#গোধুলির_শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#পর্ব২৬
#Raiha_Zubair_Ripti
সূর্য টা মাথার উপর থেকে সরে গেছে ঘন্টা খানেক আগেই। অথচ সাদমানের আধঘন্টা অপেক্ষা পেরিয়ে সেটা এক ঘন্টার সারিতে গিয়ে ঠেকেছে। সাদমান এখন ভাবনায় মশগুল। কি হচ্ছে ভেতরে? কি করছে তারা? রজনী যখন অফার করেছিল ভেতরে যাওয়ার তখন যে কেনো গেলো না সাদমান তার জন্য নিজেকে বকতে ছাড়লো না। ভেতরে গেলে এতো অপেক্ষা তো করতে হতো না। সাদমান রজনী কে ফোন করলো। বাজছে কিন্তু রিসিভ হচ্ছে না। রাগ হলো সাদমানের। ফোন টা কেনো ধরবে না। ইচ্ছে করলো ফোন টা ছুঁড়ে ফেলে দিতে। অধৈর্য্য হয়ে গাড়ি থেকে নামতে নিলে দেখে রজনী আসছে। মুখে লেগে আছে হাসি। সাদমান এর গা জ্বালা করলো এই হাসি দেখে। অপেক্ষায় রেখে হাসি সহ্য হলো না। রজনী এগিয়ে আসলো। গাড়িতে বসে বলল-
-“ সরি সাদমান বুঝতে পারি নি এতো দেরি হয়ে যাবে।
সাদমান গাড়ি স্টার্ট দিলো কোনো কথা না বলে। রজনী তাকালো সাদমানের মুখের দিকে। শক্ত হয়ে আছে মুখ। রেগে আছে নিশ্চয়ই?
-“ রেগে আছেন সাদমান? সত্যি বুঝতে পারি নি৷ ফোনটাও সাইলেন্ট করা ছিলো৷ ও আসতেই দিতে চাচ্ছিল না। বুঝিয়ে শুনিয়ে আসতে হলো। অনেক দিন দেখে নি তো সেজন্য….
-“ সেজন্য কি? এত সময় ওকে দিতে হবে? ও কি বাচ্চা? দামড়া একটা মানুষ জ্ঞান বুদ্ধি নেই? এমনি এমনি বড় হয়েছে?
রেগে বললো সাদমান। রজনী হকচকিয়ে গেলো।
-“ ওর তেমন বয়স হয় নি। রেগে কথা বলছেন কেনো? ওর জন্য ই তো আমার আসা।
সাদমান দাঁত চেপে বলল-
-“ কোলে নিয়ে রাখতেন।
-“ হ্যাঁ নিয়েছিলাম। গুলুমুলু একটা। আসতেই ইচ্ছে করছিলো না।
-“ থেকে আসতেন তাহলে রাত টা। আমি চলে যেতাম একাই।
-“ বলেছিলো থাকতে। কিন্তু থাকি নি। কেমন দেখায় না রাত থাকাটা?
-“ কেমন দেখাবে ভালোই দেখাবে। থাকতেন।
-“ উফ আপনি এমন রেগে রেগে কথা কেনো বলছেন। খুব কি ওয়েট করিয়েছি? সরি বললাম তো।
সাদমান চুপ রইলো। রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে। তাকে পাত্তা দেয় না অথচ উমরের বাসা অব্দি চলে আসে!
রজনী সাইড ব্যাগ থেকে ফোন টা বের করে। গ্যালারি তে ঢুকে পিক বের করে সাদমান এর দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলে-
-“ দেখুন আমাদের মানিয়েছে না?
সাদমান ঘুরলো। ভেবেছিল উমর আর তার ছবি দেখিয়ে বলছে। তাই রাগ নিয়ে ই কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে গিয়ে ও কিছু বলতে পারলো না। রজনীর পাশে লাল টুকটুকে একটা পরী রজনী কে জড়িয়ে ধরে চুমু খাচ্ছে।
-“ কে এটা?
-“ ঊষা। ডক্টর উমরের মেয়ে। ওর বার্থডে ছিলো আজ।
সাদমান সহসা জিজ্ঞেস করে বসলো-
-“ ওর আম্মা বেঁচে আছে তো?
