গোধুলির শেষ বিকেলে তুমি আমি পর্ব-২৮+২৯

0
95

#গোধুলির_শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#পর্ব২৮
#Raiha_Zubair_Ripti

মধ্য দুপুরে শাফায়াত এসেছে পুরো ফ্যামিলি নিয়ে বসুন্ধরা শপিংমলে। শারমিন বেগম মেয়েকে বিয়ের শাড়ি সিলেক্ট করে দিচ্ছে। রুয়াত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তা দেখছে। সাদমান আর শাফায়াত গিয়েছে পুরুষদের মলের দিকে। সাদমান নিজের জন্য পাঞ্জাবি, শার্ট প্যান্ট,জুতা,ঘড়ি, পারফিউম কিনে নিলো। এদিকে শাফায়াত একটা কিছুও নিজের জন্য চুস করতে পারছে না। সাদমান তার জিনিস গুলো কাউন্টারে দিয়ে শাফায়াত এর দিকে এগিয়ে এসে বলল-
-“ হলো তোমার ব্রো?
শাফায়াত জুতা দেখতে দেখতে বলল-
-“ এখনও হয় নি। কিছুই পছন্দ হচ্ছে না।
-“ আমি পছন্দ করে দিব?
-“ দে দেখি।
সাদমান ঘুরে ঘুরে পাঞ্জাবি শার্ট, প্যান্ট জুতা,চুস করে দিলো। শাফায়াত এর তেমন পছন্দ হলো না। তবুও সময় ওয়েস্ট হবে ভেবে সাদমান এর পছন্দ করে দেওয়া গুলোই নিয়ে নিলো। তারপর বিল পে করে চলে আসলো রুয়াত দের কাছে।

রুয়াত নিজের জন্য এখনও কিছু কিনে নি। তার শ্বাশুড়ি আর ননদেরই এখনও কেনা হয় নি। তবে এদিক ওদিক চোখ বুলিয়ে দেখছে। শারমিন বেগম রুয়াত কে তার পাশে বসে থাকতে দেখে বলে উঠল-
-“ তুমি বসে আছো কেনো রুয়াত? যা পছন্দ হয় নিয়ে নাও।

রুয়াত উঠে দাঁড়ালো। এই দোকানে থাকা পিংক কালারের একটা শাড়িতে চোখ আঁটকে যায় রুয়াতের। রুয়াত দোকানদার কে বলে শাড়ি টা দেখাতে। দোকানদার শাড়ি টা বের করে মেলে ধরে। রুয়াত শাড়ি টা ছুঁয়ে দেখে। হঠাৎ পেছন থেকে ভেসে আসলো-
-“ শাড়ি টায় দারুন মানাবে তোমায়।
রুয়াতের ওষ্ঠে হাসি ফুটলো। সহসা পিছু ফিরলে শাফায়াত এর বুকে গিয়ে ঠেকলো রুয়াতের পিঠ।
-“ সত্যি মানাবে আমায়?
-“ অবশ্যই।
-“ শাড়ি টা প্যাক করুন। আচ্ছা আপনি কি কিনলেন নিজের জন্য?
শাফায়াত হাতের প্যাকেট গুলো দেখিয়ে বলল-
-“ সাদ পছন্দ করে দিলো। আমার চয়েস ভীষণ বাজে। তবে ভুল করে হলেও তোমার শাড়ির সাথে আমার পাঞ্জাবি ম্যাচিং হয়েছে।
-“ ম্যাচ না হলেও আমি ম্যাচিং করে ঠিক আবার পাঞ্জাবি কিনাতাম।
শাফায়াত হাসলো। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ তোমার শ্বাশুড়ি ননদের এখনও কেনা শেষ হয় নি দেখছি।
-“ হ্যাঁ।
-“ তা তোমার কেনা শেষ?
-“ হু।
-“ জাস্ট একটা শাড়ি তেই হয়ে গেলো!
-“ আর কি কিনবো?
-“ আশ্চর্য গায়ে হলুদ বউভাত তার জন্য কিনবা না? জামাইয়ের টাকা বাঁচাতে চাইছো নাকি আমি কিপ্টে কোনটা?

