গোধূলী বেলার স্মৃতি পর্ব-৫০

0
1965

#গোধূলী_বেলার_স্মৃতি (Un expected Story)
#পর্ব- ৫০
#Jannatul_ferdosi_rimi (লেখিকা)

রুদ্রিক রান্নাঘরে মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে। কাজল এইবার নিশ্চিত তাকে বোকা দিয়ে বাড়ি মাথায় তুলবে। বাচ্ছার জন্যে করা সুজি সব পুড়ে গেছে। বলতে গেলে রুদ্রিক নিজেই আগ বাড়িয়েই তার ছোট্ট পরীর জন্যে সুজি রান্না করতে এসেছিলো,কিন্তু তার পরিনয়ে আজ সুজিটা পুড়ে গেলো। রান্নাঘর থেকে কিছু পুড়ে যাওয়ার গন্ধ আসতেই, রুদ্রিকের মা ও সিথি ছুটে আসলো রান্নাঘরে। রুদ্রিক একেবারে মাসুম মানুষের মতো দাঁড়িয়ে আছে। সিথি রাগি কন্ঠে বলে,

—-“তোকে কি বলেছিলাম ভাইয়ূ? বলেছিলাম নাহ তুই পারবি নাহ। তুই আমার কোনো কথা শুনতে চাস নাহ। এখন আমাদের কুহুপাখি কি খাবে? ”

রুদ্রিকের মা এইবার রুদ্রিককে সরিয়ে পুড়ে যাওয়া সুজিটা ফেলে বলে,

—” আবারো রান্না করতে হবে। আমার নাত্নীটা কখন ধরে না খেয়ে আছে।
এই ছেলেকে বারণ করলে কোনো কথা শুনেনা। ইচ্ছে করে দু তিনটে দেই কানের নীচে। ”

—-” কে আমার রুদ্রিককে বকছে শুনি? ”

দিয়া শাড়িটা কোনোরকম সামলাতে সামলাতে ঢুকছে। দেখেই মনে হচ্ছে শাড়ি পড়ে বেশ হিমশিম খাচ্ছে দিয়া। পিছন পিছন লাজুক দিয়ার শাড়ির আচল ধরে রেখেছে। নতুন বউ বলে কথা। এইটুকু তো করতেই হবে।

দিয়াকে দেখে সিথি ছুটে গিয়ে দিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলে,

—“পিপি তুমি এসেছো? জানো আমি তোমাকে কতটা মিস করেছি। এই দুইমাসে তো আমার কোনো খবরই রাখো নাহ তুমি। ”

দিয়া সিথির হাত ধরে বলল,

—–“কি করবো বল? নতুন সংসার। একটু গুছিয়ে নিতে হয় আর এই তোদের লাজুকের আংকেল তো একটা অলস! সারাদিন শুধু আলসেমি করে। আমাকে একটুও হেল্প করেনা।”

লাজুক কিছুটা অবাক হয়ে বলে,

—-“এইটা তুমি বলতে পারলে জান? তোমাকে আমি কতটা ভালোবাসি আর তুমি বাপের বাড়ি এসে আমার নামে বদনাম করছো? ইটস নট ফেয়ার। ”

রুদ্রিক ও রুদ্রিকের মা রান্নাঘর থেকে বেড়িয়ে আসে।

লাজুকের কথা শুনে সিথি মুখ চেপে হাঁসে।

দিয়া লাজুকের পেটে হাল্কা করে ধাক্কা দিয়ে বলে,

—–“সত্যি তোমাকে নিয়ে আমি পারিনা কখন কি বলতে হয় তুমি সত্যি জানোনা। ”

লাজুক হেঁসে উঠে।

রুদ্রিকের মা দিয়ার দিকে প্রশ্ন ছুড়ে বললেন,

—“দিয়া তুই শাড়ি পড়েছিস কেন? তুই তো শাড়ি হ্যান্ডেলই করতে পারিস নাহ। ”

দিয়া মুখটা কালো করে বলে,

—” কি করবো? শ্বাশুড়ি মায়ের হুকুম বলে কথা। নতুন বউ এই কয়েকটাদিন নাকি শাড়ি না পড়লে হবেনা হুহ। পাড়া-প্রতিবেশি খারাপ ভাববে।”

রুদ্রিক তার পিপির কাঁধে হাত রেখে বলল,

—-‘ কারো কথা শুনার দরকার নেই বুঝেছো?যেই ড্রেস পড়লে তুমি নিজেকে কনফর্মটেবল ফিল করো। সেই ড্র্বেসটাই পড়বে। রুদ্রিকের দিয়া পিপি তুমি বুঝেছো? প্রতিবেশির কথা এতো কানে দেওয়ার কোনো মানে হয়? ”

