গোধুলির শেষ বিকেলে তুমি আমি পর্ব-০৯

0
89

#গোধুলির_শেষ_বিকেলে_তুমি_আমি
#পর্ব৯
#Raiha_Zubair_Ripti

মধ্য রাত,, সবাই ঘুমে বিভোর। চারিদিকের পরিবেশ নিস্তব্ধতায় ঘেরা। আকাশ টায় জ্বল জ্বল করছে চাঁদ আর তারা। আর এই চাঁদ, তারারা এক স্বর্গীয় সমাবেশ তৈরী করেছে কালো রাতের এই আকাশের গায়ে। বাহিরে হিম শীতল বাতাস বইছে। পরিবেশ টার সাথে এই হিম শীতল বাতাস টা খাপ খেয়ে গেছে। রুয়াতের রুমের জানালা টা খোলা থাকায় বাতাস টা রুমে এসে পড়ছে রুয়াতের উপর। বিছানায় গুটিশুটি হয়ে শুয়ে থাকা রুয়াত থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। শাফায়াত নিজেও বেশ ঠান্ডা অনুভব করলো। পায়ের নিচ থেকে চাদর টেনে নেওয়ার জন্য চোখ মেলতেই দেখে রুয়াত শরীরের ওড়না টাকে চাদরের মতো করে শরীরের উপর নিয়ে গুটিশুটি হয়ে আছে। শাফায়াত চাদর টা টেনে রুয়াতের শরীর ঢেকে দিলো। রুয়াত নড়েচড়ে চাদর টা আরো জড়িয়ে নিলো। শাফায়াত নিজেও চাদর টা নিজের শরীরে নিয়ে শুতেই রুয়াত ঘুমের তালে শাফায়াত এর উপর হাত তুলে দেয়। শাফায়াত ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে মুখের সামনে এসে পড়ে আছে। শাফায়াত বা হাত দিয়ে চুল গুলো সরিয়ে দিলো। ড্রিম লাইটের আলোতে রুয়াতের মুখটা এখন স্পষ্ট। কে বললো মেয়েটা শ্যাম কন্যা? পাড়ার কুচুটে মহিলা গুলোর চোখে সমস্যা তা না হলে এমন মেয়ে কে কি করে শ্যামলা বলতে পারে?
হ্যাঁ রুয়াতের থেকে শাফায়াত এর স্কিন টোন টা বেশি উজ্জ্বল,জবার গায়ের স্কিন টোন টা শাফায়াত এর থেকেও বেশি ফর্সা। তাই বলে রুয়াত মোটেও শ্যামলা না। শাফায়াত আজ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো রুয়াত কে৷ মেয়েটা তার স্টুডেন্ট না হলে তাদের বৈবাহিক জীবন টা নিশ্চয়ই অন্য ভাবে শুরু হতো। শাফায়াত রুয়াত কে সময় দিচ্ছে। এতো তারাহুরোর-ই বা কি আছে? না রুয়াত পালিয়ে যাচ্ছে আর না শাফায়াত নিজে। বিয়ে যেহেতু হয়েছে তখন বৈবাহিক সম্পর্ক ঠিক একদিন হবে।

শাফায়াত বালিশের নিচ থেকে ফোন টা বের করে সময় দেখে নিলো। এখন বাজে রাত দুটো বেজে চল্লিশ মিনিট। শাফায়াত বালিশ থেকে নেমে আসা রুয়াতের মাথা টা ঠিক করে দেয়। রুয়াত উল্টো ফিরে ঘুমায়। শাফায়াত কপালে হাত ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে।

রজনীর রুমে এখনও লাইট জ্বলছে। সাদমান রজনীর রুমে সামনে দাঁড়িয়ে আছে। পানি তেষ্টা পেয়েছিল। রুমে পানি নেই সেজন্য রজনীর রুম পাশে থাকায় এসেছে আর রুয়াত যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিল কোনো কিছুর দরকার হলে রজনী কে ডেকে জানাতে। সেজন্য সাহস টা আরো বেশি পেয়েছে রজনী কে ডাকার জন্য সাদমান। কিন্তু এতো রাতেও রজনীর রুমের লাইট জ্বলতে দেখে যতটা না অবাক হয়েছিল সাদমান তারচেয়ে বেশি অবাক হয় যখন রজনীর রুমের সামনে এসে ভেতর থেকে কোনো কিছুর ক্রমাগত ভাঙার শব্দ পায়।
সাদমান দরজায় টোকা দিবে কি দিবে না সেটা নিয়ে দ্বিধায় ভুগে। কিন্তু ভেতর থেকে ভাঙার শব্দ টা থামছেই না।
সাদমান সাহস করে দরজায় টোকা দিলো। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো রেসপন্স আসলো না। সাদমান এবার রজনীর নাম ধরে ডাকলো।
-“ মিস সিনিয়র শুনছেন? কিসের শব্দ আসছে ভেতর থেকে? আপনি কি ভাঙছেন? দরজা প্লিজ খুলুন।

