গালিব মির্জা পর্ব-০১

0
9

#গালিব_মির্জা
#সূচনা_পর্ব
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

‘ আবির ভাই, তন্ময় ভাই, ধূসর ভাই, সায়ান ভাই, শুদ্ধ ভাই, আরিশ ভাই, অমুক ভাই, তমুক ভাই! ফেসবুকে কত সুন্দর সুন্দর কাজিন থিমে গল্প পড়লাম কিন্তু আমার জীবনে আর কোনো লাল, নীল, গোলাপী কিংবা কালো কোনো কালারের ভাই এলোনা। আসবে কীভাবে? কাজিন ব্রাদার তো আমারও আছে। কিন্তু সমস্যা হলো, বেডায় যখন আমারে প্রপোজ করছিলো তখন আমার বয়স মাত্র পনেরো। তখন ভাবছিলাম ফুপাতো ভাইয়ের সাথে প্রেম করা পাপ না, মহাপাপ! সেই মহাপাপ করবোনা বলেই তাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলাম। আলহামদুলিল্লাহ আমার ফুপাতো ভাইয়ের এখন একটা মেয়ে সন্তানও আছে। থাকবে না কেন? আমার যখন পনেরো বছর, উনার তখন পঁচিশ। আর এখন আমার আঠারো আর ওই বেডার আটাশ। বিয়ে করেছেও প্রেম করে। ভাবতেও কলিজা ফেটে যায় রে নগেন– ফুপাতো ভাই যখন সোয়ামী টাইটেলের লাভ স্টোরিটা মিস করে গেলাম আমি। ‘

~ তামসী মির্জা

এতটুকু লিখে ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করলো তামসী। আপাতত বেশ শান্তি পাচ্ছে সে। আশেপাশের এতো এতো কাজিন লাভ স্টোরি দেখে রীতিমতো ডিপ্রেশনে চলে যায় মেয়েটা। কারণ বাস্তবে কাজিন ব্রাদার মানেই আতংক ওর কাছে। সবগুলো বিচ্ছু, বদের হাড্ডি। ওই যে ফেবুতে পোস্ট আছে না? জীবনসঙ্গী হতে হবে শান্তশিষ্ট, কেয়ারিং কারণ ঘাড়ত্যাড়া, পাগল তো আমি নিজেই! তামসীর ক্ষেত্রেও ব্যাপারটা তাই। কাজিন থাকলেও ওর মতে একটাও জাতের না। যেগুলো আছে সেগুলো ওর মতোই পাগল, ঘাড়ত্যাড়া!

“ তামু! এই তামু! দরজা খোল হারামজাদি। “

দরজায় ঠকঠক আওয়াজ হতেই শোয়া থেকে উঠে বসলো তামসী । পরনে তার টপস, প্লাজু, চুলগুলো সব এলোমেলো হয়ে কাকের বাসা হয়ে আছে। সে এক ভয়ানক লুক! এই লুকে ছবি পোস্ট করলে নিশ্চিত ভাইরাল। তামসী বসা থেকে উঠে দাঁড়াল। দরজার কাছে গিয়ে বলল,

“ রাবিন ভাই কী হয়েছে তোমার? এভাবে মাঝরাতে দরজা ধাক্কাধাক্কি করতেছো কেন? আর তুমি এখন এখানে কেন?”

রাবিন ফের দরজায় ধাক্কা দিয়ে বলল,

“ রাত হলে তুই না ঘুমিয়ে হেনতেন কীসব পোস্ট করিস ভাই! তোর ফুপাতো ভাই কবে জন্মালো? “

“ ও তো পোস্ট! তুমি আমার এসব বলতে এলে? “

“হ, আহারে কত দুঃখ মেয়েটার! তার জীবনে কাজিন লাভ নেই…. বলি তোর কি কাজিন নাই? তোকে কতদিন বলেছি, চল প্রেম করি। তারপর বিয়ে করবো। তুই তো এমনভাবে রিয়াক্ট করিস যেনো বমি পাচ্ছে তোর। শয়তাইন্না মাতারি একটা! “

