#গোধূলি_রাঙা_আলোয়
#পর্ব_২১
“মিসবাহ, আমি কালও আপনাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে কামনা করেছি, আজও করি। কিন্তু আজ এই মুহুর্তে কাবিন কিভাবে করবেন? সেই তো আলোর মতোই হবে বিষয়টা। আলোর বয়স কম ছিল, ও ভুল করেছে। কিন্তু আমরা দু’জনই মধ্যবয়সী পরিণত মানুষ। আমাদের এভাবে পরিবারের মুখোমুখি না হয়ে লুকিয়ে বিয়ে করা কি মানায়?”
“আমার আম্মা মেনে নিবে না আতিয়া। তাছাড়া আমার মেজো ভাইয়ের বৌ রত্নাও হয়তো তোমার সাথে খুবই খারাপ ব্যবহার করবে। যতই হোক তার আপন ভাইকে জেলে পাঠানো হয়েছে। এর জন্য তুমি আর আমি ওর কাছে অপছন্দের মানুষ। আমি ভাসুর, আমার সাথে সরাসরি তর্কে না জড়ালেও, তোমাকে নিশ্চয়ই ছেড়ে কথা বলবে না। পলিনকে আগে ও যা টুকটাক একটু দেখতো। এখন মেয়েটাকে একদম চাচাতো ভাই বোনের কাছে ঘেঁষতে দেয় না। মেয়েটা খুব কান্নাকাটি করে। দাদির কাছেই থাকে। কিন্তু সবার শাপশাপান্ত থেকে তোমাকে নিয়ে পলিনের মনেও নিশ্চয়ই সেই রকমই একটা খারাপ ধারণা তৈরি করে নিচ্ছে। মা, রত্না, পলিন সবার বৈরী আচরণ কি তোমার জন্য সহজ হবে?”
“তাহলে কাবিন করে কী করবেন? আলাদা রাখবেন আমাকে? একদিন বলেছিলেন নতুন করে আবার জীবন শুরু করার কথা ভেবেছিলেন পলিনের কথা ভেবে। পলিনের মায়ের আদর, শাসন প্রয়োজন আছেন ভেবেছেন। সেই আমি যদি আপনাকে বিয়ে করে ওর মা হওয়ার জায়গাটায় না বসতে পারি, তবে আপনার বিয়েতে পলিনই বা কতটুকু লাভবান হবে? ওর তখন আরও বেশি করে মনে হবে যে আমি সত্যিই ডাইনি। আগে তো ওর মা ছিল না। এখন বাবাকেও ছিনিয়ে নিলাম।”
“আপাততঃ। তুমি তোমার মায়ের বাসায় থাকলে। বা আমি আলাদা বাসা নিয়ে দিলাম। আস্তে আস্তে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তখন তোমাকে বাড়িতে নিয়ে যাওয়া সহজ হবে।”
“এটা কি কোন সমাধান? আমাকে আলাদা ঘর করে রাখবেন। কিন্তু বাড়িতে যদি কখনোই পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হয়? একদিন আপনার মায়ের চাপে আপনি আয়নাকে দেখতে গিয়েছিলেন, আরেকদিন হয়তো আপনার মায়ের চাপে আয়নাকে বিয়ে করে নিজেদের বাসায় তুলবেন! দুটো বৌ রাখার ক্ষমতা আপনার আছে। কিন্তু আমার উপবস্ত্র হওয়ার খায়েশ নেই। মূল বৌকে বাড়িতে রেখে আলাদা ঘর করে আমাকে তোলার প্রস্তাব আগেও পেয়েছি। বিয়ের সার্টিফিকেটের সাথে আমার সকল খরচও দিতে চেয়েছে। কিন্তু কখনোই রাজি হইনি। আমি নিজের সংসার চেয়েছি, সেটা সবাইকে নিয়ে সম্মানের সাথে। কেউ আমাকে উটকো