পাশ থেকে সাদমান বলে উঠল-
-“ রুয়াত ব্রো এর মন কিন্তু অনেক বড় বুঝলে। তোমার যা পছন্দ হয় সব লুফে নাও আমার মতো।
রুয়াত আর দুটো শাড়ি নিয়ে নিলো। শাফায়াত সাদমানের কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল-
-“ সামনে তো তুই ও করবি বিয়ে। তোর বিয়েতে আমি আর রুয়াত তোকে ফতুর বানিয়ে ছাড়বো।
সাদমান হাই তুলতে তুলতে বলে-
-“ আমি বিয়ে করবো এক কাপড়ে কোর্টে গিয়ে। নো অনুষ্ঠান নো শপিং।
শাফায়াত সাদমানের কান টেনে ধরে বলে-
-“ তুই তো হাড়কিপটে।
-“ সে তো আমি আগে থেকেই। এখন কান ছাড়ো। মানসম্মান রাখবে না দেখছি লোকজনের সামনে।

শাফায়াত কান ছেড়ে দিলো। কেনাকাটা শেষে সন্ধ্যার সময় হাল্কা পাতলা খানাপিনা করে বাসায় আসে সবাই।

রুয়াত বাহির থেকে এসেই ওয়াশরুমে ঢুকে যায় গোসল সারতে। বিছানা জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে শপিং ব্যাগ। শাফায়াত সেগুলো এক এক করে আলমারি তে রেখে দেয়। শরীর চুলকাচ্ছে ভীষণ। গোসল না করলেই নয়। ওয়াশরুমের দরজায় গিয়ে টুকা দিলো শাফায়াত। রুয়াত ভেতর থেকেই বলে উঠল-
-“ কি?
-“ একটু খুলো তো।
-“ কেনো?
-“ এক নম্বর পেয়েছে।
-“ আমার গোসল শেষ হোক তারপর।
-“ আরে ততক্ষণ চেপে রাখতে পারবো না। বেরিয়ে আসবে।
-“ তাহলে সাদমান ভাইয়ার রুমে যান।
-“ আশ্চর্য একটু খুলো। আমি কি বাহিরের লোক? তোমার স্বামী ই তো খুলো।

রুয়াত একদম ভেজা জামাকাপড় চেঞ্জ করে শুকনো জামাকাপড় পড়ে দরজা খুলে। শাফায়াত ভেতরে ঢুকতে নিলে রুয়াত বেরিয়ে আসে। অবাক হয়ে বলে-
-“ বেরিয়ে আসলে কেনো?
রুয়াত টাওয়াল দিয়ে মাথার চুল মুছতে মুছতে বলল-
-“ আপনিই তো তাড়া দিলেন সেজন্য।
-“ আশ্চর্য আমি জাস্ট দরজা টা খুলতে বলেছি। তোমাকে বের হয়ে আসতে বলি নি।
-“ আমি বের না হলে আপনি হিশু করবেন কিভাবে?
শাফায়াত চোখ ছোট ছোট করে বলল-
-“ আমি কখন বললাম আমি হিশু করবো?
-“ কেনো আপনিই তো বললেন আপনার এক নম্বর পেয়েছে। আর এক নম্বর মানেই তো ওটা।
-“ ইডিয়ট। বুঝিয়েছি আমার প্রেম পাচ্ছিলো।
রুয়াত ভ্রু কুঁচকে তাকালো। রেগে বলল-
-“ এক নম্বর মানে প্রেম?
-“ হু।
-“ আপনার মাথা, গরু একটা।
শাফায়াত হাত টেনে রুয়াত কে কাছে আনলো। ঘাড়ে মুখ গুঁজে দিয়ে নেশালো কন্ঠে বলল-
-“ ছ্যাত করে উঠো কেনো রমণী, আমার হৃদয়ে আগুন জ্বালিয়ে?
রুয়াত শাফায়াত এর থেকে নিজেকে ছাড়াতে ছাড়াতে বলল-
-“ মেয়েদের কাজই পুরুষের হৃদয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া।
-“ নিভানোর শেষ ক্ষত স্থানে মলম টাও তো লাগিয়ে দেওয়া মেয়েদের কাজের মধ্যেই পড়ে।
-“ উমম মন্দ বলেন নি তা। তবে আমি তো মলম লাগাতে জানি না। আমি আগুনে আরো ঘি ঢেলে দিতে জানি। জানেন কি করে সেটা?
-“ কি করে?
রুয়াত শাফায়াতের মুখ দু হাতে ধরে কাছে টেনে আনলো। দুজনের মুখ ছুঁয়ে যাচ্ছে একে ওপরের মুখের সাথে। রুয়াত ঠোঁট কামড়ে তারপর শাফায়াত এর ঠোঁটে চুমু খেয়ে কামড় বসিয়ে দিলো।
শাফায়াত ব্যথায় চোখ খিঁচে ধরলো। তবে ছাড়লো না রুয়াত কে। আগের তুলনায় শক্ত করে চেপে ধরলো এবার কোমড় টা।
রুয়াত ছেড়ে চলে আসতে নিলে শাফায়াত চেপে ধরে ঠোঁট। মিনিট দশেক পর মনের খায়েশ মিটলে ছেড়ে দেয় রুয়াত কে। ওয়াশরুমের দিকে যেতে যেতে বলে যায়-
-“ আগুনে ঘি ঢাললে তার তেজ তো সইতেই হবে বউ। বাকিটা রাতে কাছে আসলে পুষিয়ে নিব।

