#গালিব_মির্জা
#পর্ব_১৫
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
মাঝরাতে ফোনের রিংটোনের শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেলো লামিয়ার। প্রথমবার কল রিসিভ করতে পারলোনা, কল কেটে গেলো বলে। কিন্তু পরেরবার ঠিকই রিসিভ করে ফোন কানে চেপে ধরলো সে।
“ হ্যালো!”
ঘুম ঘুম চোখে কোনোমতে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে হাসির শব্দ ভেসে এলো কানে। মুহুর্তেই সতর্ক হয়ে উঠলো লামিয়া। কোনো ছেলের হাসি!
“ হ্যালো মিশমিশ। “
মিশমিশ? এ আবার কেমন ডাক! আর লোকটাই বা কে? লামিয়া শোয়া থেকে উঠে বসলো এবার।
“ কে বলছেন? “
“ রকি বলছিলাম। “
মুহুর্তের মধ্যে চুপসে গেলো লামিয়া। ওড়নার কোণা ধরে নাড়তে শুরু করলো। থেমে থেমে বলল,
“ আপনি… এতো রাতে? “
বিয়ে বাড়িতে রকির সাথে কথা হয়েছিল লামিয়ার। ছেলেটার অগোছালো স্বভাব আর বেপরোয়াভাব লামিয়ার মনে অন্য রকম এক অনুভূতি সৃষ্টি করেছে।
“ মনে পড়লো তোমার কথা। “
সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে ঠোঁটের কোণে রেখে, বলল রকি। লামিয়ার বুক ডিপ ডিপ করছে যেন। এ কেমন অনুভূতি! কেমন অস্থির অস্থির লাগছে লামিয়ার।
“ আমার কথা? কিন্তু কেন?”
“ তুমি জানো না?”
“ না, তো। “
আবারও হাসলো রকি। লামিয়া চোখ বন্ধ করে ফেললো। একজন অপরিচিত পুরুষ এতরাতে কল করাতে রাগ করার কথা থাকলেও অজানা কারণে রাগ করতে পারলোনা লামিয়া।
“ মিশমিশ তুমি বড্ড সহজসরল। “
“ আমার নাম লামিয়া। “
“ আমি জানি, তো। “
“ তাহলে? “
“ তাহলে আমি তোমাকে মিশমিশ বলেই ডাকবো। “
লামিয়া কথা বাড়াতে চাইলোনা আর। মেনে নিলো রকির আবদার। কথা হলো কিছুক্ষণ। তারপর আবারও বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলো লামিয়া। রাতের নিস্তব্ধতা গ্রাস করে নিলো সবকিছু।
ভোরের আলোয় ঘরটা হালকা সোনালি আভায় ভরে উঠেছে। জানালা দিয়ে ঢুকে পড়া কোমল রোদ যেন নতুন জীবনের সাক্ষী। তামসী আধো ঘুমে চোখ মেলতেই দেখলো গালিব ওর দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে অদ্ভুত এক শান্তি আর ভালোবাসা।
“কী দেখছেন?”
মৃদু স্বরে লজ্জা মাখা প্রশ্ন করলো তামসী।
গালিব বললো,
“যার জন্য এতদিন অপেক্ষা করেছি, তাকে কাছে পেয়েছি কিনা সেটা যাচাই করছি।”
তামসী হালকা লজ্জায় চাদর মুখের দিকে টেনে নিলো। গালিব কাছে সরে এসে তার হাতটা আলতো করে ধরলো। সেই ছোঁয়ায় তামসীর বুক কেঁপে উঠলো। চাদর সরিয়ে দিলো অল্প।
“এভাবেই থাক। আমার প্রতিটা সকাল শুরু হোক তোকে দেখে।”
গালিবের কণ্ঠে দৃঢ়তা। তামসী চোখ নামিয়ে মিষ্টি হাসি দিলো, কিন্তু চোখের কোণে জমা হলো লাজুক আনন্দের ঝিলিক।
ওরা দু’জনই প্রথম ভোরের শান্ত নিস্তব্ধতায় একে অপরের হাত ধরে চুপচাপ শুয়ে রইলো কিছুক্ষণ। গালিব হঠাৎ অনুভব করলো তামসী আবারও ঘুমিয়ে গেছে। হাসি পেলো বেচারার। তামসী আগেও ঘুমকাতুরে ছিলো, এখনও আছে।
মনে মনে তামসীর ঘুমের কথা ভাবতে ভাবতে কোনোমতে উঠে বসলো গালিব। এমনভাবে বিছানা ত্যাগ করলো যেন তামসীর ঘুম না ভেঙে যায়। গালিব ফ্রেশ হওয়ার পর, একেবারে রেডি হয়ে ডাইনিং রুমে গেলো। সুমাইয়া মির্জা গালিবকে দেখে হেসে জিজ্ঞেস করলেন,
“ তামসী কই? এখনও ঘুমোচ্ছে না-কি? “