বলতে না পারুক, রক্ষিতা নাম না দেক তাই চেয়েছি। নিজের খরচ আমি নিজেই চালাতে সক্ষম। আমি শুধু একজন জীবনসঙ্গী চেয়েছি। আজ আপনাকে ভালোবাসি বলে ঘুরেফিরে তেমনই কিছুতে রাজি হবো, তা হয় না মিসবাহ। আপনি সিদ্ধান্ত নিন, আজ এই মুহুর্তে। হয় সবার মুখোমুখি হয়ে আমাকে বিয়ে করে বাড়িতে প্রবেশ করার সাহস করবেন। আর না হয় আজকের পর আমাদের আর দেখা না হলো।”
“আতিয়া! এসব কী বলো! আমি আয়নাকে ইতোমধ্যে জানিয়েছি যে আমার পছন্দ আছে। হ্যাঁ মেয়েটা কান্নাকাটি করেছে। ভেবেছে ওর ছেলেকে নতুন সংসারে আনতে চেয়েছে বলে আমি বিয়ে করতে না করেছি। কিন্তু আমি বুঝিয়ে বলেছি। আর অন্য সবার সাথে তুমি আমাকে মেলাতে পারো না আতিয়া। আমি বিয়ের নাম দিয়ে গোপনে ঘরে তুলে তোমাকে ভোগ করতে চাইনি। তোমাকে সমাজের কাছে স্ত্রী পরিচয় দিয়েই গ্রহণ করবো। ভোগ করতে চাইলে, টাকার বিনিময়ে পাওয়া মেয়েদের সংখ্যা কম নয়।”
“আমি বিশ্বাস করি আপনাকে। তাই এইটুকু চাই যে আপনি আপনার পরিবারের মুখোমুখি হয়ে আমাকে বিয়ে করার কথা স্পষ্ট করে বলবেন। আমিও আমার পরিবারকে জানাবো। জানি হয়তো বিষয়টা সহজ হবে না। কিন্তু সকলকে জানিয়েই বিয়ে করতে চাই। তারপর কাল বাদ আসর আপনি আমার বাসায় বরযাত্রী নিয়ে আসবেন। যদি কেউ আপনার সাথে আসতে রাজি না হয়,আপনি একাই আসবেন। আমার পরিবারেও কেউ যদি পাশে নাও থাকে, আমি একাই বধূ বেশে আপনার অপেক্ষায় থাকবো। পঁয়ত্রিশ বছর বয়সে বৌ বেশে কতটা ভালো লাগবে জানি না। কিন্তু আপনার জন্য সাজবো।”
“আমি আসবো। অবশ্যই আসবো।”
রাস্তার ওপর পাশে আড়ং এর লাইটগুলো জ্বলে উঠেছে। ঝলমল করছে তিনতলা আড়ং এর শো রুম। মিসবাহ আতিয়ার চোখ মুছে দিয়ে হাত ধরে টেনে নেয়। বলে, “চলো বিয়ের শাড়ি কিনে দেই।”
“বিয়েতে জামদানী পরবো না।”
“তবে?”
“আমার খুব শখ লাল টুকটুকে একটা বেনারসী শাড়ি পরার। কখনোই এই শখ পূরণ হয়নি। আমার মৃত স্বামী হাসানের মা আমার জন্য বেগুনি রঙের শাড়ি কিনেছিলেন। তখন বলতে পারিনি লাল চাই। আজ আপনাকে বললাম।”
“আমি কিছু চাইতে পারি?”
“অবশ্যই। আর হ্যাঁ আপনার জন্য বিয়ের পাঞ্জাবি কিন্তু আমি কিনবো। হয়তো সস্তা হবে। আমার অত টাকা কই। কিন্তু তাই দিতে চাই।”
“তোমার ইচ্ছে শিরোধার্য। এবার আমার কথা রাখ। আজ এখন থেকে তুমি করে বলবে, আপনি না। বলবে?”
“বলবো।”
আতিয়া বাড়িতে ঢুকে দেখে আয়েশা এসেছে। খলিলও আছে কিনা কে জানে! আশিকের সাথে আগেই কথা বলছে আতিয়া। আশিকও ঘরেই বসে আছে।
“আপা, হাতে কিসের ব্যাগ এত?”
