#গোধূলি_রাঙা_আলোয়
#পর্ব_১৭
দেলোয়ারা বেগম ফজরের ওয়াক্তে উঠে নামাজ পড়ে আবার শুয়ে পড়েন। সেই ঘুম গভীর হয়। সাতটার আগে আর ঘুম ভাঙে না। আতিয়াও একই রুটিন ফলো করে। আশিক আর আলো কখনো উঠে, কখনো না উঠতে পারলে কাজা নামাজ পড়ে নেয়। বাসার সবার তাই সকালের ঘুম ভাঙতে মোটামুটি সাতটা বাজে। আশিক আরও পরে উঠে। আতিয়া ঘুম থেকে উঠে চা বসায়। সকালে চা আর টোস্ট বিস্কুট খেয়ে বের হয়। বক্সে কখনো রাতের ভাত, কখনো রুটি আর আগের দিনের সবজি যা থাকে ঢুকিয়ে নেয়। ডিউটির এক ফাঁকে খেয়ে নেয়।
আজও আতিয়া সকালে উঠে হাত মুখ ধুয়ে চা বসিয়েছে। রান্নাঘর থেকে বসার ঘরের দিকে তাকিয়ে দেখে মেইন দরজাটা সামান্য ফাঁকা। অবাক হয়, এত সকালে কে বাইরে গেল! দেলোয়ারা বেগমকে রুম থেকে বের হতে দেখে প্রশ্ন করে,
“আম্মা, এত সকালে কে গেল বাইরে? দরজা খোলা ক্যান?”
“জানি না। আমি মাত্র উঠলাম। উইঠা দেখি আলো নাই পাশে। আলোরে প্রতিদিন ডাইকা উঠানো লাগে। আজ এত সকালে উঠলো দেইখা অবাক হইছি। আলো কি বাইরে গেছে নাকি?”
“এত সকালে না বলে কই যাবে!”
কিছুক্ষণের ভেতরই বোঝা যায় আলো বাসা থেকে পালিয়েছে। একটা চিঠিও লিখেছে। পড়ার টেবিলের উপর চিঠিটা গ্লাস দিয়ে চাপা দিয়ে রেখে গিয়েছে। যাওয়ার আগে আলমারি খুলে বাকি গয়না, দেলোয়ারা বেগমের জমানো পাঁচ হাজার টাকা আর ভাই আশিকের ফোনের সিম খুলে রেখে তার স্মার্টফোনটা নিয়েছে। আতিয়ার রুমে গিয়ে কিছু নেওয়ার সাহস হয় না। আতিয়ার ঘুম পাতলা জানে আলো। নিজের ভালো যে কয়টা জামাকাপড় আছে সেগুলোও নিয়েছে। চিঠিতে অবশ্য জানিয়েছে যে মা বলেছে এই গয়নাগুলোর বেশির ভাগ আলোর বিয়ের জন্য রাখা, তাই নিজের গয়না হিসেবেই সে নিয়ে যাচ্ছে। বোন আতিয়া তো বিধবা সে গয়না দিয়ে কী করবে, মায়ের বয়স হয়েছে, তারও আর গয়না পরার দরকার নাই।।আর ভাই আশিক যখন বিয়ে করবে তখন তার বৌয়ের গয়না শ্বশুর বাড়ি থেকে যৌতুক নিবে। এই সব কারণও আলো চিঠিতে উল্লেখ করে গিয়েছে। চিঠিতে লিখেছে,
“আপা, তোমরা সবাই মিলে আমাকে চোর সাব্যস্ত করেছ। কথাটা পুরোপুরি ভুল না। আমি না বলে টুকটাক টাকা পয়সা নিয়েছি ঠিক। কিন্তু নিয়েছি তো নিজের ভাই বোনের কাছ থেকে। কারণ তোমরা নিজেরা নিজ থেকে আমাকে কোন হাত খরচ দাও না। আমি হেঁটে স্কুলে যাই, স্কুল থেকে আসি। বিশটা টাকা রিকশাভাড়া কেউ দাও না। আমার বান্ধবীরা সময়ে সময়ে কত কেনাকাটা করে, আমি পারি না। বেশিরভাগ সময় তোমার কাপড়, আয়েশা আপার কাপড় ধার করে পরা লাগে। আমার গায়ে হয় না। ঢিলা হয়। ঈদে এক জোড়া জুতা দিয়ে