গালিব মির্জা পর্ব-০৬

0
10

#গালিব_মির্জা
#পর্ব_৬
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া

“ তামু? ওই তামু? “
রাবিনের গলা শুনে নিজেকে সামলে নিলো তামসী। গলা উঁচিয়ে শুধালো,
“ কী হয়েছে? “
“ দরজা খোল মাতারি। দিনদুপুরেও কেউ দরজা আঁটকে রাখে!”
ঠোঁট উল্টে তপ্ত নিঃশ্বাস ছাড়ল তামসী। দরজা আঁটকে রাখাটা আগে রপ্ত করে নিলে আজকে এভাবে ঘরে বসে থাকতে হতোনা। রাবিন তামসীর কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে দরজায় ঠকঠক আওয়াজ করে বলল,
“ কী রে ভাই? তোর কী হয়েছে? খোল না দরজা! চল একসাথে খাই। “
“ তুমি যাও ভাইয়া। আমি একটু পর আসছি। “

রাবিন কিছু বলতে যাবে তার আগেই কারো হাঁটার শব্দ শুনতে পেলো। পেছন ফিরে তাকাল রাবিন। গালিব আসছে,এদিকেই। হয়তো নিজের ঘরেই যাবে। রাবিন আবারও নিজের কাজে মনোযোগ দিলো।
“ এতো দাম দেখাইবেন না তামসী আপা। আপনাকে আমি এত দাম দিবো নট। দরজা খুলে দিন, জলদি। “

বিরক্তি চরম পর্যায়ে পৌঁছালো তামসীর। রাবিনটা সব সময় এমন করে। কখনো তো বোঝা উচিত, বিপরীত দিকের মানুষটা হয়তো একা থাকতে চায়।
“ আমি খাবো না। পরে খেয়ে নেবো। আর যেনো আমাকে ডাকাডাকি না করা হয়। “

তামসীর গম্ভীর কণ্ঠে দমে গেলো রাবিন। এরমধ্যে গালিব এসে দাঁড়াল ওর পিছনে।
“ তুই গিয়ে খেয়ে নে। আমি দেখছি তামসীকে। যা….”