রুয়াত ওড়নার আঁচল দিয়ে ঠোঁট মুছে বলে-
-“ আপনার কাছে আজ আসবোই না। সানজিদার রুমে গিয়ে ঘুমাবো।
-“ আই হ্যাভ নো প্রবলেম। সানজিদা কে আমার রুমে পাঠিয়ে দিব। আর আজ বাদে তো কাল সানজু চলেই যাবে।
-“ ওর সাথে সাথে আমিও চলে যাব আমার বাপের বাড়ি।
-“ ঘর জামাই হয়ে থাকলে তোমার বাপ জানেরই মানসম্মান যাবে আমার না।
-“ ঢুকতেই দিব না আমাদের বাসায়।
-“ তাহলে আর কি পটুয়াখালী যেতে হবে জব….
-“ জা’নে মে’রে রেখে দিব ব এর পরে আকার টা উচ্চারণ করলে।

শাফায়াত হেঁসে ওয়াশরুমের দরজা বন্ধ করে দিলো।

ছাঁদের দোলনায় বসে রোহান। সামনেই টেবিলে বিভিন্ন রকমের বিদেশি ড্রিংকস। নেহাল আর রবিন ড্রিংকস ঢালছে গ্লাসে। রোহান নির্নিমেষ চোখে চেয়ে আছে আকাশে।
নেহাল ড্রিংকস এর গ্লাস টা বাড়িয়ে দিলো রোহানের। রোহানের সেদিকে হুঁশ নেই। নেহাল মৃদু ধাক্কা দিলো। রোহান হুঁশে ফিরলো। গ্লাস টা হাতে নিয়ে কিয়ৎ ক্ষন তাকিয়ে থেকে বলল-
-“ জীবনে আমাদের কিসের পেছন ছোটা উচিত নেহাল?
নেহাল ড্রিংকস এ চুমুক দিয়ে বলল-
-“ জীবন নিজ থেকে যা দিবে সেটার পেছন।
-“ তার মানে যেটা দিবে না সেটা পাওয়ার চেষ্টা করবো না আমরা?
-“ উমমম চেষ্টা করে কি লাভ? পাওয়ার হলে তো সেটা পেয়েই যেতাম আমরা।
-“ কেনো কথাতেই আছে একবার না পাড়িলে করো শতবার।
-“ শতবার করা মানে টাইম লস্ট বই আর কিছু না। শতবার চেষ্টা করার পর ও যখন অসফল দেখা দেয় তখন সময় চেষ্টা দুটোই বৃথা হবে। তাই সর্বোচ্চ গেলে তিন-চার বার চেষ্টা করা উচিত কোনো কিছুর পেছন। বাট বারবার না।
-“ হুমম বুঝলাম। বিয়ে করছিস কবে তা?
-“ খুব শীগ্রই। সুইটির এক্সাম টা শেষ হোক তারপর।
-“ যে ব্যক্তি তার ভালোবাসার মানুষটিকে জীবন সঙ্গী হিসেবে পায়। আই থিংক সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। তাই না?
-“ আর যারা খাঁটি ভালোবাসা পেয়েও হারিয়ে ফেলে মরিচীকার পেছন ছুটে। ট্রাস্ট মি তার মতো দুর্ভাগা কেউ নেই পৃথিবীতে।
রোহানের মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটলো।
-“ সেই দূর্ভাগাদের কাতারে কি করে যেনো নাম দিয়ে ফেললাম আমি তাই না?
-“ সেটা আবার জিজ্ঞেস করছিস?
-“ করলামই না হয় একটু জিজ্ঞেস। এখন করণীয় কি আমার?
-“ কি করণীয় তা তুইই জানিস রোহু। তবে বললব- আমরা তাদের কে ভালোবাসবো যারা আমাদের কে ভালোবাসে। এমন কাউকে ভালোবাসবো না যাদের ভাবনার মাঝে ক্ষনিকের জন্য ও আমরা নেই।
-“ এটা করতে গেলে তখন সর্বপ্রথম তুইই আমার দিকে আঙুল তুলবি নেহাল।
-“ তুললে তুলবো। তুই চুপচাপ শুনে যাবি। দোষ করেছিস আর বললে শুনবি না তা?
-“ আমি তো শুনতে নারাজ।
-“ তাহলে রুমে গিয়ে বসে বসে মুড়ি দিয়ে ড্রিংসক খা যা শা’লা।
-“ আজকের ড্রিংকস এর টেস্ট এমন বাজে কেনো?
-“ কারন তর মন যে ছ্যাকা খেয়ে ভালো মন্দ বুঝতে ভুলে গেছে সেজন্য। এখন চুপচাপ মা’ল গিল আর তা না হলে রুমে যা।
-“ বউ এনে দে রুমে গিয়ে শুয়ে থাকি।
-“ বিয়ে কর গা, বউ পাবি।
-“ মেয়ে দিবে না কারো বাপ।
-“ ভিক্ষা কর। ফিতরা হিসেবে দিয়ে দিবে।
-“ সাইফুল ইসলাম এর বাড়ির সামনে গিয়ে দাঁড়াতে হবে। বলতে হবে সামনে ঈদ ফিতরা যেনো দেয় আমাকে।
-“ ফিতরা তোমার পা*ছা দিয়ে দিবে আমার বাপ।
-“ যেখান দিয়েই দিক,তবুও দিক।