তামসী শব্দ করে হেসে উঠল এবার। রাবিন তামসীর থেকে তিন বছরের সিনিয়র। সব সময় এমন মজা করে। তামসী দরজা খুলে দিতেই রাবিনের পিছুপিছু শুভ, লামিয়া, মেঘলা, রাফি সবাই তামসী ঘরে ঢুকলো।

“ আরে তোরা! একটাও ঘুমাসনি অথচ রাবিনের বাচ্চা আমাকে বকলো। “

তামসী রাবিনের পিঠে একটা চড় মেরে বললো কথাটা। ওরা সবাই তামসীকে বিশেষ পাত্তা দিলো না। সবাই গিয়ে বিছানায় গোল হয়ে বসলো। তামসী দরজা আঁটকে দিয়ে এসে, নিজেও বসলো। রাবিন বলল,

“ একটু বকেছি, মারিনি তোকে। চল আজকে একটা কমেডি হরর মুভি দেখি। “

লামিয়া বাধ সেধে বলল,

“ না ভাইয়ু আমার ভয় লাগছে। “

“ আহারে… ভীতুর ডিম একখানা। তা তোমার যখন এত ভয় তুমি এলে কেন এখানে? যাও রুমে গিয়ে ঘুমাও। “

মেঘলার কথায় ভেংচি কাটল লামিয়া। ওরা দু’জন যমজ বোন। শুভ শান্তশিষ্ট মানুষ। বয়সে তামসীর সমবয়সী প্রায়। মাস ছয়েকের বড় হবে হয়তো। শুভ শান্ত গলায় বলল,

“ ভয় পাবি না। কাঞ্চনা টু মুভি দেখবো। যতটা ভয় পাবি তারচে বেশি হাসবি। তাছাড়া আমরা আছি তো৷ “

লামিয়া ঘনঘন চোখের পলক ফেলে মাথা নেড়ে বলল,

“ তাহলে ঠিক আছে। “

ভেংচি কাটলো মেঘলা। লামিয়া কপাল কুঁচকে ফেলল তাতে। ওদের অবস্থা দেখে রাবিন হেসে উঠল। তামসী বলল,

“ রাত একটা বাজে! চল চল মুভি শুরু করি জলদি । “

রাফির ফোনেই মুভি দেখা হবে আজ৷ সামনে একটা বালিশ রেখে তার সাথে ফোনটা ঠেকিয়ে রাখা হলো। তারপর রাফি মুভি অন করতেই সকলে জড়োসড়ো হয়ে বসলো। মাঝখান থেকে শুভ বলল,

“ রাবিন বাতি অফ করে আয় না ভাইয়া। “

“ হ্যাঁ ঠিক বলেছিস। লাইট জ্বললে ভুত ভুত ফিল আসবে না। “

রাবিন গিয়ে লাইট বন্ধ করতেই লামিয়া মেঘলার হাত চেপে ধরলো। মেঘলা কিছু বললো না এবার । বোনের ভয় কাটাতে নিজেও হাতটা শক্ত করে ধরে রইলো কেবল। মুভি চলতে শুরু করেছে। সবার মনোযোগ ফোনের স্ক্রিনে।

সাভার জেলার অন্যতম প্রতিপত্তিশালী পরিবার হলো মির্জা পরিবার। মজার ব্যাপার হলো, দুই হাজার পঁচিশ সালেও এ পরিবারের তিন ছেলে একসাথে একই বাড়িতে বসবাস করছে। এ নিয়েই এলাকার মানুষের কৌতূহলের শেষ নেই। এতগুলো বছর ধরে তিন ভাইয়ের পরিবার এক ছাদের নিচে কোনো ঝগড়া-ঝামেলা ছাড়াই কীভাবে টিকে আছে–সেটাই সবার বিস্ময়ের কারণ। তবে এ পরিবারের একমাত্র মেয়ের সঙ্গে মির্জা পরিবারের যোগাযোগ নেই বহুদিন। আর এর পেছনের আসল কারণটা সকলের অজানা নয় ।

