গোধুলির শেষ বিকেলে তুমি আমি পর্ব-০৮

0
87

#গোধুলির_শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#পর্ব৮
#Raiha_Zubair_Ripti

ফুলে সজ্জিত রুমে বসে আছে রুয়াত। অপেক্ষা গুনছে শাফায়াত এর আসার। একটু আগেই সব নিয়ম পালন করে রুয়াত কে শাফায়াত এর রুমে বসিয়ে দিয়ে গেছে। পুরো রুম ফুলের গন্ধে মৌ মৌ করছে। রুয়াত পুরো রুমে চোখ বুলালো। রুমে আসবাবপত্র বলতে একটা খাট,একটা আলমারি একটা ভ্যানিটি,সোফা,সোফার সামনে টি-টেবিল,আর সাইডে একটা বুল সেলফ। যেখানে অনেক ধরণের বইয়ের সমাহার।

দরজা খোলার শব্দে ঘোর থেকে বের হলো রুয়াত। মাথা উঁচু করে ঘোমটার ভেতর থেকেই দেখলো সাদা পাঞ্জাবি পরিহিত শাফায়াত দরজা বন্ধ করে এগিয়ে আসছে তার দিকে। শাফায়াত রুয়াতের সামনে বসে হাত ঘড়িটা খুলতে খুলতে বলে-
-“ ফ্রেশ হয়ে আসুন।
রুয়াত ঘোমটা উঁচু করলো। শাফায়াত এর দিকে পূর্ণ দৃষ্টি দিয়ে বলল-
-“ আমি তো জামাকাপড় আনি নি।
-“ আলমারি তে আছে।
-“ ও বাড়ি থেকে দিয়ে দিছে জামাকাপড়?
-“ নাহ্। মা কিনে রেখেছিল। কথা কম বলে এখন যান ফ্রেশ হয়ে আসুন। ঘুম ধরেছে ঘুমাবো।

রুয়াত শাড়ির কুঁচি গুলো ধরে বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আলমারির কাছে গিয়ে আলমারি খুলে দেখে আলমারির এক সাইডে সেলোয়ার-কামিজ আছে দু তিনটা,আর চার পাঁচ টা শাড়ি। শাড়ি পড়ে যেহেতু ঘুমাতে পারবে না সেজন্য রুয়াত সেলোয়ার-কামিজ নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে শাফায়াত ড্রেস চেঞ্জ করে বিছানায় শুয়ে কপালে এক হাত দিয়ে রেখেছে। বিছানায় থাকা সজ্জিত ফুল গুলোর মধ্যে একটা ফুল ও অবশিষ্ট নেই বিছানায়। সব ফুলের স্থান হয়েছে রুমের এক কোনে থাকা ময়লার ঝুড়িতে। রুয়াত ভেবে পেলো না এখন তার কি করা উচিত। মিনিট কয়েক সময় ওয়াশরুমের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থেকেই অতিবাহিত করে ফেললো রুয়াত। শাফায়াত অন্য পাশে ঘুরে শুয়ে বলে-
-“ লাইট নিভিয়ে দিয়ে শুয়ে পড়ুন। অযথা দাঁড়িয়ে না থেকে।
রুয়াত বেনারসি টা সোফায় রেখে লাইট বন্ধ করে শাফায়াত এর পাশে শুয়ে পড়লো।

এটা কি আদৌও কোনো বাসার ঘর? বাসর ঘরে তো রোমান্টিক রোমান্টিক ভাইব থাকে অথচ তাদের মধ্যে র ভাব টাও নেই। দুজন দু প্রান্ত ঘেঁষে শুয়ে আছে। মনে হচ্ছে এদের একপ্রকার বাধ্য করে এই রুমে রাখা হয়েছে। রুয়াতের মুখ বরাবর জানালা। সেই জানালা দিয়ে স্পষ্ট চাঁদ কে দেখা যাচ্ছে। যে তার জ্যোৎস্না ছাড়িয়ে দিয়েছে এই ধরণীতে।
রুয়াত চাঁদের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ঘুমিয়ে পড়লো।

———————

সকালে সূর্যের রশ্মি চোখে পড়তেই ঘুম ভেঙে যায় রুয়াতের। আড়মোড়া ভেঙে চোখ মেলে তাকাতেই অপরিচত রুম দেখে ভরকে যায়। পরক্ষণেই মনে পড়ে সে এখন তার শ্বশুর বাড়ি । পাশ ফিরে তাকায় রুয়াত। শাফায়াত নেই বিছানায়। ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ আসছে। তারমানে লোকটা ওয়াশরুমে। রুয়াত মখমলে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। তারপর ভ্যানিটির সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখে নিলো সব ঠিকঠাক আছে কি না। এরমধ্যে ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ শুনে রুয়াত ঘাড় বেঁকিয়ে তাকায়। সদ্য গোসল করা শাফায়াত, ভেজা চুল থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে,গলায় টাওয়াল ঝুলানো,উদাম দেহ,পরনে শুধু টাউজার। রুয়াত বেহায়ার মত দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইলো। শাফায়াত গলা থেকে টাওয়াল টা সোফায় রেখে রুয়াতের পাশে দাঁড়িয়ে ভ্যানিটি তে নিজের প্রতিবিম্ব দেখে বলে-
-“ এভাবে তাকিয়ে থাকার কি মানে?
রুয়াত হকচকিয়ে গেলো। এক ঢোক গিলে ওয়াশরুমে চলে গেলো।