———————-

-“ হেই মিস রজনী আমি কি খুব দেরি করে ফেলছি আসতে?
রজনী হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে সাদমান লেট করেছে আসতে গুনে গুনে বিশ মিনিট।
সাদমান গাড়ির দরজা খুলে ঢুকতে ইশারা করলো রজনী কে। সাদমান কে আজ পাঠিয়েছে রুয়াত রজনী কে নিয়ে আসার জন্য। বিয়ে বাড়ি বলে কথা। রজনীর বাবা মা বিয়ের দিন আসবে।

রজনী উঠে বসলো গাড়িতে। সাদমান গাড়ি স্টার্ট দিলো। সাউন্ড বক্সে বাজালো- এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো তুমি বলোতো?

রজনীর বেশ ভালো লাগে এসব গান। কেমন একটা আগের দিনের ভাইব আসে মনে। নব্বই দশকের ফিল হয়। সাদমান গাড়ি চালানোর ফাঁকে ফাঁকে বারবার রজনী কে দেখছে। রজনীর নজরে আসলো সেটা। চোখ বন্ধ করে বলল-
-“ পূর্ণ দৃষ্টি সামনে দিয়ে গাড়িটা ঠিকঠাক চালান। এদিক থেকে ওদিক হলেই সোজা পটল তুলতে উপরে চলে যেতে হবে।
সাদমান এক হাত দিয়ে মাথার চুল টেনে বলে-
-“ সমস্যা কি তাতে। উপরেই না হয় আপনি আর আমি একত্রে পটল তুলবো। সেই পটল বেচে সংসার চালাবো। ছোট্ট একটা ঘর বানাবো। সেখানে আপনি আর আমি বসবাস করবো।
-“ আপনাকে কিছু বলা যায় না। বললেই সেটাকে তাল থেকে তিল বানিয়ে সেম প্রেম ভালোবাসার দিকেই চলে যান।
-“ জীবনে এই দুটো ছাড়া আর কি আছে? প্রেম ভালোবাসা ছাড়া মানুষ বাঁচে নাকি?
-“ আপনি বেঁচে আছেন কেনো এখনও তাহলে?
-“ আপনার থেকে সাড়া পাওয়ার জন্যই তো বেঁচে আছি। আপনি সাড়া দিন আমার ডাকে। দেখুন জীবনে থাকা অবশিষ্ট দিন গুলো ভালোবাসায় রাঙিয়ে দিব।
-“ আপনি সিরিয়াস আমাকে নিয়ে?
-“ আজ জিজ্ঞেস করছেন সেটা!
-“ আমার ব্যপারে সব জানলে নিশ্চয়ই আর সিরিয়াস হবেন না।
-“ যা জানার জেনে নিয়েছি। আর জানতে চাই না।
-“ কি কি জেনেছেন?
-“ সেটা সিক্রেট। আপনি রাজি হয়ে যান শুধু।
-“ রাতে ছাঁদে আসবেন কেমন? কিছু কথা বলবো।
-“ আমি এতো কিছু শুনতে চাই না। হ্যাঁ টা শুনতে চাই, না টা না আবার।
-“ রাতে আসবেন তখনই জানাবো আমার ডিসিশন টা।
-“ আচ্ছা। আমি সন্ধ্যা থেকেই ছাঁদে অপেক্ষা করবো। আপনি চলে আসবেন চটজলদি ওক্কে?

