#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-১৩)
লেখনীতে—ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
মেহজা ফ্রেশ হয়ে এসে ইরফানের বারান্দায় গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ায়। আশেপাশের প্রত্যেকটা ফ্ল্যাটে আলো জ্বলছে। মেহজা এই মুহূর্তে যেই বিল্ডিংটাতে আছে সেটি সবথেকে বড় বোধ হয়, গাড়ি থেকে নামার পর যে চোখ বুলিয়েছিল তখন দেখে নেয় ভালো করে। ইয়াজিদের রুম দশ তলায় কারণ এটিও ডুপ্লেক্স। বড়লোকের বিরাট কারবার বলে একটা কথা আছেনা! মেহজা নিচে ডাইনিং এ যেতে উদ্যত হলে তার চোখে আবারও সেই ফটোফ্রেমটি পড়ে। বেশি মাথা ঘামায়না সে এটা নিয়ে। আগের মতো কৌতূহলবোধ তার আর নেই।
নিচে গিয়ে দেখে ইমা সব রেডী করে ফেলেছে। ভাই-বোন দুজনেই টেবিলে বসা। তবে খাচ্ছেনা, গল্প করছে। মেহজা গিয়ে ইমার পাশে বসতেই ইমা তার প্লেটে ভাত বেড়ে দেয়। তারপর সবাই একসাথে খাওয়া শুরু করে। খাওয়ার ফাঁকে মেহজা একবার ইরফানের দিকে তাঁকায়। ইরফান হয়তো খাবারে মজা পাচ্ছেনা, জ্বরের কারণ রুচি চলে গেছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। তখন হঠাৎ ইমা ইরফানকে বলল,
“বাবু! খেতে খারাপ লাগছে বুঝি? কষ্ট করে হলেও এখন খেয়ে নে। ঔষুধ তো আর খালি পেটে খেতে পারবিনা।”
ইরফান শুধু ছোট করে “হুম” বলে। মেহজা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। এসব দেখে তার নিজেরও খাওয়ার ইচ্ছা মরে গেছে। কিন্তু না খেয়েও উঠতে পারছেনা। খাবার অপচয় করা ঠিক নয় এটা মেহজাও মানে আর ইমাও বারবার বলে দিচ্ছে। ইরফান বেশ অর্ধেক খেয়ে উঠে যায়। সে আর পারছেনা খেতে। ইমা আর কিছু বলেনি। জোর করে খাওয়ালে পরে বমি হতে পারে।
ইমা আর মেহজা সব কিছু ঠিকঠাক করে যার যার রুমে চলে যায়। ইমা বারবার বলে দিয়েছে ইরফানকে ঔষুধ খাইয়ে দিতে। আর ইরফান যদি বলে খেয়েছে তো ঔষুধের পাতা চেক করতে। যদি দুটো ঘর খালি থাকে তাহলে যেন বুঝে নেয় খেয়েছে। মেহজাও ইমাকে আশ্বস্ত করে সে সব সামলে নিবে। ইমা গেলে মেহজা কিছুক্ষণ বাসাটির এদিক ওদিক দেখে নেয়। আটটি রুম আছে এর মধ্যে ছয়টির একটি হলো ইরফানের বাবা-মায়ের, আর চারটি তার চার বোনের, একটি গেস্ট রুম আর একটি ছোট খাটো জিম করার রুম, বেডরুম প্রত্যেকটার সাথে এটাচড্ বাথরুম আর নিচে উপরে দুইটা লিভিং একটা ডাইনিং আর কিচেন আর কমন বাথরুম একটি। বারান্দা তিনটি রুমেই আছে একটা ইরফানের একটি ইরার ও তাদের বাবা-মায়ের রুমে। আর এমনিতে দোতলায় এক পাশে কাঁচের দেওয়াল যেটি দিয়ে বাহিরের অনেক কিছুই দেখা যায়। খুবই খোলামালে বাসা এটি। ইরফান নিজে এই ফ্ল্যাটটি নিয়েছে। নিজের একার হিসেবে নেয়নি বাবা-মা বোনদের জন্যও ভেবেছে আবার তাদের কথা ভেবে তাদের পছন্দ মতো সাজিয়েছে। এই ব্যাপারটা মেহজার খুবই ভালো লাগে। আজকাল কয়জন তার পুরো পরিবার আলাদা হওয়ার পরেও তাদের জন্য এতকিছু করে!