“শাড়ির। আর টুকটাক গয়না।”
মিসবাহ জোর করে একজোড়া বালা, গলা আর কানের একটা সোনার জড়োয়া সেট নিয়ে দিয়েছে আতিয়াকে। সোনা ছাড়া নাকি বিয়ে অসম্পূর্ণ লাগে।”
“হঠাৎ শাড়ি, গয়না!”
দেলোয়ারা বেগমও পায়ে পায়ে এসে দাঁড়ান। এখন ওনার তেজ অনেকটাই কমে গিয়েছে। জলজ্যান্ত মেয়েটা এভাবে হারিয়ে যাবে কখনও ভাবেননি। মা মন তো, এতটাও পাষাণ হতে পারে না। মেয়ের শোকে সোনা হারানোর কষ্ট, আয়েশার স্বামী খলিলের টাকা মেরে দেওয়ার কষ্ট, সবই এখন সামান্য মনে হয়। আজ তাই নিজেই আয়েশাকে ফোন দিয়ে আনিয়েছেন। সন্তানদের জন্য মনটা কেমন খা খা করছিল।
“আতিয়া, কিসের শাড়ি গয়না রে? দামি ব্যাগ দেখা যায়।”
“আম্মা, কাল বাদ আসর মিসবাহ ভাই, আপাকে বিয়ে করতে আসবে। শাড়ি, গয়না আপার বিয়ের।”
আতিয়ার হয়ে উত্তর দেয় আশিক। আয়েশা হিংসায় জ্বলে যায়, যখন বুঝতে পারে এই মিসবাহ, আশিকের দোকানের মালিক। এবং লোকটা ভালো পরিমাণ টাকা পয়সার মালিক। নিজের হিংসাকে গোপন করতে আলোর কথা তুলেই আতিয়াকে আঘাত করতে চায় আয়েশা।
“দেখেছো আম্মা! আমাদের আলোর কোন খোঁজ নাই। বাইচ্চা আছে না মইরা গেছে আমরা জানি না। আর আপা আছে নিজের চিন্তায়। সেই পরিবারেরই একজনকে বিয়া করতেছে। নিজের মা বোনেই জন্য এইটুকু মায়া নাই তোমার আপা। এত পাষাণ, এত স্বার্থপর। খালি নিজের সুখের কথাই ভাবলা আজীবন। এভাবে কোনদিন সুখী হইবা না।”
“নিজের সুখের কথা কে না ভাবে আয়েশা। তুইও ভাবোস। তাই মায়ের টাকা মাইরা দিলেও জামাইয়ের পক্ষ নেস। নিজের পছন্দে বিয়া করছস। টাকা, গয়না সময়ে সময়ে সবই বাইর করছস। আতিয়ারে অভিশাপ দেস ক্যান? তুই যদি সুখী হইতে পারোস, আতিয়াও পারবো।”
দেলোয়ারা বেগমের কথায় হতভম্ব হয়ে যায় আতিয়া। মা তার পক্ষ নিবে কেনদিন ভাবেনি আতিয়া। আয়েশাও বিশ্বাস করতে পারে না।
“কী বলো আম্মা!”
“ঠিকই কই। এই যে আলো নিখোঁজ হইলো। তুইও তো বোন। তুই কী করছস? থানা, পুলিশ, টাকা পয়সা খরচ যা করার এই আতিয়া করছে। নিজের কানের একজোড়া সোনার বালি সম্বল আছিল। সেটাও বিক্রি করছে।”
“বাহ্! আম্মা, বড়োলোক জামাই পাওয়ার গন্ধে দেখি আপা এত ভালো হইয়া গেল তোমার কাছে!”
