#গালিব_মির্জা
#পর্ব_১১
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
গালিব ও তামসী রেস্টুরেন্টের ভেতরে ঢুকতেই ওয়েটার হাসিমুখে বসতে বললো। গালিব গম্ভীর অথচ ভদ্র ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে সাড়া দিলো। তারপর হোস্টেসকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“কাপল কর্নার ফ্রি আছে?”
একটু খোঁজ নিয়ে হোস্টেস মাথা নেড়ে জানাল, হ্যাঁ। ভেতরের এক কোণের টেবিলে গিয়ে দু’জনকে বসতে দিলো। চারপাশে হালকা আলো, টেবিলের ওপর একটি ছোট ল্যাম্প, চারপাশে নরম সুর বাজছে। পরিবেশটা নিরিবিলি, উষ্ণ আর রাজকীয়।
তামসী ধীরে চেয়ারে বসার জন্য চেয়ারে হাত দিতেই গালিব চেয়ারটা আলতো করে টেনে দিলো তার জন্য। ওর আচরণে এক মুহূর্তের জন্য তামসীর বুক ধক করে উঠলো। মনে হলো, সত্যিই কোনো রাজপুত্র যেন তাকে রাজকন্যার মতো ট্রিট করছে।
“মেনু কার্ড আনুন।”
গালিব শান্ত গলায় বলতেই ওয়েটার মেনু কার্ডটা এসে টেবিলে রেখে গেল। তামসী কার্ডের দিকে হাত বাড়াতে চাইছিলো, কিন্তু গালিব তা তুলে নিয়ে নিজেই দেখতে লাগলো। চোখ বুলিয়ে বলল,
“তুই কী খেতে চাইছিস বল, আমি অর্ডার করছি।”
তামসী কিছুটা দ্বিধায় পড়ে গেল।
“যা আপনি খাওয়াতে চান…”
গালিব ভ্রু উঁচু করে তাকালো, ঠোঁটে সামান্য হাসি।
“ শিওর? “
তামসী গালিবের দুষ্টমি বুঝতে পারলোনা। স্বাভাবিকভাবেই মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল কেবল। গালিব আবারও বলল,
“ ঠিক আছে। তোর পছন্দের খাবারই অর্ডার করছি। আফটার অল, আমার রাজ্যের রাজকন্যা বলে কথা! বল কী নিবি?”
তামসীর গাল লাল হয়ে উঠলো। নিচু গলায় বলল,
“চিকেন স্টেক… আর হয়তো পাস্তা। সাথে জুস।”
“ওকে। আমি যোগ করবো স্যুপ আর ডেজার্ট।”
আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে ওয়েটারকে ডেকে অর্ডার দিলো গালিব।
খাবার আসতে দেরি হতেই দু’জন একে অপরের দিকে তাকিয়ে বসে রইলো। মাঝে মাঝে চোখাচোখি হতেই তামসী চোখ নামিয়ে নিচ্ছিলো, আবার কিছুক্ষণের মধ্যেই অজান্তে গালিবের চোখে আটকে যাচ্ছিলো দৃষ্টি। যেনো চোখে চোখেও কথা হচ্ছিল দু’জনের মাঝে।
খাবার আসতেই গালিব নিজেই প্লেট টেনে তামসীর সামনে রাখলো। ছুরি-কাঁটা তুলে দিলো হাতে।
“ধীরে খাস, তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই।”
তামসী একটু হেসে বলল,
“এভাবে সার্ভ করলে মনে হচ্ছে আমি সত্যিই রাজকন্যা।”
গালিব গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল,
“রাজকন্যাই তো।”
তামসী কাঁটা চামচ হাতে নিয়েও কিছুক্ষণ থমকে থাকলো। বুকের ভেতর অদ্ভুত এক কাঁপন, মনে হলো কারও চোখের ভেতরে ডুবে যাচ্ছে সে। তারপর নিচু স্বরে উত্তর দিলো,
“তাহলে আমি রাজকন্যা হলে, আপনি…?”
