#গোধূলির_শেষ_প্রণয়
#লেখনিতে_ছনিয়া_তাবাচ্ছুম_অনি
#পর্ব_৫/স্পেশাল পর্ব
বিষন্ন মনে ছাদে দাড়িয়ে আছে মানহা। জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে তার । জীবনের হিসাব মিলাতে ব্যস্ত। জীবনের মানেই খুঁজে পায় না মানহা। মাঝে মাঝে নিজের জীবন নিজে শেষ করে দিতে মন চায়। আত্মহত্যা মহাপাপ নইলে কবেই আত্মহত্যা করতো। মানুষের বিষাক্ত কথা শুনতে শুনতে আর কান পঁচে গেছে তার ।ছাদে ঝোলানো দোলনায় গিয়ে বসে পরে মানহা। আকাশ মেঘলা বিধায় রোদের তেজ নেই। হালকা হালকা রোদে পরিবেশটা ভালোই লাগছে মানহার কাছে। উদাসীন হয়ে চেয়ে থাকে আকাশের পানে। হঠাৎ মানহার ফোনে একটা কল আসে। আননোন নাম্বার দেখে খানিকটা অবাক হয়। তার নাম্বার টা অপরিচিত কারোর কাছে নেই। তাহলে কে কল করছে ভাবায় মানহা কে৷ প্রথম বার বেজে বেজে কেটে যায়। কল রিসিভ করবে কি করবে না দ্বিধায় পরে। মানহার ভাবনার মাঝেই আবার কল আসে। এবার রিসিভ করবে বলে ভাবে জুরুরি কিছু বলতে ফোন দিতে পারে। ফোনটা রিসিভ করে কানে নেয় মানহা,,
” ফোনের ও পাশ থেকে কেউ কথা বলছে না। মানহাও চুপ করে আছে।
দুজন দুজনার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনছে।কিন্তু কথা বলছে না। ফোনের ওপাশের জন কি বলে শুরু করবে সেটাই বুঝতে পারছে না। বলতে গিয়ে বার বার থেমে যাচ্ছে।
” মানহা বিরক্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করে, এই কে রে ভাই আপনি। খেয়েদেয়ে কাম কাজ নাই। ফোন দিয়ে যেহেতু কথায় বলবেন না তাহলে ফোন দেওয়ার মানে কি যতসব আজাইরা লোকজন। কথা বলতে এত সমস্যা থাকলে ফোন দিয়ে বসে আছেন কেন? ফোনটা কেটে দিলেই তো হয়। নাকি টাকা বেশি হয়ে গেছে। কোনটা। বলে থেমে যায় মানহা
” ❝বনবিড়াল ❞ গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠে থমকে যায় মানহা। তাকে কি বলল,
” কি বললেন আপনি?
” ❝বনবিড়াল❞
” ফোন দিছেন কেন? কে আপনি? কাকে চায়? বনবিড়াল কে?
“উফফস, এতগুলো প্রশ্ন এক সাথে করলে উত্তর দিবো কেমনে। তার থেকে ভালো ধীরে সুস্থে বলুন।
” বনবিড়াল কে?কেন ফোন দিছেন ?
” মন ভালো হয়েছে তোমার।
” মানেহহ!
” শোনো মেয়ে তোমাকে একটা কথা বলি। মানুষের কাজ কথা লাগিয়ে বেড়ানো। কে কি বলল তাই নিয়ে মন খারাপ করার কোনো মানেই হয় না। তুমি নিজে কেমন সেটা বড় বিষয়। অন্যের কথায় কান দিলে তোমারই খারাপ লাগবে। তুমিই কষ্ট পাবে। এটাই তাদের কাজ যাতে তুমি কষ্ট পাও। বুঝছো আমার কথা। এক নিঃশ্বাসে কথা গুলো বলে থামে লোকটা।
” এতক্ষণ চুপ করে সবটা শুনছিল মানহা। লোকটা ঠিকই বলছে অন্যের কথায় কান দিলে নিজেরই খারাপ লাগবে।
” কি হলো চুপ কেন?
” মানহা নিজের ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এসে উত্তর দেয়, হ্যাঁ বুঝছি। বাট কে আপনি? আমার নাম্বার পেলেন কোথায়?