মুভি, গল্পে সাদমান দেখেছে, বাচ্চার মা বেঁচে থাকে না। পরে ঐ বাচ্চার বাবার সাথে বিয়ে হয়ে যায় বাচ্চার সাথে অতিরিক্ত মেশা কোনো মহিলার।
রজনী ভ্রু কুঁচকালো সাদমান এর কথায়।
-“ অবশ্যই আছে বেঁচে ওর মা। এই দেখুন ওর মায়ের ছবি।
রজনী গ্যালারি থেকে রজনী আর লিমার পিক বের করে দেখায়। সাদমান দেখে ছবি টা। অশান্ত মন টার শান্তি মেলে। কি সব হাবিজাবি ভাবছিলো। নিজের মেন্টালিটি কে গাড়ির নি’চে ফেলে চা’পা দিয়ে পি’ষে ফেলতে ইচ্ছে করলো। সাদমান গাড়ি টা নিয়ে সোজা একটা নদীর ধারে আসলো। রজনী হঠাৎ গাড়ি টা এখানে থামাতে দেখে অবাক হয়ে বলল-
-“ গাড়িটা এখানে থামালেন কেনো?
সাদমান গাড়ি থেকে নামতে নামতে বলল-
-“ আগে নামুন তো গাড়ি থেকে। আপনি অজান্তেই আমার মন মেজাজ দুটোই শান্ত করে দিয়েছেন। তাই আমার এখন ঘুরতে ইচ্ছে করছে। ইচ্ছে করছে এই নদীর তীরে বসবো কিছুক্ষণ গোধূলির বিকেল দেখবো। শীতল বাতাস গায়ে মাখবো। নদীর জলে পা ভিজাবো। আর নৌকা বেয়ে মাঝি হবো আপনার। আসুন।
সাদমান হাত বাড়িয়ে দিলো। রজনী হাত টা ধরে গাড়ি থেকে নামলো। সাদমান রজনী কে নিয়ে নদীর তীরে আসলো। শুঁকনো বালু তে বসে রজনী কেউ বসতে বলল। রজনী ও বসলো। এই জায়গা টার কাছে মানুষের আনাগোনা কম। কিছুটা দূরে আছে মানুষ। তীরে সারি সারি করে নৌকা বাঁধা। রোদ নেমে গিয়ে শীতল বাতাস। পরিবেশ টা দারুন। রজনীর মনে পড়লো বছর কয়েক আগের কথা। নওফিল এর সাথেও সে এসেছিল এমনই এক নদীর তীরে। সেদিন বৃষ্টি ছিলো। বৃষ্টির শব্দে মুখরিত হয়ে ছিল চারিপাশ। নদীর পানির উপর টিপটিপ করে বৃষ্টির পানি পড়ছিলো। নদীর তীরে বসে ভিজেছিল নওফিল আর রজনী। প্রিয় পুরুষের সাথে বৃষ্টি বিলাস আহ! আজ সবই স্মৃতি। মানুষ মানুষ কে দেওয়া অঙ্গিকার, প্রতিশ্রুতি সব ভুলে যায়। অথচ মানুষ টিকে ভুলা যায় না। আচ্ছা নওফিল বুঝি ভালোই আছে বউ সন্তান নিয়ে তাই না? লাইফে নিশ্চয়ই কোনো অপূর্ণতা তার নেই তাই না? আহারে জীবন,দুঃখ বলতে যদি কিছুই নাই থাকতো জীবনে তাহলে কতই না ভালো হতো।
শরীরে ভেজা অনুভব হতেই রজনীর ধ্যান ভাঙলো। বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে। কই আকাশ দেখে তো মনে হয় নি বৃষ্টি আসবে। আকাশ কি বুঝে গেছে রজনীর মন? তার এই বৃষ্টি টাকেই মিস করছিলো। আর আকস্মিক আজও বৃষ্টি নামছে। মুহূর্তে আকাশ টা কেমন কালো হয়ে গেলো। সবাই দৌড়াদৌড়ি করে ছাউনির তলে যাচ্ছে। সাদমান বৃষ্টি দেখে রজনীর হাত টেনে ধরলো বৃষ্টি থেকে বাঁচার জন্য। রজনী তাকালো সেই হাতের দিকে। কিয়ৎ ক্ষন নিষ্পলক চেয়ে থেকে বলল-
-“ ভিজতে চাই আজ বৃষ্টি তে। আই লাভ রেইন। প্লিজ?