গালিব চোখ নামালো না একবারও।
“রাজপুত্র। আর রাজকন্যা আর রাজপুত্রের মিলনটাই ভবিষ্যৎ।”
ওর কণ্ঠে যে দৃঢ়তা, তা শুনে তামসীর বুকটা ভরে উঠলো। নিঃশ্বাস গাঢ় হয়ে এলো। খেতে খেতেই তার মনে হচ্ছিলো, গালিব যেন প্রতিটি আচরণে বোঝাচ্ছে– সে তামসীকে কতটা ভালোবাসে।
তামসীর এক হাতে ছুরি কাঁটা নড়ছিলো, অন্য হাতে গালিব হঠাৎ নিজের হাত রাখলো টেবিলের নিচে। তামসী চমকে গিয়ে তাকালো। গালিব শান্ত দৃষ্টিতে বলল,
“ এত ভীতু কেন তুই? আমি কিছু করছি না, তোকে। “
তামসী বিব্রত হলো। ছিহ! গালিব তো নিজের উরুতে হাত রেখেছে অথচ তামসী কীসব ভাবছিলো…
“ সরি!”
গালিব দৃষ্টি সরিয়ে ফেলল। খেতে খেতে আর কথা বললো না। তামসীও আর গালিবের দিকে না তাকিয়ে খাওয়া শেষ করলো।
সুমাইয়া মির্জা কুশন গোছাতে গোছাতে রান্নাঘর থেকে আসা মশলার গন্ধ শুঁকে বললেন,
“আজকে রাতের মেনুটা জমজমাট হবে মনে হচ্ছে।”
পাশেই তৌকির মির্জা বসে ছিলেন। হেসে বললেন,
“ গালিবের পছন্দের খাবার তৈরি হয়েছে সব। জমজমাট তো হবেই!”
মুচকি হাসলেন সুমাইয়া।
রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে হাঁসির শব্দ। লামিয়া, মেঘলা আর শুভ মিলে আলু ভর্তা নিয়ে মজার তর্ক করছে। রাফি, রাবিন একপাশে দাঁড়িয়ে থেকে খুনসুটি করছে। লামিয়া নিজের ঘরে, পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত আছে। আজকে ওরা বাড়িতে ফুচকা তৈরি করবে।
“মেঘু, তুই ভর্তায় লবণ দিসনি!”
শুভ অভিযোগ তুলতেই মেঘলা হাঁক ছাড়লো,
“আহা! আমি দিয়েছি, তোমার মুখে সমস্যা।”
“ মোটেও না। তুই আরেকবার চেক কর। লবন কম হলে খেতে মজা লাগবে না। “
শুভ ঠোঁট টিপে হেসে বললো। মেঘলা ভ্রু কুঁচকে ফেলল।
“ শুধু শুধু আমার সাথে ঝগড়া করতে আসবে না, শুভ ভাই। “
রাবিন পাশ থেকে হাসি আটকাতে না পেরে বলে উঠলো,
“ঝগড়া করতেই তোদের জন্ম।”
“ ইশশ! তুমি নিজে বুঝি সাধু?”
রাফির কথা শেষ হতেই রাবিন ওর পিঠে হালকা একটা কিল বসালো।
“ বড়দের সম্মান করবি,বুঝলি?”
রাফি ভেংচি কেটে বলল,
“ হুম । “
“ কী বুঝলি বল?”
“ বুঝলাম বলদেরকে চম্মান করতে হয়। “
রাফি কথাটা বলেই শুভর পিছনে গিয়ে লুকিয়ে পড়লো। সবাই শব্দ করে হেসে উঠল তাতে।
সাইদ মির্জা ড্রইংরুমে বসে শান্ত ভঙ্গিতে টিভি দেখছেন, মাঝে মাঝে ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে নিচ্ছেন। এমন সময় আয়মান মির্জা এলেন সেখানে।
“ খাবার খাবে, চলো। “
আয়মান আঁচলে হাত মুছতে মুছতে বললেন। সাইদ টিভির রিমোটটা হাত থেকে সোফায় রাখলেন৷ স্ত্রী’র হাত ধরে পাশে বসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“ সবাই একসাথে খাবো। গালিবরা ফিরুক। “
“ ন’টা পেরিয়ে গেছে, ওদের আসতে দেরি হবে হয়তো। বুঝতেই পারছো, এই বয়সে…..”
