#গালিব_মির্জা
#শেষ_পর্ব
#তাসমিয়া_তাসনিন_প্রিয়া
দেখতে দেখতে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। সময় যেন নিজের নিয়মেই সবার জীবনকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।।গালিব এখন ঢাকাতেই একটি নামী কলেজে শিক্ষকতা করছে। কাজের ব্যস্ততা থাকলেও পরিবার আর তামসীকে সময় দিতে ভোলে না। তামসীও বসে নেই। লেখাপড়ার পথে ধাপে ধাপে এগিয়ে গিয়ে গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে, এখন মাস্টার্স করছে। পড়াশোনার পাশাপাশি সংসারও সামলাচ্ছে সে।
রাবিনের জীবনেও পরিবর্তন এসেছে। গ্রাজুয়েশন শেষ হতেই সে ফিজাকে বিয়ে করেছে। ফিজা এখন শুধু তার স্ত্রী নয়, বরং ব্যবসায়িক সহকর্মীও। দু’জন মিলে পারিবারিক ব্যবসা বেশ ভালোভাবেই সামলাচ্ছে। মির্জা বাড়ির সবাই খুব সহজেই ফিজাকে আপন করে নিয়েছে। যেন সে এই বাড়িরই একজন ছিলো সবসময়।
শুভ আর মেঘলার সম্পর্কের কথাও অনেকটা সময় ধরে লুকোনো থাকেনি। একদিন নওশিন সাহস করে সবার সামনে সব খুলে বলেছিলো। প্রথমে মেঘলার বাবা রাগারাগি করেছিলেন, কিন্তু মেঘলার জেদের কাছে শেষ পর্যন্ত নরম হতে বাধ্য হন। তবে শুভ এখন দেশের বাইরে আছে । পড়াশোনার পাশাপাশি চাকরিও করছে সে। আসলে গালিব নিজেই শুভকে সুযোগ করে দিয়েছিলো। আগামীকালই শুভ ফিরছে দেশে, আর সেটা নিয়ে মির্জা বাড়িতে নতুন উচ্ছ্বাস।
লামিয়া আর রকির সম্পর্কটা কিন্তু অন্যদের মতো সহজ ছিলো না। রকি শুরুতে একটু খাপছাড়া আর অতিরিক্ত কেয়ারিং ধাঁচের ছিলো। সময়ের সাথে কিছুটা বদলালেও এখনও পুরোটা পাল্টায়নি। লামিয়া আবার একেবারে ছেলেমানুষী ধরনের, ছোটখাটো আবদার-রাগ নিয়ে থাকে সবসময়। ওদের মাঝে তাই মাঝেমধ্যে অল্পস্বল্প ঝগড়া হয়েই যায়। তবে দিনের শেষে দু’জনই বুঝতে পারে– তাদের ভালোবাসার ওজন সবকিছুর চেয়ে বড়। রাবিন একসময় রকির সাথে আলাপ করেছিলো, কিন্তু ওর ভেতরে নেগেটিভ কিছু খুঁজে পায়নি। তাই মির্জা বাড়ির বাকিরাও ধীরে ধীরে মেনে নিয়েছে সম্পর্কটা।
আর রাফি? সে তো এখনো সেই আগের মতোই আছে। একেবারে বোহেমিয়ান ধাঁচের– খাওয়া-দাওয়া, ঘুরে বেড়ানো, নিজের মতো থাকা। সিঙ্গেলই আছে, প্রেম ভালোবাসার ঝামেলায় এখনো জড়ায়নি। তবে তার ভোজনরসিক স্বভাব একটুও বদলায়নি।
এভাবেই মির্জা বাড়ির প্রতিটি মানুষ তাদের নিজের মতো করে জীবন কাটাচ্ছে। কেউ পরিবারে, কেউ সম্পর্কের টানাপোড়েনে, কেউ আবার শুধু নিজের সঙ্গেই ব্যস্ত। তবুও সবার মাঝেই অদৃশ্য এক বন্ধন কাজ করছে, যেটা বাড়িটাকে একসাথে করে রেখেছে।
রাত অনেকটা গভীর। মির্জা বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে আকাশের তারা গুনছে তামসী। গালিব আজকে একটু দেরি করে ফেরার কথা বলেছিলো। সেজন্য তামসী না খেয়েই, অপেক্ষা করছে। ছাদের পরিবেশটা ভীষণ সুন্দর লাগছে ওর। বাতাসে শীতল হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। মেঘমুক্ত আকাশে তারাগুলো মিটিমিটি করে জ্বলছে। প্রকৃতির এমন চমৎকার দৃশ্য দেখে আপনাআপনি হাসি ফুটল তামসীর ঠোঁটের কোণে। হঠাৎ পেছন থেকে গালিবের কণ্ঠ ভেসে এলো,
“সবসময় তারাদের সাথেই গল্প করিস? আমার জন্য কি একটুও সময় রাখবি না?”
