গোধূলি রাঙা আলোয় পর্ব-১১+১২

0
322

#গোধূলি_রাঙা_আলোয়
#পর্ব১১

মিসবাহ উসখুস করছে। আবার এভাবে মেয়ে দেখায় সে আগ্রহী নয়। তবু মায়ের জোরাজোরিতে আসতে হলো। যে মেজোবৌ রত্নার সাথে মা উঠতে বসতে সারাদিনে তিনবার অন্তত বিবাদে জড়ান, আজ সেই রত্নার মামাতো বোন আয়নাকে দেখতে আসলেন।

রত্নার মামাতো বোন আয়নার বয়স ত্রিশ ছুঁইছুঁই। আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু স্বামীর শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারে টিকতে পারেনি বলে সংসার করতে পারেনি। আয়নার নিজের পছন্দের বিয়ে ছিল বলে শুরুতে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিল। একটা ছেলেও হয়েছে সেই সংসারে। কিন্তু প্রথম প্রথম টুকটাক চড় থাপ্পড় দিলেও দিনে দিনে অত্যাচারের মাত্রা বাড়তে থাকে। একসময় সংসার খরচ দেওয়া বন্ধ করে দেয় আয়নার প্রাক্তন স্বামী। উল্টো বাবার বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে আসার চাপ দিতো। সইতে না পেরে একসময় বাবার বাড়িতে জানায় আয়না। মেয়ে আর নাতিকে নিয়ে আসে আয়নার বাবা মা। ভেবেছিলেন এতে বদ জামাই শিক্ষা পাবে। কিন্তু আয়নার বর যেন এই অপেক্ষাতেই ছিল। আয়নাকে নিয়ে যাওয়ার পরপরই নতুন বিয়ে করে। কিছুদিন মামলা মোকদ্দমা চলে কিন্তু ভালোবেসে বিয়ে করায় কাবিন ছিল অল্প টাকার। আয়নার স্বামীর তাই তালাক নিতে বেগ পেতে হয়নি। ছেলে সালমানের কথা ভেবে দ্বিতীয় বিয়ে করতে চায়নি আয়না। একটা কিন্ডারগার্টেন স্কুলে পড়ায় আয়না। কিন্তু পরিবারের চাপাচাপিতে বিয়ে করতে রাজি হতেই হয়েছে। জাহানারা বেগমের আয়নাকে পছন্দ হয়েছে। রত্নার মতো মুখরা মনে হয়নি। ঠান্ডা স্বভাব। একটা বিয়ে ভেঙে যাওয়ায় এমনি নরম হয়ে আছে।

“মিসবাহ, তুই যেমন চাইছিস তেমন মাইয়া না? দেখতে শুনতে মাশাল্লাহ খারাপ না। ছেলেও নানাবাড়িতে থাকবো। আমি আগেই কথা কইছি। পলিনের দেখাশোনা করবো, তোর দেখাশোনা করবো। মাঝেমাঝে বাপের বাড়ি আইসা পোলারে দেইখ্খা যাইবো।”

“ছেলে তো ছোটো। মায়ের জন্য কান্নাকাটি করবে না?”

“পলিন করে কান্দন? আর করলেও নানা নানী আছে, দেখবো তারা।”

“পলিনের মা যখন চলে যায় ওর বয়স মাত্র এক বছর। তাও মাকে কম খোঁজে নাই। ওকে সামলাতে কষ্ট হয়নি?”

“সামলাইছি তো তাই না? সালমানরেও তার নানা নানী সামলাবো। তুই আবার পোলা নিবি কইছ না। দুনিয়ার অশান্তি হইবো। বারো ঘরের বারো বাইচ্চা কাইচ্চার ক্যাচাল। রত্নাও রাজি না বোনপুতরে নিতে। এরাও রাজি এই শর্তে। তোর আর সমুইস্যা কী!”