রাবিন কেবল মাথা নাড়লো, তারপর দ্রুত পা চালিয়ে সিঁড়ির দিকে এগোল সে। গালিব ভালো করেই বুঝতে পারছে, তামসীর মনের অবস্থা। হাসিখুশি মেয়েটা একদিনের মধ্যে নিজেকে কেমন গুটিয়ে ফেলেছে ভেবে গালিবের খারাপ লাগছে। কিন্তু তার-ও বা কী করার ছিলো? ইচ্ছে করে তো কিছু করেনি। গালিব লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ল। দরজায় পরপর অনেকবার ঠকঠক আওয়াজ করলো। তামসী ভাবলো রাবিন এখনও দাঁড়িয়ে আছে, আর নক করে যাচ্ছে। বিরক্তি এখন রাগে এসে পৌঁছেছে। তামসী বসা থেকে উঠে খুব তাড়াহুড়ো করে দরজা খুললো। কিন্তু দরজা খুলতেই গালিবকে সামনে দেখে থমকে গেলো মেয়েটা। দু’জন দু’জনার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো কেবল। কারো মুখেই কথা নেই। তবে গালিব নড়েচড়ে উঠল। তামসীকে কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হুট করেই রুমে ঢুকে দরজা আঁটকে দিলো সে। চমকাল তামসী। তবে কিছু বললো না। আগের মতো দাঁড়িয়ে রইলো। গালিব তামসীর হাত ধরলো, তামসী যেন মৃদু কেঁপে উঠল তাতে। গালিবের রুক্ষ হাতের স্পর্শ যেন তামসীর কাছে আজ অন্য রকম অনুভূত হলো। তবে এই অনুভূতিকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে, গালিবের থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে ফেলল তামসী।
“ কিছু বলবেন? “
তামসীর গম্ভীর কণ্ঠ, গালিবের ঠিক সহ্য হলোনা। গলা খাঁকারি দিয়ে উঠলো সে। শার্টের হাতা ফোল্ড করতে করতে বলল,
“ তোর কী হয়েছে? “
“ আ…মার তো কিছু হয়নি। “
“ তাহলে তোতলামো বন্ধ করে, স্পষ্ট করে কথা বল। “
তামসী ভ্রু কুঁচকে ফেলল। একটু না হয় কথা এলোমেলো হয়ে গেছে, তাই বলে তোতলা বলবে?
“ আমার কিছু হয়নি। “
গালিব নিজের থুতনিতে হাত বুলাতে বুলাতে বিছানায় গিয়ে বসলো।
“ এদিকে আয়। “
ভ্রু উঁচিয়ে ইশারায় জিজ্ঞেস করলো তামসী, “কেন?”
ধমকে উঠলো গালিব।
“ আসতে বলছি না? “
তামসী ভয়ে ভয়ে, গালিবের পাশে গিয়ে বসলো।
“ এভাবে ঘরে বসে থাকিস কেন? স্বাভাবিক হ, কিছু হয়নি। “
লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলো তামসী। এমনিতে তো লাজলজ্জা কমই ছিলো, হুট করে যে এতো লজ্জা কোথা থেকে এলো সেটা ভেবে অবাক হচ্ছে তামসী।
“ হু। “
সংক্ষিপ্ত উত্তর তামসীর। গালিব ওর দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। মেয়েটা কবে বড় হবে! আর কবেই বা তাকে নিজের ঘরণী করবে সেসব ভাবছে ভদ্রলোক। অবশ্য তামসীর বয়স আঠারো পেরিয়ে গেছে এখন। বাড়িতে বললেই বিয়ের ব্যবস্থা হয়ে যাবে। একটা সময় ছিলো যখন এখ পরিবারের লোকজন নিজেদের মধ্যেই বিয়েশাদি করতো কেবল। মানে কাজিনদের সাথে। তারপর আধুনিক যুগের সাথে সবকিছু বদলে গেছে। এখন আর সেই নিয়মকানুন নেই। তবে গালিব তামসীকে আগে থেকেই পছন্দ করে রেখেছিলো। গালিব যখন বিদেশে চলে গিয়েছিল তখন তামসী খুব ছোটো। তখন কিছু ছিলো না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে দূরে থেকেও তামসীর প্রতি একটা সুপ্ত ভালোলাগা হৃদয়ে পুষে রেখেছিলো গালিব। তামসীর যখন ষোল বছর বয়স তখন গালিব নির্জর মির্জার সাথে একদিন কথা বলেছিলো। প্রথমে দোনোমোনো করছিলেন তিনি কারণ গালিবের সাথে তামসীর বয়সের ফারাকটা অনেক। তবুও গালিবকে তো না বলতে পারেননি তামসীর বাবা। উপর্যুক্ত সময় মেয়েকে গালিবের হাতে তুলে দিবেন বলে কথা দিয়ে রেখেছেন তিনি। এ বিষয় বাড়ির সবাই অবগত, তবে বাড়ির ছোটরা কিছু জানে না।

এতক্ষণ ধরে গালিবকে নিজের পাশে বসে থাকতে দেখে বেশ অস্বস্তি হচ্ছে তামসীর। কী করবে? এভাবে ঘরে ঢুকে দরজা আঁটকে বসে থাকে কেউ!
“ ভাইয়া আমি খেতে যাচ্ছি। “
তামসী কথাটা বলেই বসা থেকে উঠে, দ্রুত দরজার দিকে এগোল। গালিব বসে থেকেই বলল,
“ এভাবে লাফাতে লাফাতে সিঁড়ি বেয়ে নামবি না। শান্তভাবে হেঁটে খাবার খেতে যাবি। “
“ জি। “
তামসী পেছন ফিরে না তাকিয়েই কোনোমতে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আর রুমের বাইরে গিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। গালিবটাকে একদম ভালো লাগে না ওর। সবসময় কেমন গম্ভীর মুখ করে থাকে, হাসেও না। কেমন রসকষহীন কাঠখোট্টা স্বভাবের মানুষ!