চমকে ঘুরে তাকালো তামসী। চোখেমুখে লাজুক হাসি খেলে গেল। বেডা আসলো কখন? আসলো তো আসলো, এসেই ঢং– এর কথা শুরু করেছে। ভেংচি কাটল তামসী।
“ আপনি তো সবসময় ব্যস্ত থাকেন। আজকাল আপনার তো সময়ই পাওয়া যায় না।”
গালিব হেঁটে এসে তার পাশেই দাঁড়াল। দু’জনার মাঝে নীরবতা। তারপর গালিব ধীরে ধীরে বলল,
“ব্যস্ততা যতই থাকুক, তোকে নিয়ে ভাবা থামাইনি কখনো। বাড়ির বাইরে থাকলেও সব সময় তুই আমার মনে, মাথায় সব জায়গায় থাকিস। “
তামসী চোখ নামিয়ে নিলো।
“আমি ভেবেছিলাম কাজের চাপে আপনি হয়তো ভুলে গেছেন আমাকে…”
গালিব হেসে মাথা নাড়ল। একদম কাছে এসে কানে ফিসফিস করে বলল,
“যাকে ভুলে গেলে নিঃশ্বাস আটকে আসে, তাকে কি ভুলে থাকা যায়?”
তামসীর গাল লাল হয়ে উঠলো। ঠোঁটে ফুটে উঠল ছোট্ট হাসি।
“ হয়েছে। আর প্রেম করতে হবে না। চলুন খেয়ে নিবো, খিদে পেয়েছে খুব। “
গালিব তার হাতটা আলতো করে তামসীর পেটের ওপর রাখলো।
“ ছোট্ট প্রাণটাকে এভাবে শাস্তি কেন দিস তুই? তুই কি এখন একা? যে না খেয়ে বসে থাকবি? এরপর যদি আমার সোনাকে কষ্ট দিস তোর খবর আছে। ”
ধমকে উঠলো গালিব। গাল ফুলিয়ে অন্য দিকে তাকালো তামসী।
“ ঠিক আছে। “
মুখ গোমড়া করে কোনোমতে বললো কথাটা। গালিব হাসলো। কোলে তুলে নিলো তামসীকে। চমকাল তামসী।
“ মুখখানা এমন করে রাখিস না, দেখতে একটুও ভালো লাগে না। “
“ আপনি! আপনি একটা বজ্জাত লোক। “
“ ভালো হয়েছে। আমিই সবকিছু, তুই ভালো হলেই চলবে। “
গালিব তামসীকে নিয়ে ছাদ থেকে নামতে নামতে এভাবেই কথা চালিয়ে গেলো।
বিকেলের শেষ আলো। লামিয়া বারান্দায় দাঁড়িয়ে ফোন কানে নিয়ে অস্থির ভঙ্গিতে হাঁটছে।
“রকি, তুমি আজও এলে না কেন? কতদিন হলো আমরা দেখা করি না।”
ওপাশ থেকে রকি একটু চুপ থেকে গম্ভীর গলায় বলল,
“তুমি জানো, আমার পরিস্থিতি কেমন? সারাক্ষণ চেষ্টা করছি, একটা ভালো জব পেতে। সেজন্য তো বিজি থাকি। “
লামিয়া ঠোঁট কামড়ে রাগি গলায় বলল,
“তুমি শুধু অজুহাত দাও। আমি বুঝি না? তুমি চাইলে এক মিনিটও সময় বের করতে পারতে।”
রকি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তার কণ্ঠে বিরক্তির সাথে মিশে ছিল কোমলতা।
“ লামু! তুমি এমন কেন সোনা? কবে একটু বুঝদার হবে? আমি যে জব খুঁজি কার জন্য? তোমার সাথে একসাথে থাকার জন্যই তো এতো তাড়া। “
কণ্ঠ কেঁপে গেল,
“তাই বলে একটুও সময় দিবা না? আমি তো সারাদিন তোমাকেই ভাবি, প্রতিটা মুহূর্ত শুধু তোমার অপেক্ষায় কাটাই। তুমি কি জানো আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে প্রতিদিন সূর্য ডোবার আগে তোমার আসার জন্য তাকিয়ে থাকি?”