“রত্না তো পারলে পলিনরেও তার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেয়। নিজের দুই সন্তান ছাড়া ও আর কাকে চোখে দেখে! আমি কিছু বলি না মানে এই না যে আমি দেখি না, বুঝি না। আচ্ছা আমি এখন বাইর হবো।”

“মিসবাহ, হুদাই অশান্তির কথা ভাবিস না। পোলা মানুষ দুদিন কাঁদবো এরপর ঠিক হইয়া যাইবো। ওর নানা নানী বোর্ডিং স্কুলে দিয়া দিবো। ছুডি মুডিতে বাড়িত আইলে মা আইসা একবেলা দেইখা যাইবো। আমরা তো পাষাণ না। কিন্তু পোলা নিয়া সাথে গেলে সেই পোলার খরচা তোর কাঁধে আইবো। পলিনরেও তখন আয়না সময় দিবো না। নিজের পোলা নিয়া অস্থির থাকবো।”

“আম্মা, জানি না কী বলবো। চিন্তা করে দেখি।”

“এত চিন্তার তো কিছু নাই। আগামী শুক্রবার বিয়া পড়ানোর ব্যবস্থা করি। এতো আয়োজনের কিছু নাই। ঘরে ঘরে দুই পরিবারের মানুষজন মিলা বসবো। কাবিন করে বৌ নিয়া আসবো।”

“আম্মা, একটু সময় নেন। এত তাড়াহুড়ো কিছু নাই। পাঁচ বছর অপেক্ষা করতে পারছেন, এখন পনেরোদিন পারবেন না! আমি ভাবি একটু।”

“কই যাস? আইজ মার্কেট বন্ধ না?”

“আমার বন্ধু আলিফ মোটরসাইকেল এক্সিডেন্ট করছিল। দেখতে যাব যাব করে সময় পাই নাই কাল। আজ একবার দেখে আসি।”

মিসবাহ সেই কলেজ জীবন থেকে মোটরসাইকেল চালায়। তাড়াতাড়ি গন্তব্যে পৌঁছানো যায়, নিজের মতো চলাফেরা করা যায় বলে বাইক তার সবসময় পছন্দ। বাইক স্টার্ট দিয়ে আয়নার কথা ভাবতে থাকে মিসবাহ। হ্যাঁ মেয়েটা খারাপ নয়। কিন্তু কেন জানি মন থেকে একটা সম্মতি আসছে না। ছোটো ভাই হাসান আর তার বন্ধু আশিকের খুব ইচ্ছে ছিল মিসবাহ যেন আতিয়ার সাথে একবার কোথাও বসে, কথা বলে।।মিসবাহরও আগ্রহ ছিল। কিন্তু মা বেঁকে বসলেন, আর আশিকও ইতস্তত করে জানালো তার বোন নাকি বিয়ে করবে না বলে গোঁ ধরেছে। মায়ের ব্যাপারটা মিসবাহ বোঝে। কিন্তু আতিয়ার বিষয়টা বুঝলো না। আতিয়ার বিয়ে না করতে চাওয়ার পিছুটান কি তার পরিবার!

ফলের দোকানের সামনে এসে দাঁড়ায় মিসবাহ। বন্ধুর জন্য ফল নেওয়া দরকার। থরে বিথরে সাজানো লাল, হলুদ, সবুজ ফলগুলো দেখতে কী ভালো লাগে। পাশেই ফুলের ছোট একটা দোকান। নানা রঙের ফুলগুলো দিয়ে কী সুন্দর বুকে সাজানো। মিসবাহ ফল কেনে, প্রতি সপ্তাহেই কিনে। কিন্তু এই জীবনে ফুল কেনা হয়নি বললেই চলে। কখনো ফুল কেনার মানুষ ছিল না, কখনো মানুষ থাকলেও মন ছিল না। সাংসারিক দায়দায়িত্বে ভালোবাসা দিবস, ফাল্গুন, বৈশাখ কবে পার হয়ে গিয়েছে টেরই পায়নি। ফাল্গুনে হলুদ, ভালোবাসা দিবসে লাল, পহেলা বৈশাখে লাল সাদা পাঞ্জাবি পরে কারও হাত ধরে হাঁটা হয়নি। কারও বাচ্চামি বায়না মেটাতে কখনো বৈশাখী মেলায় যাওয়ার হয়নি। কাঁচের চুড়ি দেখে বাচ্চাদের মতো কারও বাড়িয়ে দেওয়া হাতে একটার পর একটা চুড়ি পরিয়ে দেওয়া হয়নি। একটা গোলাপ কিনে প্রিয়তমার জন্য তপ্ত রোদে অপেক্ষা করা হয়নি। আর এই সময়নষ্ট করা অযথা আবেগের জন্য মিসবাহর মনও আগে কখনো পুড়েনি।

