গোধূলী বেলার স্মৃতি পর্ব-৩৫

0
1705

#গোধূলী_বেলার_স্মৃতি (Unexpected Story)
#পর্ব- ৩৫
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)

শান্ত ভোরের স্নিগ্ধ আলো এসে আমার মুখে পড়তে-ই’ আমি নিজেকে রুদ্রিকের বাহুডোরে আবদ্ধ অবস্হায় অবিষ্কার করি। ঘুমের মধ্যে কি নিশ্পাপ লাগছে রুদ্রিককে। কেউ দেখলে বলবে? এই ছেলে এতেটা দুষ্টু। রুদ্রিকের কপালে লেপ্টে থাকার চুলগুলো সরিয়ে রুদ্রিকের কপালে চুমু খেলাম। রুদ্রিক ঘুমের মধ্যে-ই’ আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। আমি রুদ্রিককে নিজের থেকে ছাড়ানোর চেস্টা করে বললাম,

—“রুদ্রিক ছাড়ো আমাকে। কি করছো কী? ”

রুদ্রিক নিজের চোখজোড়া খুলে আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে বলে,

—“কাজল তুই আমাকে তুমি করে বলছিস? তারমানে রাতের রোমান্টিক ট্রিটমেন্ট কাজে লেগে গেছে। ”

আমি রুদ্রিকের বুকে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে বলি,

—“তোমার মুখে সত্যি কিছু আটকায়না অসভ্য লোক। ”

কথাটি বলে আমি চলে যেতে নিলে রুদ্রিক আমার হাত ধরে হেচকা টান দিয়ে আলতো সুরে বলল,

—“একটু কাছে থাকলে কী হয়? শেষে তো এই রুদ্রিকের কাছে-ই’ ফিরে আসতে হবে জানেমান। ”

আমি মুঁচকি হেঁসে বললাম,

—” রুদ্রিক জানো? আজকের সকাল সত্যি অন্যরকম সুন্দর লাগছে। সবকিছু-ই’ যেনো আজকে আমার কাছে স্বপ্নের মতো সুন্দর লাগছে। অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে।হয়তো তোমার জন্যে-ই’ এতোটা ভালো লাগছে আমার কাছে সবকিছু। ”

কথাটি বলে আমি রুদ্রিকের বুকে মাথা রাখলাম রুদ্রিকের আমার হাতে নিজের ধরে বলে উঠলো,

—“আমার কাছে তোর মায়াবী সৌন্দর্য়ের এই সকালের সৌন্দর্য ফিকে মনে হচ্ছে। হয়তো ভালোবাসি বলে। ”

আমি হাঁসলাম। সত্যি এই মানুষটিকে পেয়ে আমি নিজেকে সুখী মনে করি। হয়তো সব মেয়ে-ই’ এইরকম স্বামী কাম্য করে যে সবসময় ভালোবাসা
দিয়ে আগলে রাখবে।

____________

তনয় উঠে দাঁড়ালো। ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে।
তনয়ের চেয়ারের পাশে ছুটকি চেয়ারে বসে একপ্রকার ঘুমিয়ে-ই’ পড়েছে। ছুটকির জন্যে একপ্রকার বাধ্য হয়ে-ই’ তনয় কালকে সারারাত ছাদে কাটিয়েছে। কালকে যখন তনয় ছুটকিকে নিজের পাশে দেখেছিলো তখন ছুটকি একটা কথা বলেছিলো….

—“আপনি কী বলবেন জানিনা,কিন্তু আমি কিছু কথা বলতে চাই। আজকের রাতটুকু সময় আমাকে দিবেন? শুধু এই রাতটুকু আপনার ভিতরের সব কথা শুনতে চাই আমি। অনুরোধটুকু রাখবেন আমার? ”

ছুটকির কথাগুলো শুনে কেনো যেনো তনয় ফেলতে পারেনি।

তনয় দীর্ঘশ্বাস ফেললো। অনেক হয়েছে এইবার তাকে সিলেটে ফিরে যেতে-ই’ হবে। কথাটি ভেবে তনয় এক পলক ছুটকির দিকে তাঁকালো। ছুটকির গাঁয়ে ভালো করে চাঁদরটা জড়িয়ে দিয়ে বেড়িয়ে গেলো।