তোমাদের আর খবর থাকে না। কানের দুল, চুড়ি, লিপস্টিক কত কিছু লাগে। চাইলেই ঝাড়ি মারো। এভাবে ফকিন্নির মতো কোচিং এ যেতে আমার লজ্জা লাগে। তোমাদের কারও মাথায় আসে না মেয়েটা বড়ো হইতেছে তারে কয়টা টাকা হাতখরচ দেওয়া উচিত। আমার বান্ধবীরা বলে আমি কিপটা। আমি কাওরে বলতে পারি না আমার কাছে টাকা নাই, তাই খরচ করতে পারি না। তোমাদের নামে সবসময় কত বড়ো বড়ো কথা বলি সবজায়গায়। বলি আমার বোন ডাক্তার, হাসপাতালে চাকরি করে, ভাইয়ের বসুন্ধরায় দোকান আছে। আমরা নিজেদের ফ্ল্যাটে থাকি। এসব না বললে কেউ মিশতে চায় না। ছোটোলোক ফকির মনে করে, বন্ধু হয় না। আমি তাই মিথ্যা বলি।
কিন্তু মিথ্যা বললে তো হয় না। দেখাতেও হয়। কিন্তু দেখানোর জন্য টাকা কই? তোমরা কেউ তো কিছু দাও না। তাই সরানো শুরু করলাম। পঞ্চাশ, একশো যা পেতাম। একদিন সাহস করে তোমার তিন হাজার নিয়েছি, আরেকদিন ভাইয়ের পাঁচশো। এরপর দেখলাম এইটা সহজ। এতদিন টুকটাক টাকাই নিয়েছি। আঙটিটা নিতাম না। নিয়েছি কারণ আমার বন্ধুরা সবাই ঘুরতে যাচ্ছে। আমি টাকা চেয়েছি, কেউ দাও নাই। আমি কী করতাম বলো? তাই আঙটি নিয়েছি। তাছাড়া এই আঙটি, গয়না এগুলো তো আমার বিয়ের জন্য রাখা। আমারই জিনিস।
এই আঙটির জন্য তোমরা ঠিক করেছ আমাকে পাহারা দিয়ে রাখবা। তাহলে তো আমি আর এখানে তোমাদের সাথে থাকতে পারবো না। আমি একজনকে ভালোবাসি। সেও আমাকে ভালোবাসে। তাকে বিয়ে করে শ্বশুর বাড়িতে থাকবো। সে ভালো ছেলে, ঢাকায় নিজেদের ব্যবসা, বাড়ি সব আছে। কিন্তু একদম খালি হাতে শ্বশুর বাড়ি যেতে কেমন লাগে, তাই গয়নাগুলো নিয়ে গেলাম। টাকাটাও নিলাম, টুকটাক খরচ যদি লাগে। এমনি বিয়ে দিতে গেলে তো তোমাদের আরও বেশি লাগতো। আশিক ভাইয়ার ফোনটাও নিলাম। ভাইয়া মনে করো বোনের বিয়েতে পুরান ফোনটা গিফট দিছ। ফোনে ছবি তুলবো। আমার ভালো কোন ফোন নাই। আর তোমার বিয়ের সময় বৌয়ের গয়না তো শ্বশুর বাড়ি থেকে দিবে তুমি গয়না দিয়ে কী করবা। এগুলো বোনরে দিছ ভাব। আতিয়া আপাও এখন আর গয়না পরে না। আমার জিনিস আমিই নিয়েছি। চোর হলাম কিভাবে?
সবশেষে আম্মা, আমার উপর মনে কষ্ট রাইখো না। শ্বশুর বাড়ি গিয়ে তোমাদের দাওয়াত দিব। সবাই এসে আমাকে দোয়া করে যাবা। আর সোনার উপর লোভ রাইখো না। বয়স হলে আল্লাহ খোদার নাম নিতে হয়।
আল্লাহ হাফেজ,
আলো আক্তার।”
চিঠি পড়ে আতিয়া হতভম্ব। কাকে বিয়ে করতে গিয়েছে আলো! কার পাল্লায় পড়েছে! এই ষোল বছরের উঠতি বয়সী মেয়েকে নিয়ে যদি খারাপ পাড়ায় বিক্রি করে দেয় কেউ, তবে কিভাবে আলোর হদিস পাবে আতিয়া!