এই চল্লিশ বছর বয়সে এসে মিসবাহর মনে হয়, এই অযথা পাগলামিগুলোরও প্রয়োজন আছে। প্রয়োজন আছে মাঝেমাঝে হিসেবের খাতাটা বন্ধ করে কিছু বেহিসাবি খরচ করার। চল্লিশ বছর বয়সে এসে চোখ বন্ধ করলে আনন্দময় কোন স্মৃতিটা মিসবাহর চোখে ভাসে!
কিছুই না। মিসবাহ কখনো সাগর দেখতে যায়নি, কখনো পাহাড়ে ওঠা হয়নি। কখনো রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে ফুচকার স্বাস্থ্যঝুঁকির বয়ান দিতে দিতে আগুনগরম চটপটি আর ঝাল ফুচকা খাওয়া হয়নি। সময়ের আগেই মিসবাহ পরিণত হয়েছে। দায়িত্বশীল ছেলে হয়েছে। ভালো ব্যবসায়ী হয়েছে। এর মাঝেই সুখ খুঁজেছে। আর সুখী ছিলও। কিন্তু এখন কেন সব ফাঁকা লাগে! আজ এই মুহুর্তে যদি ও ট্রাকের নিচে চলে যায়, আর জীবনপ্রদীপ নিভে যায়। চোখ বন্ধ করার আগে ওর মনে হবে সমস্ত জীবনটা শুধু করেই গেল। দুদন্ড বসে ঝিরিয়ে নেওয়ার ছলেও একটু কী উপভোগ করা হলো!

হাসানকে দেখে সে। কলেজ থেকে স্টাডি ট্যুরে যায়। বিভিন্ন দিবসে সেজেগুজে বাইরে যায়। গিটার বাজায়, গলা ছেড়ে গান গায়।।পঁচিশ বছর বয়সী হাসানের ভেতর পঁচিশ বছরের মিসবাহকে খুঁজে পায় না। পঁচিশ বছরের মিসবাহ তখন ব্যবসা দাঁড় করাতে খেটে চলছে। স্টাডি ট্যুর তখন তার কাছে অজানা নাম। বিয়ের পর পায়রা খুব বলতো হানিমুনে যাবে। মা জাহনারা খুবই বকাঝকা করেছিলেন শুনে। মিসবাহও সায় দেয়নি। সাগর দেখতে গিয়ে হাজার টাকা জলে ফেলার কোন মানে হয় না। সেই তো পানি। এ আর দেখার কী আছে। তার বদলে সে টাকায় সোনার একটা চেইন কিনলে ভবিষ্যতের সম্পদ হবে। মিসবাহর টাকার সমস্যা ছিল না। তাই কক্সবাজার যাওয়ার বদলে পায়রাকে একটা সোনার চেইন এনে দিয়েছিল। পায়রাও আস্তে আস্তে এসব আবদার করা বন্ধ করে দেয়। আর মিসবাহর তা নিয়ে কোন মাথা ব্যথাও ছিল না। এখন বছরে বিভিন্ন ছুটিছাঁটায় হামিদকে নিয়ম করে বৌ বাচ্চা নিয়ে ঘুরতে যেতে দেখে। এখানে আম্মার জোর গলায় বাঁধা দেওয়া টের পায় না। পেলেও হামিদ আর রত্না তা পরোয়া করে না। ফেসবুকে তাদের হাসিখুশি ছবি দেখতে ভালোই লাগে মিসবাহর। এমন একটা ছবি তো তার আর পায়রারও থাকতে পারতো!

“স্যার, আটশো সত্তর হইছে।”

“ঠিক করে ওজন করছো মিয়া?”

বিক্রেতার ডাকে বাস্তবে ফেরে মিসবাহ।

“হ।”

ফল স্ট্যান্ডে ঝুলিয়ে বাইক স্টার্ট দেয় মিসবাহ। গন্তব্য মিলেনিয়াম হাসপাতাল। বন্ধু ভর্তি আছে সেখানেই।

#গোধূলি_রাঙা_আলোয়
#পর্ব_১২

মিলেনিয়াম হাসপাতালের নার্সদের জন্য নির্দিষ্ট পোশাক রয়েছে। বয়স ও পদ অনুযায়ী কেউ আকাশী রঙের শাড়ি পরেন, কেউ সালোয়ার কামিজ। বুকের কাছে ঝোলানো ব্যাজে নাম লেখা থাকে। মাথায় সাদা টুপি ক্লিপ দিয়ে লাগাতে হয়। চুলে সিম্পল খোঁপা।

