#গোধূলী_আকাশ_লাজুক_লাজুক (পর্ব-৯)
লেখনীতে– ইনশিয়াহ্ ইসলাম।
মেহজা আর ইকরা দুজনেই সোফায় বসে আছে। ইকরা ফোনে কথা বলছে ইনায়ার সাথে। আজ ইনায়া আর তার বাচ্চারা আসবে। ইমাকেও সেই উপলক্ষ্যে চলে আসতেই কল করেছে ইকরা। মেহজার মন মেজাজ ভালো নেই। রাগে তার শরীর কাঁপছে রীতিমত। কালকে রাতে ঘটে যাওয়া অপ্রত্যাশিত মিলনটা তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। কিছুতেই ভুলতে পারছেনা সে। ইরফানের প্রতি যতটা রাগ হচ্ছে তার থেকেও অধিক পরিমাণ রাগ হচ্ছে নিজের প্রতি। কীভাবে সে ইরফানকে নিজের কাছে আসতে দিল! ছিঃ ইরফানের কাছে তাকে বারবার হেরে যেতে হচ্ছে। গতবারের মতোই এবারও সে লাপাত্তা! হদিস নেই তার। ঘুম থেকে উঠেই দেখে ইকরা চিন্তিত মুখে বসে আছে তার পাশে। মেহজাকে উঠতে তাড়া দিয়ে একটি শাড়ি নিয়ে আসে। মেহজার আর ইকরার গঠন কিছুটা এক। তাই ইকরার ব্লাউজ তার গায়ে ঠিকঠাক হয়ে যায়। ফ্রেশ হয়ে একেবারে গোসল করে মেহজা শাড়িটা পড়ে নেয়। শাড়ি পড়ার পর নাস্তা করেই ইকরা মেহজাকে ঔষুধ খাইয়ে দেয়। এই একটি কাজ ইকরার সবচেয়ে বিরক্ত লাগে। সে তো ঠিক করেই নিয়েছে ইরফান ফিরলে তাকে স্পষ্ট গলায় জানিয়ে দিবে “ইয়াজ, নেক্সট টাইম আমি আর ঔষুধ নিয়ে দৌঁড়াতে পারবো না। সবটা নিজে করতে পারলে এটাও তুই নিজেই বুঝে নিস।”
মাহিমা বেগম মেহজার মাকে জানিয়ে দিয়েছে মেহজা তাদের বাসায় আছে আর কিছুদিন থাকবে। মেহজার মাও আর আপত্তি করেনা। উপর নিচেরই তো ব্যাপার। দরকার পড়লেই আসতে পারবে। আহামরি কোনো সমস্যা নেই। মেহজা নিজে থেকেই যখন আছে তখন আর বাঁধা দিবে কীসে!
ইকরা মেহজাকে এবার কিছুটা রেগেই বলে
“বয়স কত তোর? এই বয়সে আমি কলেজে পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন আর উচ্চতর গণিত করতে করতে জীবন ঝালাফালা করে দিয়েছিলাম। একটা প্রেমও করতে পারিনি সেখানে তুই বিয়ে করে দুই দুইবার হাজবেন্ডের সাথে ইন্টিমেট হচ্ছিস! ভাবা যায়!”
মেহজা ভাবতেই পারেনি ইকরা এমন কিছু বলবে। তার চোখ মুখ লজ্জায় লাল হয়েছে। সে কী আর ইচ্ছে করে এতদূর পর্যন্ত গেছে! সে তো চেয়েছে ইরফানকে জ্বালাতে আর তার ভালোবাসায় মুগ্ধ করতে। কিন্তু তার অপদার্থ ভাইটাই তো এত কিছু ঘটিয়েছে। এখন যত দোষ মেহজা ঘোষ!
