গোধূলী বেলার স্মৃতি পর্ব-৪০

0
1719

#গোধূলী_বেলার_স্মৃতি
#পর্ব-৪০
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)

গুলির শব্দ কানে আসতেই আমরা পিছনে তাঁকিয়ে দেখি, ইশানি ম্যাম রুদ্রিকের দিকে বন্ধুক তাক করে আছে। ইশানি ম্যাম উপরে ফায়ারিং করেছেন। গুলি গিয়ে সোজা ছাদের দেয়াল বেঁধ করে চলে গেছে। ইশানি রুদ্রিকের দিকে বন্ধুক তাক করেই বলল,
–“রুদ্রিক মাহিরকে ছেড়ে দে নাহলে কিন্তু আমার থেকে খারাপ কেউ হবে নাহ। ”

ইশানির কথা শুনে মাহির কিছুটা নিশ্চিন্ত হয়।
ইশানির কথায় সবাই ঘাবড়ে যায়। আমি রুদ্রিকের কাছে যেতে নিলে,রুদ্রিক আমাকে থামিয়ে দিয়ে, ইশানি শেখের দিকে তাঁকিয়ে বললো,

—“ইশানি শেখ আপনি কী ভেবেছেন? এইসব করে আপনি মাহির আহমেদকে বাঁচাতে পারবেন? তাহলে আপনি ভূল ভাবছেন। ”

আমি রুদ্রিককে উদ্দেশ্য করে কান্নামাখা গলায় বললাম,

—“রুদ্রিক উনার মাথা ঠিক নেই। তুমি সরে এসো। উনি তোমাকে গুলি করতেও একটিবার ভাব্বে নাহ।”

সিথিও ভয় পেয়ে বলে উঠলো,

—“ভাইয়ূ তুমি সরে এসো। ”

—-“রুদ্রিক আমি কিন্তু সত্যি গুলি করে দিবো যদি মাহিরকে ছেড়ে না দাও। ”

কথাটি বলে ইশানি শেখ বন্ধুকের ট্রিগারটা আরো চেপে ধরে।

আমি বুঝে গেলাম আমাকেই কিছু একটা করতে হবে। আমি লুকিয়েই ইশানি শেখের পিছনে গিয়ে, উনার হাত থেকে বন্ধুকটা নিয়ে নিলাম। সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ মহিলারা ইশানি শেখকে ধরে ফেললো।

মাহির পালাতে নিলে, পুলিশরা ধরে ফেলে।

রুদ্রিক আমার কাছে এসে আমার গালে হাত রেখে বলে,

—“তুই ঠিক আছিস তো কাজল বল আমাকে? ”

আমি মাথা নাড়িয়ে রুদ্রিককে জড়িয়ে ধরলাম।

ইশানি শেখ নিজেকে ছাড়ানোর চেস্টা করলেই আফজাল শেখ এসে ইশানিকে ঠাটিয়ে চর বসিয়ে দেয়।

ইশানি শেখ নিজের গালে হাত দিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে।

আফজাল শেখ রাগে ফোস করে উঠলেন। ইচ্ছে করছে আরো কয়েকটা থাপ্পড় বসিয়ে দিতে। আফজাল শেখ রাগ নিয়েই বললেন,

–“এতোটা খারাপ হয়ে গেলে তুমি? এতোটা ভালোবাসয়ে অন্ধ হয়ে গেলে যে নিজের বোনের খুনিকেও পর্যন্ত বাঁচানোর জন্যে উঠেপড়ে লেগেছো। ছিহ ইশানি ছিহ। ”

ইশানি শেখ আফজাল শেখের চোখের দিকে চোখ রেখে বলল,

—“ভাইয়ূ তুই আগে বল কুঞ্জ কী আদোও আমার আপন বোন। ”

ইশানি শেখের কথায় অফিস রুমে যেনো আরেকদফা উত্তেজনা শুরু হয়ে গেলো।

রুদ্রিক বলে উঠলো,

—“মানে কী? ”

—-“তা ভাইয়ূকেই জিজ্ঞাসা করো। ”

ইশানি কথায় আফজাল শেখ নিজের চশমা খুলে আকাশপানে তাঁকিয়ে বললো,

—“হুম কেউ জানে নাহ কুঞ্জ আমাদের নিজের বোন নাহ। আমার বাবার বন্ধুর মেয়ে। কুঞ্জের মা মারা যাওয়ার পরে কুঞ্জের বাবা আমার বাবার কাছে তার মেয়ের দায়িত্ব দিয়ে দিয়েছিলো। কেননা কুঞ্জের সৎ মা কুঞ্জকে সহ্য করতে পারতো নাহ। ছোট্ট কুঞ্জ আমাদের বাড়িতে বড় হতে লাগলো। আমার বাবা কিংবা আমরা কুঞ্জকে কখনো বুঝতে দিতাম না যে সে এই বাড়ির সন্তান নাহ। আমরা তাকে সবসময় আগলে রাখলাম। খুবই ভালোবাসাতাম। বাবা মারা যাওয়ার আগে বাবা কুঞ্জের দায়িত্ব আমাকে এবং ইশানিকে দিয়ে গিয়েছিলো।আমি ভেবেছিলাম ইশানিও হয়তো কুঞ্জকে নিজের বোন মনে করে,কিন্তু ইশানি আমার ধারণা ভূল প্রমাণ করে দিলো। ”