এই হাসপাতালটা শহরে বেশ জনপ্রিয়। দীর্ঘদিন সুনামের সাথে চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছে বলে রোগীর চাপ বেশি। হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স, ব্রাদার, এমএলএস আর পরিচ্ছন্নতা কর্মীর সংখ্যাও কম নয়। চেহারা খুব মন কেড়ে না নিলে এত নার্সের ভীড়ে আলাদা করে কাউকে মনে রাখার কথা নয়। কিন্তু আতিয়ার ছিমছাম রূপ যে প্রথম দিনই মিসবাহর নজর কেড়েছিল। প্রথম যেদিন বন্ধুকে দেখতে আসে, দশতলায় রুম নাম্বার খোঁজার ফাঁকে নার্স স্টেশনে দেখতে পায় আতিয়াকে। একমনে খাতায় কী যেন লিখছে। প্রসাধনী বিহীন সাধাসিধা মুখটায় যেন রাজ্যের বিষণ্নতা। আসেপাশে কী হচ্ছে তাতে আতিয়ার সামান্য মনোযোগ নেই। শেষ বিকেলের আলো করিডর জুড়ে। আতিয়ার মুখ সেই আলোয় আবারও মিসবাহর চোখে অন্যরকম মায়াবী হয়ে দেখা দেয়। এগিয়ে গিয়ে কথা বলে না মিসবাহ। অথচ এরপর মিসবাহ এই নিয়ে তিনদিন হাসপাতালে আসলো। আর ফ্লোরে ঘুরে ঘুরে আতিয়াকে ঠিকই আবিষ্কার করে নিলো প্রতিদিনই। নিজের কাছে নিজেই যুক্তি দিয়েছে বন্ধুকে দেখতে আসে। রোজই কিছুটা সময় দোকান থেকে নিয়ম করে বের হয়। বন্ধুর পাশে কিছুক্ষণ বসে। তারপর আতিয়াকে খুঁজে বের করে দূর থেকে দেখে চলে যায়।

আকাশী নীল শাড়িতে পরিপাটি আতিয়াকে চমৎকার লাগে মিসবাহর। পরিশ্রম করায় মেদহীন শরীর আতিয়ার। সেদিন দোকানে জবুথবু অবস্থায় দেখেছিল আতিয়াকে। এখানে কর্মক্ষেত্রে সপ্রতিভ আতিয়াকে দেখে মুগ্ধ হয় মিসবাহ। আতিয়ার শাড়ির কুচি কী নিখুঁত! এভাবে শাড়ি পরতে কারও নাকি কুঁচি ধরতে সাহায্য করতে হয়! পায়রা এটাই বলতো মিসবাহকে। পায়রার শাড়ি এলোমেলো হয়ে থাকতো। কোথাও যাওয়ার আগে মিসবাহকে অনুরোধ করতো শাড়ির কুঁচি ধরতে, না হলে ওর কুঁচি পিছলে যায়। মিসবাহর তখন এসব আদিখ্যেতা মনে হতো। পায়রার শাড়ি উঁচুনিচু হয় থাকতো পায়ের কাছে। আতিয়ার তো কেউ নেই। তাহলে ওর শাড়ি এমন টানটান কী করে! নিজে নিজেই হয়তো এমন পরিপাটি শাড়ি পরতে শিখে গিয়েছে। তবু মিসবাহর বড়ো শখ হয়, আতিয়ার পায়ের কাছে বসে শাড়ির কুঁচি ঠিক করে দিতে। আতিয়া হাসে বড়ো কম। চোখ জোড়ায় রাজ্যের বিষণ্ণতা। মাঝেমাঝে করিডরে কাজের মাঝে ক্লান্ত আতিয়াকে আবিষ্কার করেছে মিসবাহ। সেসময়গুলো মিসবাহর ইচ্ছে করেছে দুইকাপ চা হাতে নিয়ে সামনে যায়। দশ তলার উপর উদ্দাম বাতাসে করিডরের টানা বারান্দায় দাঁড়িয়ে আতিয়ার সাথে চা খেতে বড়ো শখ হয় মিসবাহর। কিন্তু ভাবনা আর আগায় না।

আজও চোখ জোড়া ইতিউতি আতিয়াকে খোঁজে। বন্ধু রিলিজ পেয়ে যাবে কাল। আর কোন বাহানায় হাসপাতালে আসা হবে না। বাড়িতেও আয়নার সাথে বিয়ের তোড়জোড় চলছে। তবু আতিয়ার কী অমোঘ আকর্ষণে পড়লো মিসবাহ!