রুমে গিয়ে মেহজা দেখে ইরফান শুয়ে আছে বেডের একপাশে। মেহজা প্রথমে বেড সাইড টেবিলের ঔষুধ গুলো পরখ করে নেয়। ইরফান ঔষুধ খেয়েছে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে সে। মেহজা দেখে বারান্দার গ্লাসের ডানপাশে একটি লম্বা চিকন টেবিলে ইলেক্টিক কেটলী, কফি মেশিন সহ আরো অনেক সামগ্রী আছে কফি এবং চা বানানোর। মেহজা আলতো হেসে সেদিকে গিয়ে একটু কফি করে নেয়। দুধ নেই এখানে তারমানে ইরফান ব্ল্যাক কফিই খায়। কিন্তু মেহজা তো ব্ল্যাক কফি অপছন্দ করে। মগটা রেখে দিবে তখনিই পেছন থেকে ইরফান বলে ওঠে,
“নিচের ড্রয়ারে ইনটেক মিল্ক আছে। নিয়ে নাও সেখান থেকে।”
মেহজা হঠাৎ ইরফানের আওয়াজে কিছুটা ভয় পেয়ে যায়। পড়ে ইরফানকে তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে শান্ত হয়। লোকটি ঘুমায়নি! মেহজা কোনো প্রকার নড়াচড়া করছেনা দেখে ইরফান কিছুটা বিরক্তি প্রকাশ করে নিজেই গিয়ে দুধের প্যাকেটটা নেয়। মেহজাকে বলে,
“লিকুইড হলে হবে তো?”
মেহজা বাধ্য মেয়ের মতোই মাথা নাড়িয়ে জবাব দেয়,
“জ্বি হবে।”
ইরফান নিজেই এবার কফিটা সুন্দর করে তৈরি করে দেয় মেহজাকে। মেহজা সেটি নিয়ে এক চুমুক দেয়। অসাধারণ খেতে। কফিটা নিশ্চয়ই কোনো ভালো ব্রেন্ড এর, দুধ, চিনি সবকিছুই বিদেশী মনে হচ্ছে। মেহজা এখন আর কৌতূহল দমন করতে না পেরে ইরফানকে বলে,
“আচ্ছা এই কফিটা নিশ্চয়ই কোনো ভালো ব্রেন্ড এর! এতো মজার কফি আমি আর কখনও খাইনি।”
ইরফান মেহজার চঞ্চলতা দেখতে পেয়ে আনন্দিত হয়। সে পাশে থাকে ডিভাইনে গিয়ে বসে বলে,
“হ্যাঁ। এটি নাম করা কফির মধ্যে একটি। বিশ্বের সবচেয়ে আজব কফি বলে আমি মনে করি। এটার দামটাও কিন্তু চওড়া! মূলত এটি এক ধরণের পাখির মল দিয়ে তৈরি করে। ইন্দোনেশিয়াতে এই কফি পাওয়া যায়। সেখানে কফি পরিপক্ক হলে গাছ থেকে তুলে পাখিগুলোকে খেতে দেয়। তারা সেটি গোটা খেয়ে ফেলায় পরে তাদের মল থেকে সেগুলোর বীজ পাওয়া যায়। তারপর সেগুলো নিয়ে রোদে শুঁকিয়ে ভালো মতো ওয়াশ করে ব্লেন্ড করে। আর….