সাদমান হাত ছেড়ে দিলো। বসে পড়লো ফের বালিতে। বৃষ্টির পানিতে ভিজে গেলো দুটো দেহ। রজনী ফিল করছে এই বৃষ্টি কে। আর সাদমান তাকিয়ে দেখছে তার বৃষ্টি বিলাসী প্রিয়তমা কে। সাদমানের বুকের ভেতর কেমন ঢিপঢিপ করে আওয়াজ হচ্ছে৷ কিন্তু কেনো? রজনী কে দেখে? হ্যাঁ তাকেই দেখে। বৃষ্টির ফোঁটা মুখে পড়ায় কেমন ঘনঘন পলক ফেলছে। গোলাপি ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। সাদমান এর কেমন ঘোর লেগে আসছে। ঐ গোলাপি ঠোঁট জোড়া ছুঁইয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। হাত টাও বাড়ালো। হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকে উঠায় নিজের হুঁশে ফিরলো সাদমান। একটু আগে করা ভাবনায় ভীষণ লজ্জিত। এদিকে ঠান্ডা বাতাসের তীব্রতা ও বেড়ে গেলো। শীত শীত লাগছে। সাদমান সয়ে নিচ্ছে সেই ঠান্ডা একমাত্র রজনীর জন্য। চারিদিকে আঁধার ঘনিয়ে আসতেই রজনীর মনে হলো এখন বাসায় ফেরা উচিত। সেজন্য সাদমান এর দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ বাসায় ফেরা যাক এখন তাহলে?
-“ হু।
সাদমান বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। পা বাড়াতেই রজনী হাত মুঠোয় নিলো। সাদমান তাকালো সেই হাতের দিকে। রজনীর দৃষ্টি সামনে। সাদমানের শরীরে উত্তেজনা কাজ করছে। এক আকাশ সম ভালো লাগার উত্তেজনা। রজনী নিজ থেকে তার হাত ধরেছে! সাদমান এর চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছে-“ শুনো পৃথিবী দেখো আমার ভালোবাসা আমার হাত ধরেছে।
কিন্তু পারছে না। চেপে রাখলো হৃদয়ে। গাড়ির কাছে আসতেই রজনী হাত ছেড়ে দেয়। গাড়িতে উঠে বসে। সাদমান বাড়ির দিকে রওনা হয়।
নিজের রুমে শরীরে চাদর জড়িয়ে শাফায়াত এর কোলে পা দিয়ে সোফায় বসে আছে রুয়াত। শীতে আর টিকতে না পেরে আলমারি থেকে চাদর বের করে জড়িয়ে নিয়েছে। শাফায়াত ল্যাপটপে কাজ করছে। সামনেই টেবিলে কফি ভর্তি দু মগ। যেটা একটু আগে রুয়াত বানিয়ে নিয়ে এসেছে। শাফায়াত কে এতো গভীর ভাবে কাজে মনোযোগ থাকতে দেখে রুয়াতের ভালো লাগলো না। সেজন্য শাফায়াত এর কোলে পা নাড়াচাড়া করতে লাগলো। শাফায়াত গম্ভীর কন্ঠে বলল-
-“ আহ্ বিরক্ত করো না রুয়াত। ইম্পর্ট্যান্ট কাজ করছি।
রুয়াত কফির মগ নিয়ে চুমুক বসিয়ে বলে-
-“ কি ইম্পর্ট্যান্ট কাজ আমাকেও বলেন।
-“ ভার্সিটির। তোমাদের না সামনে ইয়ার চেঞ্জ পরীক্ষা? পড়তে বসো না কেনো?
রুয়াত কান দিলো না সে কথায়।
-“ আজকের ওয়েদার রা জোশ তাই না?
-“ হ্যাঁ তার জন্য শীতে আজ গোসল করো নি খচ্চর।
রুয়াত শাফায়াত এর বাহুতে ধাক্কা দিলো।
-“ এত শীত দেখছেন না? আমি গোসল করে শরীর কে কষ্ট দিতে যাব কেনো?