দেলোয়ারা বেগম বিলাপ করতে শুরু করেন। কিছুক্ষণ মেয়েকে গালি দেন, কিছুক্ষণ গয়নার জন্য বিলাপ করেন। পরক্ষণেই আবার কমবয়সী মেয়েটা কার সাথে কোথায় গিয়ে কোন বিপদে পড়েছে তাই ভেবে চিন্তায় অস্থির হোন।
“আম্মা, কান্নাকাটি কইরো না এখন। খবরদার কাউরে কিছু বলবা না এখন। কিছু বলার দরকার নাই। আমি খোঁজে বের হইতেছি। খোঁজ নিতাছি কোন ছেলের সাথে লাইন করছে। তার আগে যেন কেউ টের না পায়।”
আশিক সাবধান করে।
“আশিক, পুলিশে জানাবি? কোথাও গেল, কার সাথে গেল। কাল রাতে ওরে এমনে জেরা না করলেই হতো।”
“আপা, আলো কিন্তু এত বোকাও না। আমার মনে হয় ও অনেকদিন ধরেই বিয়ে করার কথা ভাবছিল। হুট করে কাল রাতের ঘটনায় নেওয়া সিদ্ধান্ত না। ভাবছিল আগে থেকেই। কালকের ঘটনায় হয়তো জলদি জলদি এসব করছে। তবে যে ছেলের সাথে গিয়েছে সেই ছেলে তো আকাশ থেকে পড়ে নাই। আমি খোঁজ নিচ্ছি।”
আশিক দুপুরের ভেতর খোঁজ নিয়ে বের করে ফেলে আলোর যে ছেলের সাথে সম্পর্ক তার নাম রাতুল। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্সে পড়ে। বাড়ি কামরাঙ্গীচর। ঠিকানাও মোটামুটি বের করেছে। ছেলের পড়ালেখা প্রায় শেষ, তবে এখনো কিছু করে না। বন্ধুবান্ধব নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, ভাইয়ের সাথে ব্যবসার কাজে সাহায্য করে। কামরাঙ্গী চরে বাড়িটা নিজেদের হলেও অবস্থা যে খুব ভালো তা নয়। অনেকগুলো ভাই-বোন। অবিবাহিত বড়ো ভাই বোন সবই আছে। এই ছেলে আলোকে কিভাবে বিয়ে করবে বুঝতে পারছে না আশিক। করলেও বাড়িতে নিয়ে তুলবে কিভাবে! মনে হচ্ছে আলো রাতুলের সবটা জানে না। ততটুকুই জানে যতটুকু রাতুল জানিয়েছি। সাথে নিজেও আরেকটা চিন্তায় পড়ে, রাতুল কতটুকু জানে আলোর ব্যাপারে। আলো নিজেই চিঠিতে লিখেছে যে সবাইকে বলতো বোন ডাক্তার, ভাইয়ের ব্যবসা আছে, নিজেদের ফ্ল্যাট আছে।।এসব কথা নিশ্চয়ই রাতুলকেও বলেছে! বোনটা নিজেকে যতটা বুদ্ধিমান ভাবে ততটা আসলে না। বাইরে না দেখালেও মনে মনে চিন্তা ঠিকই হচ্ছে আশিকের। রাতুল যে জায়গাগুলোয় আড্ডা দেয়, সেসব জায়গায় খুঁজে রাতুলকে পায়নি আশিক। আলোর বন্ধুরা জানিয়েছে আজ আলোর রাতুলের সাথে কোথাও বেড়াতে যাওয়ার কথা। কোন একটা রিসোর্টে! ঢাকার আশেপাশে ব্যাঙের ছাতার মতো অসংখ্য রিসোর্ট হয়েছে। কোথায় গিয়েছে আলো! ফিরে আসতে পারবে তো! না সেখান থেকেই হাতবদল হয়ে যাবে!