#চলবে?

#গোধুলির_শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#পর্ব২৯
#Raiha_Zubair_Ripti

সূর্যাস্তের সাথে সাথে পৃথিবীতে অন্ধকার নেমে আসে। গোধূলির পরে আসে সন্ধ্যা, আর সন্ধ্যা যতই বাড়তে থাকে রাতের আগমণ ততই ত্বরান্বিত হয়। রাত মূলত প্রত্যেক মানুষের বিশ্রামের সময় বিশেষ কোন আনন্দঘন মুহূর্ত ও ভালোবাসার সময় কাটাবার জন্য রাতের জুড়ি নেই। তেমনই অনেক আশা নিয়ে উৎসুক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ছাঁদে সাদমান৷ ছাঁদের ওপর পাশে গায়ে হলুদের স্টেজ। বসে আছে সানজিদা। তার আশেপাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে লোকজন। পুরো ছাঁদ টা মরিচ বাতি দিয়ে সাজানো। ঝলমলে করছে সেই বাতির আলোয় পুরো ছাঁদ। সাদমান বারবার ঘড়ি দেখছে। রজনী কেনো আসছে না? সন্ধ্যার পর এক বারের জন্য ও তাকে দেখতে পারে নি সাদমান। শাফায়াত সাদমান কে ছাঁদের উল্টোপাশে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে এগিয়ে এসে বলে-
-“ একা একা দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?
সাদমান পাশে ফিরলো। শাফায়াত কে দেখে বিরস মুখে বলল-
-“ একটু পর দোকলা হবো। তুমি তোমার বউয়ের কাছে যাও,গো। আমাকে মিঙ্গেল হবার জন্য স্পেস দাও।
শাফায়াত বুঝলো না কথার মানে। সেজন্য ভ্রু কুঁচকে বলল-
-“ মিঙ্গেল হবি মানে?
-“ মিঙ্গেল মানে সিঙ্গেলের স টা বাদ দিয়ে ম টা লাগালে তো মিঙ্গেল ই হয়।
-“ মাথাটা গেছে নাকি একদম?
-“ হয়তো। এখন যাবে তুমি এখান থেকে?
শাফায়াত চলে আসলো। একটু পরই ছাঁদের দরজা দিয়ে রজনী কে প্রবেশ করতে দেখলো সাদমান। লেমন কালারের শাড়ি, শরীরে কাঁচা ফুলের গহনা। মাথায় বেলি ফুলের গাজরা। একদম সাদমান কে শেষ করে দেওয়ার মতো লুক। রজনী স্টেজের দিকে চলে গেলো। তা দেখে সাদমানের মুখ চুপসে গেলো। আশ্চর্য মেয়েটার কি মনে নেই তাকে যে সে অপেক্ষা করতে বলেছিল! এদিকে যে সাদমান অপেক্ষা করছে সেটা কি তার নজরে যায় নি?

রজনী রুয়াতের পাশে এসে বসলো। রুয়াত মুচকি হাসি উপহার দিলো। শারমিন বেগম সানজিদার গালে হলুদ ছুঁইয়ে দিচ্ছে। রুয়াতের পালা আসতেই রুয়াত শাফায়াত এক সাথে চলে যায়। সেই সুযোগে সাদমান এসে রজনীর পাশে বসে। রজনী ঘাড় বেঁকিয়ে তাকায়। সাদমান রাগান্বিত হয়ে তাকিয়ে আছে। এই রাগান্বিত চেহারা দেখে রজনীর মনে হলো সে তো সাদমান কে কিছু বলতে চেয়েছিল। নিজের মনকেই ইচ্ছে মতো বকে নিলো রজনী। মিহি কন্ঠে বলল-
-” সরি সাদমান। আমার একটু ও খেয়াল ছিলো না।
সাদমান গম্ভীর মুখে বলল-
-“ ইট’স ওকে। এখন তো মনে পড়েছে। তো এখন বলুন।
-“ এখানেই?
-“ এখানে বলতে না চাইলে আপনাকে নিয়ে কি নির্জন জায়গায় যাব?
-“ জায়গা টা একটু নির্জন হলে ভালো হয়।
-“ ওকে তাহলে চলুন।