গালিব হ্যাঁ বোধক ইশারা করলো। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন সুমাইয়া। গালিব চেয়ার টেনে বসলো। রাবিন, মেঘাল ও শুভও ব্রেকফাস্ট করছে।
“ মেয়েটার স্বভাব বদলানো যাবে না। “
“ দরকার নেই। যেমন আছে থাক। “
গালিব জুসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে, বলল। আইমান এলেন। সুমাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“ সত্যি, তামসীর বদলানোর দরকার নেই। ও যেমন আছে তেমনই ঠিক আছে। “
“ ভাবি! আপনাদের আহ্লাদে মেয়েটা আরও আধপাগল হয়ে গেছে। “
হেসে উঠলেন আইমনা, সাথে রাবিনসহ বাকিরাও। কেবল গালিব হালসো না।
ধীরে ধীরে সময় গড়িয়ে গেছে। হাসি, খুনসুটি, একসাথে কাটানো মুহূর্তে কেটে গেছে কয়েকটা সপ্তাহ। এরই মাঝে গালিব আর তামসীর দাম্পত্যজীবনও একেবারে মানিয়ে গেছে। দু’জনের মাঝে লাজুকতা, টুকটাক রাগ-অভিমান থাকলেও ভালোবাসায় সব ঢাকা পড়ে যায়। তবে একটা অস্বস্তি ভেতরে ভেতরে গলগল করে– গালিবের বিদেশ ফেরার দিন ঘনিয়ে আসছে। ছুটি প্রায় শেষ, হাতে আর মাত্র ক’টা দিন। তামসীকে ছেড়ে যাওয়ার চিন্তায় গালিবের বুকটা হালকা ভার হয়ে ওঠে, তামসীর তো কথাই নেই।ওর মনে বারবার কেমন যেন শূন্যতা ভর করে বসে।
অন্যদিকে, রাবিন আর ফিজার গল্প এখন পুরোপুরি প্রেমের রঙে রাঙা। ফিজার ঠোঁটের কোণে সারাক্ষণ হাসি খেলে যায়। রাবিনও আগের চেয়ে অনেক বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেছে, যেনো হঠাৎ জীবনকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছে। দু’জনকে এখন প্রায়ই একসাথে দেখা যায়। ওদের ভেতরে কোনো টানাপোড়েন নেই, আছে পরিপক্ব ভালোবাসার মিষ্টি নির্ভরতা।
আরেকদিকে লামিয়া আর রকির সম্পর্কটা এখনও পুরোপুরি বাঁধা পড়েনি, তবে ‘হবে হবে’ ভরা এক আবহ তৈরি হয়েছে। রকি যতটা চেষ্টা করছে সহজভাবে এগোতে, লামিয়া ঠিক ততটাই তার মনোভাব বুঝতে পারছে। একেকটা মুহূর্তে ওদের চোখাচোখি হয়, কথার আড়ালে অন্য রকম ইঙ্গিত চলে যায়। মনে হয় দু’জনেই বুঝছে,কিছু একটা ঘটতে চলেছে। রকির স্বভাব লামিয়াকে খুব টানে। চাইলেও দূরে সরতে পারে না আজকাল। প্রায়শই রাতে ফোনালাপ হয় তাদের। তবে রকি দেখা করার জন্য জোরাজোরি করলেও লামিয়া ভয় পায়। মেয়েটা যে ভীষণ ভীতু! মেঘলা জানে রকির বিষয় সবটাই। রাবিনকে বলতে চেয়েও বলেনি এখনও। তবে শুভকে বলেছে। শুভ রকির বিষয় যতটুকু জেনেছে তাতে, রকি ছন্নছাড়া এক ছেলে। মা নেই ঘরে, বাবা আর সে। নেশা করে তবে অতিরিক্ত না। যতটা অগোছালো লাগে ততটাও না। লেখাপড়ার দিকেও ভালো। তাই শুভ ভালোমন্দ কিছু বলেনি লামিয়াকে। তবে পুরোপুরি বিষয়টা মানতেও পারেনি শুভ। এ নিয়ে প্রায় মেঘলার সাথে কথা বলে সে।
“ তামু? এই তামু?”
রাবিনের ডাক শুনে রুম থেকে বেরিয়ে এলো তামসী। সময়টা এখন সন্ধ্যাবেলা। গালিব বিকেলে বেরিয়েছিল, এখনও বাসায় ফেরেনি।
“ কী হয়েছে তোমার? এতো হাঁকডাক কীসের? “
রাবিন হাসি হাসি মুখে, তাকালো তামসীর দিকে। মাথা চুলকে নিয়ে বলল,
“ ফিজা আজকে বিয়ের কথা বললো। “
তামসী ফিক করে হেসে উঠল।
“ এমনভাবে বললে যেন তুমি মেয়ে, আর ফিজা আপু ছেলে– তোমাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। “
মুখটা মলিন করে ফেলল রাবিন।
“ ধুরু! তোর সাথে বলতে এসেও শান্তি নেই। যাই নওশিন আপুকে কল দিয়ে বলি। “
“ আরে শোনো! মজা করেছি তো। এখন বলো, কবে বিয়ে করবে বলে ভেবেছো?”