ইরফানকে আর বলতে না দিয়েই মেহজা মুখ বাঁকিয়ে ফেলে বলে ওঠে,
“ছিঃ আপনি আমাকে আগে বলেন নি কেন?”
“আগে বললে কী করতে!”
“কী করতাম মানে! খেতাম না ইভেন ছুঁয়েও দেখতাম না।”
“আমার আগে বলা না বলার ধার ধারো তুমি? আর তাছাড়া তুমি নিজেই খেতে নিলে তাই আমি দিলাম। আর তাছাড়া এটাতে খারাপ কীসের! এটা সম্পূর্ণ পরিষ্কার করেই তৈরি করা হয়েছে। সব হাবিজাবি তো খেতে পারো এটা খেলে কী এমন হবে? আর খেতে তো মজা। তুমি নিজেই তো বললে।”
“তা ঠিক। মজা অনেক। এটা খেলে কোনো সমস্যা হবেনা তো! এটা সত্যিই পরিষ্কার?”
ইরফান এবার চোখ গরম করে দাঁতে দাঁত চেপে মেহজাকে বলল,
“ফার্স্ট ক্লাস কফি নিয়ে ছি ছে করছো আর রাস্তায় নোংরা পরিবেশের আনহেইজেনিক খাবার তো গান্ডে পিন্ডে খাও। আমি জানিনা বুঝি!”
“কীভাবে জানেন?”
“দেখেছি তো তাই।”
“সত্যি? আপনি আমাকে দেখেন!”
“না দেখার কী আছে।”
“ওহ ফলো করেন বুঝি?”
“কেন? ফলো করার কী আছে! রাস্তায় আসা যাওয়া করতে মাঝেমাঝে দেখি।”
“আপনার অফিস তো ওখানে না।”
“ওখানে না হলে কী আমার যাওয়া যাবেনা! আমি দরকারেই যাই।”
“আমাকে দেখতে যান না তা শিউর। তবে ফুলটুসি দেখতে যান সেটা বুঝে গেছি।”
“হোয়াট! তোমার মুখের ভাষা এত বিশ্রী!”
“আগে জানতেন না?”
“চুপ করবে তুমি! অসহ্য!”
“আমি তো অসহ্য হবোই বাকি সব আপনার সহ্য হয় আমি ছাড়া। আজ আপনার সাথে ঐ মেয়েটা কে ছিল?”
“কোন মেয়ে?”
“নাটক করবেন না। আমি দেখেছি আজ আপনাকে একটি মেয়ের সাথে। অবশ্য থাকবেই তো। সে সুন্দর, স্লিম, লম্বা, বয়সেও ডিফারেন্ট নেই আমার মতো, সে নিশ্চয়ই উচ্চশিক্ষিত! কতোটা মর্ডান! ইশ! দেখলেই তাঁকিয়ে থাকার মতো।”
ইরফান কঠিন দৃষ্টিতে তাঁকায়। কোনো মানুষ নিজেকে ছোট করে কীভাবে কথা বলতে পারে! তার চোখে তো মেহজাই একজন পরিপূর্ণ নারী। মেহজাকে সে যে নজরে দেখে এসেছে এখন অব্দি আর কোনো মেয়েকে সে সেভাবে দেখেনি। কোথায় মেহজা অসুন্দর? তার মেহজা খুবই সুন্দর, মেহজা মোটা নয় মেহজা কী জানে মেহজার কোমরের মধ্যে যে হালকা ভাজটি পড়ে সেই ভাজটি ইরফানকে মুহূর্তের মধ্যে নিয়ন্ত্রণ হারা করে দিতে সক্ষম। সেই ভিজে শাড়ি পরিহিত মেহজার কোমর সেদিন কতোটা আকৃষ্ট করেছিল তাকে সে কী জানে? লম্বায় মেহজা তার কাঁধ বরারবর হিল পড়লে তো তার গলার সমান হবে। একেবারে পার্ফেক্ট! তাও সে কেন এসব বলছে? সে কী হিংসা করছে! ইরফানের কাছে অন্য কোনো মেয়ের আনাগোনা কী তাকে কষ্ট দেয়। ইরফান মেহজার সামনে গিয়ে দাঁড়ায় তারপর বলে,
“তুমি সিনানের সাথে কী করছিলে তখন?”