সাদমান রজনীর হাত ধরে ছাঁদ থেকে নেমে গেলো বাগানে। এখন বাগানে কারো বেশি আনাগোনা নেই। সবাই ছাঁদে ব্যস্ত। রজনী কে দোলনায় বসিয়ে নিজেও বসলো। তারপর বলল-
-“ এবার বলুন।
রজনীর বুক টা ধুকপুক করছে। সব শোনার পর সাদমান কেমন রিয়াকশন করবে সেটা ভেবে। লম্বা করে শ্বাস নিলো। তারপর বলল-
-“ আপনি তো জানেন আমি সিজোফ্রেনিয়া রোগে আক্রান্ত, তার উপর ডিভোর্সেস। আরো একটা ক্ষুত আছে। বলতে পারেন ক্ষুত না অপূর্ণতা আছে আমার জীবনে। আমাকে বিয়ে করলে কখনও বাবা ডাক শুনতে পারবেন না…..
সাদমান সহসা রজনী কে জড়িয়ে ধরলো।
-“ লাগবে না বাবা ডাক শোনা। আমি বাচ্চা ছাড়াই কাটিয়ে দিব আপনার সাথে বাকি জীবন। আপনি শুধু থেকে যান,গোটা বিশ্ব কে দেখিয়ে দিব সব পুরুষ এক না,বাবা ডাক টাই সব কিছু না,সবার উর্ধ্বে ভালোবাসা,আর প্রিয় মানুষটার হাত ধরে বিপদে-আপদে হাতটা শক্ত করে ধরে পাশে থাকা।

রজনী জোর করে সাদমানের থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বলল-
-“ আবেগে ভেসে কি সব বলছেন সাদমান! হুশে আসুন। কোনো পুরুষই এমন মেয়ে চায় না। আপনি কেনো চাচ্ছেন?
-“ কারন আমি সব পুরুষের কাতারে পড়তে চাই না। আমি অনেক আগেই এই কথাটা জেনেছি। রুয়াত বলেছে আমায়। আমরা বাহিরের দেশে গিয়ে উন্নতমানের চিকিৎসা করাবো। তাতেও না হলে টেস্টটিউব পদ্ধতি অনুসরণ করবো একান্তই দরকার হলে। তবুও আমার আপনাকেই চাই রজনী।
-“ পাগলামি করছেন সাদমান। বাস্তবতা দেখুন। দিন শেষে আপনার আফসোস হবে আমাকে নিয়ে। অন্য দিকে আমি আপনার সিনিয়র। লোক সমাজে চলতে পারবেন না।
-“ আফসোস! হ্যাঁ অবশ্যই আফসোস হবে আপনাকে জীবনে না পেলে। আপনি আমার এক সূক্ষ্ম অনুভূতি রজনী । আপনি আমার শখের না বরং অধিক প্রিয় একটা মানুষ। আপনি ছাড়া আর কাউকে এতো করে চাই নি,আর না এতো মায়া করে ভালোবেসেছি। কাউকে নিয়ে এতো করে কল্পনা জল্পনা ও করি নি। জানেন প্রতিদিন ঘুমের ঘোরে আপনাকে নিয়ে আমার কল্পনায় পাড়ি জমাই। সেখানে ছোট্ট একটা কুঁড়েঘর আছে। সেই ঘরে আপনাকে নিয়ে সংসার সাজাই। ইশ কি সুন্দর সেই কল্পনা জানেন? আমি প্রতিবার চাই ঘুম টা ভাঙুক আমি না জাগি। কারন জাগলেই স্বপ্নটা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। যখনই আমি ঐ কুঁড়েঘর অব্দি পৌঁছে গিয়ে ভেতরে ঢুকতে চাই কোনো এক অপ্রত্যাশিত কারনে আমার ঘুম ঠিক ঐ মূহুর্তেই ভেঙে যায় । আমার সারাটাদিন অস্থিরতায় কেটে যায়। আপনি বুঝেন আমার এই অস্থিরতা? একটু ফিল করবেন? করুন না। খুব কি ক্ষতি হবে একজন জুনিয়র কে জীবন সঙ্গী করলে? আমি তো জেনে শুনেই আপনাকে চাইছি। সমাজ কে পরোয়া করি না আমি। ট্রাস্ট মি আপনার একটা কথার ও অবাধ্য হবো না। সবাই তো বেস্ট বউ হতে চায়। আমি না হয় বেস্ট স্বামী হয়ে দেখাবো। আপনি যেমন আছেন তেমনই থাকবেন। এক চিমটি ও বদলাতে হবে না নিজেকে। বরং আমি না হয় পাহাড় সমান নিজেকে বদলাবো। তবুও আমাকে আপনার ভাগ্যের সাথে জুড়ে নিন। এই যে ধরুন না রাস্তার ভিক্ষুক যেমন ভিক্ষা চায়। আমিও আপনাকে আমার জন্য ভিক্ষা চাচ্ছি।
ব্যাক্তিত্ববান মানুষটাও নির্দিষ্ট একজনের কাছে ভীষণ বেহায়া হয়। এই যে দেখুন তার উদাহরন টা আমি নিজেই। আমিও কিভাবে যেনো সেই খাতায় নাম দিয়ে ফেলেছি। আপনি প্লিজ বিশ্বাস ভরসা করে একবার আমায় আপনার হাত টা ধরতে দিন।