” আচ্ছা রাখি এখন । পড়ে কথা বলব। আমি এখন ব্যস্ত আছি।
” আরে আমার একটা প্রশ্নের ও তো উত্তর দেন নি। আর এখন ব্যস্ততা দেখাচ্ছেন খুব ভালো৷।
” বনবিড়াল সত্যি আমি অনেক ব্যস্ত পরে কথা বলব। আর মন খারাপ করে থেকো বলে কল কেটে দেয় । ফোনের ওপাশে থাকা লোকটা মুচকি মুচকি হাসে মানহার মুখের এক্সপ্রেশনের কথা ভেবে।
মানহা ফোন হাতে নিয়ে ভ্যাবলার মতো তাকিয়ে থাকে ফোনের স্কিনে। আননোন নাম্বার থেকে ফোন দিয়ে তাকে এতএত কথা বললো অথচ লোকটা তার পরিচয় দিলো না আজব। লোকটা আমাকে চেনে কিভাবে। আর আমার যে মন খারাপ এটাই বা জানলো কি করে। আবার আমাকে বনবিড়াল বললো। উফফস আল্লাহ। সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। হায় আল্লাহ! জীবনটা ক্যান এমন জটিল করে দিচ্ছো।
______
খান ভিলায় বিয়ের তোরজোর শুরু হয়ে গেছে। আর পাঁচদিন পরেই অয়ন আর নিরার বিয়ে। সুন্দর করে ডেকোরেশন করা হয়েছে। বিয়ের পাঁচদিন আগে থেকেই সবাই আসতে শুরু করে দিছে। আজ সন্ধ্যায় মানহার ফুপি ফুপা ফুপাতো ভাই বোনেরা আসবে। মানহা খুব খুশি তার ফুপি আসছে। এই পনেরোটা দিনকে মনে হয়েছে পনেরো টা বছর তার ফুপি কে দেখেনি। প্রতিদিন কথা হলেও মন ভরে না। যে মানুষ গুলো এই দুই বছর তাকে আগলে রাখছে তাদেরকে কি করে ভুলা যায়। তার একাকিত্বের দিনে তারাই তাকে সঙ্গ দিয়েছে। তাকে হাসানোর জন্য কি না করে নি ভাবতে চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরে মানহার।
মায়ের ডাকে ভাবনা থেকে বেড়িয়ে আসে মানহা। হ্যাঁ আম্মু বলো কি করতে হবে।
” মা রে কষ্ট করে তোর ফুপির রুমটা গুছিয়ে দে। আমি কাজ ফেলে যেতে পারছি না।
” আচ্ছা আম্মু। আমি গুছিয়ে রাখছি বলে পা বাড়ায় দোতালায়।
***
ড্রয়িংরুম জুরে হইচই হচ্ছে। মানহার ফুপি তানভি খান আবেগ উৎফুল্ল হয়ে যান নিজের পরিবারকে দেখে। কত গুলো দিন পর নিজের কাছের মানুষ গুলো কে দেখছে। মানহার ফুপির এক ছেলে এক মেয়ে। ছেলে নাম তাসকিন আর মেয়ে তানশি। ছেলেটা বড় আর মেয়ে ছোট। তাসকিন আর তানশি দুজনেই মানহার ছোট। তানশি দৌড়ে গিয়ে মানহাকে ঝাপটে ধরে হ্যাগ করে। মানহা টাল সামলাতে না পেরে যেতে গেলে নিজেকে সামলে তানশিকে জড়িয়ে ধরে। তানশি ইনোসেন্ট ফেস করে বলে,,
” আপু তুমি আমাকে ভুলে গেছো? একটু খোজও নাউ না? নিজের পরিবার কে পেয়ে আমাদের সবাইকে ভুলে গেছো।
” আরে পাগলী বোন আমার। একটু ব্যস্ত ছিলাম সেজন্য তোর সাথে কথা বলতে পারিনি। আমি যখনই ফুপিমণির সাথে কথা বলতাম তখন তুই থাকতি না।
” থাক তোমাকে আর বলতে হবে না। আমি সব জানি বলে দুরে সরে দাড়ায়।
” আচ্ছা বনু সরি। আর হবে না এই দেখ আমি কান ধরছি। তানশি তাকিয়ে দেখে সত্যি সত্যি তার মানহাপু কান ধরছে।
” আচ্ছা মেনে নিলাম। আর যেন না হয়।
” যথাআজ্ঞা ম্যাম।
মানহার বলার ধরন দেখে হেসে ওঠে তানশি।
মানহার ফুপি রা সবাই ফ্রেশ হতে চলে যায়। রাতটা অনেক হাসি ঠাট্টার মাধ্যমে কাটায়।