“আলো আর তোরে তো সবসময় ভালা পাইছি। কী করছস তোরা? একটা মাইয়া মুখে চুনকালি দিয়ে পলাইয়া গেল। কই আছে কে জানে। সবাই খোঁজ নিতে আইসা আমাকে ঠেস দিয়া যায়। কয় বাপ মরনের পরে মাইয়া নষ্ট হইয়া গেল, আমি মা হইয়া খেয়াল করি নাই! অথচ আলো আর তোর জন্য করি নাই এমন কী আছে? তুই যে এত বড়ো বড়ো কথা কস, তুই আর তোর জামাই এতদিন আইছস মায়ের কাছে? আসোস নাই ভাবছস ঝামেলাতে না পড়স। এখন ঐ পোলা সব স্বীকার করার পর নিশ্চিন্ত হইছস। তাই আজ ডাকনের পর আসছস। শোন তোদের কারও সাথে আর কোন অশান্তি চাই না আমি। তুই যা পাইতি নিয়া গেছস। আলো যা পাইতো নিয়া গেছে চুরি কইরা। আশিক ছেলে মানুষ। নিজেরটা নিজে কামাই কইরা চলবো। কিন্তু আমার আতিয়া মাইয়াটা কি পাইছে এই সংসারে! আমার শরীর খারাপ লাগে। ঘুমের ভেতর মৃত্যু দেখি, তোদের বাপরে দেখি। আমারে কয় আতিয়ার একটা গতি করতাম আমি। আশিক তোর মিসবাহ্ ভাই যদি আসলেই আমার আতিয়ার ভালা চায়, তাহলে আমার কোন আপত্তি নাই। এইবার মাইয়াটা সুখ পাক।”
আয়েশা আর কিছু বলে না। ঝগড়া করার জন্য গলায় জোর আসে না আর। আতিয়া দৌড়ে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে। দেলোয়ারা বেগমও আতিয়াকে জড়িয়ে ধরেন। ষাটোর্ধ দেলোয়ারা বেগমের কুঁচকানো চামড়ার হাত দুটো ধরে বড়ো কোমল মনে হয় আতিয়ার। কতদিন, কতদিন মায়ের এই স্নেহর জন্য আকুল ছিল সে। আজ যেন দু’জনের মাঝখান থেকে স্বার্থের পর্দাটুকু উঠে গেল।
(চলবে)
#গোধূলি_রাঙা_আলোয়
#পর্ব_২২
আতিয়ার বাসার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র জাহানারা ভিলায়। যদিও রাজকীয় কোন বাড়ি নয়, তারপরও নিজের শ্রমে বাবার জায়গার উপর তিল তিল করে এই বাড়ি দাঁড় করিয়েছে মিসবাহ। এই বাড়ি তাই মিসবাহর রক্তপানি করা রাজবাড়ীই। বাড়ির নাম দিয়েছে মায়ের নামে। জাহনারা ভিলা। তিনভাই এই বাড়িতে একসাথে যৌথ পরিবার হিসেবেই রয়েছে। নিচের তালায় কেউ থাকতে চায় না এখন। বদ্ধঘর গরম, আলো প্রবেশ করে না। তাই নিচে দোকানঘর আর গুদাম করে দিয়েছে। দোতলা পুরোটা নিয়ে মিসবাহর পরিবার থাকে।
ছাদের উপর একপাশটা খোলা, আরেকপাশে তিনটি ছোটো রুমের জন্য দুটো কমন বাথরুম আর একটা কমন রান্নাঘর করে রাখা। ভাড়া দেওয়া আছে রুমগুলো। দোকান আর গুদামের লোকজনই পরিবার নিয়ে ভাড়া থাকেন। মাসে পঞ্চাশ হাজার টাকা ভাড়া আসে সবকিছু মিলিয়ে। তা থেকে তিন ভাই দশ হাজার করে ত্রিশ হাজার রাখে। বাকি বিশ হাজার জাহনারা বেগমের জন্য বরাদ্দ করে দিয়েছেন মিসবাহ। মাকে যেন নিজের টুকটাক হাতখরচ, দান-খয়রাতের জন্য কোন ছেলের উপর নির্ভরশীল না হয়ে থাকতে হয়। কামরাঙ্গীচরে এখনো ঢাকার মূল অংশের মতো বাড়িভাড়া অতিরিক্ত নয়। বাড়িওয়ালা, ভাড়াটিয়া সম্পর্কও এখানে অনেকটা ঘরের মানুষদের মতো। তাই বাকবিতন্ডা শুরু হওয়ার পর তাদেরই কেউ কেউ এই রাতেও ঘরে চলে এসেছেন। বয়স্ক মহিলারা জাহনারা বেগমকে সামলাচ্ছেন। কমবয়সী মহিলারা রত্নার পক্ষ নিয়ে কথা বলছেন। মিসবাহর পক্ষে যেন কেউই নেই!