কিন্তু নাহ্ ভেতর থেকে ভাঙার শব্দ ছাড়া রজনীর কন্ঠের শব্দ আসছে না। সাদমান বুঝতে পারছে না এখন তার কি করা উচিত। রজনী তো তার ডাক শুনে কোনো কথা রিপিট করছে না। সাদমান আর দেরি করলো না রুয়াতের রুমের দিকে ছুটে আসলো। দরজায় কড়া নেড়ে বলল-
-“ ব্রো শুনতে পারছো? একটু বাহিরে আসবে?
শাফায়াত এর কেবলই চোখে ঘুম এসেছিল দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে ঘুম টা ভেঙে গেলো। মনে মনে সাদমান কে বকতে ভুল করলো না। রুয়াতের দিকে তাকিয়ে দেখলো চাদর সরে গেছে। শাফায়াত সেটা ঠিক করে দরজা খুলে দিলো। সাদমান অস্থির কন্ঠে বলল-
-“ ব্রো মিস সিনিয়র এর রুমের ভেতর থেকে ক্রমাগত কিছু ভাঙার শব্দ আসছে। আমি ডেকেছি কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ পাই নি।
শাফায়াত ভ্রু কুঁচকে বলল-
-“ মিস সিনিয়র টা কে?
সাদমান এদিক ওদিক তাকিয়ে বলল-
-“ রজনী।
চকিতেই চমকে উঠলো শাফায়াত।
-“ কি হয়েছে রজনীর?
-“ তার রুম থেকে কিছু ভাঙার শব্দ আসছে। আমি ডেকেছি রেসপন্স করে নি।
শাফায়াত হাঁটা লাগালো রজনীর রুমের দিকে। এখনও ভাঙার শব্দ ভেসে আসছে। শাফায়াত দরজায় ধাক্কা দিয়ে বারবার বলে উঠছে-
-“ রজনী ওপেন দ্যা ডোর। ভাঙচুর করছেন কেনো। দরজা খুলুন কুইক।
দরজা খুললো না রজনী । কিন্তু মিনিট দুয়েকের মধ্যে ভাঙচুরের আওয়াজ থেমে গেলো।
শাফায়াত এর কন্ঠস্বর শুনে কবির শিকদার সামিরা শিকদার আর কবির শিকদার এর বোন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন। শাফায়াত কে রজনীর রুমের দরজা ধাক্কাতে দেখে সামিরা শিকদার ভয়ার্ত কন্ঠে বলে উঠে-
-“ কি হয়েছে শাফায়াত, রজনী কি করেছে?
শাফায়াত দরজায় ধাক্কা দিতে দিতে বলে-
-“ রজনী রেসপন্স করছে না আন্টি। এতক্ষণ রুমের ভেতর থেকে ভাঙচুরের আওয়াজ আসছিলো।
সামিরা শিকদার দরজায় ধাক্কা দিলো। অস্থির কন্ঠে মেয়েকে ডাকতে ডাকতে বলল-
-“ রজনী মা দরজা খুলছিস না কেনো? ও রজনীর বাবা কিছু করো না। রজনী তো দরজা খুলছে না।

কবির শিকদার এর মনেও অজানা ভয় ঢুকে গেলো। আর দেরি না করে শাফায়াত কে বলল দরজা টা ভেঙে ফেলতে। শাফায়াত আর সাদমান দুজনে দরজা ভাঙার ব্যাবস্থা করে। কবির শিকদার সামিরা শিকদার কে বলল তাড়াতাড়ি রুয়াত কে ডেকে আনতে।
সামিরা শিকদার মেয়ের রুমে দিকে ছুটলেন। রুয়াতের বাহুতে হাল্কা ধাক্কা দিয়ে বলে-
-“ রুয়াত উঠ। রজনী দরজা খুলছে না।
রুয়াত হাল্কা চোখ মেলে তাকালো। ঘুমের রেশ এখনও কাটে নি। সামিরা শিকদার মেয়েকে শোয়া থেকে উঠে বসালো।
-“ রজনী দরজা খুলছে না রুয়াত।
সামিরা শিকদার এর বলা কথাটা কান অব্দি ভালোমতো পৌঁছাতেই রুয়াতের ঘুমের রেশ কেটে যায়। ত্বরিত গতিতে মায়ের দিকে তাকায়। বড় বড় চোখ করে বলে-
-“ আপু দরজা খুলছে না!
রুয়াত সহসা ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো। রজনীর রুমের সামনে আসতেই দেখে শাফায়াত, সাদমান আর কবির শিকদার মিলে রুমের দরজা ভাঙার চেষ্টা করছে। রুয়াতে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বোন কে ডেকে উঠছে-
-“ আপা এই আপা দরজা খুলছিস না কেনো? আপা দরজা টা খোল না।