-“ আহামরি ও শীত না। চাইলেই রাজি হলে পারতে গোসল করতে। এক সঙ্গে। ইউ নোও হোয়াট আই মিন? ভ্রু নাচিয়ে বলল শাফায়াত।
রুয়াত গরম কফির মগ দেখিয়ে বলল-
-“ এটা ঢেলে দিব বুকের উপর তখন ঝলসে যাবে বুকটা। ভালো লাগবে?
শাফায়াত মাথা এলিয়ে দিয়ে টেনে শ্বাস ছেড়ে বলে-
-“ তুমি ভালোবেসে যা দিবা। আমি সাদরে তা গ্রহণ করে নিব মিসেস নোয়াস।
রুয়াত এগিয়ে আসলো। শাফায়াত এর শার্টের বুতাম টা খুলে মগ টা চেপে ধরলো। শাফায়াত মুচকি হেসে তাকিয়ে রইলো রুয়াতের চোখের দিকে। রুয়াত শাফায়াকে নিশ্চুপ থাকতে দেখে কফির মগ সরিয়ে আনলো। কিন্তু শাফায়াত সময় নিলো না রুয়াত কে টেনে ঠোঁটে ঠোঁট ডুবিয়ে দিতে। আকস্মিক এমন হওয়ায় গরম কফির মগ হাত থেকে পড়লো ফ্লোরে। মিনিট পাঁচেক পর শাফায়াত ছেড়ে দিলো।
-“ এটা কি ছিলো?
শাফায়াত নিজের বুকের দিকে তাকিয়ে বলে-
-“ ভিটামিন সি নিলাম। ঘাটতি ছিলো দেহে সেজন্য।
-“ ঠান্ডা হওয়ার পরই মগ চেপে ধরছি। তাই বইলেন না সত্যি সত্যি ঝলসে দিছি বুক।
শাফায়াত হাসলো। পুনরায় ল্যাপটপ টা কোলে নিয়ে বলল-
-“ পড়তে বসো। প্রস্তুতি নাও এক্সাম এর।
বৃষ্টি শেষ হয়েছে রাত ১১ টার দিকে। বৃষ্টি থামার পরই ক্লাব থেকে বাসায় এসেছে রোহান। রাতের রান্না টা বুয়া করে যায় নি। বিরক্তির অনুভব হচ্ছে তার জন্য। রান্না ঘরে আসলো। তিন প্যাকেট নুডলস থাকায় চটপট সেটা রান্না করলো। প্লেটে পরিবেশন করে রুমে এসে বসতেই পেকেটে থাকা ফোন বেজে উঠে। রোহান প্লেট টা টেবিলের উপর রেখে ফোন টা বের করে দেখে নীতির ফোন। রোহান রিসিভ করলো না। সাইডে রেখে দিলো। ফোন টা কেটে যেতেই আবার বেজে উঠলো। পরপর তিনবার এমন হলো। চারবারের মাথায় রোহান রিসিভ করলো। ধমকের স্বরেই বলল-
-“ হোয়াট’স রং উইথ ইউ নীতি? এতো ফোন কেনো দিচ্ছিস?
নীতি ভয় পেয়ে গেলো আকস্মিক এমন ধমকে।
-“ একটু আপনার গলা শুনতে ইচ্ছে করছিলো। সেজন্য ফোন দিয়েছি। তাই বলে এভাবে রাগ করবেন?
-“ শুনেছিস গলার আওয়াজ?
-“ হু।
-“ এখন রাখি। ঘুমিয়ে পড়।
রোহান কে’টে দিলো ফোন। নীতির সাথে রুড আচারণ ই করতে হবে এখন থেকে। তা না হলে নীতি আরো বাড় বাড়বে। রোহান আর চায় না এসব। নীতির এসব কে প্রশ্রয় দিলে নেহাল ভাববে রুয়াত কে না পাওয়ায় তার বোনের কাছে ফিরে এসেছে সে।
নীতি ফোনের স্কিনে নিষ্পলক চেয়ে রইলো। লোকটা কবে বুঝবে তার মন? আর কত অপেক্ষা করবে সে? কবে তার অপেক্ষার ফল মিষ্টি হবে?
#চলবে?