সবাই নীরব হয়ে রইলো।

ইশানি ম্যাম বলে উঠলেন,

—“তো কী করবো? কুঞ্জ আমার আপন বোন নয়, কিন্তু মাহির আমার স্বামী যাকে আমি ভালোবাসি।”

আমি রুদ্রিককে ছেড়ে ইশানি ম্যামকে উদ্দেশ্য করে বললাম,

—“ভালোবাসা খারাপ নয় ইশানি ম্যাম, কিন্তু ভূল মানুষকে আকড়ে ধরা কিংবা ভালোবাসাটা অন্যায়।
ভূল মানুষকে ভালোবেসে শুধু জীবনের কষ্টটাই পাবেন। দেখুন নাহ সেই কষ্ট কিন্তু আপনি ঠিকই পাচ্ছেন। আজকে আপনার পরিবার আপনাকে ঘৃণা করছে। ”

আমাকে থামিয়ে রুদ্রিক এগিয়ে এসে বললো,

—“কাকে কি বলছিস কাজল? এদের কাছে নিজেদের স্বার্থ ছাড়া আর কোনো কিছু বড় নয়।
মানলাম ফুপিয়াম্মু ইশানি শেখের আপন বোন নয়,কিন্তু ফুপিয়াম্মু এই ইশানি শেখকে কী কম ভালোবাসতো? আমি তো সবকিছুই নিজের চোখে দেখেছি। ”

আফজাল শেখ ইশানি শেখের দিকে তাঁকিয়ে কঠোর
গলায় বললো,

—“ইন্সপেক্টর ইশানি ও মাহিরকে এখুন গ্রেফতার করুন এবং দেখবেন ওদের যেনো কঠোর থেকে কঠোরতম শাস্তি হয়। ”

আফজাল শেখের কথা শুনে পুলিশ ইশানি ও মাহিরকে ধরে নিয়ে যায়৷ যাওয়ার আগে মাহির সকলের দিকে তাঁকিয়ে বললো,

—“সবাইকে সে দেখে নিবে। ”

________________

আমরা শেখ বাড়িতে ঢুকতেই বড় ম্যাম সাহেব ছুটে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন,

—“কাজল মা তোরা ঠিক আছিস তো? ”

আমি হাঁসিমুখে বললাম,

—“আমরা একদম ঠিক আছি। ”

সাদি ভাইয়া ও লাজুক আংকেল ও ঢুকলো।

সাদি ভাইয়া রুদ্রিকের কাঁধে চাপড়ে বলল,

—“সত্যি তুই রুদ্রিক আজকে তুই কি করছিস বুঝতে পারছিস তো? তোর জন্যে আজকে মাহিরের মতো লোক ধরা পড়লো। ”

বড় সাহেব ও রুদ্রিকের কাছে গিয়ে বললো,

—“সত্যি রুদ্রিও তুমি না থাকলে কি যে হতো? তুমি আমাকে কিংবা তোমার মাকে তুমি যতই ঘৃণা করো নাহ কেনো? একটা কথা তো তুমিও মানবে রুদ্রিক। এই শেখ পরিবারের প্রতি তোমারাও ভালোবাসা রয়েছে। ”

রুদ্রিক ছলছল চোখে তার বাবা ও মায়ের দিকে তাঁকিয়ে বললো,

—“আপনারা আমার বাবা-মা। আপনাদের জন্যে আমি এই পৃথিবীর আলো দেখেছি। আপনাদের কী করে ঘৃণা করতে পারি আমি? আজ তো সবকিছুই আমার কাছে পরিষ্কার। আজ আমি বড় হয়েছি এবং বুঝতে শিখেছে যে আমি যদি আপনাদের জায়গা থাকতাম, তাহলে হয়তো আমিও হয়তো এইরকমই রিয়েক্ট করে ফেলতাম। ”

সিথির দিকে তাঁকিয়ে কথাটি বললো রুদ্রিক।

সাদি ভাইয়া সিথিকে উদ্দেশ্য করে বললো,

—“সিথি তুমি এখনো বুঝতে পারলে নাহ? রুদ্রিক বলতে চাইছে তুমি যদি কুঞ্জ পিপির মতো ভূল একটি কাজ করতে তাহলে হয়তো রুদ্রিকও এইরকম রিয়েক্ট করতো। ”