সাইদ মির্জা মুচকি হাসলেন। আশেপাশে তাকিয়ে বউয়ের কপালে টুক করে একখানা চুমু খেলেন। আয়মান চমকে উঠে বললেন,
“ কী করছো সাইদ! বাড়ি ভর্তি লোকজন, ছেলেমেয়েরা সবাই আছে। তুমি! তুমি আর শুধরলে না। “
“ আরে শান্ত হও৷ এতো হাইপার হওয়ার মতো কিছু হয়নি৷ ছেলেমেয়েদের তো শিখতে হবে, জীবনসঙ্গীকে আজীবন কীভাবে ভালোবাসতে হয়। “
“ ধ্যাৎ! “
আয়মান বসা থেকে উঠে চলে যেতে চাইলে সাইদ মির্জা বাঁধা দিয়ে বললেন,
“ বসো আয়মান। গালিব আর তামসীর বিয়েটা কবে দেওয়া যায়, বলো।”
আয়মান বসলেন।
“ তামসীর বাবা-মায়ের সাথে কথা বলে দেখো। গালিবের ছুটিও তো একমাস, তারমধ্যে আট দিন চলে গেলো। “
গম্ভীর কণ্ঠে, “ হুম।” বললেন সাইদ মির্জা।
“ হুম। আসছি আমি। আর আধঘন্টা অপেক্ষা করবো তারপর সবাইকে খেতে ডাকবো। “
“ঠিক আছে। “
আয়মান চলে যেতে সাইদ মির্জা ফের টিভির স্ক্রিনে মনোযোগ দিলেন।
কালো রঙের চার চাকার গাড়িটি শহরের ব্যস্ততা পেরিয়ে আস্তে আস্তে নিরিবিলি রাস্তায় ঢুকল। চারপাশে হালকা আলো, দূরে গাছের ছায়া, বাতাসে ভেসে আসছে রাতের নীরবতা। গাড়ির ভেতরে কেবল গালিব আর তামসী– নিঃশব্দ এক জগত। স্টিয়ারিংয়ে হাত রেখে গালিব একবার চোরা চোখে তাকাল পাশে বসা মেয়েটির দিকে। তামসীর খোলা চুল বাতাসে উড়ছে, হালকা লাইটে তার মুখটা যেন আরো দীপ্তি ছড়াচ্ছে। গালিব অজান্তেই মুচকি হেসে ফেলল।
“কী?”
তামসী জানালার বাইরে তাকিয়ে থেকেও টের পেল দৃষ্টি, ধীর কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল।
“তুই।”
গালিব সংক্ষিপ্ত উত্তর দিলো।
তামসী ভুরু কুঁচকালো,
“আমি আবার কী করলাম?”