#গোধুলির_শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#পর্ব২৭
#Raiha_Zubair_Ripti
কেটে গেছে একটা সপ্তাহ। আজ নাইমুর এসেছে তার মা কে নিয়ে শাফায়াত দের বাসায়। বিয়ে নিয়ে কথা বলতে। রজনী চলে গেছিলো তার নিজ বাসায় তার পরের দিন সকালেই। রুয়াত সানজিদা কে সাজিয়ে নিয়ে এসেছে। পড়নে মিষ্টি কালারের শাড়ি। মাথায় ঘোমটা। নতুন বউ লাগছে। নাইমুর চোখ সরাতেই পারলো না সানজিদার থেকে।
শাফায়াত এর মা শারমিন বেগম আর নাইমুর এর মা নূর জাহান কথা বলছেন বিয়ের ডেট নিয়ে। পাশেই শাফায়াত বসে ফোন স্ক্রোল করছে। রুয়াত রান্না ঘরে গেলো জগে পানি আনতে। সেটা দেখে শাফায়াত ও পেছন পেছন গেলো। রুয়াত পানি নিয়ে পেছন ঘুরতেই দেখে শাফায়াত বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে আছে। সকাল থেকে মেয়েটা খেটেই যাচ্ছে। রান্না বান্না থেকে শুরু করে ঘর গুছানো,সানজিদা কে সাজানো এভরিথিং।
-“ এখানে কেনো আপনি? যান গিয়ে বসুন। কিছু লাগলে বলুন এনে দিচ্ছি।
শাফায়াত এগিয়ে আসলো। মিহি কন্ঠে বলল-
-“ তোমাকে দরকার।
কথাটা বলেই রুয়াতের থেকো জগ টা হাতে নিয়ে হাঁটা ধরলো।
-“ চুপচাপ বসে থাকবা। সকাল থেকে অনেক কাজ করছো। খাবার সার্ভ করা সেটা আমি আর আম্মু পারবো।
সোফার কাছে এসে সোফায় বসতে বলে হাত ছেড়ে দিলো। রুয়াত বসলো সোফায়। শাফায়াত গ্লাসে পানি ঢেলে সোফায় বসলো।
নূর জাহান জানান অতি শীগ্রই সানজিদা তার বাড়ি নিয়ে যেতে চান। শারমিন বেগম আপত্তি জানালেন না তা নিয়ে। দুই পরিবারের সম্মতি তে বিয়ের ডেট ফিক্সড হলো সামনের সপ্তাহে। খুব বেশি আয়োজন হবে না। মিডিয়াম পরিসরে বিয়ে টা হবে।
দুপুর হতেই শারমিন বেগম রুয়াত কে বলল টেবিলে খাবার সাজাতে। রুয়াত জ্বি বলে উঠতে নিলে শাফায়াত বাঁধা দিয়ে বলে-
-“ রুয়াত বসুক আম্মু। খাবার সার্ভ তো আমি করে দিচ্ছি।
রুয়াত উঠে দাঁড়ালো।
-“ আপনা কে করতে হবে না। আমি পারবো।
শাফায়াত পাত্তা দিলো না সেই কথা৷ আগে আগে হাঁটা শুরু দিয়ে টেবিলের কাছে এসে খাবার সার্ভ করতে লাগলো। পেছন পেছন রুয়াত ও আসলো। তবে শাফায়াত তার বাঁধা শুনলো না। উপায়ন্তর না পেয়ে রুয়াত শাফায়াত এর হাতে হাতে সাজাতে লাগলো টেবিল।
নূর জাহান সেটা দেখে মুচকি হাসলো। বলল-
-“ বাহ্ শাফায়াত তো ভারী বউ পাগল। ভালোই সংসারে ঝগড়া হবে না।
শারমিন বেগম প্রতিত্তোরে হাসলো। নূর জাহান কে নিয়ে উঠে আসলো। নাইমুর উঠে আসার সময় সানজিদা কে ফিসফিস করে বলল-
-“ আমি ও এমন বউ পাগল হবো দেখে নিও।