_________
রুদ্রিক ছাদে উঠে দেখে সাদিসহ বাকিরা সবাই ঘুমাচ্ছে। পাশে বেয়ারের বোতল দেখে রুদ্রিক রেগে যায়। সবকটা রাতে পার্টি করেছে। কথাটি ভেবে রুদ্রিক রাগান্বিত কন্ঠে চেচিয়ে বলে,
—-“সবগুলো তাড়াতাড়ি উঠ। ”
রুদ্রিকের চিৎকারে সবাই ধরফরিয়ে উঠে বসে।
সাদি কোনোরকম উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
–“এইভাবে ষাড়ের মতো চেচাচ্ছিস কেন?”
রুদ্রিক বলে উঠে,
—“এখানে সব ছোট ছোট বাচ্ছারা আছে আর তোরা সারারাত ধরে পার্টি করছিলি? ”
পলক মুখে হাত দিয়ে বলে,
–“তো কী করবো? তুই তো ব্যাটা দিব্যি ছিলি বাসর…

পলকের কথা শেষ হওয়ার আগে-ই’ রুদ্রিক পলকের পেটে ঘুসি দিয়ে বলে,

—“আর একটা কথা বললে খবর আছে তোদের। এখানে না দাঁড়িয়ে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নে। আজকে রিসেস্পশন ভুলে গেলি? রান্নার দিকটা কারা দেখবে? ”

ইথান উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

—“হু ভাই এখন তোর ভৌ ভাতের কাজগুলোও আমাদের-ই’ করতে হবে। ”

—“তা নয়তো কী তোরা কী ভেবেছিস?আমি তোদের ফ্রি ফ্রি খাওয়াবো?

রুদ্রিকের কথা শুন্র সাদি মুখটা কাচুমাচু করে ফেলে।

______

আমি আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ভেজা চুলগুলো মুছে নিলাম। আজকে সত্যি নিজেকে পরিপূর্ণ নারী মনে হচ্ছে। শাড়ির আঁচল মাথা দিয়ে নীচে নেমে এলাম।

আমাকে নিচে নামতে দেখে দিদুন এগিয়ে এসে বলে,।

—-“দিদিভাই কেমন হলো ঘুম? ”

—“খুব ভালো হয়েছে। ”

দিদুন এইবার একজন বাড়ির সার্ভেন্টকে ডেকে বললো,

—“তুমি বড়দের রান্না করো নাও। একটু বেশি করে রান্না করো। রুদ্রিক বাবার বন্ধুরাও আছে। আমি বরং গিয়ে বাচ্ছাদের জন্যে রান্নার ব্যবস্হা করে আসি। ”

দিদুনের কথার মাঝে-ই’ আমি বলে উঠলাম,

—-“দিদুন বাচ্ছাদের জন্য আজকের রান্না আমি করি? ”

আমার কথায় দিদুন চমকে বলে উঠে,

—-“সেকি কেন? তুমি নতুন বউ। এখন রান্নাঘরে ঢুকার কোনো দরকার নেই। ”

আমি কিছুটা আবদারের সুরে বললাম,

—“প্লিয দিদুন। আজকের রান্নাটা আমি করি? আমার কোনো অসুবিধা হবে নাহ। তাছাড়াও আমিও তো মায়া কুঞ্জ পরিবারের সদস্য। তাহলে আমি কি নিজের পরিবারের জন্যে রান্না করতে পারিনা? ”

দিদুন হেঁসে বললেন,

—-“তোমার কথার সাথে পারবো নাহ। আচ্ছা তুমি বরং খুশিমনে রান্না করতে চাইছো। তাহলে সেইটাই করো। ”

দিদুনের কথা শুনে আমি মাথা নাড়াই।

রুদ্রিক সবাইকে তার কাজ বুঝিয়ে দিয়ে রান্নাঘরের দিকে চোখ যায়।

রুদ্রিক এগিয়ে যায় সেদিকে। রুদ্রিক তাঁকিয়ে দেখে কাজল কোমড়ে শাড়ির আঁচল গুজে রান্না করছে। বাচ্ছারা তার পাশে ঘুড়ঘুড় করছে। কাজল রান্না করছে এবং বিভিন্ন গল্প বলে শুনাচ্ছে।

