ্যামিলিই ছিলাম | প্রথম থেকেই | শুধু ওই ফ্যামিলিটার কোনো নাম ছিল না ! কিন্তু আজকে আমি আমাদের ফ্যামিলিটাকে নাম দিতে চাই | সারা জীবনের জন্য এই সম্পর্কগুলোকে নিজের কাছে রেখে দিতে চাই | কিন্তু আমি জানি এতো সহজে তুমি রাজি হবে না | আমার জন্য যেই অপমানটা তোমাকে কাল সহ্য করতে হয়েছে সেটার পর সব কিছু ভুলে আবার নতুন করে শুরু করা অতো সহজ না | কিন্তু আমি ওয়েট করবো | রোজ চেষ্টা করবো একটু একটু করে পুরোনো জায়গা ফিরে পাওয়ার | রোজ চেষ্টা করবো তোমার মনে আমার জন্য জায়গা তৈরী করার |” …

এতক্ষনে অনন্যার চারিদিকটা আবছা হয়ে গেছে | চোখে অনেকদিনের জমে থাকা জল এসে ভিড় করেছে | কাল তো ভেবেছিলো সারা জীবনের জন্য এই ছেলেটাকে দূরে সরিয়ে রেখে দেবে | কিন্তু আজ আবার সব হিসেবে উল্টো পাল্টা হয়ে গেলো | আজ তো হাজার চাইলেও আর রাগ দেখতে পারছে না ! কঠিন হতে পারছে না ! তখনই আচমকা ওর হাতটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরলো আরেকটা হাত | আবছা চোখে ভেসে উঠলো সেই ছেলেটার মুখ | কৌস্তভ এরপর আর কখনো ওকে ছাড়বে না | বরং সারা জীবনের জন্য এই হাতটাকে মুঠোবন্দি করে রাখবে | অনন্যা আর কৌস্তভকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারলো না তাই | আঁকড়ে ধরলো ওকে | এতদিন ধরে একটা খেলাঘর বানিয়েছিলো ও মনে মনে | আজ হঠাৎ বাস্তব এসে সেটাকে ছুঁয়ে দিলো | খেলাঘরটা সত্যি হলো |
——-< সমাপ্ত >——