সানজিদা হাসলো। বউ পাগল ছেলে রা সত্যি অসাধারণ। বিশেষ করে তারা, যারা মা কে মায়ের জায়গায় আর বউ কে বউয়ের জায়গায় রেখে সমান তালে এগিয়ে যায়।
খাবার টেবিল জুড়ে বইছে নানা রকমের খাবারের বাহার। পোলাও,রোস্ট, টিকা,দই,মিষ্টি, পায়েস,গোস,ডাল,ডিম। চোখ জুড়িয়ে আসলো শারমিন বেগম এর। সে আজ রান্না ঘরের ধারে কাছেও যায় নি। তার ছেলের বউ একা হাতে এতো রান্না করেছেন” সত্যি প্রসংশা না করে পারছেন না।
সবাই বসে খেয়ে নিলো দুপুরের খাবার। বিকেল হতেই চলে গেলো নাইমুর তার মা কে নিয়ে।
সন্ধ্যার দিকে গোল বৈঠক বসে বসার ঘরে। বিয়ে সামনের সপ্তাহেই। শারমিন বেগম আত্নীয় দের ইনভাইট করে দিলেন। সাথে রুয়াতের বাপের বাড়ির সকল কে।
রুয়াত সোফার এক কোনে বসে তাদের ব্যস্ততা দেখছে। শাফায়াত লিস্ট বানাচ্ছে। আহ! পুরুষ টা তার কতই না খাটবে বোনের বিয়েতে। রুয়াত ফিসফিস করে বলে উঠল-
-“ ঠান্ডা শরবত এনে দিব? যে হারে পরিশ্রম করছেন।
-“ শাফায়াত তাকালো। শারমিন বেগম ফোন কানে করে চলে গেলেন। হয়তো নেটওয়ার্কে সমস্যা তাই কথা বলতে গিয়েছে অন্য সাইডে। শাফায়াত কলম টা টেবিলের উপর রেখে পূর্ণ দৃষ্টি রুয়াতের দিকে দিয়ে বলল-
-“ ভিটামিন সি দিবা? আই নিড দ্যিস।
রুয়াত সোজা হয়ে বসলো। এতোক্ষণ ঝুকে ছিলো।
-“ আপনি এতো অভদ্র কেনো? আমি তো আপনার ভালোর জন্যই বলেছি এটা। শয়তানি না করলে চলে না?
-“ না চলে না৷ শুধু তোমাকে দেখলেই আমার শয়তানি টা বেড়ে যায়। তা না হলে আমি অনেক ভদ্র পুরুষ। ইউ নোও না?
রুয়াত এবার সরু চোখে তাকালো।
-“ আমি সিরিয়াস কিন্তু। শরবত বা ঠান্ডা কিছু লাগলে বলুন নিয়ে আসি। আমি কিন্তু চলে যাব রুমে।
-“ আমিও কিন্তু সিরিয়াসলি বলছি রুয়াত। আই নিড ভিটামিন সি। আজ নিতে পারি নি ভিটামিন সি। তোমার তো দায়িত্ব রোজ নিয়ম করে তিন বেলা ভিটামিন সি সাপ্লাই করা।
রুয়াত বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। রুমের দিকে যেতে যেতে বলে গেল-
-“ অসভ্য।
শাফায়াত পেছন থেকে বলে উঠল-
-“ তার জন্য কি তুমি দায়ী নয়?
-“ মোটেও না।
-“ মোটেও হ্যাঁ। উসকিয়ে ছো তুমি আমায়। এখন তার ঝাঁঝ তো নিতেই হবে।
রুয়াত মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলো।
রুমে আধশোয়া হয়ে শুয়ে আছে সাদমান। সেদিন ভেজার পর থেকে শরীরে জ্বর। রুয়াত রুমে যাওয়ার আগে সাদমান কে দেখতে চলে আসলো। দরজায় কড়া নেড়ে বলল-
-“ আসবো?
সাদমান দরজার দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ হ্যাঁ রুয়াত আসো।
রুয়াত রুমের ভেতর ঢুকে বলল-
-“ কেমন আছেন এখন জ্বর কমেছে?