বিশ মিনিটের মতো ধস্তাধস্তি করে দরজা টা ভাঙতে সক্ষম হলো শাফায়াত, কবির শিকদার,সাদমান। দরজা খোলার সাথে সাথে সবাই হুড়মুড়িয়ে রুমে ঢুকতেই শাফায়াত এর শরীরের সমস্ত লোম খাঁড়া হয়ে গেলো। সাদমানের যেনো মনে হলো সে ভুল দেখছে। কবির শিকদার স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রুয়াত দৌড়ে বোনের কাছে ছুটে গেলো। ফ্লোরে র’ক্তের ছড়াছড়ি, চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভাঙা কাঁচের জিনিসপত্র। রজনীর পা,হাত থেকে গড়গড় করে র’ক্ত বের হচ্ছে। রুয়াত র’ক্ত মাখা রজনীর হাত খানা ধরে চিৎকার করে বলে উঠে-
-“ ও মা মা আমার আপা। মা আপার এমন হইলো ক্যান। এ আপা কথা বল, কথা বল না। ও বাবা আপু কথা কয় না। মা আপারে কথা কইতে কও আমার সাথে।

কবির শিকদার শাফায়াত কে বলল তাড়াতাড়ি করে রজনীকে ধরতে। ইমিডিয়েটলি হসপিটালে নিতে হবে। শাফায়াত সাদমানের শরীর টাকে ধাক্কা দিলো। সাদমান পাথরের ন্যায় জমে আছে। বুকের ভেতর কেমন চিনচিনে ব্যথা করছে। শ্বাস টা নিতে কষ্ট হচ্ছে। মনে হচ্ছে এই রুমে অক্সিজেন নেই। শাফায়াত সাদমান কে নড়তে না দেখে ফের ধাক্কা দিয়ে বলে-
-“ হোয়াট’স রং উইথ ইউ সাদমান। রজনী কে ধর। হসপিটালে নিতে হবে।

সামিরা শিকদার ঠাই দাঁড়িয়ে আছে। তার যে র’ক্ততে ফোবিয়া। কবির শিকদার স্ত্রীর কথা কিয়ৎ ক্ষনের জন্য বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন। স্ত্রীর যে র’ক্ততে ফোবিয়া সেটা মনে পড়তেই তাড়াতাড়ি সামিরা শিকদার কে ঠেলে বাহিরে নিয়ে গেলেন। কাকুলির দিকে চেয়ে বললেন সামিরা শিকদার কে রুমে নিয়ে গিয়ে সামলাতে। কাকুলি সামিরা শিকদার কে নিয়ে নিজের রুমে গেলেন। সামিরা শিকদারের চোখে এখনও ভাসছে তার বড় মেয়ে টার র’ক্তাক্ত দেহ।
এর আগেও এমন টা হয়েছে কিন্তু এতো বাড়াবাড়ি পর্যায়ে যায় নি৷ ভাঙচুর অব্দিই ছিলো সেটা।
কিন্তু আজ একদম মারাত্মক পর্যায়ে চলে গেছে। সামিরা শিকদারের শরীর ক্রমাগত ঠান্ডা হয়ে চোখ বন্ধ হয়ে আসলো। কাকুলি সামিরা শিকদার কে চোখ বন্ধ করতে দেখে সহসা সামিরা শিকদার কে ধরে ফেলে। দু বাহু ধরে ঝাঁকাতেই সামিরা শিকদার শরীরের সমস্ত ভার ছেড়ে দেয়।
কাকুলি চিৎকার করে ভাই কে ডাকে।

এদিকে কবির শিকদার বোনের ডাক শুনে বুঝতে পেরে যায় অঘটন টা ঘটেই গেছে। মেয়ের পেছন ছুটবে নাকি স্ত্রীর পেছন? শাফায়াত কে রজনী কে ধরে গাড়িতে নিয়ে যেতে বলে ছোট লাগালেন বউয়ের কাছে। জ্ঞান হারিয়েছে সামিরা শিকদার, কবির শিকদার পার্সোনাল ডক্টর কে ফোন লাগালেন। এই মধ্য রাতে আসতে বললেন শিকদার বাড়িতে। ডক্টর আসতে রাজি হন নি, কবির শিকদার তার সিচুয়েশন টা জানাতেই আসতে রাজি হলেন। বোন কে বলে গেলেন ডক্টর এসে পড়বে সে যেনো সামিরা শিকদার কে সামলায়।

কবির শিকদার গাড়ির কাছে আসলেন। রুয়াত গাড়িতে উঠে বসেছে। কবির শিকদার ও উঠে বসলেন। শাফায়াত আর সাদমান রজনী কে রুয়াতের কোলের উপর শুইয়ে দেয়। রুয়াতের অবস্থা ও বাজে। কান্না কাটি করার ফলে চোখ মুখ ফুলে গেছে। চুল গুলো এলোমেলো হয়ে আছে। বারবার বোনের গালে আলতো করে থাপ্পড় দিয়ে বলছে বোনকে উঠতে। সাদমান একটু পর পর র’ক্তে মাখা রজনীর দেহটার দিকে তাকাচ্ছে। ঘুমানোর আগেও তো তার মিস সিনিয়র এর সাথে কথা হলো। কয়েক ঘন্টার ব্যাবধানে কি থেকে কি হয়ে গেলো! মেয়েটার র’ক্তাক্ত দেহ টার দিকে তাকালেই নিঃশ্বাস টা বন্ধ হয়ে আসছে। মেয়েটা এমন করলো কেনো? কি এমন হয়েছিল যে নিজেকে এভাবে আঘাত করলো?

#চলবে?