রুদ্রিক মুঁচকি হেঁসে দাঁড়িয়ে দেখতে থাকে বাচ্ছাদের এবং কাজলের কান্ড।

আমি রান্না করছি তার মাঝে-ই’ টিংকু বলে উঠে,

—“ভালো আপু আমার প্রচন্ড ক্ষিদে পেয়েছে। ”

আমি বলে উঠলাম,

—“টিংকু সোনা কিছুক্ষন অপেক্ষা করো এখুনি হয়ে যাবে। ”

তখনি পটল মুখ ফুলিয়ে আসে। আমি পটলকে দেখে বলি,

—“কি হয়েছে পটল সোনা মুখ ফুলিয়ে রেখেছো কেন? ”

পটল বলল,

—” রুদ্রিক ভাইয়া আমাকে অনেকগুলো চকলেট দিয়েছিলো তা খুঁজে পাচ্ছি নাহ। ”

আমি কিছুক্ষন ভেবে বললাম,

—-“সত্যি তো কোথায় গেলো? ”

মুসকান আমার আঁচল ধরে টানে। আমি কিছুটা ঝুঁকে বলি,

—“কি হয়েছে মুসকান সোনা? ”

মুসকান আদো আদো গলায় বলল,

—“আমি পতল ভাইয়ার চকলেত খেয়ে ফেলেছি। তুমি পতল ভাইয়াকে বলো নাহ ওক্কে? ”

আমি হেঁসে বললাম,

—“আচ্ছা বলবো নাহ। ”

দিদুন রুদ্রিকের পাশে দাঁড়িয়ে বলল,

—“সত্যি একদিন-ই’ কাজল সবাইকে কতটা আপন করে ফেলেছে। বাচ্ছারা ও এখন কাজল বলতে অজ্ঞান। ”

রুদ্রিক কাজলের দিকে তাঁকিয়ে-ই’ বলে,।

—“এইজন্য-ই’ তো কাজলকে এতোটা ভালোবাসি। ”

রুদ্রিক রান্নাঘরে প্রবেশ করে বলল,

—“এইযে পুঁচকি বাহিনী ও আমার ছোট্ট গার্লফ্রেন্ড বাইরে আপনাদের কথামতো সব খেলনা নিয়ে আসা হয়েছে। আপ্নারা গিয়ে দেখে আসুন। ”

রুদ্রিকের কথায় বাচ্ছারা একপ্রকার খুশিতে লাফিয়ে-ই’ বের হয়ে যায়।

আমি মু্ঁচকি হেঁসে আবারো রান্নার দিকে মনোযোগ দিলাম।

রুদ্রিক আমার হাতধরে বলল,

–“কাজল একটা কথা রাখবি? ”

—“হুম বলো। ”

—“তুই সবসময় এইভাবে-ই’ মায়া কুঞ্জের বাচ্ছাদের আগলে রাখিস। মায়া কুঞ্জের প্রতিটি সদস্য আমার শুধু দায়িত্ব নয় বরং আমার ভালোবাসাও বটে। এইসব মাসুম অনাথ বাচ্ছাদের সাথে থাকলে আমি নিজের সুখ খুঁজে পাই। ওরা আমার কাছে ঠিক কতটা মূল্যবান তোকে বলে বুঝাতে পারবো নাহ।

আমি রুদ্রিকের হাত ধরে বললাম,

—“এই একদিনে ‘মায়া কুঞ্জের ‘ প্রতিটি সদস্য আমার মনের গহীনে আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। এখন থেকে তো আমিও এই পরিবারের সদস্য। এখন থেকে এই পরিবারকে আগলে রাখা আমারোও দায়িত্ব। ”

রুদ্রিক প্রাপ্তির হাঁসি হাঁসলো। আমি রুদ্রিককে প্রশ্ন করে বললাম,

—“এই বাড়ির নাম ‘মায়া কুঞ্জ কেন? ”