-“ হ্যাঁ কিছুটা কমেছে।
-“ ওহ্। আচ্ছা থাকুন তাহলে আসি। কিছু দরকার হলে টেক্সট করে জানাবেন।
-“ আচ্ছা।
রুয়াত রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমের দিকে হাঁটা ধরলো। কাছে আসতেই ফোনে নোটিফিকেশন আসলো। সাদমান মেসেজ পাঠিয়েছে-
-“ তুমি বলেছো কিছু দরকার হলে তোমায় মেসেজ দিতে। আই নিড ইউর সিস্টার। প্লিজ ডু সামথিং।
রুয়াত রজনীর নম্বরে কল লাগালো। রজনী ঊষার সাথে কথা বলছিলো। রুয়াতের কল পেয়ে ঊষার থেকে বিদায় নিয়ে কল রিসিভ করলো।
-“ কেমন আছিস রুয়াত?
-“ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। কিন্তু একজন ভালো নেই।
-“ কে?
-“ সাদমান ভাইয়া। তুমি তাকে কল দিয়ে একটু খোঁজ-খবর নাও। তার ভালো লাগবে।
-“ হ্যাঁ আমি ভেবেছিলাম ফোন দিব। কিন্তু হয়ে উঠে নি। এখনই দিচ্ছি।
রুয়াত কেটে দিলো ফোন। রজনী কল করলো সাদমান এর নম্বরে। সাদমান ফোন হাতে নিয়ে তাকিয়ে ছিলো। হুট করে ফোন আসতেই হাত থেকে সেটা পড়ে গেলো। তড়িঘড়ি করে ফোনটা উঠিয়ে কানে নিয়ে বলল-
-“ আসসালামু আলাইকুম রজনী । কেমন আছেন?
-“ ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেমন আছেন এটা জিজ্ঞেস করার কথা ছিলো আমার। আর আপনি জিজ্ঞেস করে বসলেন। সে যাই হোক। আমি ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন এখন?
-“ আপনার কন্ঠস্বর শুনে এখন একদম ফাস্ট ক্লাস আছি।
-“ কেনো আমার কন্ঠে কি মেডিসিন লাগানো নাকি? যে শুনলেন আর ভালো হয়ে গেলেন?
-“ ধরে নিন কিছুটা তাই।
-“ আচ্ছা ধরলাম। তা ওষুধ খেয়েছিলেন দুপুরে?
-“ হ্যাঁ খেয়েছি।
-“ আপনার শরীর টা তো দেখছি মেয়েলি শরীরের থেকেও বাজে। আমি ভিজলাম অথচ আমার জ্বর আসলো না। আর আপনার সেদিন রাতেই চলে আসলো! ফরেনার বলে কথা।
-“ তা যা বলেছেন। বউয়ের সাথে বৃষ্টি বিলাস করতে গেলে আগাম মেডিসিন খেয়ে তারপর ভিজতে হবে। তা না হলে সাময়িক সুখের জন্য একমাস বেড রেস্টে থাকতে হবে।
-“ বউয়ের জন্য সামান্য এইটুকু সহ্য করতে পারবেন না?
-“ সহ্য করতে পারি বলেই তো বিয়ে না হয়েও এক রমণীর জন্য ভিজে অসুখ বাঁধিয়ে বিছানায় শুয়ে আছি।
-“ রমণী কে নিয়ে গিয়েছিল কে? রমণী কি বলেছিল সে যাবে ওখানে?
-“ তা বলে নি। তবে…
-“ তবে কি?
-“ তার মুখে হাসির কাছে এই জ্বর নিছকই ফিকে।
-“ পাম দিয়ে পটাতে চান আমায়?