ওপাশে রকির নিঃশ্বাস ভারী হয়ে উঠল।
“লামিয়া… তুমি জানো না তুমি আমার জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। আমি তোমাকে এড়িয়ে যাচ্ছি না, আমি চাই নিজের একটা অবস্থান তৈরি করতে। “
একটু নীরবতা। তারপর রকি ধীরে ধীরে বলল,
“চলো কাল দেখা করি। অনেকদিন হলো তোমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলিনি– তুমি ছাড়া আমার কিছুই পূর্ণ নয়।”
লামিয়ার মুখে হালকা হাসি ফুটলো, চোখ ভিজে উঠল আনন্দে।
“প্রমিজ, কাল তুমি আসবে?”
“প্রমিজ, লামু। কাল তোমাকে আমার হাতে ধরে রাখব, যেন সময় থেমে যায়।”
লামিয়া হেসে উঠল এবার। রকিও মুচকি হাসল।
“ ঠিক আছে। “
“ পাগলি একটা! “
লামিয়া কিছু না বলেই কল কেটে দিলো এবার। লজ্জা পেয়েছে মেয়েটা!
সন্ধ্যাবেলা।
মির্জা বাড়ির ড্রইংরুমে সবাই একসাথে বসেছে। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে কথাবার্তা চলছে। ফিজা আর রাবিন সোফার একপাশে বসে গল্প করছিল। মেঘলা আর লামিয়া একটু দূরে, তবে চুপচাপ বসে আছে । তামসী একট বই হাতে নিয়ে আছে কিন্তু মনোযোগ দিয়ে শুনছে সব। গালিব অন্য পাশে বসে আছে, সাইদ মির্জার পাশের সোফায়।
নওশিন এসেছে গতকাল। তবে ছেলে নিয়ে একা এসেছে, ব্যস্ততার জন্য জামাই আসেনি সাথে । মূলত শুভর আসার কথা জেনেই নওশিনের দেশে আসা।
নওশিন হঠাৎ বলল,
“শুভ তো আগামীকালই ফিরছে, তাই না?”
গালিব মাথা নেড়ে উত্তর দিলো,
“হ্যাঁ, কাল দুপুরের ফ্লাইটে নামবে। আমি নিজেই এয়ারপোর্ট থেকে নিয়ে আসব।”
ফিজা মুচকি হেসে বলল,
“তাহলে বিয়েটা আর দেরি কেন? শুভ এখন পড়াশোনার পাশাপাশি কাজও করছে। আমার মনে হয়, সময়টা একদম পারফেক্ট।”
রাবিন গম্ভীর গলায় বলল,
“হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো। তবে চাচ্চুর সাথে আবারও বসা দরকার। আগেরবার উনি একটু রেগে গিয়েছিলেন।”
সাইদ মির্জা উঁচু গলায় বললেন,
“ তৌকির এখন আর কিছু বলবে না। আমি ওকে সব বুঝিয়ে বলেছি।”
এবার নওশিন আনন্দে হাত চাপড় দিলো।
“তাহলে তো কাজ সহজ হলো। শুভ এসে পৌঁছালেই বিয়ের তারিখ নিয়ে আলাপ শুরু করা যাবে।”
তামসী হেসে বলল,
“আমি তো ভাবছি, বিয়েটা যদি শীতকালে হয় তাহলে কেমন হয়? আবহাওয়া তখন সুন্দর থাকে।”
গালিব একচোখ মিটমিট করে বলল,
“বিয়ের প্ল্যান শুরু হয়ে গেছে মনে হচ্ছে! শুভ এসে জানুক আগে, তারপর না হয় সবাই মিলে ঠিক করি।”
মেঘলা মাথা নিচু করে লজ্জায় মৃদু হেসে ফেলল। চারপাশে হাসির রোল পড়ে গেল। সাইদ মির্জা ছোটোদের মাঝে রইলেন না, নিজের রুমের দিকে এগোলেন।