মেহজার এবার চরম রাগ উঠে। মেহজাকে সে এর আগেও সিনানের নাম নিয়ে কিছু বাজে ইঙ্গিত করেছিল। এবারও করছে। সে কী মেহজাকে বিশ্বাস করেনা! কেন মেহজার প্রতি তার এতো অবিশ্বাস! মেহজার এবারও পুরো কফি খাওয়া হয়না। মগটা রেখে দ্রুত গতিতে বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়ে। আর রাগে ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ছাড়ে। ইরফান মৃদু হেসে ঘরের সব লাইট বন্ধ করে দরজাটা লক করে দেয় ভালো করে। তারপর পা বাঁড়ায় বিছানার দিকে। মেহজা ইরফানে কাজে রাগ ভুলে আতংকিত হয়ে পড়ে। সে কী করতে চলেছে মেহজা বুঝে যায়। উঠতে নিলেই ইরফান মেহজাকে ঝাপটে ধরে বলে,
“যাচ্ছো কোথায়? পানিশমেন্ট আছে তোমার! পরপুরুষের সাথে হেসে খেলে কথা বলতে পারো আর আমাকে দেখলেই রাগ দেখাও। খুব বেড়েছো তুমি। আজ তোমাকে কঠিন শাস্তি দিব। ওয়েট!”
বলেই টি শার্ট টি গা থেকে খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। মেহজাও কম কীসে ইরফানের প্রতিটা কাঁমড়ের বদলে সে পাল্টা আক্রমণ করে। কখনও নখ দিয়ে পিঠে আঁচড় দেয় তো কখনো নিজেই ইরফানকে কাঁমড়ে দেয়। এটি যেন যুদ্ধ সম!
————————-
সকালে মেহজা আগে উঠে। ঘুমন্ত ইরফানের দিকে তাঁকিয়ে সে কিছুক্ষণ মনে মনে কিছু ভাবে। তারপর দৌঁড় লাগায় বাথরুমে। ইরফান উঠে গেলে তার সামনে সে লজ্জা পাবে। তাই আগেই গোসল সেরে রেডী হয়ে সোজা ইমার কাছে ছোটে।
ইমা বিছানার চাঁদর ঠিক করছিল। মেহজার হুট করে আগমনে সে কিছুটা ভড়কে যায়। মেহজাকে কিছু বলবে তার আগেই তার দিকে নজর যায়। শান্ত স্বরে বলে
“এই শীতের ভোরে গোসল নিয়েছো কেন তুমি? হোস্টেলেও এমন কর নাকি! একজন তো জ্বর বাঁধিয়ে বসে আছেই এখন তুমিও কী সেটাই চাচ্ছো?”