জাহানার ফোন দিয়ে বড়ো মেয়ে,ছোটো মেয়েকেও আসতে বলেছেন এই রাতেই। ছোটো মেয়ে হেলেন চলে এসেছে। বড়ো মেয়ে মোনা আসেনি। সবাই জাহনারা বেগমের পক্ষে। কেউই আলোর মতো মেয়ের পরিবার থেকে বৌ আনতে মত দিচ্ছে না। আতিয়া নাকি কোন মতেই এই বাড়িতে আসার যোগ্য না। এতোগুলা মহিলার আক্রমণে মিসবাহর অসহায় লাগে, কোণঠাসা হয়ে পড়ে। হেলেন বলে,
“ভাইয়া, আব্বা মারা যাওয়ার পর আপনি আমাদের গার্জিয়ান ছিলেন। আপনার ভালোমন্দ সব সিদ্ধান্ত আমরা আব্বার সিদ্ধান্তের মতো মেনে নিয়েছি। কারণ আপনি পরিবারকে ভালোবাসতেন। আমার তো এখনও বিশ্বাসই হয় না আপনি এই বয়সে বিয়ে করার জন্য এভাবে আম্মার বিপক্ষে দাঁড়াইছেন। আপনি হাসানের বয়সী হলেও মানা যেত। এই বয়সে নিজের পছন্দে দ্বিতীয় বিয়ে করার জন্য কেউ এভাবে ঘরে অশান্তি করে!”
“হেলেন, তুই, আম্মা সবাই তো চাইতি আমি যেন আবার বিয়ে করি। তুই নিজেও তো নানা প্রস্তাব আনছিস। পলিনের মায়ের দরকার আছে এই কথা তোরা সবাই বলছিস। এখন আমি যঝন নিজেই বিয়ে করতে চাইছি তোরা সবাই আমার বিরুদ্ধে কেন দাঁড়াচ্ছিস! এই জন্য যে আমি নিজে পছন্দ করে কাউকে বৌ করতে চাই? আম্মা আমার জন্য আয়নাকে পছন্দ করেছে। আয়না কি পাত্রী হিসেবে আলোর চেয়ে বেশি ভালো? আয়নার আগে একটা বিয়ে হয়ে ডিভোর্স হয়েছে, একটা ছেলে আছে। তাও আম্মার জিদ আমার আয়নাকে বিয়ে করতে হবে। এই জিদের কারণ কি এটাই যে আয়না আমার নিজের পছন্দ করা মেয়ে না? আমার বয়সে আমি যদি নিজের পছন্দে বিয়ে করতে চাওয়াটা মানানসই না হয়। তাহলে তোর কি বড়ো ভাইকে এসব প্রশ্ন করা মানানসই? না আম্মার এত জিদ করা মানানসই।”
“ভাইয়া সমস্যা তো ওনার পরিবারে। দেখ ওনার বোনের জন্য রত্না ভাবীর ভাই জেল খাটতেছে। একন যদি তুমি ওনাকে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে আসো সবার সাথে সবার অশান্তি হবে। এই বাড়িতে আসার আগেই যে মহিলা মা ছেলের সম্পর্ক নষ্ট করে দেয়। সে বাড়িতে আসলে ঘর ভাগ হবে।”
“এই বাড়িতে আগে আমার কোন রা ছিল না দেখে সব শান্তি ছিল। আমি কখনোই কন আওয়াজ তুলিনাই তাই তোদের সবার কাছে ভালো ছিলাম। কেনদিন পায়রাকেও আওয়াজ তুলতে দেই নাই। তাই ওর কাছে ভালো স্বামী হতে পারি নাই। ও আমার উপর বিশ্বাস রাখতে পারে নাই, চলে গিয়েছে ঘর ছেড়ে। একা হয়েছি আমি আর আমার মেয়ে। কিন্তু এসব কারও শান্তি ভঙ্গ করে নাই। তোরা সবাই যার যার জীবনে ভালো আছিস। সবচেয়ে বড়ো কথা রত্নার ভাই নিজের অপরাধে জেল খাটছে। ওর ভাইয়ের উপর ভরসা করে একটা মেয়ে ঘর ছাড়ছিল, আর ও সামান্য টাকার বিনিময়ে কার হাতে মেয়েটাকে তুলে দিলো? আজ আতিয়া আমার উপর বিশ্বাস রাখছে, আমি এই বিশ্বাস নষ্ট করি কিভাবে?”