আমার প্রশ্নে রুদ্রিক বাচ্ছাদের দিকে তাঁকিয়ে বলল,

—“আমার ফুপিয়াম্মুর খুব ইচ্ছে ছিলো। এইরকম একটা অনাথ আশ্রম করার। তাই ফুপিয়াম্মুর নামের সাথে মিলিয়ে এই বাড়ির নাম রেখেছি ‘মায়া কুঞ্জ’
একটি বাড়ি তখনই গৃহ হয়ে ওঠে যখন সেখানে থাকে মায়ার বাঁধন ও ভালোবাসা। ‘ ‘মায়া কুঞ্জ’ নামটি তারই প্রতীক। মায়ার বন্ধন দিয়ে প্রত্যেকটি পরিজনদের একত্রে বেঁধে রাখার অঙ্গীকার স্বরূপ কাজ করবে এই নামটি। ”

রুদ্রিকের কথা আমি মুগ্ধ হয়ে শুনলাম।

____________
ভারি লেহেঙ্গা পড়ে রুমে বসে আছি আমি। সিথি এবং দিয়া পিপি সেই কখন আমাকে সাঁজিয়ে স্টেজের দিকে চলে গেছে,অথচ আমাকে এখনো নিতে আসলো নাহ। নাহ আমাকে-ই’ যেতে হবে কথাটি ভেবে আমি বাইরের দিকে পা বাড়াতে নিলে-ই’ কেউ বলে উঠে,

—“ভালো-ই’ তো রুদ্রিককে ফাঁসিয়ে ড্রাইভারের মেয়ে থেকে শেখ বাড়ির বউ হয়ে গেলে। ”

আমি পিছনে তাঁকিয়ে দেখি ইশানি ম্যাম।

—“আপনি এসেছেন? ”

ইশানি ম্যাম এগিয়ে এসে বললেন,

—“না এসে কী করে পারি বলো? দেখতে এসেছিলাম। আমার ভাইপো ও ড্রাইভারের মেয়ের বউভাত কেমন হচ্ছে। ব্রাহ্মণ হয়ে তো ভালো-ই’ চাঁদে হাত বাড়িয়ে চাঁদ নিয়ে নিলে। তো তুমি কী ভেবেছো? শেখ বাড়ির বউ হয়ে নিজের নামের পাশে ড্রাইভারের মেয়ের ট্যাগ সরিয়ে ফেলবে?”
(লেখিকাঃ রিমি)

আমি হেঁসে বললাম,

—“সত্যি ইশানি ম্যাম আপনি আমাকে হাঁসালেন।
আপনি যদি ভেবে থাকেন আপনার এইসব চিপ কথা শুনে আমি ভ্যা ভ্যা করে কেঁদে মন খারাপ করে আজকের দিনটি খারাপ করবো তাহলে আপনি ভুল ভাবছেন। প্রথমত কোনো পেশায়-ই’ ছোট নয়। আমার বাবা ড্রাইভার হলেও সৎ পয়সায় উপার্জন করে। আপনার মতো নিজের কম্পানির লাভের জন্যে, নিজের ভাইপোর সাথে ছলেনার মতো খারাপ কাজ করেনি।”

কাজলের কথা শুনে ইশানির রাগে কিছু বলতে যাবে তখনি তার ফোন বেজে উঠে। কম্পানির ফোন। ইশানি নিজের হাত ও অপর ফোনটি রেখে,রুম থেকে তাড়াহুড়ো করে বেড়িয়ে পড়ে।

ইশানি ম্যাম বেড়িয়ে যেতে-ই’ উনার আরেকটি ফোন বেজে উঠে। সেই ফোন মাহির (হাজবেন্ড) নামটি দেখে আমি যেনো একপ্রকার শকড হয়ে যাই। আমি যতটুকু জানি ইশানি ম্যামের তো ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে তাহলে এই মাহির পাশে লেখা হাজবেন্ড টা কে? ফোনটা অনবরত বেজে চলেছে। আমি ফোনটা তুলতে-ই’ সেখানে….

বাকীটা আগামী পর্বে…

চলবে।

লেখিকাঃ জান্নাতুল ফেরদৌসি রিমি