দিয়া লাজুকের দিকে তাঁকাতেই লাজুক বললো,

—“আমিও তো দিয়াকে কতবার বলি। সে কি শুনে আমার কথা? সারাদিন শুধু কি কি ভাবলো তা নিয়ে চিন্তা। মার সাথে থাকতে থাকতে তোমাদের দিয়া পিপিও সেকালের হয়ে গেছে। ”

—-“আচ্ছা এতোদিন পরে আসলাম একটা সেল্ফি না তুললে কি করে হয়? কাজলকে কেউ ডাক ভাই। কাজলকে ছাডা কি আর সেল্ফি হয়?
দিয়া এইবার ফোনটা হাতে নিয়ে সেল্ফি তুলতে গিয়েও থেমে গেলো। লাজুক দিয়ার কাঁধে হাত রেখে বলল,

—-” কি করছো কী দিয়া তুমি কি সব ভূলে গেলে? ”

দিয়া রুদ্রিকের দিকে তাঁকিয়ে অসহায় হয়ে বলল,

——“আমি সরি রুদ্রিক।আমি সত্যি ভূলেই যাই। কি করবো বল? কাজল তো আমাদের সবার অভ্যাসে পরিনত হয়ে গেছে। এখন ও না থাকলে কোনোকিছুই ভালো লাগেনা। ”

কাজলের কথা উঠে যাওয়াডক রুদ্রিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

—“দিয়া পিপি আমি বরং একটু উপরে যাই। আমার
কুহুর এখনো খাওয়া হয়নি। ”

রুদ্রিক তার মায়ের থেকে সুজির বাটিটা নিয়ে উপরের দিকে চলে গেলো।

মুহুর্তেই পরিবেশটা কেমন থমথমে হয়ে গেলো। রুদ্রিকের যাওয়ার পানে তাঁকিয়ে সিথি চোখের জল ফেললো।

রুদ্রিক রুমে গিয়ে দেখে তার ছোট্ট মেয়ে কুহু কাঁদছে। রুদ্রিক তার মেয়েকে কোলে তুলে নিয়ে কান্না থামাতে থামাতে বলে,

—-“ওরে আমার মা টা খুব খিদে পেয়েছে তাইনা? এইতো বাবা এসে গেছে। দাঁড়াও এখুনি তোমাকে খাওয়াচ্ছি নাহ হলে তোমার মা তো আমাকে আবার বকা দিবে নাহলে।”

রুদ্রিক তার মেয়েকে খুব যত্ন করে খায়িয়ে দিয়ে, কাজলের কাছে গিয়ে ইনোসেন্ট ফেস করে বলে,

—“এইযে ম্যাডাম আপনার মেয়েকে সময়মতো খায়িয়ে দিয়েছি হুহ। এখন কিন্তু আমাকে আর বকতে পারবি নাহ বুঝেছিস? মেয়েটাযে কাঁদছিলো সে খেয়াল আছে নিজের মতো ঘুমিয়ে যাচ্ছিস। ”

রুদ্রিকের করা কোনো কথাই কানে যাচ্ছে নাহ কাজলের। কেননা সে তো এখন কোমায়। কোমায় থাকা রোগী কী কখনো কোনো কথা বলতে পারে? কিংবা কোন কিছু শুনতে পারে?

হ্যা কাজলের ঘটে যাওয়া সেই র্ঘটনার ১০ মাস হয়ে গেছে। কাজল এখন কোমায় রয়েছে। রুদ্রিক নিজের ঘরেই চিকিৎসার সকল সরঞ্জাম এনে কাজলের চিকিৎসার ব্যবস্হা নিজের ঘরেই করে রেখেছে রুদ্রিক। এই ১০ মাসে সবকিছুই পাল্টে গেছে। রুদ্রিকের বিশ্বাস কাজল ঠিক সুস্হ হয়ে ফিরবে।

দিয়া ও লাজুকের বিয়ে হয়েছে ২ মাস হলো। যদিও দিয়া কাজলকে ছাড়া বিয়েটা করতে চাইনি,কিন্তু রুদ্রিকের জন্যে ঘরোয়াভাবে করে নিয়েছে।