সানজিদা এসেছে ভাই আর ভাবির জন্য খাবার নিয়ে। দরজা ভেতর থেকে আটকানো দেখে সানজিদা দরজায় কড়া নাড়ে-
-“ ভাইয়া উঠেছো?
শাফায়াত আলমারি থেকে শার্ট বের করে পড়তে পড়তে বলে-
-“ হ্যাঁ উঠেছি।
-“ খাবার নিয়ে এসেছি।
শাফায়াত দরজা খুলে দিলো। সানজিদা খাবারের ট্রে টা নিয়ে ভেতরে ঢুকে টি-টেবিলের উপর রেখে দেয়।
-“ খাবার টা খেয়ে ভাবি কে নিয়ে নিচে আসতে বলছে মা।
-“ আচ্ছা যা আসতেছি।
সানজিদা চলে গেলো। শাফায়াত খাবার প্লেটের দিকে তাকিয়ে দেখে,ব্রেড আর ডিম পোস সাথে জুশ। শাফায়াত একটা ব্রেডে এক টুকরো ডিম উঠিয়ে মুখে পুরে নিলো। দু গ্লাসের মধ্যে থেকে এক গ্লাস জুশ নিয়ে ঢকঢক করে খেয়ে নিলো। শাফায়াত এর খাওয়া শেষ হতেই রুয়াত ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসে। শাফায়াত রুয়াত কে দেখে বলে-
-“ খাবার টা খেয়ে নিন চটজলদি। মা নিচে ডেকেছে।
রুয়াত ভেজা টাওয়াল টা বেলকনিতে মেলে দিয়ে খাবার টা খেয়ে নিলো। শাফায়াত রুয়াতের খাওয়া অব্দি বিছানায় বসেছিলো। খাওয়া শেষ হতেই রুয়াতের উদ্দেশ্যে বলে-
-“ নিচে চলুন।
রুয়াত খাবার প্লেট টা হাতে নিয়ে আসতে নিলে শাফায়াত থেমে যায়। রুয়াত ভ্রুকুটি করে।
-“ মাথায় ওড়না কই?
রুয়াত জিভে কামড় দিয়ে ট্রে টা নিচে নামিয়ে মাথায় ঠিকমতো ওড়না দেয়। তারপর ট্রে নিয়ে শাফায়াত এর পেছন পেছন যায়।

বসার রুমে শারমিন বেগম সহ পাশের বাড়ির দু জন মহিলা বসে আছে। রুয়াত কে আসতে দেখে শারমিন বেগম এগিয়ে এসে রুয়াতের থেকে ট্রে টা নিয়ে টেবিলের উপর রেখে রুয়াত কে ধরে তাদের সামনে বসায়। শাফায়াত সোফার এক প্রান্তে বসে ফোন স্ক্রোল করে।
মহিলা দুজন রুয়াত কে পর্যবেক্ষণ করে। শাফায়াত ফর্সা সুন্দর রুয়াত শ্যাম কন্যা। শারমিন বেগমের উচিত ছিলো ছেলের জন্য ছেলের মতোই ধবধবে ফর্সা বউ আনার। সুফিয়া বেগম রুয়াত কে দেখে বলে উঠল –
-“ ভাবি আমাদের শাফায়াতের স্কিন এতো ধবধবে সাদা আর তার বউ আনলা শ্যামলা? এর থিকা তোমার ননদের মাইয়া জবা তো অনেক সুন্দর আছিলো। তার সাথে তো মানাইতো শাফায়াত রে।

কথাটা খুব একটা পছন্দ হলো না বসার রুমে বসে থাকার করোরই। শাফায়াত আড়চোখে তাকালো মায়ের দিকে। শারমিন বেগম ছেলের চাহনি দেখলো। এই পাশের বাড়ির কুচুটে মহিলা গুলোও না শুধু খুঁত ধরতেই আসে এর ওর। এটা রুয়াতের নিজের বাড়ি হলে এতক্ষণে দু চার কথা শুনিয়ে দিত এদের। কিন্তু শ্বশুর বাড়ি হওয়ায় চুপচাপ সহ্য করে নিলো। শারমিন বেগম মিষ্টির প্লেট টা তাদের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে-
-“ অনেকক্ষণ হয়েছেন এসেছেন। এবার মিষ্টি টা খেয়ে বিদায় হন। আমার ছেলের পাশে কাকে মানাবে আর কাকে মানাবে না সেটা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না। আর জবা সে সুন্দরী দোয়া করি সেও তার মতো সুন্দর স্বামী পাক। আমার ছেলের আপত্তি নেই রুয়াত কে নিয়ে সেখানে আপনি গায়ের রং বিচার করার কে? কূটনামি একটু কম করে করবেন। আপনার গায়ের রঙের চেয়ে রুয়াতের গায়ের রঙ উজ্জ্বল। তাই কম্পেয়ার করতে হলে আপনার সাথে করুন অন্যকে নিয়ে নয়।