ইকরা নিজেই নিজের কাজে হতভম্ব হয়ে যায়। ইশ! তার মুখের কথাগুলোও এক্কেবারে যখন তখন বেরিয়ে আসে। আহ! কি লজ্জা, কি লজ্জা! ইকরা মেহজার মুখোমুখি হয়ে বলে
“আসলে হয়েছে কী! তুই তো ছোট। তাই আমি একটু বেশিই পজেসিভ হয়ে যাচ্ছি। আমার তোকে এভাবে বলা একদম উচিত হয়নি। কিছু মনে করিস না রে। আমরা আমরাই তো। আজ ইয়াজ আসুক। ওর খবর করে ছাঁড়বো আমি।”
“থাক আপু। তোমার আর কিছু করতে হবেনা এবার যা করার আমিই করব। তুমি শুধু দেখতেই থাকো। আজ ঐ লুচ্চার খবর ছাপিয়ে তবেই ছাঁড়বো।”
“আহ! লুচ্চা বলছিস কেন? বিশ্রী একটা শব্দ। আমার ভাইটা কিন্তু মেয়েদের খুব সম্মান দিয়ে চলে।”
“তাহলে তুমি কি বলতে চাইছো! আমি মেয়ে না?”
“তুই তো ওর বউ।”
“রাখো এসব বউ টউ। ঐ লোক আমাকে তো ভালোবাসেই না বরং আমাকে পেলেই তার ওসব করার জন্য চুলকানি শুরু হয়। শালা ধান্দাবাজ। দূষিত পুরুষ।”
“ছিঃ ভাষা ঠিক কর। এসব কী আবল তাবল বকছিস!”
“সবাই নিজের মানুষকেই সাপোর্ট করে। আমি তো কেউ না। অন্যের মেয়ে…..
“আর আমার ভাবী।” টিটকিরি করেই কথাটা বলে ইকরা
মেহজার কান্না পাচ্ছে। আকাশ কাঁপিয়ে যেমন বৃষ্টি নামে তেমনি মেহজার শারা শরীর কাঁপিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কেউই তাকে বুঝেনা। তার আপন বলতে কেউ নেই। সেদিন তার জননীও তাকে অবিশ্বাস করেছিল বন্ধু সুলভ পিতা মুখ ফিরিয়েছিল। তাকে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। নেই তার আপনা মানুষ। কোথাও কেউ নেই তার সে যে বড় একা। বাপ মা মুখ ফিরিয়েছে আরো আগেই। ভাগ্যের খেলায় যাও এক স্বামী পেয়েছে সে তাকে ভালোবাসে না ভালোবাসে শুধুই তার দেহ। মেহজাকে কয়জনা ভালোবাসে? মেহজার রুহ্ টাকে কে ভালোবাসে? আছে এমন কেউ? কোথায়! সে দেখছেনা কেন? তার তো দেখতে ইচ্ছে করছে। বুক ফেটে যাচ্ছে তার। হৃদয়ের গহীনে কোথাও কেউ বলে উঠছে যে “ইয়াজিদ তোকে ভালোবাসবে কেন? তুই কি ওর হৃদয়হরণী! বেশি উঁড়িস না। নিজের যোগ্যতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাক।”
মেহজা উঠে ইরফানের রুমে গিয়ে দরজাটা ঠাস করে লাগিয়ে দেয়। এতটাই জোরে যে ইকরাও কেঁপে উঠে। ইকরা ইরফানকে কল করে। আজ অনেক হয়েছে। মেহজা খুবই কষ্ট পাচ্ছে। ছোট্ট মনে কত বড় আঘাত সে দিচ্ছে। এটা কী ঠিক! মোটেই না!