কাজলের থেকে কোনোপ্রকার উত্তর না পেয়ে, রুদ্রিক আশাহত হয়। তখনি তার কানে তার মেয়ের কান্নার আওয়াজ আসে। রুদ্রিক ছুটে তার মেয়ের কাছে গিয়ে তার মেয়ের কান্না থামাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ১০ মাস ধরে রুদ্রিকই তার মেয়েকে সামলিয়ে যাচ্ছে। রুদ্রিক ও কাজলের মেয়ের নাম কুহু শেখ। কাজলের নামের সাথে মিলিয়েই রুদ্রিক তার মেয়ের নাম রেখেছে।

মেয়েকে ঘুম পাড়িয়ে কাজলের দিকে এক পলক তাঁকিয়ে রুদ্রিক বারান্দায় চলে গিয়ে, রুদ্রিক এক প্যাকেট সিগারেট বের করে। স্মোকিং করতে করতে
গুন গুন করে গাইতে থাকে,

সবকিছু বদলে গেলো এক রাতের নিমিষে
তুমি হারিয়ে যাবে বলেছিলে কবে?
আজ তোমায় হারিয়ে আমি একা এই রাতে
ভাবনাতে তোমাকে খুঁজেছি কি তবে?

ভাবি তুমি আসবে ফিরে
ধরবে হাতগুলো
বলবে তুমি কেঁদো না
ফিরে এসেছি এই দেখো

আর বলবে কেঁদো না তুমি
এবারই তো শেষ কান্না
বসে আছি আমি তোমার জন্যে…
আসোনা, ফিরে আসোনা
আসোনা, ফিরে আসোনা

ফিরে এসেছি, ভালোবেসে
তোমায় আমি প্রতিটিবার
সব ব্যথা ভুলে, সব কষ্ট ফেলে
এসেছি আজি আমি তোমার কাছে

তবু তুমি নেই আজ আমার পাশে
হারিয়ে গেছো তুমি বহুদুরে

রুদ্রিকের গানের প্রতিটা বেদনা প্রতিটা সুর তার কাজলকে ঘিড়ে। আজ যেনো রুদ্রিক তার গানের মাধ্যমে তার এতোদিনের জমানো কষ্টগুলো প্রকাশ করছে। আজ সত্যি কাজল থেকেও যেনো নেই। আজ কাজল রুদ্রিকের কাছে থেকেও বড্ড দূরে

দরজার বাইরে থেকে সবকিছুই শুনতে পারছে সিথি। সাদি সিথির পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলে,

—“আজ রুদ্রিকের গানের প্রতিটা শব্দের পিছনে রয়েছে এতোদিনের লুকিয়ে থাকা কান্না। যা রুদ্রিক শক্ত মুখে এতোদিন সহ্য করে গেছে। আমাদের রুদ্রিক কতটা চাপা স্বাভাবের হয়ে গেছে তাইনা? ”

সিথি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

—-“আমার ভাইটা নিজের কষ্টগুলো লুকিয়ে কীভাবে দিব্যি ঠোটে হাঁসি ঝুলিয়ে থাকে তাইনা? ভাবতে খুব অবাক লাগে। ”

সিথির কথা শুনে সাদি মাথা নাড়ায়।

গানটা গাইতে গাইতে রুদ্রিক কাজলের কাছে গিয়ে, কাজলের হাতদুটো ধরে কান্নার সুরে বলে,

—‘জানেমান রে আমি আর পারছি নাহ সত্যি। সারাদিন মিথ্যে হাঁসি ঝুলিয়ে রাখতে রাখতে আমি সত্যি আজ ক্লান্ত। আমার যে কতটা কষ্ট হয় আমি সত্যি বলে বুঝাতে পারবো নাহ। আচ্ছা এমনটা তো আমরা কেউ আশা করেনি বল? আমাদের একটি মিষ্টি সংসার হওয়ার কথা ছিলো তাইনা? তাহলে আজ এইরকমটা হলো কেন বল নাহ কাজল? আজ ১০ টা মাস হয়ে গেলো আমাদের মেয়ে এখনো তোর স্পর্শ পায়নি? কেনো হলো এইসব? সবকিছুই যেনো আজ এলোমেলো হয়ে গেলো।”

আফসোস আজকে রুদ্রিকের আর্তনাদ আজ কাজলের কানে পৌঁছাচ্ছে নাহ।

রুদ্রিক কাজলের হাত জোড়া নিজের গালের সাথে মিশিয়ে নিয়ে চোখের জল ফেলতে থাকে।

_____________

রুদ্রিক, সিথি ও সাদি রুদ্রিকের রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে ডক্টর কাজলকে চেক করছে। প্রতি-সপ্তাহে ডক্টর এসে কাজলকে চেক করে যায়। তখনি হঠাৎ ডক্টর চিৎকার করে উঠে।

চলবে।