___________
আজ শপিংয়ে যাবে সবাই। মানহা তার ফুপাতো দুই ভাই বোনের জন্য ড্রয়িংরুমে অপেক্ষা করছে। তাদের এখনও হয়নি। খান পরিবার থেকে যাবে অয়ন,মিরাজ, তাসকিন, মানহা, তানশি, অয়নের খালাতো বোন মাইশা আরও কয়েকজন কাজিন আছে তারা যাবে।
সবাই গিয়ে গাড়িতে বসে। অয়ন ড্রাইভ করছে অয়ন। অয়নের পাশের সিটে তাসকিন। আর সবগুলো পিছনে। তাসকিন সবার থেকে আলাদা। চুপচাপ স্বভাবের। খুব কম কথা বলে। বেশি কথা বলা পছন্দ করে না। চুপচাপ নিজের মতো কানে ইয়ারপোড গুজে এফবি স্কল করছে। তাসকিনের মতো মানহাও সেম কাজ করে কিন্তু সেটা বেশিক্ষণ টেকে না। ফোন কেড়ে নেয় মানহার থেকে।
পিছনে সবগুলো হইচই শুরু করে দিছে। তাদের আনন্দ কে আরও বেশি করতে একটা গান প্লে করে অয়ন৷ এতে তানশি জোরে চিৎকার করে ওঠে খুশিতে।
***
শপিংমলে গিয়ে এক সাথে হয় নিরা আর আবরার। তারা দুজনেই আসছে। আর কাউকে আনেনি। তারা একটা বেস্ট মলে যায়। আবরার কে দেখে এগিয়ে আসে একটা ছেলে,,
” স্যার এখাবে আসার কি দরকার ছিল। একটা ফোন করলেই তো আপনার বাসায় সব হাজির হয়ে যেতো। আবরার মুচকি হেসে উত্তর দেয়,
” এখানে এসে কেনার যে আনন্দ সেটা তো আর হতো না। সবাই মিলে একসাথে একটু ঘুরাঘুরিউ হয়ে গেলে সাথে কেনাকাটাও। কি বলো।
” জ্বী স্যার। আপনি ঠিক বলছেন। ভিতরে আসুন স্যার।
আবরার একটা চেয়ারে বসে। অয়নের একটা কল আসায় এতক্ষণ এখানে ছিল না৷ ফোন পকেটে রাখতে রাখতে ভিতরে আসে। অয়নকে দেখে ছেলেটা বললো,
” স্যার আপনিও আসছেন। আগে বলবেন না। আজকে আমাদের শুভ দিন। নইলে আপনাদের মতো দুটো কাস্টমার একসাথে আসে। অয়ন হাসি মুখে ছেলেটার কথায় সায় দেয়। আবরারের পাশে আরেকটা চেয়ারে বসে অয়ন। দোকানদার ছেলেটা একটা একটা করে অনেক গুলো শাড়ি বের করে বলে,
” স্যার এগুলো আমাদের দোকানের সবচেয়ে বেস্ট কালেকশন।
” আবরার শাড়ি গুলোর মধ্যে থেকে একটা সাদা রঙের। কি সুন্দর কাজ করা। শাড়ি দেখে সেটা হাতে নিয়ে দেখে আবরার। সাদার উপর ছোট ছোট স্টোনের কাজ করা। শাড়িটা অসম্ভব রকমের সুন্দর।
অয়নের মেয়ে কাজিন গুলো জিনিস দেখতে ব্যস্ত। নিরা আর মানহা দুজনে একসাথে কাপড় দেখছে। অয়ন মানহা আর নিরাকে ডাক দেয়। দুজনে আসলে অয়ন নিরার জন্য বিয়ের শাড়ি পছন্দ করতে বলে। নিরার একটা একটা করে শাড়ি দেখে কিন্তু সবগুলো এত বেশি সুন্দর যার জন্য সবগুলো পছন্দ হয়েছে। কোন টা রেখে কোনটা নিবে কনফিউজড হয়ে পরে বলে,
” অয়ন প্লিজ তুমি চুজ করে দাও। আমি কনফিউজড হয়ে যাচ্ছি। সব গুলো খুব সুন্দর লাগছে। মানহা নিরার অবস্থা দেখে মিটিমিটি হাসছে। অয়ন তার ভিতর থেকে লাল রঙের একটা শাড়ি নিরার উপর ধরে বলে, পারফেক্ট। এটাই তোমাকে খুব মানাবে।
আবরার শাড়িটা ধরে বসেই থাকে। আড়চোখে মানহা কে দেখে। মেয়েটা চুপচাপ দাড়িয়ে সব দেখছে। কিন্তু কিছু নিচ্ছে না।আবরার কিছু একটা ভেবে সবার আড়ালে ছেলেটাকে ডেকে শাড়িটা প্যাক করতে বলে।