বিকেল বেলায় ইনায়া এসে পড়ে। তার ছেলেরা তো এসেই নানুর কোলে উঠে পড়ে। নানু বলতে অজ্ঞান তারা। মেহজা সারাদিনে একবারো রুম থেকে বের হয়নি। ইনায়া আসলেই সে একটু বেরিয়ে সবার সাথে কুশলাদি করে। ইনায়া মেহজাকে কিছু উপহার দেয়। কয়েকটি শাড়ি ও এক জোড়া ডায়মন্ডের দুল যা তার স্বামী আরাফাত মেহজার জন্য পাঠিয়েছে। মেহজার একদমই সেই উপহার নিতে ইচ্ছে করেনি একপ্রকার জোর জবরদস্তিতে নিতে বাধ্য হয়। রুমে এনে সোজা ইরফানের কাবার্ডে ঢুকিয়ে দেয়। তাদের জিনিস তাদের ঘরেই থাকুক। এসবের লোভ মেহজার নেই। তার সবচেয়ে বড় লোভ হচ্ছে “ভালোবাসার” যা সে পাচ্ছেই না। ভালোবাসা নেই ধন, দৌলত আছে সেখানেও সুখ নেই। মেহজার বাবার, ভাইয়ের টাকা পয়সার কমতি আছে ! তাদেরও বাড়ি আছে, গাড়ি আছে, গুলশানের সবচেয়ে দামি ফ্ল্যাট গুলোর একটিতে তারা থাকছে। বিলাশ বহুল জীবন কাটাচ্ছে। অভাব সে কখনোই দেখেনি। তবে এবার দেখছে। টাকা পয়সা বা খাবারের নয়! এক চিলতে ভালোবাসার বড্ড অভাব। মাতৃ আদর পায়না আজ অনেক দিন। মা তাকে খাইয়ে দিয়েছে শেষ তার পরীক্ষার সময়। ছোট ভাই রাফসানটাও এখন আর ঝগড়া করেনা। রাদিফ তো দু দন্ড বাসায় থাকারও সময় পায় না। বাবা তো কম্পানীর লাভ লসের বেড়াজালে আটকা পড়ে আছে। তার দিকে তাঁকানোর সময় কোথায় তাদের? নামে মাত্র শ্বশুড়বাড়ি। যেখানে স্বামীর থেকে কোনো ভালোবাসা পাচ্ছেনা সেখানে শ্বশুড়-শ্বাশুড়ি আর ননদ দের থেকে পাওয়া তো বিলাসিতা। কিন্তু সে বিলাসিতা টা করছে। তাকে সবাই খুব আদর স্নেহ করে কিন্তু কোথাও একটা ফাঁকা তো থেকেই যায়। পরক্ষণেই মেহজা ভাবে সে তো বেশ স্বার্থপর! এই যে ইকরা তাকে সব কিছুতে আগলে রাখে, ইমা তাকে পড়াশুনার দিক দিয়ে খুব সহায়তা করছে। কলেজে তার কত খেয়াল রাখে! ছিঃ ইরফানের ভালোবাসার কাঙাল হয়ে সে বাকিদের ভালোবাসার কোনো গুরুত্ব দিচ্ছেনা। সে তো মানুষ বড্ড খারাপ!
সন্ধ্যায় ইরফান আসে। ঘামে ভিজে আছে তার সারা শরীর। ইরফান হুট করে রুমে ঢুকাতে মেহজা কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। ইরফান মেহজাকে এখনও দেখবে তা আশা করেনি। মেহজাকে দেখে তার ক্লান্তি ভুলে যায় সে। মিষ্টি একটি হাসি উপহার দেয় সে মেহজাকে। তারপর কাবার্ড থেকে বেছে বেগুনী রঙের একটি টি শার্ট আর কালো ট্রাউজার নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ে। মেহজা সেদিকেই চেয়ে রয়, ইরফানের হাসিটা খুব সুন্দর। আচ্ছা ইরফান হাসলো কেন? তাকে দেখে নাকি এমনেই!
ইরফান বের হয়ে দেখে ছোট্ট টেবিলটার উপরে কফি। এই সময়ে তার মা ছাড়া আর কেউই কফি রেখে যাবেনা। তাই সে আর তা খায়নি। ইনায়া ইরফানের দরজায় নক করে বলে
“আসবো ভাই!”
“আসো না। জিজ্ঞেস করার কি আছে?”
“আছে তো! যেমন ধর তোর আস্ত একটা জীবন্ত বউ আছে।আর তার সাথে তোর অনেক প্রাইভেট সময় কাটাতে হয়। সেই সময়টা যেকোনো মুহূর্তেই হতে পারে। তাই একটু আগে থেকেই যাচাই করে নিচ্ছি।”
ইরফান মৃদু হেসে বলে
“মেহজা নেই তো রুমে।”
“নেই মানে! এখানেই তো ছিল।”
“হয়তো ইকরা আপুর সাথে। তুমি আসো।”
“হুম।”
ইনায়া কফি কাপ ভরতি দেখে বলে
“কফি খাসনি? মেহজা বানিয়েছে তো!”