দেখতে দেখতে নওশিনের বিয়ের পর তিনদিন কেটে গেছে। এরমধ্যে মির্জা বাড়ির পরিবেশ বদলে গেছে। মন খারাপ থাকলেও সবাই আগের মতো নিজেদের কাজকর্মে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। গালিবের ছুটি শেষ হতে মাসখানেক বাকি। তাই তার কোনো কাজ নেই আপাতত। বাড়ির সকল ছেলেমেয়ে স্কুল-কলেজে যাওয়া শুরু করেছে। বিয়েতে অনেক দিন ঠিকমতো ক্লাস করা হয়নি বলে সবারই লেখাপড়ার চাপ বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে তামসীর সামনে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির পালা, তাই ঝুট-ঝামেলা ছাড়া আছে সে।

মির্জা বাড়ির বিশাল রান্নাঘরে দুপুরের রান্নাবান্নার প্রস্তুতি জমে উঠেছে। সাদা মার্বেলের টপ, দেয়ালে ঝকঝকে টাইলস, মডার্ন চিমনির হালকা শব্দ ভেসে আসছে। একপাশে লম্বা কাউন্টারে কাটা সবজি সাজানো স্টিলের বাটিতে– রঙিন ক্যাপসিকাম, গাজর, মটর, ফুলকপি। বড় স্টেইনলেস স্টিলের হাঁড়িতে ভাত চড়ানো হয়েছে, সাথে আলাদা গ্যাসবার্নারে মুরগির রোস্ট আর গরুর রেজালার প্রস্তুতি চলছে। নন-স্টিক কড়াইয়ে ডাল ফুটছে, সাথে হালকা মশলার গন্ধে পুরো রান্নাঘর ভরে গেছে। এককোণে রাখা মাইক্রোওভেনে গরম হচ্ছে নানরুটি।

সুমাইয়া মির্জা এপ্রোন পরে গরুর রেজালা নেড়ে দিচ্ছেন, আয়মান মির্জা ফ্রিজ থেকে ঠাণ্ডা দই বের করছে, লামিয়া ব্লেন্ডারে সালাদের জন্য মেওনেজ তৈরি করছে। লামিয়া মেয়েটা এই বয়সেই রান্নাবান্নার দিকে ঝুঁকেছে। প্রথম প্রথম সুমাইয়া মেয়েকে বারণ করতেন, রান্না ঘরে আসতে। তবে এখন আর করেন না। কারণ লামিয়া ভীষণ রাঁধতে পছন্দ করে। তাই মেয়েকে এখন রান্নার কাজে দেখলে কিছু বলেন না তিনি।

“ আম্মু মেওনেজ তৈরি করা হয়ে গেছে। “
হাসিহাসি মুখে বলল লামিয়া৷
“ তাহলে তুই, গোসল করতে যা এখন। “
“ আচ্ছা। “
লামিয়া সুবোধ বালিকার মতো মায়ের কথা শুনে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। আয়মান হেসে বললেন,
“ লামিয়া এতো শান্ত, গুণী একটা মেয়ে – যাদের ঘরের বউ হয়ে যাবে, ঘর আলোকিত করে রাখবে। “
সুমাইয়া মুচকি হাসলেন। মেয়ের প্রশংসা শুনতে বেশ ভালোই লাগে। তবে লামিয়া যেমন শান্ত, মেঘলা ততটাই অশান্ত। তাই লামিয়ার কথা ভাবলে অটোমেটিক মেঘলার ভবিষ্যতের বিষয়ও ভেবে ফেলেন সুমাইয়া।
“ তা ঠিক বলেছেন ভাবি। কিন্তু আমার মেঘলার কী হবে! মেয়েটা দিনদিন বিচ্ছু হয়ে যাচ্ছে শুধু। “
“ আরে বয়স হোক, বুঝবে সব। এতটুকু মেয়েকে নিয়ে, এতকিছু ভেবো না। “