তখনিই ইমার চোখ যায় মেহজার ঠোঁটের পাশে। নিজেই অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। কটমট দৃষ্টিতে ফ্লোরের দিকে তাঁকিয়ে থাকে। সে নিজেই বোকা বনে গেল। তার মনে রাখা উচিত ছিল মেহজার সাথে তার অসভ্য ভাইটাও যে রয়েছে।
#চলবে।
#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-১৪)
লেখনীতে–ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
সকাল দশটা বেজে তিন মিনিট। মেহজা সোফায় বসে আছে বিরক্তিকর ভাব নিয়ে। ইমা একটু আগেই এখান থেকে কলেজে গেছে সোজা। আর ইরফান ইমাকে এগিয়ে দিয়ে আসছি বলে সে কখন যে বের হলো এখনও ফিরার নাম নেই। একা একা যেন মেহজার সময়টা কাটছেই না। অনা আর প্রথি কলেজে তাই ওদের সাথেও যোগাযোগ করা যাচ্ছেনা। ইকরাকে ইমা যাওয়ার আগে বলেছে সুযোগ পেলে আসতে। এখন দেখা যাক সে আসে কী না! এমনিতেও তো সে মেহজার উপর রাগ করেছে তার রাগ ভাঙানোর সুযোগও মেহজা পায়নি। আজ আসলে মেহজা তার কাছে ক্ষমা চাইবে, রাগ ভাঙাবেও। কলিংবেলের শব্দ পেতেই দৌঁড়ে দরজার কাছে ছুটে যায় সে। দেখে একজন মধ্যবয়সী মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। মেহজা তাকে কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই মহিলাটি বলে ওঠে,
“ভাবিজান আইছেন? আমারে তো চিনবেন না আমি কিন্তু চিনি আমনেরে। আমি ওইছি ভাইয়ের রাঁধুনী। ছেফ ছেফ!”
ছেফ কথাটি শুনে মেহজার খুব হাসি পায়। সে হা হা করে হেসে ওঠে। মহিলাটি বলে,
“মাশাআল্লাহ্! খুউব সুন্দর ভাইয়ের পসন্দ আসে বটে।”
মেহজা মৃদু হেসে মহিলাটিকে ভেতরে ঢুকার জায়গা করে দেয়। তারপর দরজা লক করে উনার পিছনে রান্নাঘরে ঢুকে। মেহজা তাকে জিজ্ঞেস করে,
“আপনার নাম কী?”
“মিতালি বেগম। হেই আপনে মিতালি আফা কইলেও সাইরবো।”
“সাইরবো!”
“হইবো আর কী!”
“ওহ্। আচ্ছ মিতালি আপা আপনি কতদিন ধরে এই বাসায় রান্নার কাজ করেন!”
“এমনে তো এক্ষন টানা ছয় হাত মাস করছি কিন্তু মূলত দুই বছর আগেই আমি এখানে কাম শুরু করছি। ভাইয়ের আব্বা আম্মা তেনারে থাকতে দিত না এক মাস থাইকা যাইতো গা। তবে ওহন আর যায়না।”
“ওহ আচ্ছা।”
“জ্বি।”
“তো আজ কী রান্না করবেন!”
“ইমা আফা সকালে ফোন দিয়া কইছে আজকে গরুর গোস্ত রান্না কইত্ত। আর ভাইজানের সালাদ তো হে নিজেই বানাইবো। তাছাড়া রুই মাছ, ইলিশ আর চিংড়ী মাছ ও করতে। মোরগ পোলাও করতে কইছে কিন্তু আমি পারিনা তাই আফা কইছে ভাত কইল্লেই ওইবো।”
“এত কিছু করবেন? কেন! এক পদ রান্না করলেই তো হয়। সর্বোচ্চ দুই পদ।”
“ভাইয়ে তো দুই পদ এ খায় কিন্তু ছোড আফাও আইবো আবার আমনে আছেন না!”
“ওহ্ ভুলেই তো গেছি। আপা আমি মোরগ পোলাও করতে পারি। আমি বরং রান্না করে নেই সেটি। আর ইলিশ মাছ আর চিংড়ী মাছটাও আমি করব। আর গরুর মাংস আর রুই মাছটাও না হয় আমিই করে নেই। মানে আজকের সব রান্না আমিই করি। আপনি শুধু ভাতটাই করেন।”
“না না। কি কন! আমি আছি কেন?”
“আমি ছিলাম না তাই তো আপনি ছিলেন। এখন আমি আছি তাই আমি রান্না করব। আর আপনিও তো আছেন আমার সাথে। আমাকে না হয় হেল্প করবেন। আপনি এক কাজ করুন আমাকে সব কিছু কেটে কুটে দিন আর সব দরকারি জিনিস দিন আমি শুধু রাঁধব। তাহলেই তো হয়।”
“আমি….