রজনী কি বলবে? কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে আজ সে! এই ছেলেটা এতো করে চাইছে কেনো! রজনীর যে ভয় হয় এতো ভালোবাসা দেখলে। তার কপালে কি সইবে এতো ভালোবাসা?

সাদমান রজনী কে চুপ থাকতে দেখে বলল-
-“ চুপ কেনো রজনী কিছু বলুন না। আপনি হ্যাঁ বললেই আমি বাবা আর মা কে আসতে বলবো বিডি আপনার আর আমার বিয়ে নিয়ে কথা বলতে।
-“ আরেক টু ভেবে দেখুন না সাদমান। সারাটা জীবনের ব্যাপার। মত বদলাতেও পারে।
-“ আপনি এখনও আমায় চেনেন নি রজনী। আমি যা বলি তাই করি। আমার আপনাকে পেলে আর কোনো কিছু নিয়ে আফসোস থাকবে না জীবনে।
রজনী আমতাআমতা করে বলল-
-“ আ….আমাকে একটু ভাবার সময় দিন।
-“ ভাবাভাবির কি আছে? আচ্ছা যান,আজকের রাত টা দিলাম ভাবার সময়। সারা রাত না ঘুমিয়ে জেগে থেকে ভাববেন। ফজরের আজান হতেই আমি আপনার দোরগোড়ায় এসে হাজির হবো।
-“ বেশ।
-“ তাহলে এখন চলুন আমেজে মেতে রই।
সাদমান রজনীর হাত ধরে চলে গেলো।