ইরফান চমকিত হয় সাথে আনন্দিত। মেহজা তার জন্য কফি এনেছে! ইশ! এখন মেহজা এসে যদি দেখে ইরফান কফি খায়নি তাহলে কতটা কষ্ট পাবে। এখনও অনেক গরম আছে খেয়ে নেওয়া যাক। ইরফান গিয়ে কফি কাপটা হাতে নেয়। তারপর ইনায়াকে উদ্দেশ্য করে বলে
“জরুরী কোনো কথা আছে তোমার!”
“হ্যাঁ। বুঝলি কীভাবে?”
“সচরাচর আসো না তো আমার রুমে তাই।”
“তুই বলতে চাচ্ছিস দরকার পড়লেই আসি?” হালকা রাগ দেখিয়ে বলল
ইরফান আবারো হাসে। তারপর কফিতে চুমুক দেয়। ইনায়া ইরফানকে ভালো করে দেখে নেয়। তার ভাইটি কতটা সুন্দর। গৌড় বর্ণের ইরফানের চড়া প্রশস্ত কাধটি দেখলেই কেমন একটা রাজকীয় ভাব ভাব মনে হয়। ইরফানের ক্লিন শেইভ করা গাল গুলো চমৎকার দেখাচ্ছে। হুট করেই হেসে উঠাটা ইনায়ার নজর এড়ায়না। তার গম্ভীর ভাইটা এখন হাসতেও পারে! ইনায়া ইরফানকে উদ্দেশ্য করে বলে
“কেমন হয়েছে কফিটা! দুর্দান্ত নাকি এভারেজ!”
“অসাধারণ!”
“তাই? তোর বউ করেছে বলে বলছিস নাকি….
“সত্যি মজার।”
“জানি। আমরা সবাই খেয়েছি তো। চা টাও খুবই ভালো করে মেহজা।”
“ওহ!”
ইরফানের মন খারাপ হয়ে যায়। সে ভেবেছে মেহজা শুধুই তার জন্যই স্পেশালী কফি করে এনেছে। তবে তা নয়, সে সবার জন্যই করেছে। ইনায়া ইরফানকে আবারো বলে
“ভালোবাসিস!”
“কাকে?”
“কাকে আবার! তোর বউকে।”
“জানিনা।”
“জানিস না!”
“না।”
“তোর বউ কিন্তু তোকে খুব ভালোবাসে।”
“হয়তো!”
“তোর কথাবার্তায় স্বার্থপরতা ফুটে উঠছে ইরফান। মেয়েটি তোকে ভিষণ ভালোবাসে তুইও ভালোবাসার চেষ্টা কর। ছোট মন ওর, কষ্ট দিস না ওকে। ওরা আবেগী হয় অনেক।”
“ঠিকই বলেছো। আমার প্রতি আসলে ওর আবেগ কাজ করে। ভালোবাসা নয়।”
“তাই নাকি! কে বলেছে তোকে?”
“আমি বুঝি।”
“মেয়েদের মন বোঝা নয়রে সোজা। জানিস! মাত্র জন্ম নেওয়া বাচ্চা মেয়েটার মনও কেউ বুঝে উঠতে পারেনা। দুই বছরের মেয়ে তার বাবার জন্য কান্না করছে তার বাবা সেটা বুঝেনা বাবা বুঝে আহারে! আমার মেয়েটার বোধ হয় চকলেট খেতে ইচ্ছে করছে। ওমনি সে ছোটে চকলেটের দোকানে আর তার মেয়ে বসে কাঁদে। বাবা আবারও চলে গেছে এই ভেবে। আর সেখানে মেহজা কতবড় মেয়ে।”
ইরফান নিশ্চুপ। কেন যেন সে মেহজার ভালোবাসাটা স্বীকার করতেই পারেনা। তার কাছে মনে হয় সব মেহজার আবেগ। দুদিন পর যখন সে আরো বড় হবে তখন হয়তো ইরফানকে বুড়ো বলে দূর ছাই করবে। তাই ইরফানও তাকে কঠিন ভালোবাসতে ভয় পায়।
বারান্দার গ্লাসের ওপাশে থাকা মেহজা সব শুনে পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে। লোকটির কাছে তার ভালোবাসা আবেগ সমতুল্য! হায়রে জীবন! হায়রে প্রেম! হায়রে মরণ ফাঁদ “ভালোবাসা”!
#চলবে