“প্লিজ!”
মিতালি হেসে সব কিছু কেটে মসলা পাতি সব যোগাড় করে দেয়। আর মেহজাও পাক্কা গিন্নির মত রান্নাবান্না করা শুরু করে।
বেলা একটায় সব রান্না শেষ বাকি আছে শুধু গরুর মাংস। প্রেশার কুকারে বসিয়েছে নরম করার জন্য। প্রথম সিটি বেজে উঠতেই সেখানে ইকরা হাজির। মেহজাকে দেখেই ভ্রু কুঁচকে বলে ওঠে,
“বাহ্!রান্নাও করছিস দেখছি। তো এত ঢং করলি কেন? সেই তো আমার ভাইয়ের ভাত-ই রাঁধছিস। নিজেও কষ্ট পাস ওকেও কষ্ট দিস।”
মেহজা ইকরার সেইসব কথা পাত্তা না দিয়ে উচ্ছাসিত কন্ঠে বলে ওঠে,
“আপু তুমি কখন এলে? কেমন আছো!”
“এই তো এখন এলাম। এখন আর কেমন আছি জিজ্ঞেস করে কী হবে। হুহ!”
মেহজা হেসে ওঠে। তারপর ইকরাকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে সরি বলতে থাকতে। এক পর্যায়ে ইকরা হেসে বলে,
“থাম থাম! হয়েছে অনেক। আমি ফ্রেশ হতে যাচ্ছি তুইও গোসল সেড়ে আয়। রান্না কমপ্লিট!”
“হ্যাঁ অলরেডী!”
“জলদি কর। মিতালি আপা তুমি কিন্তু খেয়ে যাবে। আমাদের ঘরের বউয়ের হাতের রান্না না খেয়ে যাবেনা।”
“হো খামু। ভাবিজানেও কইছে না খাই জাইতেনা।”
“আচ্ছা। আমি আসছি ফ্রেশ হয়ে।”
মেহজাও নিজের ক্জে মনোযোগ দেয়। তারপর বাকিটা কমপ্লিট করে। মিতালিকে খেতে দিয়ে সে উপরে চলে যায়। মিতালির তাড়া আছে অন্য জায়গায়ও যেতে হবে। মেহজা নীল রঙের একটি সফ্ট জর্জেটের থ্রি পিস পড়ে
নামায ও পড়ে নেয়। তারপর ইকরার রুমে যায়। দেখে ইকরা শুয়ে আছে মাথায় হিজাব। বোধ হয় নামায পড়েই শুয়েছে। মেহজা ইকরাকে ডাকতেই সে উঠে বসে। তারপর মেহজাকে বলে,
“নামায পড়েছিস?”
“হ্যাঁ আপু।”
“এখন নিয়মিত পড়িস তো?”
“হোস্টেলে পাঁচ ওয়াক্ত মিস যায়না। আজ ফজরটা ….
“কাল থেকে যেন আর মিস না যায়।”
“আচ্ছা।”
“ইয়াজ এখনও আসেনি!”
“না।”
“কোথায় ও?”
“জানিনা তখন শুধু ইমা আপুকে পার্কিং পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসবে বলেছিল। এখ….
“ধোঁকাবাজ নাম্বার ওয়ান। অফিসেই গেছে ও আর তা না হলে কোনো জায়গায় গিয়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে।”
“আড্ডা!”
“রাজনীতি করে তো। একবার এক সম্মেলনে যায়।”
“তাই বলে আড্ডা বলবে!”