জাহনারা বেগম উঠে দাঁড়ান। ছোটো মেয়ে হেলেনের দিকে তাকিয়ে বলেন, “হেলেন, তোর ভাইরে কইয়া দে কাল বাদ আছর সে আমাদের সাথে গিয়া আয়নারে বিয়া কইরা এই বাড়ির বৌ হিসাবে নিয়া আসবে। আর তা না করলে সংসার আলাদা করুম। আমি আর হাসান, হামিদ আর রত্নার সাথে খামু। মিসবাহ তার বৌ নিয়া আলাদা হইবো। এই ঘরেই আলাদা পাক হইবো আলাদা চুলা বসবো। ঘর ভাগ হইবো। বাড়ি কে বানাইছে বিষয় না। জায়গা আমার স্বামীর। বাড়ির মালিকানা আমার। আমি যেমনে চাইমু সেমনে ভাগ কইরা দিমু। যার লগে থাকুম তারে বেশি অংশ দিমু।”
আতিয়া কোন পার্লারে যায়নি। নিজে নিজেই শাড়ি পরেছে। লাল রঙের আলোয় মুহূর্তে কেমন বৌ বৌ মায়া ফুটে উঠেছে চেহারায়। শাড়ি পরে বসে থাকে আতিয়া। হাত আগায় না, কিভাবে কী সাজবে তাও বুঝে না। আয়েশা আর খলিল আসেনি। আশিক ছেলে মানুষ। দেলোয়ারা বেগম রান্নাবান্না দেখছেন। তাদের কারও কাছ থেকে কোন সাহায্য নেওয়া সম্ভব না। আতিয়া একা একা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে থাকে। আর দশটা বৌয়ের চেয়ে তার বৌ সাজাটা কত আলাদা! কোন বান্ধবী নেই সাথে, যারা হাসি তামাশা করে আসর জমাবে। একপাল ছোটোবড়ো কাজিনের দল নেই, যারা স্পিকার ভাড়া করে এনে জোরে গান চালিয়ে দিয়ে বোঝাবে যে এটা একটা বিয়ে বাড়ি। আশিক ওর দু’জন বন্ধু নিয়ে এসে বসার ঘরে কিছু ফুল, ডেকোরেশনের জিনিস দিয়ে সাজিয়েছে। আতিয়ার কাছ থেকে কোন টাকা নেয়নি।
রান্নায় দেলোয়ারা বেগমকে কুটাবাছা করে এগিয়ে দিয়েছে আতিয়া। এরপর পাশের বাসার দুই খালা এসে আতিয়াকে উঠিয়ে দিয়েছে। গোসল করে তৈরি হতে বলেছে। গোসলের আগে ওনারাই আতিয়ার গায়ে একটু হলুদ ছুঁইয়ে দিয়েছেন। আয়োজন সীমিত। পোলাও, মুরগী আর গরুর ঝাল মাংস, ডিমের কোরমা করেছেন দশজনের আন্দাজে। মিষ্টি হিসেবে সাগুর পায়েস রান্না করেছেন। নামাজের পরই বরযাত্রী আসার কথা। আতিয়ার কেমন অস্থির লাগছে। মিসবাহর বাড়িতে অশান্তি হচ্ছে জানে আতিয়া। মিসবাহ ঠিক মতো কথা বলার সুযোগও পায়নি। শুধু গভীর রাতে জানিয়েছিল ও আসবে। জোহরের নামাজের পরই রওনা দিবে ইনশাল্লাহ।
আতিয়ার হাত কাঁপছে। শাড়ির কুঁচি গুলো আজ নিখুঁত হয়ে ভাঁজ হচ্ছিল না। এলোমেলো উঁচুনিচু হয়ে যাচ্ছিল বারবার। মনের অস্থিরতা চলে এসেছে হাতেও। বারবার পিপাসা পাচ্ছে। হঠাৎ কলিংবেলের শব্দে আতিয়া চমকে ওঠে।
“আপু,আমরা চলে এসেছি!”