পরের দিন শুভ ফিরলো দেশে। সেই নিয়ে মির্জা বাড়ির লোকজনের আনন্দের শেষ নেই। সবাই শুভর আসাকে উপলক্ষ্য করে একটা পার্টির আয়োজনও করলো। পরিবার, আত্মীয়স্বজন সকলে এলো। এ বাড়িতে এখন যেন সুখ আর সুখ। শুভর সাথে মেঘলার বিয়ের তারিখও ঠিকঠাক করা হলো। রকিকেও বিয়ের বিষয় কথা বলার জন্য ডাকলো সাইদ মির্জা। রকি, না করেনি। যদিও চাকরি হয়নি তবুও বিয়েতে দেরি করতে চায়নি রকি। তবে বিয়ের পর লামিয়াকে কিছুদিনের জন্য বাবার বাড়িতে রাখবে– এটাই কথা হলো।
“ কী হয়েছে? এভাবে মুখ গোমড়া করে রেখেছিস কেন?”
বেলকনিতে দাঁড়িয়ে ছিলো মেঘলা, শুভ এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো। মেঘলা তাতে আরও গাল ফুলিয়ে ফেলল। বলল,
“ তো কী করবো? হেসে হেসে কথা বলবো?”
“ হ্যাঁ, তাই তো বলবি। “
“ কচু বলবো, তোমার সাথে। কতগুলো বছর আমাকে দূরে সরিয়ে রেখেছো, মনে আছে? “
শুভ মুচকি হাসলো। মেঘলাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে ধরলো।
“ সেসব তো তোর আর আমার ভবিষ্যতের জন্য।”
“ হু,জানি। “
“ সবকিছুই গালিব ভাইয়ার জন্য হলো মেঘলা। আমার মতো এতিম ছেলেকে এই পরিবার যা যা দিয়েছে সেটা কখনো ভুলবার নয়। “
মেঘলা শুভর বুকে মৃদৃ ঘুষি মেরে বসলো।
“ এসব কেমন কথা? এই পরিবার কি তোমার না? নিজের পরিবার, করবে না তো কে করবে?”
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল শুভ। মেঘলার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।
“ ঠিক বলেছো। “
মেঘলা মুচকি হাসল। ওভাবেই জড়িয়ে রইলো শুভকে।
মির্জা বাড়ির প্রতিটি মানুষের জীবন এভাবেই হাসি-আনন্দে কাটতে থাকলো। গালিব ও তামসীর ঘরে নতুন সদস্য আসাতে সেই আনন্দ আরো বেড়ে গেলো।
“ মাম্মা! আম্মা! মা…..”
সারার মুখে প্রথম মা ডাক শুনে আবেগে ভেসে যাচ্ছে তামসী। এতটুকু বাচ্চাটা আজ মা বলে ডাকছে– ভেবেই আনন্দ হচ্ছে।
গালিব হেসে বললো,
“ দেখলি? সারা তোকে আগে মা বলে ডাকলো। “
ভেংচি কাটল তামসী। সারাকে কোলে তুলে নিয়ে বলল,
“ ডাকবেই তো। আমি তো আপনার মতো নই, যে কথায় কথায় ধমক দেবো।”
“ কী বললি? আমি সারাকে ধমকাই?”
“ তা তো বলিনি। সারার মা’কে তো ধমকান। “
গালিব লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ল।
“ সারাকে আমার কাছে দে, তারপর গিয়ে এক কাপ কফি নিয়ে আয়। “
তামসী আবারও ভেংচি কাটল। সারাকে চুমু খেলো তারপর বাবার কাছে দিয়ে বলল,
“ আচ্ছা। “
গালিব মুচকি হেসে মেয়েকে কোলে তুলে নিলো। তামসী রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। গালিব সারার সাথে খেলতে লাগলো।
সমাপ্ত