-“ সত্যি বলায় যদি পাম হয়। আর সেই পামে যদি পটে যান তাহলে এরকম সত্য পাম হাজার দিব।
-“ আচ্ছা আচ্ছা হয়েছে। রাতের খাবার টা খেয়ে মেডিসিন খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। আল্লাহ হাফেজ।
সাদমান শুধু হুমম বলল। রজনী কে’টে দিলো ফোন। সাদমান নির্নিমেষ চোখে চেয়ে রইলো ফোনের দিকে।
স্টেশনের বেঞ্চে বসে আছে রোহান নেহাল আর নীতি। চলে যাব নীতি আজ তার নিজ ঠিকানায়। যেখানে সারা বছরের এক বড় অংশ সময় অতিবাহিত করতে হয়। রোহান আসতে চায় নি কিন্তু নীতির জন্য না এসেও পারলো না। ফোন করে করে কান পচিয়ে ফেলছে। নেহাল মাঝখানে বসে আছে। ট্রেন আসতেই নীতি নেহাল উঠে দাঁড়ালো। নেহাল বোন কে জড়িয়ে ধরলো। আদর করলো। ফোন আসতেই একটু সাইডে চলে গেলো। আবার ছুটি পাবে তবেই আসতে পারবে। নীতি ল্যাগেজ নিলো। রোহান এখনও নিশ্চুপ হয়ে বসে ফোন স্ক্রোল করছে। নীতি একঝলক তাকালো। তারপর ফিসফিস করে বলল-
-“ আপনার হৃদয় টা পুড়ছে না? আমার খুব পুড়ছে হৃদয় টা। কত গুলো দিন আবার না দেখে থাকতে হবে আপনাকে। ফোন দিলে একটু ধরবেন কেমন? আমি নিশ্চুপ হয়ে আপনার কন্ঠ শুনবো। বিরক্ত মোটেও করবো না। আর রাজনীতি করছেন করুন। একটু দেখেশুনে করবেন কেমন? আপনার যেনো কিছু না হয়। তাহলে হয়তো পৃথিবীতে সেদিন অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দিবে আমার জন্য।
রোহান উড়ে দাঁড়ালো। ফোন টা পকেটে ঢুকিয়ে সোজাসুজি প্রশ্ন করলো-
-“ ভালোবাসিস আমাকে?
ভালোবাসিস আমাকে? কথাটা এতো নিদারুণ লাগলো কেনো নীতির কাছে? মনে হলো কিছুটা স্বর্গীয় সুখের ঘ্রাণ পেলো। নীতি কে চুপ থাকতে দেখে রোহান তাড়া দিয়ে বলল-
-“ চুপ কেনো? বল বাসিস ভালো আমায়?
নীতির কেমন যেনো কেঁদে দিতে ইচ্ছে করলো। চোখ টলমল করলো। কোনোরকমে মাথা নাড়ালো উপর নিচ।রোহান সময় ব্যয় করলো না নীতি কে জড়িয়ে ধরতে। মাথায় চুমু খেয়ে বলল-
-“ বাসিস না আর ভালে নীতি। ভুলে যাস আমায়। তোর যোগ্য নই আমি। আমি স্বার্থপর হতে চাই না। তোর ভালোবাসা কে স্বীকার করতে গেলো লোকে বলবে আমি স্বার্থপর, সুবিধাবাদী। নিজের স্বত্বা কে হেয়ো করতে চাই না। ভুলে যা আমায়। আজকের পর থেকে আমাকে নিয়ে ভাবিস না। সুখ পাবি না আমাকে নিয়ে ভাববে দুঃখ ছাড়া। ভালো থাকিস।
রোহান ছেড়ে দিলো নীতি কে। নীতি বরফের মতো জমে গেলো। কি বলল এটা রোহান? তাকে ভুলে যেতে! আট বছরের ভালো লাগা, ভালোবাসা কে সে ভুলে যাবে? নেহাল কথা বলে শেষ করে চলে আসলো বোনের কাছে। বোনের ল্যাগেজ টা হাতে নিয়ে বোনের এক হাত ধরে ট্রেনে উঠিয়ে দিলো। ট্রেন ছাড়ার জন্য উদ্যোত হলো। নীতি জানালা দিয়ে তাকালো। রোহান তাকিয়ে আছে তার দিকেই। হাত উঁচা করে বিদায় জানাচ্ছে। আকাশী কালার শার্টে কি সুন্দর লাগছে লোকটা কে। লোকটা কি তার অপ্রাপ্তি তেই থেকে যাবে? নীতি শুনেছে কোথাও। ভালোবাসা সত্যি হলে না পাওয়ার অপেক্ষায় ও নাকি অনেক মানুষ তার কাঙ্খিত মানুষ টিকে পেয়ে যায়। আচ্ছা নীতি অপেক্ষা করলে কি সেও পাবে তার এই কাঙ্খিত মানুষ টি কে? পেতেও তো পারে। হ্যাঁ সে অপেক্ষা করবে সেই দিনটির যেদিন রোহান নিজ থেকে এসে তাকে স্বীকার করবে। কেটে যাক এক যুগ তাতেও নীতি রাজি অপেক্ষা করতে।
#চলবে?