মির্জা বাড়ির তিন ছেলে– বড় সাইদ মির্জা, তার পর মেঝো ভাই নির্ঝর মির্জা, আর সবার আদরের ছোট ভাই তৌকির মির্জা। সাইদ মির্জার তিন সন্তান: গালিব মির্জা, রাবিন মির্জা ও নওশিন মির্জা। গালিব দেশের বাইরে কলেজের লেকচারার হিসেবে কাজ করছে, তবে আগামীকালই সে দেশে ফিরছে। স্বভাবের দিক থেকে রাগী, গম্ভীর, কথা কম বলে সে। রাবিন অনার্সের ফাইনাল ইয়ারে পড়ছে। হাসিখুশি, সবাইকে মাতিয়ে রাখাই ওর স্বভাব। আর নওশিন সদ্য গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে, মেয়েটা ভীষণ শান্ত প্রকৃতির। নির্ঝর মির্জার দুই সন্তান– রাফি মির্জা ও তামসী মির্জা। তামসী সবে এইচএসসি পরীক্ষা শেষ করেছে, আর রাফি নতুন করে কলেজে ভর্তি হয়েছে। তামসী পাগলাটে ধরণের মেয়ে একটা, ঘাড়ত্যাড়া আর বদমেজাজি। কথায় কথায় রেগে যাবে আবার রাগ পরেও যাবে। আর রাফি হলো ভদ্র ছেলে তৌকির মির্জার দুটি যমজ মেয়ে আছে– লামিয়া ও মেঘলা। তারা দু’জনেই দশম শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। দুজন যমজ হলেও স্বভাবের দিক থেকে আলাদা। লামিয়া মেয়েটা ভিতু, আর মেঘলা তার বিপরীতে দারুণ সাহসী। এ বাড়ির আরেকজন বিশেষ সদস্য হলো শুভ। সে রক্তের সম্পর্ক না থাকলেও পরিবারের অংশ। ছোটবেলা থেকেই নির্ঝর মির্জা তাকে নিজের ছেলের মতো করে বড় করেছেন। শুভ ভীষণ শান্ত, ভদ্র, লাজুক টাইপের মানুষ।

রাতে সবাই মুভি দেখার ভেতরই ঘুমিয়ে পড়েছিল। সকাল হতেই রাবিনের ঘুম ভেঙে গেল। চোখ কচলাতে কচলাতে চারপাশে তাকাল, আর দেখল মেঘলা তামসীর গায়ের ওপর পা ছড়িয়ে দিব্যি ঘুমোচ্ছে। লামিয়া একপাশে নীরবে শুয়ে আছে, আর রাফি নিজের মতো গুটিশুটি হয়ে গভীর ঘুমে বিভোর। শুভ ছিল না– সম্ভবত সে আরও আগে উঠে নিজের ঘরে চলে গেছে। রাবিনও তাদেরকে ডাকাডাকি না করে চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেল। বাড়িতে এখন কাজের ধুম, কারণ দু’দিন পর নওশিনের বিয়ে।

সেজন্যই গতকাল রাতের মুভি দেখাতে নওশিন উপস্থিত ছিল না। বিয়ের আগে রাত জাগলে চেহারার গ্লো নষ্ট হতে পারে, সাথে ডার্ক সার্কেলও দেখা দেবে। তাই সে আপাতত রাত দশটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে।

সকালের নাস্তা খেতে মির্জা বাড়ির সব ছেলেমেয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে আছে। বাড়ির বড় বউ আয়মান মির্জা হাতে নানান খাবারদাবার নিয়ে টেবিলের ওপর সাজিয়ে দিলেন। মেঝো বউ ফাতিমা মির্জা ধীরে ধীরে প্লেট ধরে ছেলেমেয়েদের সামনে তুলে দিচ্ছে, যেন সব ঠিক মতো পৌঁছে।

চেয়ারটিতে বসে থাকা তামসী ঘুমের ঢুলে নিজের মাথা বাম-ডান করে নাচাচ্ছে। হঠাৎ রাবিন এক পলকে তার মাথায় হালকা একটা গাট্টা মেরে দিল। আর ঠিক তাতেই মেয়েটার ঘুম ভেঙে গেল। চোখ বড় করে দেখল রাবিনের দিকে, আর এক লহমায় তেতে উঠল।