“আড্ডাই তো। চল লিভিং এ যাই। আমার ভিষণ ক্ষুদা পেয়েছেরে। সেই কখন বেরিয়েছি বাসা থেকে।”
“তাহলে সোজা ডাইনিং এ চলো।”
“না না। ইয়াজ আসুক। একসাথেই খাবো।”
মেহজা মাথা নাঁড়িয়ে সায় দেয়। এরা সামনা সামনি তো একজন আরেকজনকে দেখতেই পারেনা কিন্তু ভেতরে ভেতরে কত আদর, মায়া, স্নেহ আর ভালোবাসা! দুজনে নিচে গিয়ে বসে কিছুক্ষণ গল্প করতে থাকে। ইরফান এখনো আসেনি দেখে সে কল দেয়। বারবার কল কেটে দেওয়াতে ইকরা রাগ করে। আজ এলে খবর আছে এই সেই নানান কথা বলতে থাকে। তখনিই ইরফান সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল,
“বারবার কল কেটে দিচ্ছি এরপরেও কল দিচ্ছিস কেন?”
আকস্মিক ইরফানের আওয়াজে মেহজা ও ইকরা দুজনেই ভয় পেয়ে যায়। পেছনে ইরফানকে দেখে ইকরা চেঁচিয়ে বলে,
“এমন ভয় পাইয়ে দিলি কেন বেয়াদব! কখন এলি তুই? দেখলাম না তো!”
“দেখবি কীভাবে! তোরা মেয়েরা যখন রুমে বসে ফুসুর ফাসুর করিস তখন পাশ দিয়ে বাঘ হেটে গেলেও টের পাবিনা।”
ইকরা কিছু বলতে যাবে তার আগে ইরফান বলে ওঠে,
“খুব ক্ষিদা পেয়েছে। অভুক্ত ও অসুস্থ শরীরটা নিয়ে এখন তোরসাথে ঝগড়া করতে পারবো না।”
ইকরা আর মেহজা এই কথাতেই হুড়মড়িয়ে উঠে গেল। ইরফান যে অসুস্থ তা কারো খেয়ালই ছিল না। এমন শক্ত হয়ে থাকে যে বোঝা দায়! ইরফান চেয়ারে বসলে মেহজা ইকরাকেও বসতে বলে খাবার পরিবেশন করে দেয়। মোরগ পোলাও দেখে ইরফান ভ্রু কুঁচকে বলে,
“মোরগ পোলাও! মিতালি আপু করেছে নাকি?”
“না। তোর বউ করেছে আজ সব রান্না।”
“আমার বউ?”
“হ্যাঁ তোর বউ। এই যে তোর পাশে জলজ্যান্ত মানুষটি দাঁড়িয়ে আছে সে তোর বউ।”
“জানি আমি। তবে ও রান্না করতে জানে নাকি!”
মেহজা কথাটা শুনে ক্ষেপে উঠে বলে,
“জানিনা মানে? আমি আরো একবছর আগে থেকেই সব রান্না করা শিখেছি। আপনার মত আকামা না আমি।”
“আমি আকামা মানে!”
“খাবার টেবিলে ঝগড়া কীসের ইরফান?”
ইমা এসেছে। বেসিনে গিয়ে হাত মুখ ধুঁয়ে সেও প্লেট নিয়ে বসে। ইমাকে দেখে পরিস্থিতি ঠান্ডা হয়ে পড়ে মুহূর্তেই। ইকরা তো রান্নার প্রশংসা করতে করতে শেষ। ইমারও খুব ভালো লেগেছে। শুধু ইরফানই বলল,
“ক্ষুদার সময় বিস্বাদকর খাবারও মজা।”
মেহজা তাতেই রেগে গেল। রাগের চেয়ে অভিমানটা বেশি হলো। প্রিয় মানুষটার জন্য সেই সকাল থেকে কষ্ট করে এতকিছু করল আর সে কিনা এমন একটি মন্তব্য করেছে! কিশোরী মনটা মুহূর্তেই কান্নায় চেপে বসল। কিন্তু কান্নাটা সবার দৃষ্টিগোচরেই থেকে গেল।
#চলবে!