আতিয়ার হসপিটালের সিনিয়র স্টাফ নার্স জমিলা সিস্টার আর জুনিয়র সোনিয়া এসেছে। ওদের দুজনকে দেখে আতিয়ার এত ভালো লাগে। বন্ধু বলুক বা বোনের মতো, কর্মক্ষেত্রে এই দু’জনই আতিয়ার খুব কাছের। নিজের বিয়েতে আতিয়া শুধু এই দুইজনকেই নিমন্ত্রণ করেছে।
“আপু, মাশাল্লাহ লাল বেনারসীতে কী মানিয়েছে।”
“কী আর মানানো। শুধু শাড়িই পরলাম। সাজগোজে হাত আগাচ্ছে না।”
“হাত আগানো লাগবে না। তুমি হলে বৌ মানুষ চুপচাপ বসে থাকো। দেখ আমি কিভাবে সাজাই। সেদিনের মতো আজও ভাইয়া তোমার উপর থেকে চোখ সরাতে পারবে না।”
জমিলা সিস্টার এসে আতিয়ার হাতে আরেকটা তাবিজ গুঁজে দেন।
“দেখছিস আমার হুজুরের তাবিজের গুণ। এক তাবিজে তোর কপালের ফাঁড়া কেটে বিয়ে হচ্ছে। এখন বিয়ের পর দুধে ভিজিয়ে কোমরে এই তাবিজ বাঁধবি। স্বামী বশে থাকবে, দীর্ঘায়ু হবে।”
আতিয়া তো ঐ তাবিজ কবেই ফেলে দিয়েছে। মিসবাহ আতিয়ার জীবনে কোন তাবিজের গুণে নয়, বরং স্রষ্টার আশীর্বাদ রূপেই এসেছে। কিন্তু জমিলা সিস্টারকে কিছু বলে না আতিয়া। মনে কষ্ট পাবে সিস্টার।
“সোনিয়া, একদম হালকা সাজাবি। মুখ বেশু সাদা করিস না। এত লাল লিপস্টিক দেব না।”
“উফ্ চুপ করে বসো। আমাকে সাজাতে দাও। তাজা ফুল এনেছি। তোমার খোঁপায় লাগিয়ে দেব।”
আতিয়ার দু’চোখে কাজল টেনে সাজ শেষ করে সোনিয়া। সোনার গয়নাগুলো পরিয়ে দিতেই যেন রুম আলো হয়ে যায়। বৌ সে তো বৌ ই। বিয়ের সাজে এক আলাদা আলো আছে। যেকোন বয়সী, যেকোন নারীকে এই সাজে এক অন্যরকম পরিপূর্ণতা দেয়। আসরের সব আলো যেন বধূ নিজের দিকেই টেনে নেয় এই একটি বিশেষ দিনে।
“আপু, মাশাল্লাহ মাশাল্লাহ। এত সুন্দর লাগছে।”
দেলোয়ারা বেগম দরজায় এসে দাঁড়ান।
“আতিয়া, তোরে সুন্দর লাগতেছে। মাশাল্লাহ, আল্লাহ তোরে সুখী করুক।”
নিজের আঙ্গুল থেকে পুরানো আঙটিটা খুলে আতিয়ার আঙ্গুলে পরিয়ে দেন দেলোয়ারা বেগম।
“আম্মা, এইটা কী করেন। এইটা আব্বার স্মৃতি। আপনের হাতেই থাক।”
“তোরে কিছু তো দিতে পারলাম না। যা ছিল তোর, সবই তোর কাছ থেকে নিয়ে নিছি আমরা সবাই। এই আঙটিটা দেই। না করিস না।”