“ এই রাবিনের বাচ্চা রাবিন! তুমি আমাকে মারলে কেন? “

রাবিন প্রত্যুত্তরে কিছু না বলে আরেকটা চাটি দিয়ে বলল,
“ যখন মেরেছি বদনাম হলো তখন মেরেই বদনামের ভাগিদার হলাম। “

তামসী রাগে ফুঁসছে। বড় চাচীর দিকে তাকিয়ে ঠোঁট উল্টে কান্না কান্না ভাব করে বলল সে,

“ বড় আম্মু! দেখো তোমার ছেলে হুদাই মারছে আমাকে। “

তামসীর এমন চেহারা দেখে আয়মান সত্যি সত্যি মেরেছে ভেবে রাবিনের কান টেনে ধরলেন। ব্যথায় আহ করে উঠলো রাবিন। আয়মান বললেন,

“ এই দুষ্ট ছেলে সবসময় তামসীর সাথে এমন করিস কেন তুই? “

“ আহ… মা লাগছে আমার। ও ঢং করতাছে। ঢংগী একটা… শয়তান মাতারি। “

তামসী ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসলো। আয়মান আরো দু’টো কানমলা দিয়ে ছেলেকে ছেড়ে দিলেন। দুই ভাইবোনের হাবভাব দেখেই বুঝে গেছেন সবকিছু দুষ্টমি। ওদিকে আশপাশের কোনো কিছু খেয়াল না করে নিজের মতো গাণ্ডেপিণ্ডে গিলতে ব্যস্ত হয়ে গেছে রাফি। এই ছেলেটা ভীষণ পেটুক। খাওয়াদাওয়া ছাড়া যেন ওর পৃথিবীতে কিচ্ছু নেই। শুভ আর নওশিন এখনও ডাইনিং রুমে আসেনি। লামিয়া, আর মেঘলা নিজেরা না খেয়ে রাফির খাওয়াদাওয়া পর্যবেক্ষণ করছে কেবল। আচমকাই রাফি ওদের দিকে তাকিয়ে বলল,

“ লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছিস কেন? ছোঁচা! সরর… আমার পেট খারাপ হবে। “

লামিয়া আহত দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো রাফির দিকে। মেঘলা ক্যাটকেটে গলায় বলল,

“ তোমার আবার পেট খারাপ? গু খেলেও তোমার কিছু হইতো নট। পেটুক একটা। “

“ ওয়াক! চুপ বেয়াদব! খবরদার আমার খাওয়ার দিকে নজর দিবি না। ডিঙি অবতার একখানা, শুধু জানে কটকট করতে। “

মেঘলা ভেংচি কেটে অন্য দিকে তাকাল। রাফিও নিজের খাওয়ায় মনোযোগ দিলো আবার। এরমধ্যেই সাইদ মির্জা এলেন ডাইনিং রুমে। রাবিনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

“ তাড়াতাড়ি খেয়েদেয়ে বের হও। গালিব আসছে, ভুলে গেছো না-কি? এয়ারপোর্টে যেতে হবে তোমাকে। “

বাবার কথায় চুপসে গেলো রাবিন। গালিব ভাইয়া! উফ… আস্ত একটা গম্ভীর লোক। পুরাই বোরিং। তামসী খেতে খেতে রাবিনের দিকে নজর দিলো।

“ জি বাবা। খাওয়া শেষ প্রায়। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই বের হচ্ছি। “

সাইদ মির্জা শার্টের হাতা ঠিক করতে করতে বললেন,

“ ওকে। আমি অফিসে যাচ্ছি। তোমার ভাই এবার যদি চাকরি ছেড়ে ব্যবসায় মন না দেয় তাহলে সবকিছু তোমাকেই দেখতে হবে। “

রাবিন কিছু বললো না আর। ব্যাবসায়ী কথাবার্তা মোটেও ভালো লাগে না ওর। সাইদ মির্জা যেভাবে এসেছিলেন সেভাবেই চলে গেলেন। তবে চিন্তায় পড়লো তামসী। গালিব ভাইয়া বাড়িতে এলেই সবাই কেমন চুপসে যায়। লোকটা ভীষণ বোরিং…

চলবে…