(চলবে)
#গোধূলি_রাঙা_আলোয়
#পর্ব১৮
আলোর ভীষণ ভালো লাগছে। এত সুন্দর জায়গায় আগে কখনো আসেনি। যদিও রাতুলের দুই বন্ধুর সাথে আসা মেয়ে দুটো খুব নখরা করছে, বলছে রুম ছোটো, বাথরুম ছোটো বাথটাব নেই, রুম অতটা পরিষ্কার না, খাওয়া ভালো না, সুইমিং পুল ছোটো আরও কত কী!
অথচ আলোর তো সবই ভালো লাগছে। কী সুন্দর সাদা টাইলসের রুম, সাদা টাইলস বসানো বাথরুম। বাথরুমের একটা অংশ গোসল করার জন্য আলাদা করে দেওয়া। গোসল করলে পুরোটা বাথরুম ভিজবে না। তাদের বাসায় একটাই বাথরুম, সেই বাথরুমের কালো রঙের ফ্লোর সবসময় ভিজে থাকায় কেমন পিচ্ছিল হয়ে থাকে। এই বাথরুমের চেয়ে আয়তনে অর্ধেক সেই বাথরুমেই কাপড় ধোয়া থেকে সবকিছু করতে হয়। আর এই মেয়েগুলো কী বলে যে বাথরুম ছোটো! আর বিছানাটা কী ঝকঝকে সাদা চাদরে ঢাকা তুলতুলে নরম। গা এলিয়ে দিলে শরীর ঢুবে যায়। আলোর খুব ইচ্ছে হচ্ছে সুইমিং পুলে নামার কিন্তু রাতুলের ইচ্ছায় আগে রুমে আসতে হয়েছে। আলোকে ভীষণ করে কাছে পেতে উতলা হয়ে গিয়েছে রাতুল। আলোও খুব বেশি আপত্তি জানায়নি। রাতুলকে রাগিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে নেই। থাক আগে রাতুলের সাথে রুমে সময় কাটাক। সবে বেলা বারোটা। বিকেল চারটা পর্যন্ত সুইমিং করা যাবে। এত তাড়ার কিছু নেই। সবাইকে বিদায় দিয়ে রুমে এসে ঢুকেছে রাতুল। বাকিরা সুইমিং এ যাচ্ছে। রাতুল দরজা লাগিয়ে দিয়ে আলোর কাছে আসে। আলোর বয়স সবে ষোল হলেও রাতুলের বয়স প্রায় পঁচিশ।
রাতুল প্রেম ভালোবাসার কথা বলে খুব বেশি সময় নষ্টের ভেতর যায় না। সময় কম, যা করার এই সময়ের ভেতর করতে হবে। রাতুলের অস্থিরতায় কষ্ট হয় আলোর। পূর্ণ বয়সী যুবকের শরীরের ভারে নিষ্পেষিত হতে হতে প্রথম মিলনের স্বাদ উপভোগ করার চেয়ে কেমন যন্ত্রণা হতে থাকে। তবু দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে যায়। প্রথম প্রথম এমন কষ্ট হয় শুনেছে। মনকে বোঝায় আলো।
বেলা গড়াতে থাকে ঘড়ির কাঁটা ঘুরতে ঘুরতে বেলা তিনটে। আলোর সমস্ত শরীরে কেমন ব্যথা। রাতুল কোন একটা কিছু খেয়েছে বুঝতে পারছে আলো। রুমে এসেই একটা ট্যাবলেট খেয়েছিল। বললো এটা প্রয়োজন। তারপর কেমন পশুর মতো আচরণ। এতোদিনের চেনা রাতুল আর আজকের রাতুলের মাঝে অনেক পার্থক্য। এই রাতুলের মাঝে যেন কোন মায়া মমতা নেই। প্রবল ভাবে পিষে ফেলা আর আঘাত দেওয়ার মাঝেই যেন শারীরিক আনন্দ খুঁজে পাচ্ছিল রাতুল। থেমে থেমে বারবার ঝড় উঠেছে রিসোর্টের এই নিরিবিলি কামরায়। ঝড় শেষে সাদা চাদরে ছোপ ছোপ লাল রক্ত ঘোষণা দিচ্ছে আলোর কুমারিত্ব হারানোর।