সিথি সাদির কথা শুনে কিছুটা তাচ্ছিল্যের সুরেই বলল,

—“আমাদের সম্পর্ক কী আর পাঁচটা ভাই-বোনের মতো? ভাইয়ূ তো আমাকে সহ্য করতে পারেই নাহ। ”

সিথির কন্ঠে তীব্র অভিমান প্রকাশ পাচ্ছে। যা রুদ্রিকের ভিতরের কষ্ট দ্বিগুন বাড়িয়ে দিচ্ছে।

সাদি খানিক্টা হেঁসেই বলল,

—“হাইরে পাগলি তুমি শুধু তোমরা ভাইয়ের বাইরেরটাই দেখলে? ভিতরে দেখার চেস্টা করলে নাহ? জানো তোমার ভাইয়ূ তোমাট ব্যাপার নিয়ে কতটা পসিসিভ ছিলো? ভার্সিটিতে কোন ছেলে তোমার দিকে চোখ তুলে তাঁকানোর সাহস পেতো না কেন? শুধুমাত্র রুদ্রিকের জন্যে। কেউ যদি ভূলেও তোমার দিকে চোখ তুলে তাঁকাতো তাহলে তো রুদ্রিক তাকে সোজা হসপিটালেই পাঁঠিয়ে দিতো। রুদ্রিক বেশিরভাগ সময় তোমার জন্যই মারামারি করতো,তাও তোমরাই চোখের আড়ালে। এরপরেও বলবে রুদ্রিক তোমাকে সহ্য করতে পারেনা?”

সাদি ভাইয়ার কথা শুনে সিথি রুদ্রিকের কাছে ছুটে গিয়ে, রুদ্রিককে জড়িয়ে ধরে।

—-“ভাইয়া সরি।”

কান্নার সুরে কথাটি বললো সিথি।

—“ডোন্ট সরি। আম সরি। আমি আসলে বাবা-মায়ের প্রতি অভিমানের জন্যে তোকে সবসময়
দূরে সরিয়ে রেখেছি। আমি সত্যি সরিরে বোন। ”

রুদ্রিকের কথা শুনে সিথি এইবার কেঁদেই দিলো।

বড় মেমসাহেব এইবার বলে উঠলেন,

—“সব দোষ আমার। আমি সবসময় রুদ্রিককে অবহেলা করেছি। আমি ভেবেছি রুদ্রিক ছেলে ও নিজেকে ঠিক সামলাতে পারবে কিন্তু আমি ভূল
আমি ভেবেই দেখেছি আমার ছোট্ট ছেলেটারও তার মাকে প্রয়োজন। তার শাস্তি ও পেয়েছি আমি। ”

জেসমিন শেখ কেঁদে দিলেন। রুদ্রিক এইবার তার মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে বলল,

—“মা আমিও খুব সরি৷ বাবা সরি৷ ”

নিজের ছেলের মুখে এতোবছর পর বাবা এবং মা ডাক শুনে, রুদ্রিকের বাব-মা তাকে জড়িয়ে ধরে। সিথিও জয়েন করে।

আমার চোখ যেনো জুড়িয়ে যাচ্ছে। এতোবছরের অভিমান অবশেষে শেষ হলো তবে।

দিয়া পিপি এইবার কোমড়ে হাত দিয়ে বলল,

—“আজকে এতোটা খুশির দিনে একদম কান্নাকাটি না ওকে? চলো আমরা সবাই মিলে একটা সেল্ফি তুলে। সাদি এন্ড নাঁকবোঁচা এ্যাসিস্টেন্ট তোমরাও আমাদের সাথে জয়েন হও। ”

দিয়া পিপির কথা শুনে সবাই হেঁসে উঠলো।

সবাই একসাথে অনেকগুলো সেল্ফি তুললাম।

🌼🌼🌼🌼🌼🌼🌼🌼🌼

________

আমি আয়নায় দাঁড়িয়ে চুল মুছে যাচ্ছি। তখনি পিছন থেকে রুদ্রিক আমাকে জড়িয়ে ধরে, আমার ঘাড়ে চুমু খায়। আমি কেঁপে উঠলাম। রুদ্রিক আমার আরো কাছে আসতে যাবে তখনি আমি তার পেটে গুতা মেরে বললাম,

—“সবসময় দুষ্টুমি তাইনা? রাতে তো কম দুষ্টুমি করোনা। ”

রুদ্রিক এইবার কিছুটা বিরক্ত হয়েই বলল,

—“কাজল তোর মনে হয় আমার রোমান্টিক মুডের বারোটা না বাজালে ভালো লাগে নাহ।”

আমি মুখ বেঁকিয়ে বললাম,

–“বেশ করেছি। ”

রুদ্রিক কিছু বলতে যাবে তার আগেই রুদ্রিকের ফোন বেজে উঠে। রুদ্রিক ফোনের স্ক্রিনে তাঁকিয়ে দেখে ‘পুলিশ স্টেশন ‘ নামটি।..

চলবে।