“কাউকে খোঁজেন?”

নারী কণ্ঠের ডাকে চমকে ওঠে মিসবাহ।

“আতিয়া না আপনি? ভালো আছেন? এখানেই চাকরি করেন তাহলে!”

নিজের অপ্রস্তুত ভাব লুকাতে মরিয়া মিসবাহ।

“জ্বি এখানেই কাজ করি। আপনার বন্ধুর কেবিন তো এদিকে না। কাউকে খোঁজেন?”

“আমার বন্ধুর কথা জানেন?”

“জ্বি আপনি কেবিনে ঢোকার সময় দেখেছি। পরে জানলাম রোজই আসেন বন্ধুকে দেখতে। এমন বন্ধু পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।”

“জ্বি, জ্বি ধন্যবাদ। আপনি এখানে আছেন মনে থাকলে খুঁজে বের করতাম। হাসপাতালে পরিচয় কেউ থাকলে সুবিধা। মানে জরুরি দেখাশোনার জন্য ভালো।”

“আপনার বন্ধুর দেখাশোনায় কোন গাফলতি হচ্ছে না হাসপাতাল তরফ হতে। তিনি তো রিলিজও পাচ্ছেন।”

“জ্বি জ্বি। এই হাসপাতালের তো এমনিতেই ভালো সুনাম আছে। আপনাদের মতো দক্ষ লোকজন সেবা দিচ্ছেন।”

আতিয়া হেসে দেয়। মিসবাহকে গত দু’দিন ধরেই লক্ষ্য করেছে আতিয়া। দূর থেকে ওকে অনুসরণ করে মিসবাহ। এরপর কিছু না বলে চলে যায়। যদিও বিয়ে নিয়ে সমস্ত আশা ও বাদ দিয়েছে। তবুও দূর হতে কারও নজর ওকে অনুসরণ করছে, আর সে নজরে কোমলতা আছে, স্নেহ আছে ভেবে ভালো লাগে আতিয়ার। রোজকার কামার্ত পুরুষের ভয়াল নজর দেখে অভ্যস্ত আতিয়ার এই নজরে মনে অজানা শিহরণ হয়।

মিসবাহও আতিয়াকে আজ প্রথম হাসতে দেখলো। হৃদয় থেকে উঠে আসা হাসিরও এক অন্য রকম গুণ আছে। জটিল পরিস্থিতিও সহজ করে দিতে পারে। হৃদয়ের বরফ গলাতে পারে। এক আশ্চর্য জাদুর প্রদীপের মতো হাসি না বলা অনেক কথা বলে দেয়। জটিল সমীকরণ সহজ করে তুলে। মিসবাহ আবিষ্কার করে আতিয়ার হাসি বড়ো সুন্দর।

দিন কেটে যায়। ক্যালেন্ডারের হিসেবে দুই সপ্তাহ শেষ। মিসবাহ দোকানের হিসেব দেখছে। মনটা ফুরফুরে। এমন সময় ফোনে কল আসে। আননোন নাম্বার দেখে রিসিভ করে মিসবাহ।

“হ্যালো।”

“আসসালামু আলাইকুম।”

রিনরিনে নারী কণ্ঠে অবাক হয় মিসবাহ। পরিচিত কারও কণ্ঠ নয়। তবুও চেনা চেনা লাগে।

“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কে বলছিলেন?”