“কিছু না… তুই চুপচাপ বসেও এমন এক ঝড় তুলিস আমার ভেতরে, যার কোনো শব্দ হয় না।”
কথাগুলো শুনে তামসীর বুকটা কেঁপে উঠল। হালকা লজ্জায় মুখ ফিরিয়ে নিল জানালার বাইরে, কিন্তু ঠোঁটের কোণে একটুকরো হাসি আটকাতে পারল না। গাড়ি চলতে চলতে নির্জন রাস্তায় ঢুকল। দু’পাশে অন্ধকার, মাঝে মাঝে আলোর খণ্ড খণ্ড ছায়া। গালিব স্পিড কমিয়ে দিল, যেন এই সময়টা আরেকটু দীর্ঘ হয়।
“ এটা কোথায় এলেন! চারদিক কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। “
আশেপাশে নজর বুলিয়ে দিয়ে বলল তামসী। গালিব আরেকটু সামনে গিয়ে গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিলো।
“তামসী।”
গম্ভীর অথচ কোমল কণ্ঠে ডাক দিল গালিব।
“হুম? ”
চোখ না ফিরিয়েই উত্তর দিল তামসী। গালিবের দৃষ্টি কেমন ঘোলাটে লাগছে। তামসী শুকনো ঢোক গিলল। চারপাশটা বড্ড নিরিবিলি। গালিব কোনো কথা না বলে আচমকাই তামসীর কোমরে হাত রেখে, কোলে তুলে বসালো তাকে। তামসী চমকাল।
“ কী করছেন! বিয়ের আগে এসব কেমন কাজকর্ম, হ্যাঁ? “
“ চুপ করে বস,এতো নড়াচড়া করিস না। “
তামসী গালিবের গলা জড়িয়ে ধরে আছে। দু’জনের দৃষ্টি মিলেমিশে গেছে।
তামসী গালিবের কোলে বসে যেন দিশাহারা হয়ে গেল। বুকের ভেতর অদ্ভুত কাঁপুনি উঠছে। এত কাছে কখনো তাকে এভাবে পায়নি। গালিবের বুকের তাপ, কোলের শক্ত অথচ নিরাপদ অনুভূতি, আর সেই দৃষ্টি যেন সরাসরি ভেতরটা ভেদ করে যাচ্ছে।
“ গা…গালিব…ভাই ”
কণ্ঠটা আটকে এল তামসীর। গলা শুকনো হয়ে গেছে।
গালিব ধীরে ধীরে তার মুখটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিল। চোখে চোখ পড়তেই তামসীর বুক কেঁপে উঠল।
“ গালিব…ভাইয়া এটা ঠিক হচ্ছে না… ”
কণ্ঠটা কেঁপে উঠল তামসীর।
গালিব হালকা হেসে মাথা নিচু করল, কানের পাশে উষ্ণ নিঃশ্বাস ছুঁইয়ে দিল।
“ ঠিক-ভুলের হিসেব এখন নয়, তামসী। শুধু তুই আর আমি আছি।”
কয়েক সেকেন্ড যেন থেমে গেল সময়। তামসী প্রথমে শ্বাস আটকে ফেলল, তারপর ঢোক গিলল, বুকের ভেতর যেন ঢাক বাজছে।
গালিব খুব ধীর গতিতে এগিয়ে এল, যেন তাকে সময় দিচ্ছে– চাইলে সরে যেতে পারে। কিন্তু তামসী সরে গেল না। চোখ বন্ধ করে নিল অজান্তেই।
প্রথম ছোঁয়া হলো ঠোঁটে। একেবারে নরম, কাঁপা কাঁপা এক চুমু। তামসীর পুরো শরীর শিহরে উঠল। শ্বাসপ্রশ্বাস এলোমেলো হয়ে গেল, মনে হচ্ছিল বুক থেকে শব্দ বের হবে। গালিব থেমে গেল এক মুহূর্ত, যেন জানতে চাইছে,সে রাজি কিনা। তামসী ধীরে ধীরে গালিবের শার্ট মুঠো করে ধরল। এটাই তার জবাব। গালিব তখন আরও গভীরভাবে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিল। শুরুর সেই দ্বিধা ধীরে ধীরে বদলে গেল এক অদ্ভুত আবেশে। চারপাশের অন্ধকার, নির্জন রাস্তা, গাড়ির ভেতরের উষ্ণতা– সব মিলিয়ে যেন শুধু তাদের দু’জনকেই ঘিরে ধরল। তাদের প্রথম কিসটা ছিল অদ্ভুত রকমের।একসাথে ভয়, লজ্জা, আকাঙ্ক্ষা আর ভালোবাসার প্রকাশ। তামসী অনুভব করল এটাই হয়তো সেই মুহূর্ত, যেটা একবার হলে সারাজীবনের জন্য মনে গেঁথে যায়।
চলবে….