সবার কেনাকাটা শেষ হলে শপিংমল থেকে বের হয় সবাই। আজ অনেক বেশিই গরম পড়ছে। গরমে অবস্থা কাহিল হয়ে গেছে সবার। আবরার শুভ্র রঙের শার্ট পরে আসছে। সাথে কালো প্যান্ট। গরমে ঘেমে ভিজে গেছে শরীর। হেটে হেটে গাড়ির কাছে যাচ্ছে। পিছন থেকে লক্ষ্য করে মানহা। চারপাশের মেয়েগুলো চোখ দিয়ে গিলে খাচ্ছে আবরারকে। কেন যেন মানহার রাগ লাগে। কেন রে ভাই তোরা পুরুষ মানুষ দেখোস নি। এভাবে ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছোস ক্যান। নিজের ভাবনায় নিজেই অবাক হয় মানহা। সে কেন এসব ভাবছে। তাড়াতাড়ি করে গাড়িতে গিয়ে বসে পরে। দুইটা গাড়িতে সবাই ভাগ করে বসে। তানশি তো ভাবিকে ছাড়া বসবেই না। মানহা কেউ সাথে নিয়ে গেছে। সে ভাবির সাথে অনেক গল্প করবে। আবরার ড্রাইভিং সিটে বসে আছে। তানশি নিরাকে নিয়ে পিছনের সিটে গিয়ে বসে পরে। মানহাও পিছনে বসতে গেলে আবরারের কথায় থেমে যায়,,
” আমাকে দেখে কি ড্রাইভার মনে হয়। যে যার ইচ্ছে মতো বসছে৷ কেউ একজন সামনে আসো। তানশি মানহাকে বলে,
” আপু প্লিজ তুমি ভাইয়াটার পাশে বসো। আমি ভাবিমণির সাথে বসবো। মানহা আমতা আমতা করে বলে আমি, হ্যাঁ আপু তুমি প্লিজ ভাইয়ার কাছে বসো না। নিরার কথায় অগত্যা আবরারের পাশের সিটে বসতে হয় মানহার। সিট বেল্ট বেধে ভালো করে বসে। মানহা কে ভালো করে বসতে দেখে গাড়ি স্টার্ট দেয় আবরার।
গাড়ি চলছে নিজ গতিতে। পিছনে নিরা আর তানশি গল্পের ঝুরি খুলে বসছে। গাড়ির ভিতর যে আরও দুটা মানুষ আছে সেটা জানেই না তারা। মানহা গাড়ির গ্লাস নামিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। বাইরে থেকে বাতাস এসে মুখে বাড়ি খাচ্ছে মানহার। শরীর শীতল হয়ে উঠছে মানহার। খুব ভালো লাগছে। গাড়ি ড্রাইভিং করছে আর আড়চোখে মানহা কে দেখছে। তারপর বললো,
” শুনুন।
” আবরারের ডাকে বাইরে থেকে মুখ সরিয়ে আবরারের দিকে তাকিয়ে বলে,
” জ্বী বলুন।
” একটা প্যাকেট বের করে মানহার দিকে দিয়ে বলে এটা আপনার জন্য।
” মানহা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে, আমার জন্য কেন?
” নিন না।
” আমি অনেক গুলা ড্রেস নিছি। লাগবে না।
” কেউ যদি উপহার দেয় সেটা কি ফিরিয়ে দিতে হয়।
” উপহার অবাক হয়ে বলে,
” জ্বী ভেবে নিন না এটা আমার তরফ থেকে আপনার জন্য সামান্য কিছু উপহার।
” মানহা আর না করতে পারে না। না করলে লোকটা কে অপমান করা হবে। সেজন্য ভদ্র তার খাতিরে নেয়।
” ধন্যবাদ।
পিছন থেকে নিরা আর তানশি একসাথে চিল্লিয়ে বলে আমরা কিন্তু দেখে ফেলছি। আপুকে লুকিয়ে গিফট দিচ্ছেন। দুজনের কথা শুনে লজ্জায় পরে যায় মানহা। লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলে। আবরার ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে থাকে। যেন কিছুই হয়নি।
দশ-বারো মিনিট পর একটা রেস্তোরাঁয় আসে সবাই। দুপুরের খাবার খেয়ে তারপর যাবে। দুইটা টেবিলে বসে পাঁচজন পাঁচজন করে। তারা মোট দশজন এখানে। খাবার পাট চুকিয়ে দুই দিকে দুই টা গাড়ি রওনা দেয় বাসার উদ্দেশ্য,,,
চলবে ইনশা আল্লাহ।
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।