“জ্বি, আমি আয়না।”

একমুহূর্ত থমকে যায় মিসবাহ। আয়না! রত্নার মামাতো বোন! যার সাথে মা জাহনারা বেগম বিয়ের জন্য মরিয়া হয়ে গিয়েছেন। আয়না নাম্বার কোথায় পেল! মা দিয়েছেন! যেহেতু মিসবাহ এখনো বিয়ের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দিচ্ছে না, পিছলে যাচ্ছে। তাই হয়তো আয়নাকে কথা বলতে বলেছেন। কিন্তু না, এটা হওয়ার কথা না। মিসবাহর মা যতই মরিয়া হোন, মিসবাহর সাথে বিয়ের আগে আয়নাকে এত কাছাকাছি আসার সুযোগ কখনোই দিবেন না। বরং বিয়ের পরও নানা নিয়ম কানুন আর বাহানা করে স্বামী স্ত্রীকে দূরে দূরে রাখার মানুষ মা। মায়ের মতে ছেলে স্ত্রীর বেশি কাছাকাছি গেলে পরিবার থেকে দূরে হয়ে যায়। আর মিসবাহকে তিনি পরিবার থেকে দূর করতে চান না।

“হ্যালো, শুনতে পাচ্ছেন?”

“জ্বি জ্বি। কী ব্যাপার আয়না, ফোন দিলেন যে। কোন সমস্যা?”

“না সমস্যা না। মানে একটু কথা বলতাম। যদি আপনি অভয় দেন। আর আমি যে ফোন দিয়েছি রত্না বা খালাম্মাকে বলবেন না প্লিজ। ফোন দিয়েছি শুনলে অনেক কথা শুনতে হবে আমাকে আমার বাড়িতে।”

“তাহলে ফোন দিলেন কেন?”

“মনকে সামলাতে পারি না। কেমন নিষ্ঠুর আর অসহায় লাগে সারাক্ষণ। মনে হলো আপনি আমার কষ্ট হয়তো বুঝবেন বললে। আপনার আম্মা একটু আগে জানালেন আগামী শুক্রবার আপনারা আসবেন। হয়তো সেদিনই কাবিন হবে। আমার বাসায় সবাই এত খুশি যে কিছু বলে পরিস্থিতি খারাপ করতে চাই না। এমনিতে নিজের পছন্দে বিয়ে করে কম ভুগিনি। নিজের পরিবারকেও ভুগিয়েছি। তাই তাদের উপর কথা বলার সাহস বা শক্তি কোনটাই আর নাই।”

মনে মনে চমকে যায় মিসবাহ। শুক্রবার বিয়ে মানে! আম্মা একতরফা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো! এই বাড়াবাড়ি মিসবাহর আর ভালো লাগে না। সে এখন আর কমবয়সী ছোকরা কেউ না যে তার সিদ্ধান্ত বাবা মা নিবেন। রীতিমতো মধ্যবয়সী পুরুষ। কিন্তু আয়নার সমস্যাটা কোথায় জানা দরকার। আয়নাও যদি অন্য কাউকে পছন্দ করে, তাহলে বিষয়টা সহজেই সমাধান হয়ে যাবে। আজ বিকেলে আতিয়াকে নিয়ে বেড়িবাঁধের কাছে যাওয়ার কথা। ওখানে ঘন্টা হিসেবে নৌকায় ঘোরা যায়। আতিয়াই কথায় কথায় বলেছে ওর খুব ইচ্ছে নৌকায় ঘুরবে। কোনদিন এসব করা হয়নি মিসবাহরও। তাই অজানা টানে আজ দ্রুত হাতের কাজ শেষ করছে। ঘড়ি যেন লাফিয়ে লাফিয়ে চলছে। চারটা বাজতে দেরি নেই। এর মাঝেই আয়নার ফোন। কিন্তু আয়নার কথাগুলোও শোনা প্রয়োজন।

“বলুন আয়না। কী বলতে চান। আমি শুনছি। আপনার কি অন্য কাওকে পছন্দ?”

“না না কী বলেন! এসবের মাঝে আমি আর নেই। একবার তো নিজে ভালোবেসে বিয়ে করে দেখেছি। এসব প্রেম ভালোবাসায় সুখ নেই।”

“সুখ আসলে কোথায় আয়না! আমি তো পরিবারের পছন্দে বিয়ে করেছিলাম। সুখপাখির দেখা তো পাইনি। আমার তো মনে হলো জীবনে প্রেমের অভাবেই হয়তো এই সুখপাখির দেখা কখনো পাওয়া হয়নি।”

“বিয়ের পর ভালোবাসা পাওয়ার জন্য বিয়ের আগেই প্রেম করতে হবে কথাটা বোধহয় ভুল। দায়িত্ববান আর অনুভূতিশীল মানুষ হলে প্রেম যেকোন সময় হতে পারে। কিন্তু মুখ ভর্তি প্রেমের আলাপ, আর অন্তর ভর্তি বিষ নিয়ে থাকা দায়িত্বহীন মানুষকে জীবনে জড়ালে যে কী পরিমাণ ভুগতে হয়, তা আমার চেয়ে বেশি কেউ জানে না।”

“তা হলে অন্য আর কী সমস্যা?”