ঘড়ির কাঁটা তিনটা ছুঁইছুঁই। সবাই একটু অস্থির। মনে অমঙ্গল চিন্তা উঁকি মারছে। আশিক বাসা থেকে বের হয়ে গিয়েছে। দোকানের দিকে গিয়ে একটু খোঁজ নেবে ভাবছে। আতিয়া বারবার ফোন দিচ্ছে মিসবাহকে। কিন্তু ফোন বন্ধ পাচ্ছে। হাসানকে ফোন দিয়েছিল আশিক। শুনেছে ছোটো একটা এক্সিডেন্ট হয়েছে। আতিয়াকে বলে ভয় পাইয়ে দিতে চায় না বলে একটা বাহানা দিয়ে বের হয়েছে।
“আতিয়া, কী হইলো রে? ফোন ধরে না? মন ঘুইরা যায় নাই তো?”
“জানি না আম্মা। মন ঘুরলেও আর কী করার আম্মা।হয়তো তোমার মেয়ের কপালে লেখা নাই।”
মুখে কথাটা বললেও মনে বিশ্বাস করতে বড়ো। কষ্ট হয় আতিয়ার। চোখ জ্বালা করছে। কান্না আটকানোর চেষ্টায় রত আতিয়া দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে। নাহ্ মিসবাহ আসবে যেহেতু বলেছে নিশ্চয়ই আসবে। বিশ্বাস হারাবে না আতিয়া।
সন্ধ্যা ছয়টা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিটে দশ লাখ একটাকা কাবিনে মিসবাহর সাথে বিয়ের বন্ধনে বাঁধা পরে আতিয়া। ছোটো একটা এক্সিডেন্ট হয়েছিল ঠিকই। মিসবাহর বাইক এক্সিডেন্ট হয়েছে। ফোনটা পরে ভেঙে গিয়েছে। হাতেও সামান্য আঘাত পেয়েছে। কনুইয়ের কাছে চামড়া ছিলে গিয়েছিল পড়ে গিয়ে। মিসবাহর আঘাত দেখে আতিয়া নিজেই বেঁকে বসেছিল বিয়ে করতে। তার মনে জাঁকিয়ে বসেছে বরাবরের মতোই সেই অপয়া অপবাদের ভয়। তার সংস্পর্শে ভালোবেসে যেই আসে, সে ক্ষণিকের সাথী হয়। মিসবাহ তখন নিজেই পাশে গিয়ে বসে। বলে,
“আতিয়া, আমি যদি বলি তোমার কাছে আসব বলে কথা দিয়েছি বলেই আল্লাহ আমাকে আজ জীবন দিলেন। বিশ্বাস করো পিকআপটা যেভাবে আমার দিকে হঠাৎ এগিয়ে এসেছিল চোখের সামনে সাক্ষাৎ মৃত্যু দেখেছি। সেই মুহূর্তে মনে হয়েছে আমি আমার আতিয়াকে দেওয়া কথা কি রাখতে পারবো না! দৈবাৎ কিভাবে পিকআপের চাকার নিচে মাথা না গিয়ে রাস্তার অন্যপাশে পড়লাম, নিজেও জানি না। শুধু তোমায় কথা দিয়েছিলাম বলেই হয়তো এই জীবনটা আজ উপহার পেলাম। এখন তুমি আমাকে ফিরিয়ে দিলে এই জীবন নিয়ে আমি কোথায় যাব। সব হেলায় ফেলে যে আমি তোমার কাছে এসেছি।”
এমন করে ভালোবাসার প্রসাদ দিলে, তার ফিরিয়ে তো দেওয়া যায় না। আতিয়াও পারে না।
(চলবে)