মহিলা টা অপমানে চুপ হয়ে গেলো। মিষ্টি না খেয়েই পাশের মহিলা কে টেনে চলে গেলো। শারমিন বেগম রুয়াতের গালে আলতো হাত রেখে বলে-
-“ এসব মহিলার কথায় কান দিবে না। এরা আসেই নিচু যায়গায় বেশি পানি ঢেলে জায়গাটা কে নষ্ট করতে।
রুয়াত মুচকি হেঁসে বলে-
-“ না মা উনাদের একটা কথাও কানে নেই নি।
-“ গুড। এই সানজিদা রুয়াত কে তোর রুমে নিয়ে যা। একটু পর পার্লারের লোক আসবে।

সানজিদা নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসে রুয়াত কে নিয়ে যায়।

দুপুরের দিকে শিকদার বাড়ি থেকে কবির শিকদার আর রুয়াতের ফুফা হালিম আসে। রুয়াত কে লেমন কালারের শাড়ি পড়ানো হয়েছে। আর শাফায়াত সাদা শার্ট, তার উপর ব্লাক স্যুট।

সাদমান অফ হোয়াইট কালারের পাঞ্জাবি পড়েছে। সাদমান এর চোখ জোড়া রজনী কে খুঁজছে। কিন্তু রজনী আসে নি৷ কবির শিকদার সন্ধ্যায় ফেরার পথে রুয়াত, শাফায়াত ও সাদমান কে শিকদার বাড়ি নিয়ে আসে।

মেয়ে ও মেয়ের জামাই আসায় হুলস্থূল আয়োজন করেছেন সামিরা শিকদার। হরেক রকমের পিঠা নানান স্বাদের খাবার৷ খাবার টেবিলে বসিয়ে সাদমান ও শাফায়াত কে খাবার খাওয়াচ্ছে। সাদমান খাবার খাওয়ার চাইতে এদিক ওদিক বারবার তাকাচ্ছে যেনো রজনী কে একটু দেখতে পারে। কিন্তু নাহ্ রজনীর ছায়া কেও দেখতে পেলো না।

খাবার দাবার খাওয়া শেষে শাফায়াত কে রুয়াতের রুমে পাঠানো হয়। আর সাদমান কে গেস্ট রুমে। গেস্ট রুম টা রজনীর তিন রুম পড়ে। সাদমান নিজের জন্য বরাদ্দ করা রুমের দিকে যেতে নিলে দেখে রজনী তার রুম থেকে বের হচ্ছে সাথে রুয়াত ও। সাদমান দাঁড়িয়ে যায়। চোখ জোড়া রজনী কে দেখামাত্রই শীতল হয়ে গেলো। হৃদপিণ্ড জুড়ে বয়ে গেলো হিমেল হাওয়া। রুয়াত সাদমান কে দেখে মুচকি হেঁসে বলে-
-“ ভাইয়া আপনি এখানে?
সাদমান মাথা চুলকে বলে-
-“ আন্টি এদিকেই দেখিয়ে দিলো থাকার জন্য রুম।
-“ ওহ্ আচ্ছা আসুন রুম টা দেখিয়ে দেই।
রুয়াত হাঁটা ধরলো। সাদমান রজনীর দিকে তাকিয়ে বলল-
-“ কেমন আছেন মিস সিনিয়র?
-“ জ্বি ভালো। আপনি?
-“ ভীষণ ভালো লাগছে এখন।
-“ কেনো আগে খারাপ ছিলেন?
-“ হ্যাঁ তেমনটাই। আপনি আজ ও বাড়ি গেলেন না যে?
-“ ও…ঐ আরকি শরীর টা ভালো ছিলো না সেজন্য যায় নি। রাত তো অনেক হলো গিয়ে ঘুমান। গুড নাইট।

রজনী নিজের রুমের দরজা বন্ধ করে দিলো। সাদমান বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে সোজা চলে গেলো। রুয়াত গেস্ট রুমের সিটকানি খুলে দেয়। সাদমান আসতেই বলে-
-“ কোনো কিছুর দরকার হলে ডাক দিবেন। পাশেই আপুর রুম আছে।
সাদমান মাথা ঝাকায়। রুয়াত চলে যায়।

শাফায়াত বিছানায় বসে রুয়াতের রুম টাকে দেখছে। বেশ পরিপাটি বলাই চলে। রুয়াত রুমে ঢুকে শাফায়াত কে বসে থাকতে দেখে বলে-
-“ আপনি কি বাহিরে যাবেন?
শাফায়াত অন্য মনস্ক হয়ে জবাব দেয়-
-“ কেনো? পরক্ষনেই কথার মানে বুঝতে পেরে বলে- না।
রুয়াত রুমের দরজা আঁটকে দেয়। লাইট বন্ধ করে শুতেই শাফায়াত বলে উঠে –
-“ আপনার বোন কি পুরোপুরি সুস্থ হয়ে গেছে?
রুয়াত চোখ বন্ধ করে দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বলে-
-“ না।

#চলবে?