“আমি এখন আপনার আম্মাকে খালাম্মা বলেই বলি। বিয়ের আগে আম্মা বলতে লজ্জা লাগে।”

“জ্বি বলেন। আম্মা কোন লেনদেনের কথা বলেছে?”

“লেনদেনের কথা তো আগেই হয়েছে। রত্না আপা জানিয়েছেন। আব্বা আম্মার এসবে কোন আপত্তি নাই। তারা আমার একটা ভালো বিয়ে চান। আমি আগে না চাইলেও এখন চাই। কারণ বুঝতে পারছি যত দিন যাচ্ছে আমি গলগ্রহ হয়ে যাচ্ছি ভাইদের। কাল আব্বা আম্মা মারা গেলে, ভাই ভাবিদের অনুগ্রহ আর দয়ায় কাজের মানুষের মতোই জীবন কাটাতে হবে। আমার স্কুলের বেতন আর কয় টাকা। নিজের একটা সুন্দর সংসার হোক আমিও তাই চাই।”

“আম্মাকে আমি এসব টাকা পয়সা লেনদেনের কথা বলতে নিষেধ করেছিলাম।”

“থাক ওসব নিয়ে খালাম্মাকে কিছু বলবেন না। না চাইলেও আব্বা আম্মা দিতেন। ডিভোর্সি মেয়ের জন্য এই খরচ করতে হবো ওনারা জানেন।”

“আমিও ডিভোর্সি পুরুষ।”

“দুটো তো এক না সমাজে। আসলে আমি এই জন্য ফোন দেই নাই। আপনার নাম্বার গোপনে যোগাড় করেছি একটা অনুরোধ করতে। কারও কাছে জোর গলায় নিজের একটা আর্জি জানানোর জোর নাই। শেষমেশ আপনার কাছে সাহস করে ফোন দিলাম। আপনিও তো এক সন্তানের পিতা। আমার ছেলেটাকে আমার সাথে গ্রহণ করেন প্লিজ। ওরা ওকে বোর্ডিং এ পাঠিয়ে দিবে। ছেলেকে নেওয়ার জন্য যেন কোন চাপ না দেই তা খালাম্মা আগেই জানিয়েছেন। রত্না আপাও নিষেধ করেছেন। তাই কেউ আমার ছেলের জন্য বিয়েটা ভাঙুক চায় না। আমি কোন উপায় না পেয়ে আপনাকে অনুরোধ করতে ফোন দিয়েছি। আমাদের সাথে রুমে রাখা লাগবে না। বাসার যেকোন জায়গায় ওর জন্য একটা খাট পেতে দিলে হবে। বা বসার ঘরে ফ্লোরিং করে থাকবে। আমার ছেলেটা খুব নরম সরম ঠান্ডা। কোন দুষ্টুমি করবে না। করলে আমি নিজে শাসন করবো। পলিনের কোন অযত্ন হবে না। স্কুলের বেতনও আপনার দেওয়া লাগবে না। আমার স্কুলের চাকরির বেতন থেকে আমি কিছুটা জমাতাম, আর আব্বা এফডি করে দিয়েছেন কিছু টাকা। সেখান থেকেই ওর পড়ালেখা চলবে। আপনি শুধু ওকে আমার কাছে রাখার অনুমতি দেন। প্লিজ প্লিজ। আর রাজি না হলেও বিয়েটা ভাঙবেন না প্লিজ। আমি অনুরোধ করায় বিয়ে ভেঙে গিয়েছে জানলে বাড়িতে বিরাট অশান্তি হবে।”

আয়নার ফোন রেখে স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে মিসবাহ। এ কী পরিস্থিতিতে ফাঁসলো। একজন ওর সাথে সংসার হচ্ছে ধরেই নিয়েছে, আরেকজনকে সে নিজে বিয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছে একটু একটু করে। দুজনের কারও সাথেই খারাপ কিছু হোক চায় না মিসবাহ।

(চলবে)