সুমাইয়দ মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। দুই জা মিলে আবারও রান্নাবান্নার দিকে মনোযোগ দিলেন।

ঢাকার এক নামকরা প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি। লাল ইটের বিল্ডিং, সামনে বিশাল সবুজ লন, চারপাশে ব্যস্ততা। গেট দিয়ে ঢুকেই ভিড় কেউ ক্লাসে যাচ্ছে, কেউ ক্যান্টিনে, কেউবা গিটার হাতে বসে আড্ডা দিচ্ছে।

রাবিনের হাতে ল্যাপটপ ব্যাগ, জিন্স আর চেক শার্ট পরে ক্যাম্পাসে ঢুকলো। সবার মতো ওরও মুখে হালকা চাপা টেনশন। কারণ অনার্সের শেষ বছর মানেই ফাইনাল পরীক্ষা, প্রজেক্ট, থিসিস জমা– সব একসাথে। সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠতে উঠতে রাবিন ফোন বের করে মেসেঞ্জারে টিপতে লাগল। ওর বন্ধু অয়ন হেসে বলল,
“ওরে, ক্লাসে ঢোকার আগেও ফোন টিপাটিপি ! ভাইয়া দেশে ফিরছে বলে কি এখনো ধমক খাওনি?”
রাবিন হেসে উত্তর দিল,
“আহা, আমার গালিব ভাইয়া ধমক ছাড়া আর কিছু জানে নাকি?”
অয়ন ফিক করে হেসে উঠল। রাবিন মুখটা মলিন করে ফেলল।
“ আহারে… বেচারা। থাক কী আর করবি! “
“ সর হারামি… মজা নিচ্ছিস.. মজা?”
রাবিন অয়নকে কয়েকটা ঘুষি মেরে ক্লাসের দিকে এগোল।

ক্লাসরুমে ঢুকতেই প্রজেক্টরের আলোয় পড়াশোনার পরিবেশ। ফাইনাল ইয়ার বলেই সবাই সিরিয়াস। স্যারের সামনে বসতেই ফিসফিস শুরু করল রাবিনের বন্ধুরা। জিজ্ঞেস করলো একজন আরেকজনকে,
“ রাবিনকে দেখলাম অনেক দিন পর। কাহিনী কী রে?”
“ রাবিনের বোনের বিয়ের ঘরোয়া অনুষ্ঠান শেষ হলো কদিন আগে।”
“ এই জন্যই তো ওকে কিছুদিন ক্যাম্পাসে দেখা যায়নি।”
“ হুম। “
রাবিন চুপচাপ হাসলো, কিন্তু ভেতরে ভেতরে গর্ব হচ্ছে– ধনী পরিবারের ছেলে সে। সেই কারণে সবার কাছে তার একটা আলাদা দাম আছে। সবাই আসলে ওকে না, ওর বাবার টাকাপয়সার জন্যই ওকে তেল দিয়ে কথা বলে। আর সেটা রাবিন ভালো করেই বুঝতে পারে। তবে গালিব ভাই দেশে আসার পর থেকে মাথার ওপর কড়া নজরদারি এটাই তাকে সবচেয়ে বেশি ভাবায় রাবিনকে ।

ক্লাস শেষে ক্যান্টিনে গেলো রাবিন আর সাথে তার গ্রুপ। টেবিলে বার্গার, কফি, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই। আড্ডায় হাসাহাসিতে চললো অনেকক্ষণ। ক্লাসে এলেই রাবিন সবাইকে খাওয়াবে। এজন্যই ওর পিছনে লোকজনও থাকে।

চলবে…..