তামসী বেশ গম্ভীর হাবভাব করে বলল কথাটা। রাবিনও খুব ভাবুক হয়ে কিছু একটা ভেবে বলল,
“ এক বছর পর। আমার গ্রাজুয়েট কমপ্লিট হবে, পাশাপাশি কোম্পানিতে জয়েনও করবো। তারপর বিয়ে। “
তামসী হাততালি দেওয়ার ভঙ্গিতে বলল,
“ কংগ্রাচুলেশনস, রাবিনইন্না। “
কপাল কুঁচকে ফেলল রাবিন। তামসীর চুল ধরে একটা টান মারলো।
“ ভালো হয়ে যা তুই। “
“ তুমি ভালো হও। ভাবি ডাকো, বুঝলে?”
“ আগে ভাইপো / ভাইঝির মুখ দেখা তারপর, ভাবি বলে ডাকবো। “
রাবিন এটুকু বলেই পেছন ফিরে দৌড়ে যাবেই এমন সময় গালিবকে দেখে থমকে গেলো। তামসীও চোখ বড়ো বড়ো করে ফেলল তাকে দেখে। রাবিন যে কোন দিক দিয়ে পালাবে সেটাই ভাবতে লাগলো।
“ ভাইয়া… আমি আসলে… আসলে আমি… না মানে তুমি…. “
রাবিনের অবস্থা দেখে মুখে ওড়না চেপে ধরে হাসতে লাগলো তামসী। গালিব শান্ত গলায় বলল,
“ তুই আসলে কী বলতে চাচ্ছিস?”
রাবিন কোনোমতে গালিবকে পাশ কাটিয়ে যেতে যেতে বলল,
“ কিছু না, ভাইয়া। “
রাবিন চলে যেতেই শব্দ করে হেসে উঠল তামসী। গালিবও মৃদু হাসলো।
“ রাবিন ভাইয়া আপনাকে যমের মতো ভয় পায়। “
“ ভয় পাওয়া ভালো। তুই চল, আমার সেবা করবি এখন। “
রুমে ঢুকলো গালিব, পিছুপিছু তামসীও এলো।
“ কিচ্ছু করবোনা আমি। আপনি তিনদিন পর আমাকে একা রেখে অন্য দেশে চলে যাবেন, তাই কিছু করবোনা। “
তামসীর অভিমান বোঝে গালিব। কিন্তু কী আর করার! যেতে তো হবেই। তবে গালিবের মনে আপাতত অন্য ভাবনা ঘুরপাক খাচ্ছে। সাইদ মির্জা বলছিলেন এখানকার কোনো ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করলেও তো ভালো হতো। তাহলে দেশের মাটিতেই সবাই একসাথে থাকা যেতো। কিন্তু গালিব একটুআধটু দোটানায় আছে। তামসীকে রেখে একমাসও থাকতে পারবে না সে৷ তাতে এখানে জব করাই বেটার বলে মনে হচ্ছে ওর।
“ তাই বলে এমন করবি?”
গালিব তামসীর হাত ধরে নিজের পাশে বসালো। তামসী মুখখানা গোমড়া করে বলল,
“ হু এমনই করবো। “
গালিব শার্টের বোতাম খুলতে গেলে তামসী নিজে থেকেই সেগুলো খুলতে লাগলো। গালিব বলল,
“ শোন মন খারাপ করিস না। দেখি কী করা যায়। “
“ কী আর করবেন? সেই তো আমাকে রেখে বিদেশ চলেই যাবেন!”
গাকিব মৃদু হেসে তামসীর থুতনিতে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।
“ সে পরে দেখা যাবে। রাবিন কিন্তু কথাটা খারাপ বলেনি। বয়স হয়ে যাচ্ছে আমার, ছেলেমেয়ের মুখ দেখতে দেরি হয়ে যাচ্ছে। “
গালিবের কথা শুনে তামসীর চোখ দুটো যেন কোটর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলো।
“ কী!”
“ হু।”
“ কিন্তু আমি এখন তৈরি নই। আমার সময় লাগবে, গালিব ভাইয়া। “
“ চুপ! এখনও ভাইয়া? কতবার বকলাম তবুও ভাইয়া ডাকা বন্ধ হলোনা তোর। “
তামসী হাসলো।
“ অভ্যাস! বদলাতে সময় লাগবে একটু। “
“ তা ঠিক আছে। আমিও মজা করেছি। সবে উনিশে পড়লো তার, এখুনি বেবি নেওয়ার দরকার নেই। দুই / তিন বছর পর দেখা যাবে। ওকে?”
তামসী হাসিমুখে গালিবের কাঁধে মাথা ঠেকিয়ে দিয়ে, ‘ হ্যাঁ ‘বলল।
চলবে….