“আলো, উঠে মুখ হাত ধুয়ে কাপড় বদলাও। খেতে যাব। চারটার পর লাঞ্চ কুপন কাজ করবে না। সুইমিং করার সময়ও শেষ হয়ে যাচ্ছে।”
“আমি মাথা ওঠাতে পারছি না। অনেক রক্ত গিয়েছে।”
“আরে না। সাদা চাদর দেখে অনেক রক্ত মনে হচ্ছে। তুমি তাড়াতাড়ি গায়ে একটু পানি দিয়ে গোসল দাও। ঠিক হয়ে যাবে।”
“আমি একটু শুই। দুর্বল লাগতেছে।”
“ধ্যুত! এত দুর্বল হলে কিভাবে হবে। শোনো ছয়টায় কিন্তু বের হয়ে যেতে হবে। আগে তোমাকে তোমার বাসার কাছে নামিয়ে দেব। তারপর আমার বাসায় যাব।”
“আমার বাসায়? আমি না তোমাকে বলছি যে বাসায় চিঠি লিখে চলে আসছি আমি।”
“আলো, পাগলের মতো কথা বলে না। আমার মেঝো ভাই এখনো বিয়ে করেনি, দুই বোন অবিবাহিত আছে। আমি নিজেই এখনো কিছু করছি না। এই সময় তোমাকে নিয়ে উঠবো কই! তারচেয়ে তুমি বাসায় যাও। বিয়ে তো আমরা করেই ফেলেছি। আমরা এখন নিজ নিজ বাসায় যাই। বাসায় জানাবো। আমার আম্মা, আব্বা তোমাদের বাসায় যাবে। সুন্দর করে তোমাকে তুলে আনবে। এর মাঝে তুমি বাসায় বলে দশলাখের ব্যবস্থা করবা।”
“দশ লাখ! কী কও! এত টাকা কী জন্যে?”
“আমাদের সংসার করতে হলে আমাকে কামাই করতে হবে না? তোমার স্বামী বেকার থাক চাও তুমি? আমি এই টাকা দিয়ে কোথাও চাকরিতে ঢুকবো। না হলে ব্যবসায় লাগাবো। তারপর তো সব তোমারই।”
“দশ লাখ দূর, আমার পরিবার এক লাখও দিতে পারবো না। যা ছিল আমি নিয়ে এসেছি।”
“কী আনছো?”
“আমার বিয়ের জন্য বানানো গয়না আনছি।”
রাতুল উঠে গিয়ে আলোর ব্যাগ হাতে নেয়।
“আগে বলবা না! কত ভরি হবে? আরে বোকা এই ব্যাগ এমনে রাখে কেউ। আগেই তো আমার হাতে দেওয়া দরকার ছিল। কয় ভরি গয়না?”
“গলার চেইন, কানের দুল, এক জোড়া চুড়ি, দুটো আঙটি। তিন, সাড়ে তিন ভরি হবে।”
“মাত্র! আরে আট দশ ভরির নিচে বিয়ের গয়না হয় নাকি!”
“আমার মেঝো বোনের বিয়েতে আড়াই ভরি দিয়েছে।।কত সুন্দর বিয়ে হয়েছে। কেন হবে না।”
“তোমার ডাক্তার বোন, ব্যবসায়ী ভাইয়ের হাত এত ছোটো কেন! তোমাদের নিজেদেরও তো টুকটাক সম্পদ আছে না?”