রাত টা হই হুল্লোড় করে কাটালো সবাই। তারপর যে যার রুমে চলে গেলো। রুয়াত শাফায়াত নিজেদের রুমে এসে বেলকনি তে বসে আছে। রুয়াতের বায়না সে শাফায়াত এর কাঁধে মাথা রেখে কিছুক্ষণ বসে থাকবে। সারাদিন ছুটোছুটি করে বউ এর মুখে এমন আব্দার শুনে ক্লান্ত থাকার পরও মানা করতে পারে নি শাফায়াত । তার বউ টা তার কাছে বেশি কিছু তো চায় না,চায় শুধু একটু একাকী সময়। রুয়াত শাফায়াত এর কাঁধে হাত রাখলে শাফায়াত আলতো করে কোমড় চেপে ধরে। রুয়াত এক হাত দিয়ে শাফায়াত এর বুকের পাঞ্জাবি খামচে ধরে। কিছুক্ষন নীরব থেকে রুয়াত বলল-
-“ মানুষ কে ততক্ষণ চেনা যায় না যতক্ষণ না সেই মানুষটির সংস্পর্শে কেউ না আসে তাই না?
-“ হু। আমাকে চিনতে পারলে নাকি আমার সংস্পর্শে এসে?
-“ ভীষণ বাজে ভাবে চিনেছি আপনায়।
চোখ টিপে হেঁসে বলল রুয়াত। শাফায়াত কথার মানে বুঝে মুচকি হাসলো।
-“ আপনার হাসি অনেক সুন্দর আপনি জানেন সেটা?
-“ তুমি বললে দেখে আজ জানলাম।
-“ মিথ্যা কথা। এর আগে কেউ বলে নি?
-“ না।
-“ কেউ প্রশংসা ও করে নি?
-“ উমমম না মনে হয়।
-“ এহ মিথ্যুক একটা। এতো হ্যান্ডসাম ছেলে তার নাকি কেউ প্রশংসা করে নি। জবার তো করার কথা। ও যা ছ্যোবলা প্রকৃতির মেয়ে।
-“ হোয়াট ইজ ছ্যোবলা? ছ্যোবলা কি?
-“ সেটার সম্পূর্ণ মানে ভালোভাবে আমিও জানি না, তবে এটা মানে মেবি কেঁড়ে কেঁড়ে নেওয়া বা ছ্যাচড়ামো করা,বা বেলেহাজ হয়ে পিছু পড়ে থাকা।
শাফায়াত চোখ ছোট ছোট করে বলল-
-“ আর কিছু নেই?
-“ থাকলেও আপাতত মনে পড়ছে না। আচ্ছা জঞ্জাল জবা আসলো না কেনো?
-“ জানি না তো।
-“ কেনো জানেন না?
-“ তুমি কেনো জানো না?
-“ আমি তো ওকে দেখতে পারি না।
-“ আর আমি মনে হয় ওকে ভীষণ দেখতে পারি।
-“ আপনার না এক্স ছিলো ও।
-“ আমি কি ওর সাথে প্রেম করছি নাকি যে এক্স হবে।
-“ তাহলে বিয়ের কথা উঠেছিল কেনো?
-“ ফুপিই এনেছিল প্রস্তাব বিয়ের। আম্মাও রাজি ছিলো একটু। কিন্তু আমি রাজি ছিলাম না। কাজিন হিসেবে ও ঠিক আছে বাট বউ হিসেবে না।
-“ বউ হিসেবে আমি নিশ্চয়ই ঠিক?
একটু প্রাউড ফিল নিয়ে বলল রুয়াত। শাফায়াত রুয়াতের হাতের পিঠে চুমু খেয়ে বলল-
-“ শুধু ঠিক না,একদম পারফেক্ট।
রুয়াত হেসে ফেললো।

এদিকে সাদমান রুমে আসার পর থেকে শুধু হাসফাস করছে। ঘুম তো মোটেও আসছে না। শুধু মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে রজনী কি বলবে সেটা ভেবে। একবার বিছানায় গড়াগড়ি করছে তো আরেক বার বেলকনি গিয়ে বসছে,আবার রুমে এসে পায়চারি করছে। এভাবেই ভোরের আজান অব্দি কাটালো। সাদমান আর রুমের ভেতর থাকলোই না। সাদমান সোজা রজনীর রুমের সামনে এসে দরজায় টুকা দিলো। রজনী যেনো সাদমানেরই অপেক্ষায় ছিলো। আওয়াজ পেতেই দরজা খুলে দিলো। সাদমান হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকলো,এবং সরাসরি জিজ্ঞেস করলো-
-“ আপনার উত্তর টা মিস রজনী?
রজনী এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল-
-“ আমি রাজি।
কথাটা যেনো বিদ্যুৎের ন্যায় এসে প্রবেশ করলো সাদমানের কানে। সাদমান তার কান কে বিশ্বাস করতে পারছে না। সত্যি রজনী এটা বলেছে! সাদমানের তো নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী ব্যক্তি মনে হচ্ছে। তার ভালোবাসা কে তার আল্লাহ পাইয়ে দিচ্ছে। এই খুশি সে কিভাবে প্রকাশ করবে বুঝে উঠতে পারছে। রজনীর হাত সহসা মুঠোয় নিল। তারপর ওষ্ঠ ছুঁইয়ে দিয়ে বলল-
-“ ধন্যবাদ রজনী আমাকে বিশ্বাস ভরসা করার জন্য। আমার যে কি খুশি লাগছে বলে বুঝাতে পারবো না। আমি এখনই বাবা মা কে বিডি আসতে বলছি।
সাদমান চলে গেলো। রজনী নির্নিমেষ চোখে চেয়ে দেখলো সাদমানের যাওয়া। এতো খুশি এই ছেলেটা শুধু হ্যাঁ বলাতেই!

#চলবে?