“রাতুল, রাগ করো না। আমি একটু বাড়াই বলছি বুঝছো। আমার বোন হাসপাতালের নার্স। সেই সংসার চালায়। ভাই দোকানে চাকরি করে। বেতন কম। তবে সামনে বড়ো চাকরি পাবে। পরীক্ষা দিছে ভালো ভালো জায়গায়। ছাত্র ভালো।”
রাতুল কথার মাঝে ব্যাগে খুঁজতে খুঁজতে গয়নার পুটলি পায়। গয়না খুলে খুবই হতাশ হয়। সনাতনী সামান্য কিছু গয়না। বিক্রি করতে গেলে ভরিতে আরও কাটা যাবে। পুরো তিনভরির দাম পাবে না। দুই, আড়াই লাখ পেতে পারে।
“আলো, এইটা তুমি ঠিক করো নাই। তুমি বাড়িয়ে বললা ক্যান? আর এই গয়নায় কী হবে? শোন এই গয়না আমার কাছে থাক। তুমি আজ বাসায় যাও। দশ লাগবে না। আর পাঁচ লাখের ব্যবস্থা করে ফোন দিও। আমি আব্বা আম্মাকে পাঠিয়ে তোমাকে তুলে আনার ব্যবস্থা করবো।”
“আমি এত কিছু বুঝি না। তুমিই তো খালি আদর করার সময় বলতা তোমার কাছে একবারে চলে আসার জন্য। আজ যখন এসেছি তখন এভাবে আমার জীবন নষ্ট করলা। বিয়া করে বাসায় না নিতে পারলে আমার সাথে সম্পর্ক ক্যান করলা। এতক্ষণ আমাকে খামচি দিয়ে, কামড়ে কিছু রাখো না। আমি সব সহ্য করছি। এখন আবার আমার গয়না নিতে চাও। রাখো আমার গয়না রাখো।”
“এই মা*গী! ইতরামি করস? তুই নিজে এসে শুয়েছিস আমার সাথে। আমি কোন জোর করছি? এখন আবার বলোস যে আমি তোকে নষ্ট করছি!”
“তুমি আমারে গালি দিতে পারলা! জানোয়ারের মতো অত্যাচার করো নাই এতক্ষণ? তোমাকে স্বামী ভেবে সহ্য করছি। এখন তুমি যদি আমাকে সাথে করে বাড়িতে না নাও আমি সবাইরে বলবো তুমি আমারে ফুসলাইয়া এখানে আনছো। বিয়ে করছো। তারপর জোর করে রেপ করছো। আমার গায়ের দাগ দেখাবো সবাইরে। সবশেষে আমার সাথে থাকা টাকা পয়সা গয়নাও নিয়ে যাইতে চাইতেছ। আমি চিৎকার করে বাইরে সবাইকে বলবো।”
রাতুল তাড়াতাড়ি গয়নার পোটলা রেখে দেয়।
“আরে বোকা মেয়ে। আমার বাঘিনী একদম। আমি তোমাকে পরীক্ষা করলাম বোকা। এভাবেই গলায় শক্তি রেখে তেজ রেখে কথা বলতে হবে আমার বাড়িতে গেলে। আমার ভাই বোন,মা, বাবা কেউ তো ছেড়ে কথা বলবে না। সাহস রাখবা হ্যাঁ?”
“সত্যি! আর টাকা চাইলে যে। এত টাকা কিন্তু আমার ভাই বোনের নাই।”
“আরে কিছু লাগবে না। তোমার গয়নাও তোমার কাছে রাখো। আমার বাসায় ঢুকার আগে পরবা। নতুন বৌ ভাব আসে যেন। আর আজ কিন্তু আমরা আসলেই বাড়ি যাচ্ছি না। কারণ আজ আমাদের হানিমুন রিসোর্টে। আমরা এইখানেই রাতে থাকবো। ওরা চলে যাবে। তোমারে একটু সারপ্রাইজ দিতে চাইলাম। তুমি তো আমাকে বিশ্বাসই করো না।”
“না না বিশ্বাস করি। অবশ্যই করি। না করলে কি তোমার সাথে আসতাম। মাফ করে দাও।”
“হ্যাঁ কত কিছু বললা। জানোয়ার নাকি আমি! বৌকো আদর করলে এসব শুনতে হয়।”
“আমি অনেক কষ্ট পাইছি।”
“আচ্ছা স্যরি। তুমি এখন আস্তে আস্তে উঠে গোসল করে নাও। আমি খেয়ে। আমি তোমার জন্য রুমে খাওয়া নিয়ে আসবো। খেয়ে ব্যথার ঔষধ খেয়ে ফেললে আর ব্যথা থাকবে না।”
রুম থেকে বের হয়ে রাতুলের খাওয়ার চিন্তা মাথায় উঠেছে। আগে আলোর একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এই মেয়ে যে নাছোড়বান্দা। সাথে বাড়িতে না নিলে এখানে তামাশা করবে। গয়না আর টাকাগুলো নিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতে পারলে ভালো হতো। এই ফকিন্নি মেয়েকে বৌ করে সাথে নিয়ে যাওয়ার কোন ইচ্ছেই রাতুলের নেই।
(চলবে)